প্রত্যেক মানুষের জীবনে তার স্কুল কলেজের বেশ জোরালো প্রভাব থেকে যায়। অবশ্য কোন বিশেষ প্রভাব কে কিভাবে নেবে তা পুরোপুরি নির্ভর করে তার নিজস্ব মানসিকতার ওপর। কিন্তু তাদের সব ধরনের শিক্ষা ও সংস্কৃতির সুযোগ দেওয়ার দায়িত্ব, কর্তব্য কিন্তু এই শিক্ষাক্ষেত্রগুলির ওপর ন্যস্ত থাকে।
কলকাতার বুকেই এই রকম একটু উঁচুমানের প্রতিষ্ঠানে চার-চারটি বছর আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। হ্যাঁ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই বলছি। সময়টা ছিল ১৯৭৯ – ১৯৮৩। সর্বক্ষেত্রে আমরা যেরকম সুযোগ পেয়েছিলাম, তা খুব কম লোকেদের ভাগ্যে জোটে। সুবিধে ছিল এক ক্যাম্পাসের মধ্যেই ছিল পুরো বিশ্ববিদ্যালয়টি, কাজেই প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও মানবিকতা, এই তিন ‘বিবিধের মাঝে মিলন মহান’ দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছিল।
প্রবেশ দ্বার
আর সেসময় বিশ্বায়নের চাপ ছিল না, ছিল না এতসব আন্তর্জালিক ব্যাপার সাপার। তখন বিজ্ঞান, প্রযুক্তির ছাত্রদেরও গান, বাজনা, খেলাধুলো, ফিল্ম, ফটোগ্রাফি, পর্বতারোহণ, – সব কিছুতেই রীতিমতো আগ্রহ ছিল। জনৈক জনপ্রিয় সংবাদপত্রের ভাষ্য উল্লেখ করে বলা যায়,- তখন সব কিছুতেই সবাইকে ভাগ নিতে হত, নইলে ‘পিছিয়ে পড়তে হয়’ এই ভাবনা বেশ ভীতিপ্রদ ছিল।
অরবিন্দ ভবন
আমরা এখানে আসার দু বছর আগেই পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে গেছে। আমরা যখন যাদবপুরে এলাম, তখন উপাচার্য পরিবর্তনের প্রক্রিয়া চলছে। ১৯৭৯ সালের জুন মাসের কোন একটি দিনে যখন অরবিন্দ ভবনে, হাজির হলাম, বেশ কিছু বন্ধু সহকারে। সে অভিজ্ঞতা খুবই তৃপ্তিদায়ক ছিল। এরপরে আগস্ট মাসে আমাদের ক্লাস শুরু হয়ে গেল।
একটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের স্বাগত জানানো হয়েছিল, নামটি ভারী সুন্দর – ভ্রাতৃবরণ উৎসব। অনুষ্ঠিত হয়েছিল গান্ধী ভবনে। বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়েছিল, বড় দাদা – দিদিরা আলোচনা, আবৃত্তি, গান, পাঠে আমাদের মন জয় করে নিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, সত্যিই বেশ ভাল জায়গাতেই এসেছি। আহা, কিসব গানও ছিল – সেই সময় প্রথম শুনেছিলাম একটি গান, ‘চারটি নদীর গল্প শোন’! এখনো কানে বাজে। গানটির ইতিহাস জেনেছি অনেক পরে কিন্তু অনুরাগ আর কৌতূহল, দুটিই তৈরী হয়েছিল ঐসময়েই।
এর পরেই পথের পাঁচালীর ২৫ বছর উপলক্ষে সত্যজিৎ রায় রেট্রোস্পেক্টিভ এর আয়োজন। এই অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল গান্ধী ভবনে। উদ্বোধনে এসেছিলেন প্রখ্যাত চিত্র সমালোচক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। মঞ্চে ছিলেন আমাদের নতুন উপাচার্য মনীন্দ্রমোহন চক্রবর্তী। শমীকবাবু সত্যজিতের ওপর বক্তৃতাতে অনেক কিছু প্রাপ্তি বলে পূর্ণতার খাতিরে একটু অপ্রাপ্তির কথাও বলে থাকবেন। তা সম্ভবত এই যে পশ্চিমবঙ্গে উদ্ভূত জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর সত্যজিৎ কেন সেভাবে ছবি করেননি। মনীন্দ্রবাবু তাঁর বক্তৃতাতে সেই প্রসঙ্গ এনে একটু বিনীত ভাবেই বললেন, “আমাদের কি প্রাপ্তিকে বড় করে দেখা উচিত নয়, অপ্রাপ্তির থেকে?” শমীকবাবু একটু অপ্রস্তুত, কিন্তু উপস্থিত ছাত্ররা তুমুল হর্ষধহ্বনির মাধ্যমে উপাচার্য কে তারিফ জানিয়েছিল। এই রেট্রোস্পেক্টিভেই আমাদের বেশ কিছু ছবি দেখা হয়। ‘সীমাবদ্ধ’ দেখতে গিয়ে ক্লাস টেস্ট পেছোনোর কথা বলতে গেলে এক শিক্ষক বেশ শ্লেষের সঙ্গেই বললেন, ‘সীমাবদ্ধ’ই থাক না, পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার কিছু আছে কি?’ আমরা বেশ লজ্জিত বোধ করেছিলাম, টানাপোড়েন কিন্তু ছিলই।
গান্ধী ভবন
যাদবপুরের ভূগোল সম্বন্ধে যাঁরা অবহিত তাঁরা জানবেন যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং আর আর্টস – সায়েন্স বিভাগের মধ্যে অল্পই দূরত্ব। কিন্তু এর মাঝে আছে একটি ঝিল আর তার ওপর একটি ছোট্ট সেতু। আশির দশকে তখন প্রেমের রমরমা! ইঞ্জিনিয়ারিং এর তুলনাতে ‘ঝিল কে উসপার’ মহিলা সংখ্যা অনেক বেশী, বিশেষতঃ আর্টস বিভাগে তাঁরাই সংখ্যাগুরু। সেই নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রদের বেশ একটু আক্ষেপও থাকতো। আক্ষেপ খুব যুক্তিযুক্ত।
তখন খুব কম মেয়েই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে আসত। আমাদের ফার্স্ট ইয়ারে ইলেকট্রিকালে ৫-৬ জন, কেমিক্যালে ২-৩ জন, ইলেকট্রনিকসে ৩ জনের কথা মনে আছে। সব মিলে জনা দশেকের বেশি নয়। অবশ্য আর্কিটেকচার বাদে। আর্কিটেকচারে বেশিরভাগই মেয়ে। অন্যেরা তাই আর্কিটেকচারের ছেলেদের ঈর্ষা করতাম। বিশেষতঃ ইলেকট্রনিক্স আর আর্কিটেকচার ছিল এক বিল্ডিং এ। লিফটের জন্য প্রতীক্ষা করার সময় আর্কিটেকচার এর একজন ছেলের সঙ্গে একাধিক মেয়েকে দেখে অনেকে কপাল চাপড়াত। ওদের সম্পর্কে নানারকম গালগপ্পো বানানো হত। খুব প্রচলিত গপ্পো ছিল যে তারা নাকি অনেক সময় ধরে একসাথে পড়েই চলে, অনেক রাত দুপুর পর্যন্ত!! তবে এসব গল্প সম্ভবত উর্বর, ঈর্ষাপরায়ণ মস্তিষ্ক উদ্ভূত। কেউ কেউ আবার রেগে বলতো – ওটা আর-কি-টেকচার নয় তো!! ঐ বিভাগের নাম – ‘আর-কি কেচ্ছা’। উফফ, ঈর্ষার সবুজ চোখ বুঝি একেই বলে!!
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল মেকানিকালের। তখন ওই ডিপার্টমেন্টে মেয়েদের পড়ার সুযোগ ছিল না — যুক্তি ছিল, ওগুলোর শারীরিক খাটনি বেশি এবং মেয়েরা তা পারবে না। তবে একবিংশ শতাব্দীতে শুনেছি কিছু কিছু পালটেছে। এই প্রসঙ্গে এক স্যারের মজার গপ্পো মনে পড়ে যায়। তিনি কোন বিভাগের তাও ভুলে গেছি, শুধু মনে আছে নামের প্রথম অক্ষর ছিল ‘ক’ দিয়ে আর পদবি ‘রায়’। তিনি নাকি একটি মেয়ের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকতেন। ব্যস, ‘যদুবংশী’রা এমনিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত খুব গায় না, কিন্তু তারাই শুরু করল সমবেত কণ্ঠে, মেয়েটির উদ্দেশে –
‘কে রয় (K. Roy) ভোলে তোমার মোহন রূপে’
প্রেমের আর আড্ডার দুই বিখ্যাত জায়গা ছিল দুটি ক্যান্টিন। ইঞ্জিনিয়ারিং এ ছিল CET ক্যান্টিন, যা তার মালিকের অর্থাৎ ‘সত্যেনদার ক্যান্টিন’ নামেই বিখ্যাত ছিল। আর অন্যদিকে AC ক্যান্টিন। এয়ার-কন্ডিশনিং নয় কিন্তু, যদিও প্রথমে দাদারা এই বলে আমাদের বোঝাত। আসলে এ সি হল এমেনিটি সেন্টার। এখনকার কথা বলতে পারবো না, তখন দুটি ক্যান্টিনেই ভিড় উপচে পড়ত। ইঞ্জিনিয়ারিং এর আমরা, যারা আড্ডার সঙ্গে নিয়মিত তাস খেলতাম, তাদের কাছে সত্যেনদার ক্যান্টিন ছিল বেশী প্রিয়। ল্যাবের তিনঘণ্টার আগেই শেষ করে দৌড় দিতাম, জায়গা দখল করার জন্য।
আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং এর অনুষ্ঠানের নাম ছিল Cultural – YY অর্থাৎ বছরের সংখ্যা। প্রথম আমরা দেখেছিলাম Cultural – 80। আর্টস – সায়েন্স ফেস্ট এর নাম ছিল বেশ রোমান্টিক – বসন্তোৎসব। তা এসব প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে যাঁরা ভাগ নিতেন, তাঁরা শিল্পী হিসেবে বেশ ভালই ছিলেন। খুব ভাল ভাল অনুষ্ঠান হত, এদিকে আবার পড়া পরীক্ষা! সব মিলিয়ে চলতে থাকতো। এই সময় আবার এক স্যরের কাছে Cultural – 81 এর জন্য ক্লাস টেস্ট পিছনোর অনুরোধে শুনতে হয়েছিল, “Self-Culture বলেও কিছু হয়, সেটা করে দেখতে পারো!”
যাদবপুরে অসংখ্য ক্লাব ছিল, যার যা নেশা বা শখ, তা পূরণ করার ছিল ভরপুর আয়োজন। গানের ক্লাব গীতি সংসদ, বিজ্ঞান ক্লাব, ফিল্ম ক্লাব, ফটোগ্রাফি ক্লাব, মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাব, এংলিং ক্লাব (Angling club) – শেষের টির নাম শুনিনি আগে। পরে জানলাম সেটি মাছ ধরার ক্লাব। সেটি অবশ্য ছাত্রদের জন্য নয়, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের জন্য। আমার এক বন্ধু ব্যাপার সাপার দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বলে ফেলেছিল, “পড়াশোনার ক্লাবও থাকতে পারে রে! নইলে পড়াশোনা হবে কি করে”!
তখন প্রোগ্রাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে খুব উৎসাহ ছিল শ্রোতাদের মজার মজার মন্তব্য শোনারও। কোন ছাত্রী খুব গভীর আবেগের সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে, “আমি প্রদীপশিখা, তোমার লাগি, ভয়ে ভয়ে একা জাগি” – মন্তব্য উড়ে এল “আহা রে, গলাটা ভারী মিষ্টি, দেখতেও সেরকম হলে একা জাগার প্রশ্নই আসতো না” – বোঝ কাণ্ড। আর ছিল প্যারডি – ‘ফুলে গন্ধ নেই, এ তো ভাবতেও পারিনা’ – গানের প্রথম দুটি অক্ষর পাল্টে (সকলেই বুঝে গেছে) এমন ভাবে আমাদের মাথায় ঢুকেছিল, পরবর্তী কালে ঐ গান শুনেই নাকে হাত চলে আসত, স্বয়ংক্রিয় ভাবেই। এমনকি ‘ডন’ ছবির বিখ্যাত গান – ‘হর দিওয়ানো, মুঝে পহচানো’ – যে ‘ভজ গৌরাঙ্গ, জপ গৌরাঙ্গ’র সুরে নিখুঁত গাওয়া যেতে পারে তা এখানে এসে জানা হল।
একটা প্রতিযোগিতার নাম প্রথম শুনলাম – JAM – Just A Minute। মাত্র একমিনিটের মধ্যে বলতে হবে কিছু কথা। থামা চলবে না, ভুল কথা বলা চলবে না, তথ্যগত, যুক্তিগত, ব্যাকরণগত ভুল থাকা চলবে না অথচ বিষয়টি চিত্তাকর্ষক হবে। বিষয়টি দেবেন উপস্থিত বিচারকরা। দারুণ উত্তেজনাপূর্ণ ব্যাপার ছিল। এই ফেস্ট এ অন্যান্য কলেজের ছেলেরাও আসত। একবার সেন্ট জেভিয়ার্স এর একটি ছেলে অসাধারণ বাগ্মিতাতে যাদবপুরকে হারিয়ে প্রথম হল। স্বাভাবিক ভাবেই ছেলেরা ক্ষুণ্ণ হলেও মেয়েরা কিন্তু ছেলেটির প্রশংসাতে একেবারে পঞ্চমুখ হয়েছিল। ছেলেটি যখন প্রথম পুরস্কার নিচ্ছে, বেশ কিছু ছেলে একটু ম্রিয়মাণ ছিল, সম্ভবত তাদের প্রেমিকারাও সোৎসাহে হাততালি দিচ্ছিল।
JAM এর একটি গল্প খুব প্রচলিত ছিল, বিষয় গুলো অনেক সময় একটু উল্টোপাল্টা ও থাকত। একবার বিষয়য় দেওয়া হল ‘টল’ – মানে জল-টলের ‘টল’! যে ছেলেটি দারুণ বলেছিল তার বক্তব্য ছিল অনেকটা এইরকম,-
“একবার আমরা প্রচণ্ড গরমে বেড়াতে গেছি, শান্তিনিকেতন। দেখে রওয়ানা দিলাম শ্রীনিকেতনের উদ্দেশে। গরমে সবাই কাবু। অসহ্য জলতেষ্টা। একটি বাড়ীর দাওয়াতে দেখি একজন লোক। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘প্রচণ্ড তেষ্টা, গলা শুকিয়ে কাঠ। দাদা, একটু জলটল হবে?’ আমাদের ভালো করে দেখে লোকটি বলল, ‘জল হবে না, টল হতে পারে’। আমরা তো হতবাক, ‘দাদা, টল কি?’ – ‘সে কি এও জানেন না? যা খেয়ে মানুষ টলমল করে তাই হল ‘টল’” –
কি মোক্ষম না! দর্শক ও বিচারকমণ্ডলী একেবারে কুপোকাত।
আমরা নাটকও দারুণ দেখেছি যাদবপুরে, একেবারে বিনা পয়সাতে – মারীচ সংবাদ, জগন্নাথ, ব্যারিকেড, টিনের তলোয়ার, ছোট বকুলপুরের যাত্রী ইত্যাদি বিখ্যাত নাটক। এছাড়া গ্রুপ থিয়েটারের প্রচুর নাটক। এমনকি নাটক প্রতিযোগিতাতেও ভাগ নিত যাদবপুরের ছেলেরা। অরুণ মুখোপাধ্যায়, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত তারকাদের চোখের সামনে দেখে মুগ্ধ একেবারে। তবে কিছু পাজী ছেলে আবার নাটকের সংলাপগুলো মুখস্থ করে উল্টোপাল্টা ভাবে লাগিয়ে খুব মজা দিত। অনেকের মনে থাকতে পারে ‘জগন্নাথ’ নাটকের কথা।
এই নাটকে ‘জগন্নাথ’ হল এক খুব সহজ, সরল মানুষের চরিত্র। ‘জগন্নাথ’ নাটকটি ল্যু স্যুনের দ্য ট্রু স্টোরি অব আকিউ (The True Story of Ah Q) গল্প অবলম্বনে লেখা, অনুপ্রাণিতও বলা চলে। ল্যু স্যুন বলতে চেয়েছিলেন যে, বিদেশি শাসনে থাকার ফলে একটা দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ডিফিটিস্ট অ্যাটিচ্যুড গ্রো করে এবং সাধারণ মানুষ তার ভিকটিম হয়ে পড়ে। তারা একটা নিজস্ব জগৎ তৈরি করে। পরিচালক অরুণ মুখোপাধ্যায় স্বয়ং ছিলেন জগন্নাথের ভূমিকাতে, আর একটি চরিত্র ছিল নন্দ।
জগন্নাথের বন্ধু নন্দ বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে ফাঁসিয়ে দেয়, জগন্নাথ কিন্তু নির্ভীক। শেষ দৃশ্যে, ফাঁসি যাবার আগে, তার এক সংলাপ ছিল, তাচ্ছিল্যের সঙ্গে, ঘাড় বাঁকিয়ে- “আমাকে হারাবে, নন্দ?” সেই সংলাপ খুব জনপ্রিয় হল। প্রেমে, ক্লাসটেস্টে, খেলাতে অন্য প্রতিযোগীর সঙ্গে তুলনা এলেই, ব্যাস! সেই অরুণ মুখোপাধ্যায় স্টাইলে, তাচ্ছিল্যের সঙ্গে, ঘাড় বাঁকিয়ে “আমাকে হারাবে, নন্দ?” ভারী মজা হয়েছিল।
পরিচালক অরুণ মুখোপাধ্যায় — জগন্নাথের ভূমিকাতে
ফেস্টিভ্যালে আমরা অনেক বিখ্যাত ছবি দেখেছিলাম। সবচেয়ে বিখ্যাত সম্ভবত, ভিত্তিও ডি সিকার ‘বাইসাইকেল থীভস’।
বাইসাইকেল থীভস ব্রেথলেস
তখনই শুনেছিলাম, এই সিনেমাটি নাকি সত্যজিতের কাছে বিরাট অনুপ্রেরণা ছিল। আবার যখন ফিল্মোৎসবে গোদার এর ‘ব্রেথলেস’ দেখে না বুঝেও সব্বাই মুগ্ধ, শেষে ফরাসী ভাষাতে ভেসে উঠল – “Fine”!! যার মানে হল শেষ। আমাদের যেমন ‘The end’! এও খুব জনপ্রিয় হল। পরীক্ষা, ওয়ার্কশপ, প্রেমে ছাড়াছাড়ি, বন্ধুত্বের অবসান, ছুটির শেষ – সব কিছুতেই ‘fine’ চলল কিছুদিন।
এইসব ব্যক্তিত্বদের একেবারে সামনে বসে নাটক করতে বা বক্তৃতা দিতে দেখে আমাদের সাংস্কৃতিক চোখ যে অনেক খুলে গেছিল তা মানতেই হবে। আমাদের ফার্স্ট ইয়ারে ক্লাস হত ইন্টিগ্রেটেড বিল্ডিং এ। সেখানেই ছিল গীতি সংসদ। যাদবপুরের মিউজিক ক্লাব। প্রায় আমরা গানের শব্দ শুনতে পেতাম। একদিন আকাশ বেশ মেঘলা। বৃষ্টি শুরু হয়নি। দাঁড়িয়েছিলাম একতলাতে। গীতি সংসদের গান ভেসে আসছিল দোতলা থেকে,
আকাশতলে দলে দলে মেঘ যে ডেকে যায় / ‘আ য় আ য় আ য়‘॥
জামের বনে আমের বনে রব উঠেছে তাই– / ‘যা ই যা ই যা ই।
গীতি সংসদ খুব বেশী রবীন্দ্রসঙ্গীত করত না। কিন্তু ঐ দিন ঐ গানটি শুনে খুব ভাল লেগেছিল। আকাশে মেঘ, ছেলেমেয়েদের মিলিত কণ্ঠে গানটি সেদিন এক অন্যমাত্রা পেয়েছিল। এমনি আর এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমাদের নিজের বিল্ডিং এ। আমাদের প্রথম দুতলা ছিল সিভিল, পরের তিনতলা ইলেকট্রনিক্স – তার ওপর আর্কিটেকচার। একদিন আমরা হেঁটে হেঁটে ওপরে উঠছিলাম, হঠাৎ চোখে পড়ল, কানেও এল দোতলাতে সিভিলের কোন অনুষ্ঠানে এক শিক্ষক গাইছেন,
এখন আকাশ ম্লান হল, ক্লান্ত দিবা চক্ষু বোজে– /
পথে পথে ফেরাও যদি মরব তবে মিথ্যা খোঁজে।
বাহির ছেড়ে ভিতরেতে / আপনি লহো আসন পেতে–
তোমার বাঁশি বাজাও আসি / আমার প্রাণের অন্তঃপুরে ॥
নাম মনে নেই কিন্তু সেই শিক্ষকের স্নিগ্ধ গায়নভঙ্গী আর ছাত্রদের মুগ্ধ হয়ে শোনার ছবিটি আমার স্মৃতিতে চিরন্তন। আমি নিজেও বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে শুনে ফেললাম।
একবার এও মনে আছে ওপেন এয়ার থিয়েটারে শুনলাম ভূপেন হাজারিকার অনুষ্ঠান। পৌঁছতে একটু দেরী হয়ে গেলে দেখি গান শুরু হয়ে গেছে – সেই অনন্য ভূমিকাতে তিনি গাইছেন:
“বশীকরণ কাজল চোখে পিঠে দোলে চুল গো / যৌবনেরই আঙিনায় ওড়ে গাঁদা ফুল গো”
ওপেন এয়ার থিয়েটার ভূপেন হাজারিকা
ওঃ, সে যে কি এক অদ্ভুত অনুভূতি না দেখলে বলে বোঝানো যাবে না। এটাও মনে রাখতে হবে তখনকার যাদবপুরের ছাত্রদের অর্থনৈতিক অবস্থা এত বেশী উন্নত ছিল না। কাজেই অনেকের কাছে এই নায়কদের এত কাছ থেকে দেখতে পাওয়া, গান শুনতে পাওয়া ছিল বেশ বিরল অভিজ্ঞতা।
ধীরে ধীরে শেষ হয়ে এল চার বছরের মধুর, স্মৃতিময় জীবন। ১৯৮৩ সাল। আমরা বন্ধুরা বলাবলি করতাম এই বছর ভারতবর্ষে দুটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে – কপিলের নেতৃত্বে একেবারে অপ্রত্যাশিত ভাবে ভারতের প্রথম ক্রিকেট ‘বিশ্বকাপ জয়’ আর কিছুটা প্রত্যাশিত ভাবেই আমাদের ‘ইঞ্জিনিয়ার’ হয়ে ওঠা।
আজ প্রবাসে বসেও যাদবপুরের সেই মধুর দিনগুলো মনে পড়লে এক অদ্ভুত শিহরণ বোধ করি। যখনি ফিরি কলকাতাতে, একবারের জন্য হলেও লোভ সামলাতে পারিনা উঁকি মেরে দেখে আসার। শুধু ইঞ্জিনিয়ার নয়, সাহিত্য-সংস্কৃতির জীবনভর শিক্ষার শুরু যে পীঠস্থানে, তাকে একটু ছুঁয়ে আসা আর কি!
(ছবিগুলি – ইন্টারনেট থেকে নেওয়া)
*লেখাটি শারদীয়া অন্যদেশ, ২০১৭ তে প্রকাশিত হয়েছিল। ওয়েব ভার্সন রূপে প্রথম প্রকাশ।
Khub bhalo laglo. Jadavpur amaeer randhre randgre . — Anupamda
LikeLiked by 1 person
একদম তাই, অনুপমদা।
LikeLike
খুব সুন্দর বর্ণময় বর্ণনায় ফুটিয়ে তুলেছো তোমাদের ছাত্রবেলার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র। অনেককিছু জানতে পারলাম এই সুন্দর লেখাটির থেকে যা কোনদিন জানতাম না।
LikeLiked by 1 person
অরু, ভালোবাসা!!
LikeLike
JU te jara poreche ba pore ba porbe tader sathe eki experience hoy.. karon ami 2003 e passout hoyeo amar feelings tao same… !!
LikeLiked by 1 person
খুব ভালো লাগলো জেনে। অনেক ধন্যবাদ।
LikeLike
Bhaskar, daarun likhechhis. Chokher saamne sab bhese uthchhilo. Great 👍
LikeLiked by 1 person
থ্যঙ্কু, থ্যাংকু!!
LikeLike
Phire gelam oi din gulo te
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ।
LikeLike
Very nice. I graduated a few years later. But still it took me back down the memory lanes. The ambience was similar when I graduated. I understand it is different today
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ।
LikeLiked by 1 person
ভাস্কর:
তোমার সময়কার যাদবপুরের যথার্থ documentation — পড়ে আনন্দ পেয়েছি। পরবর্তীকালে নতুন কিছু সংযোজনের অপেক্ষায় রইলাম।
Blog -এর minimalist format খুব পছন্দ হয়েছে।
∆ ভাস্করদা
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ। ফর্ম্যাটটা ও ছেলেরই করা।
LikeLike
Lovely read – even though we were somewhat senior – most of what you wrote was a repeat of our times too. We had the Emergency, the first college elections, the first college fest Sanskriti -78 (those days all three faculties banded together). I still remember the topic of a JAM “Pickpocketing in a nudist colony” . Yes – those were exciting times. I realized in the mid-eighties that I’ve become a misfit – the environment and the people were still bubbling with high spirits and energy- only I haven’t kept up with the times – I stopped going even though JU was my para-university. Still crazy after all these years.
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ! সত্যিই, যাদবপুরের সেই দিনগুলো ভোলার নয়।
LikeLike
Thanks a lot!!
LikeLike
May I ? A tad vintage of 71. But how come you had only so few girls at your time ? Even we had equal to you . I mean girls. And why did not u write more about Arts and Science including Pharmacy. And did you intentionally avoid politics ? And what about Coffee House? And Sports ? What about Hostel Life? Whatever you have written was succinct and good. I shared with our JU group .
LikeLiked by 1 person
You are correct. I have only included the Cultural aspect. You may notice, there is even not much mention about the Teachers.
Thanks a lot for appreciating.
LikeLiked by 1 person
ভাস্কর তাঁর চোখে যা দেখেছে তাই বলতে চেয়েছে ৷ আর ওতো ইতিহাস লিখতে বসে নি ৷বেশ লিখেছে ৷
LikeLiked by 1 person
একদম । এটাতে শুধুই সংস্কৃতি!
LikeLiked by 1 person
Dear Bhaskar,
Ei pratham eto sundar akta rachona porlam. Khub bhalo laglo.
Keep up the good effort. God bless you my young brother.
LikeLiked by 1 person
বেশ মনোরম লেখাটি…সত্যি যাদবপুর প্রযুক্তিবিদ্যার সাথে সাথে যে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিমনস্ক করেছে তা অনস্বীকার্য…. পড়তে পড়তে আমাদের সময়ের (১৯৯৪-১৯৯৮) যাদবপুরের ছবি ঝলক দিয়ে গেল….”সংস্কৃতি”, নবীনবরণ, পি.সি, এম.সি ইত্যাদি ইত্যাদি…তবে একবিংশ শতকে নয়, বিংশ শতকের শেষের দিকেই (১৯৯০-১৯৯৪, ১৯৯৪-১৯৯৮, ১৯৯৫-১৯৯৯) জে.ইউ তে মেয়েরা মেকানিক্যাল নিয়ে পড়েছে…শারীরিক খাটনি কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি কখনো….
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ সুদেষ্ণা।
LikeLike
Khub bhalo laglo Bhaskar. Amar Jadavpurer 5 bochor 1976 -1981
Koto smriti, kichui Ateet mone hoyna, Sab I bartoman
Inter college festival Sanskriti ullekh pelam na
Anek katha likhe sesh kora jai na
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ।
LikeLike