২৩শে অক্টোবর, ২০১২। সেটি ছিল নবমীর সকাল। আগের দিন অনেক রাত অবধি চলেছিল আমাদের সন্ধিপুজো আর তার পরের আড্ডা। সকালে উঠতে একটু দেরী হয়েছিল। উঠেই পেলাম সেই ভয়ংকর খবর, সন্ধিপুজোর আড্ডাতে আমরা যখন ব্যস্ত ছিলাম, আমাদের
ছেড়ে চলে গেছেন প্রিয় সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সব চ্যানেলেই দেখানো হচ্ছে সেই খবর। দেখতে দেখতে মন পিছু হাঁটছিল, স্মৃতির রাস্তা ধরে।
স্মৃতির শহর বিদায় জানাচ্ছে প্রিয় সাহিত্যিককে
বেশ কিছু বছর আগের কথা, সম্ভবত ২০০৪। একটি পুজো কমিটির উদ্যোগে ব্যাঙ্গালোরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল একটি বঙ্গ সম্মেলন। সেখানে একদিন “দেশ” পত্রিকার একটি বৈঠক ছিল – তাতে তৎকালীন সম্পাদক হর্ষ দত্তর সঙ্গে “দেশ” পত্রিকার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন আমাদের “নীললোহিত” – শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এর পর পরই আরেকটি সভা ছিল – যাতে ব্যাঙ্গালোরের প্রবাসী বাঙ্গালীদের মুখোমুখি হয়েছিলেন – স্বয়ং সুনীল আর যা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন রঞ্জন ঘোষাল অর্থাৎ আমাদের রঞ্জনদা। প্রারম্ভিক ভূমিকাতেই রঞ্জনদা একটি ভারী সুন্দর কথা বলেছিলেন – “আমরা তাঁর জীবনের নারী-নক্ষত্র চিনি – তিনি স্বাতী”।
সেই সন্ধ্যাতে তাঁর মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম। সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। সেকথাই শোনাতে যাচ্ছি। এক অসাধারণ মানুষের সঙ্গে এক অনির্বচনীয় সাক্ষাৎকার। সুনীল সম্পর্কে এর আগে শুনেছি যে তিনি সমালোচনাতে বিদ্ধ হলেও সহাস্য থাকেন। মনে পড়ে তিনি ‘সেই সময়’ বা ‘প্রথম আলো’ রচনাকালীন সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকার পাতায় অনেক চিঠি পেতেন, সেগুলি বেশ ঝাঁঝালোই থাকত। কিন্তু তাঁর উত্তর থাকত খুব বিনম্র। অস্বীকার করবো না যে এই জ্ঞানটুকুই আমাকে বেশী সাহসী করে তুলেছিল। সুতরাং, পরীক্ষা করার এক সুযোগ তো এসেছে, কে আর ছাড়ে? আর প্রিয় সাহিত্যিকের কাছ থেকে তাঁর সাহিত্য সম্পর্কে কৌতূহল নিবৃত্ত করার লোভও সাংঘাতিক।
আমার প্রথম প্রশ্নটি কিন্তু বেশ নিরীহই ছিল। সেটি শুনে তিনি বেশ খুশীই হয়েছিলেন। আশির দশকের মাঝামাঝি সুনীল শুরু করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস, ‘পূর্ব পশ্চিম’। ‘দেশ’ পত্রিকাতে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হত। এই উপন্যাস যখন ধারাবাহিক ভাবে শুরু হল, তখন তিনি এক চমকপ্রদ ব্যাপার ঘটিয়েছিলেন। উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রের প্রায় শেষ গন্তব্যগুলি তিনি পাঠককে জানিয়ে দিয়েছিলেন।
এই প্রসঙ্গে “পূর্ব-পশ্চিম” নিয়ে একটু আলোচনা না করলে আমার প্রশ্নের তাৎপর্য পাঠকের কাছে স্পষ্ট হবে না।
“পূর্ব-পশ্চিম” বাংলা সাহিত্যের এক ভীষণ উল্লেখযোগ্য, মর্মস্পর্শী আখ্যান। যে দেশভাগ বাংলার মানুষকে আজীবন ক্ষতিগ্রস্ত করে এসেছে, সাতের দশকের শুরুতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন সেই দেশভাগের স্মৃতিকেই আবার ফিরিয়ে আনলো। এর সঙ্গে রয়েছে ষাট-সত্তরের নকশাল আন্দোলনের পটভূমি। তার সঙ্গে আবার মিলিত হলো নায়ক অতীনের আমেরিকার প্রবাসজীবনের অভিজ্ঞতা। সেখানে কর্মসংস্কৃতি খুব অদ্ভুত। বৃদ্ধ বাবা খুব অসুস্থ জেনেও তারপক্ষে হঠাৎ করে দেশে ফিরে আসা সম্ভব হচ্ছে না।
আটের দশকে ধারাবাহিকভাবে যাঁরা উপন্যাসটি “দেশ” পত্রিকাতে পড়েছেন তাঁরা মনে করে দেখতে পারেন এই ঘটনা দিয়েই শুরু হয়েছিল ধারাবাহিক উপন্যাসটি। বৃদ্ধ বাবা প্রতাপ মজুমদার রাস্তায় হাঁটছেন।
শুরুর ঘটনাকালটিকেও ধরা যেতে পারে আশির দশকের মধ্যভাগ অর্থাৎ সুনীল যখন উপন্যাস লিখছেন। প্রতাপ কলকাতার রাস্তায় বেরিয়েছেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা হচ্ছে বন্ধুকন্যা অলির সঙ্গে। তিনি ভাবছেন অলির সঙ্গে একটা অন্যায় করা হয়েছে। প্রতাপের ছেলে অতীন অলির সঙ্গে প্রেম করেছিল কিন্তু পরবর্তী কালে তার বিয়ে হয় শর্মিলার সঙ্গে। শর্মিলা খুব সরল মেয়ে, একটু ভুলে যায়। তাই নিয়ে সে খুব অপরাধবোধে ভোগে। এছাড়া অতীনের দাদা পিকলুর কোন অস্তিত্ব দেখা যায়না উপন্যাসের শুরুতে। আর একটি চরিত্র হল সুলেখা। সুলেখা অনিন্দ্য রূপসী, ত্রিদিবের বৌ। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে একটি সুসজ্জিতা ম্যানেকুইনকে দেখে তাঁর হঠাৎ মনে পড়ে যায় সুলেখার কথা! তিনি স্তব্ধ হয়ে ভাবেন রূপসী, বিদূষী সুলেখা কোন দুঃখে নিজেকে শেষ করে দিয়েছিলেন?
এরপরে যখন উপন্যাস চলতে শুরু করে তখন এসে যায় এই চরিত্রগুলি। অলির সঙ্গে অতীনের প্রেমালাপ পর্বেই কিন্তু পাঠক জেনে গেছে যে তা স্থায়ী হবেনা। সুলেখার সঙ্গে যখন পাঠক ঘনিষ্ঠ হচ্ছেন তাঁরা ভাবছেন, প্রতাপের মতই, কেন তিনি এমন হঠকারিতা করবেন। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার কিন্তু! লেখক যেন পাঠককে এক প্রচ্ছন্ন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন ধারাবাহিকের শুরুতেই। হে সতর্ক পাঠক, তোমাকে আমি আমার চরিত্রগুলির কিছু পরিণতির আভাস তো দিয়েই রাখলাম। এরপরে আমিও লিখবো, তুমিও ভাবো। দেখা যাক, আমরা কিভাবে ঐ পরিণতির দিকে যেতে পারি। কৌতূহলী, আগ্রহী পাঠকও যেন তাল মিলিয়ে চলতে থাকলেন, ভাবতে থাকলেন লেখকের সঙ্গেই।
যাঁরা এখন এই লেখাটি গ্রন্থাকারে পড়েছেন, তাঁরা জানেন সেখানে “উপসংহার” বলে একটি পর্ব আছে। সেখানে প্রতাপ মজুমদার সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়েছেন। আগে যা বলেছি, এটি ছিল একেবারে শুরুতেই। ধারাবাহিক চলাকালীন সুনীল যখন পথ পরিবর্তন করেন তখনো তিনি সেকথা সবিনয়ে জানিয়েছিলেন।
আমি সে কথা উল্লেখ করে সুনীলকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,
-“এটা কিন্তু একটা দারুণ ব্যাপার হতে যাচ্ছিল। কিন্তু আপনি হঠাৎ করে সরে এলেন। উপন্যাসের এক জায়গাতে এসে জানালেন, যে এইভাবে উপন্যাস শুরু হয়েছিল কিন্তু আবার আমরা এখানে ফিরে এলাম। এরপর যখন বই হয় বের হয় “পূর্ব-পশ্চিম” তখন আমরা একেবারে সরল রৈখিক একটি ব্যাপার দেখলাম। সেই চমকপ্রদ ফ্ল্যাশব্যাক, সেই একেবারে এক আনকোরা নতুন রীতি, সব উধাও। আমি খুব হতাশ হয়েছিলাম। কেন এরকম হল?”
সুনীল বেশ ধৈর্য ধরে শুনে উত্তর দিলেন,
“আপনার বেশ বিস্তারিত মনে আছে দেখছি। আসলে প্রথমে শুরু করে এত বড় ফ্ল্যাশব্যাক, এটা কি একটু বেশীই হয়ে যাচ্ছেনা? পাঠকের পক্ষেও এতটা ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে। তাই এখন এরকম ভাবেই রাখা হয়েছে। তাতে কতটা ভাল আর কতটা খারাপ হল, তা আপনারাই বিচার করবেন”।
যুক্তির দিক থেকে ঠিকই হয়তো। ১৯৮৫ – ৮৬র বর্তমান জগৎ থেকে যদি পাঠককে একেবারে দুম করে চলে যেতে হয় প্রায় চার দশক পিছনে, অসুবিধা হতেই পারে। কিন্তু আমার মনে আক্ষেপ রয়ে গেছে তা নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিচ্ছি।
সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকার পাতায় ও বই রূপে – পূর্ব পশ্চিম
সুনীল কবিতা দিয়ে শুরু করলেও তাঁর নিজের ভাষাতেই “গদ্যের জগতে তিনি এত বেশী দাপাদাপি করেছেন যে কবিতা পিছিয়ে গেছে”। শক্তির মৃত্যুতে তিনি জানিয়েছিলেন, “আমি লিখেছি বটে, ‘শুধু কবিতার জন্য, আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়/ মানুষের মতো ক্ষোভময় বেঁচে থাকা, শুধু কবিতার জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি’ – তবে একথা আমাকে মানায় না, শক্তিকেই মানায়”!
তিনি বিশ্বাস করতেন যে গদ্যের ভাষাতে কাব্যময়তার খুব বেশী স্থান নেই, তা অনেক ঋজু হওয়া উচিত। সেই প্রসঙ্গেই দ্বিতীয় যে উপন্যাস নিয়ে প্রশ্ন করেছিলা, তা হল ‘সপ্তম অভিযান’। এটি আমার খুব প্রিয়। আটের দশকের শেষাশেষি কোন শারদীয়া পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসের একটি নারী চরিত্রের নাম শান্তা। সে খুব সুন্দর কবিতা লেখে। তার কিছু কবিতা ছিল উপন্যাসেই। এমনকি একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে একটি ভারী সুন্দর কবিতা সে আবৃত্তি করে শুনিয়েছিল।
সেবার সুযোগ পেয়ে তাঁকে এই নিয়ে দ্বিতীয় প্রশ্ন করেছিলামঃ
আমি – আপনি সাধারনতঃ উপন্যাসে বেশী কাব্যময়তার পক্ষে নন, কিন্তু তা সত্বেও “সপ্তম অভিযান” নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন যেখানে একটি নারী চরিত্র ছিল, সে কবি। বেশ কিছু কবিতাও ছিল – দারুণ লেগেছিল। কিন্তু পরে এরকম উপন্যাস আর কেন লিখলেন না?
সুনীল – ওগুলো একবারই হয়। দ্বিতীয়বার হয় না। আপনি কি আমার “মায়াকাননের ফুল” পড়েছেন?
আমি – হ্যাঁ, সেখানে আপনি ক্রিয়াপদ ঠিক সেভাবে ব্যবহার করেননি কারণ বাংলা ক্রিয়াপদের ভাণ্ডার খুব সমৃদ্ধ নয়।
সুনীল – ঠিক। ওই রকম উপন্যাস ও আমি দুবার লিখিনি, কারণ ওগুলো দ্বিতীয়বার লিখতে নেই!
এই উত্তরটি আমার খুব মনোমত হয়েছিল। সত্যিই তো, কি সুন্দর যুক্তি! সব কিছু ‘রিপিট’ করতে নেই, হাজার ইচ্ছা হলেও। কারণ আগের অভিঘাতের রেশ নষ্ট হতে পারে।
এবারে ছিল মোক্ষম তৃতীয় প্রশ্ন – জিজ্ঞেস করেছিলাম, –
“বাংলা সাহিত্যে বিগত বছরগুলিতে বিখ্যাত সাহিত্যিকদের লেখাতে এমনকিছু চরিত্র এসেছে যা আমাদের চিরকালে মনে থেকে গেছে। দূরবীনের ধ্রুব, মাধুকরীর পৃথু, বা উত্তরসাধক এর মেধা ভাটনগর। কিন্তু সুনীলের উপন্যাস সুখপাঠ্য হলেও তাতে এইরকম গভীরমনস্ক চরিত্রের অভাব থেকে গেছে বেশ কিছুদিন। কেন পাচ্ছিনা এরকম চরিত্র?”
এই প্রশ্ন কিন্তু খুবই আক্রমণাত্মক! উপস্থিত দর্শক বেশ হৈ চৈ করে উঠেছিল আমার উদ্দেশে। কিন্তু সুনীল একটুও বিরক্ত হননি। স্মিতমুখে আমার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলেন, “কেন, রবীন্দ্রনাথকে পাননি?”
আমি বলেছিলাম, বাস্তব কাহিনীর ভিত্তিতে চরিত্র গড়ে তুলতে আপনার জুড়ি নেই। কিন্তু আমি বলছি একেবারেই কাল্পনিক চরিত্রের কথা। আগে আপনি এরকম চরিত্র দিয়েছেন কিন্তু বিগত বেশ কিছুদিন ধরেই তার অভাব অনুভব করছি।
এইসময় দর্শক আসন থেকে কেউ কেউ আপত্তি করলেন, জানাতে লাগলেন তাঁদের বিভিন্ন পছন্দের চরিত্রের কথা। কিন্তু আমি বলেছিলাম এগুলি সব পুরনো চরিত্র। সুনীল কিন্তু একবারও না রেগে গিয়ে শুনছিলেন আমার বক্তব্য। আমি শেষ করেছিলাম এই বলে যে ১৯৯৫ সালে “শান্তনুর ছবি” উপন্যাসে শান্তনুকে ছাড়া গত দশ বারো বছরে আমার কোন চরিত্র মনে দাগ কাটেনি। সুনীলের মুখে কিন্তু কোন রাগ দেখলাম না। স্মিত মুখে অভিযোগ শুনছিলেন।
স্মিত মুখে বললেন,
“সব অভিযোগ শুনলাম। ঠিক আছে, দেখা যাক এর পর কি লেখা যায়!”
আমি প্রায় স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এত অদ্ভুত সহজভাবে মেনে নিলেন। এরপর আরো কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আসর শেষ হল।
যে মুহূর্তে উনি ওপরের মঞ্চ থেকে নেমে এলেন, বাইরের খোলা হাওয়ায় দাঁড়িয়ে একটি সিগারেট ধরালেন, আমি গিয়েই বেশ সহজভাবে বললাম যে আমি কিন্তু তাঁর অনুরাগী পাঠক হিসেবেই একথা বলেছি। সুনীল আরো সহজভাবে বললেন তিনি বুঝেছেন এবং তিনি কিছু মনে করেননি। এরপর চাইতেই অটোগ্রাফও দিলেন। সত্যিই তাঁর এই পরমসহিষ্ণুতা আমাকে মুগ্ধ করেছিল বললে কম বলা হবে, আপ্লুত করেছিল। আসলে প্রিয় লেখকের সঙ্গে দেখা করার স্বপ্ন থাকে, তাঁর সঙ্গে কথা বলার, আলোচনা করার। কিন্তু স্বপ্নভঙ্গের গল্পও আমি কম পড়িনি বা শুনিনি। সেদিক থেকে এ আমার অনন্য অভিজ্ঞতা।
এই প্রসঙ্গে ‘শান্তনুর ছবি’ উপন্যাসের কথা একটু বলে নিই। কি সাংঘাতিক কথা আমি বলে ফেলেছিলাম নিজের অজান্তেই!

ছবির নায়ক শান্তনু সিনেমা পরিচালনা করে। সে ভালো সিনেমাই করে, রুচিবোধসম্পন্ন সিনেমা। স্ত্রী ঝর্ণা স্কুলে পড়ায়, সে শান্তনুর ছবির বেশ অনুরাগী। সিনেমার জগতে অল্প নাম ডাকও হয়েছে শান্তনুর। সামনে নতুন একটা সিনেমায় হাত দেওয়ার কথা, ‘জীবনময়’।
চিত্রনাট্য, অভিনেতা, অভিনেত্রী রেডি, এনএফডিসি টাকা দিচ্ছে, কথাবার্তাও হয়ে গেছে। কিন্তু প্রথম দফার টাকাটা যে কেন ছাড়ছে না, হাত গুটিয়ে বসে থাকতে থাকতে শান্তনু অশান্ত হয়ে উঠছে। সে কি আদৌ করতে পারবে সিনেমাটা সব সমস্যা কাটিয়ে?
একদিন হঠাৎ করে তার স্ত্রী ঝর্ণাকে দেখে খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে, একেবারে প্রথম যৌবনের মত দৃপ্ত, তীব্র সঙ্গমের পরই বাথরুমে গিয়ে শান্তনু আবিষ্কার করেছিল “তার পেচ্ছাপের রঙ লাল!” কি হয়েছে তার? এমন তো আগে হয় নি! “শান্তনু কপাল কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইল”!
পরে জানা যায়, শান্তনুর প্রস্টেট ক্যানসার। কিন্তু সে ছবি শেষ করে তবেই চিকিৎসা করতে চায়। নতুন কাজ তার জীবনের স্বপ্ন, সে বাড়ির কারুকে জানায় না। তার ঘনিষ্ঠ ডাক্তার বন্ধুদেরও অনুরোধ করে। ছবি শেষ করে সে যখন অপারেশন টেবিলে যায়, তার আর জ্ঞান ফেরে না। তার ছবিটি কিন্তু নাম করে। এই মর্মস্পর্শী কাহিনী আমার মনকে খুব ছুঁয়েছিল। কিন্তু এর পিছনের কারণটা জেনেছি অনেক পরে। তাঁর মৃত্যুর পর জানি ১৯৯৫ সালেই সুনীল জানতে পারেন তাঁর নিজস্ব প্রস্টেট ক্যানসারের কথা! কি অদ্ভুত! শান্তনু কি সুনীলের নিজেরই এক সত্ত্বা? সেজন্যই কি এত মর্মস্পর্শী, আমাকে এমনভাবে ভাবিয়েছিল? হয়তো তাই।
এরপরের পর্ব ব্যক্তিগত আলাপচারিতা রঞ্জনদার বাড়িতে। সেখানে গিয়েও তাঁকে ছাড়িনি। বেশ অনেকদিন আগে উইলিয়াম রাদিচের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে গেলে সঞ্চয়িতার চাইতে অন্য ধরনের একটি কাব্য সঙ্কলন প্রকাশ করা প্রয়োজন। তিনি নিজে সম্পাদনার দায়িত্ব নিতে রাজি আছেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এই ব্যাপারে কাজ কিছু হয়েছে কিনা। একটু বিমর্ষভাবে তিনি জানালেন যে ১৯৯১ সালে কপিরাইট উঠে যাবার পর তিনি কাজ শুরু করবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু আরো দশবছর কপিরাইট বেড়ে যাওয়াতে তিনি উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। ভবিষ্যতে দেখা যাক কি হয়। রাদিচের সঙ্গে এই সাক্ষাৎকারে সুনীল বেশ কিছু কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে। একটি আলোচনা ছিল ‘প্রশ্ন’ কবিতা নিয়ে। রাদিচে কবিতাটিকে সঙ্কলনে স্থান দেওয়াতে সুনীল বলেছিলেন যে তিনি খুব ছোটবেলাতে এই কবিতাটি অনেকবার পড়েছেন, কিন্তু এখন এই কবিতাটির কাব্যমূল্য নিয়ে তিনি যথেষ্ট সংশয়ান্বিত। এই কথাটি আমার একটু খারাপ লেগেছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে যখন পড়েছি, সুনীলের সঙ্গে একমত না হয়ে পারিনি। শেষ পর্যায়ে এসে, সেই যে –
“যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো / তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো।” –
এই কথার মধ্যে যতটা বাণী বা মূল্যবোধ আছে, ততটা কাব্যময়তা নেই। স্বতস্ফূর্ততার বড্ড যেন অভাব। সুনীলের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আমার এখন মনে হয় রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কবিতার বই নিশ্চয় গীতবিতান।
রঞ্জনদার হাতে ছিল সুনীলের শ্রেষ্ঠ কবিতার বইটি। সত্যি কথা বলতে আমি কবিতায় খুব বেশী পটু নই। কিছু কিছু পড়েছি। সুনীলেরও কিছু কবিতাই।
তারমধ্যে সবথেকে প্রিয় যেটি সেটির শুরু – “নীরার অসুখ হলে কলকাতার সবাই বড় দুঃখে থাকে”! আমি রঞ্জনদাকে অনুরোধ করেছিলাম সেটি আবৃত্তি করার জন্য। খুঁজতে অসুবিধা হলেও সুনীলই জানিয়ে দিলেন শেষে একটি প্রথম ছত্রের অনুযায়ী সূচীপত্র আছে। সেটি বার করার পর রঞ্জনদা বললেন, “না, না, আমি না। তোমার পছন্দের কবিতা, তুমিই পড়ো”।
আমার তো ইচ্ছে ছিলই। কিন্তু কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না! স্বপ্নের লেখক, তাঁর সামনে বসে কবিতা পাঠ করবো আমি? শুরু করলাম। তিনি নিবিষ্ট মনে
শুনতে লাগলেন। পাঠ শেষ হলে সবাই কবিতাটির আবার প্রশংসা করলেন।
দূরে থাকি বলে রাত্রি ঘনিয়ে আসতেই বিদায় নিতে হল। ফিরলাম এক অসামান্য অভিজ্ঞতা নিয়ে।
মনে পড়ে যাচ্ছিল পঠিত কবিতার শেষ কয়েক লাইন-
“অমনি আড়াল সরে, বৃষ্টি নামে,
মানুষেরা সিনেমা ও খেলা দেখতে
চলে যায় স্বস্তিময় মুখে
ট্রাফিকের গিঁট খোলে,
সাইকেলের সঙ্গে টেম্পো,
মোটরের সঙ্গে রিক্সা
মিলেমিশে বাড়ি ফেরে যা-যার রাস্তায়
সিগারেট ঠোঁটে চেপে কেউ কেউ বলে ওঠে,
বেঁচে থাকা নেহাৎ মন্দ না!”
সত্যিই! এরকম বর্ণময় মানুষের সঙ্গে একটি অনির্বচনীয়, অবিস্মরণীয় সন্ধ্যা কাটানোর পর তো আমারো মনে হচ্ছে – সত্যিই – – “বেঁচে থাকা নেহাৎ মন্দ না !”
Bhalo laglo.
LikeLike
ধন্যবা।
LikeLike
অসাধারণ লাগল লেখাটাChandana
LikeLike
ভাল লাগল, ভাস্করদা। সুনীল আমার প্রিয় ঔপন্যাসিক বা গল্পকার নন। কবি সুনীল অন্য মানুষ। তবে, সব ছাপিয়ে আসলে যা রয়ে যায় তা হল সুনীল বাংলা সাহিত্যজগতে এক নক্ষত্র যাকে বলে স্টার। স্টার আর অভিনেতা যেমন এক জিনিস নয়, স্টার আর লেখকও এক জিনিস নয়। তবু, স্টার স্টারই। তাকে আপনি গোনাগুনতি কয়েকটি শব্দতে বেশ ধরেছেন। আপনার প্রশ্নের পর একটুও রাগ না করে তিনি ফাঁকায় গেলেন সিগারেট ধরাতে। যন্ত্রণাদীর্ণ সুনীলকে আমি ওই একঝলক দেখলুম। ধন্যবাদ।
LikeLiked by 1 person
অজস্র ধন্যবাদ শেখর। আমি তো জানি তোমার মতামত।
কেন জানি, আমার বরাবরই ওঁকে খুব কাছের মানুষ বলে মনে হয়। ওঁর প্রবন্ধগুলিও আমার বড় প্রিয়।
LikeLike
অজস্র ধন্যবাদ শেখর। আমি তো জানি তোমার মতামত।
কেন জানি, আমার বরাবরই ওঁকে খুব কাছের মানুষ বলে মনে হয়। ওঁর প্রবন্ধগুলিও আমার বড় প্রিয়।
LikeLiked by 1 person
আলোচনাটির মধ্যে মুগ্ধ পাঠকের সমর্পণ থাকলেও সততা বেশ প্রত্যক্ষভাবে চোখে পড়ে। সাধুবাদ জানাই।
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ দাদা।
ওঁকে আমার বড় কাছের মানুষ বলে মনে হয়, তাই ‘সমর্পণ’ স্বাভাবি।
LikeLike
অনেক ধন্যবাদ, শিবাংশু দা।
LikeLike
চমৎকার লাগল এ লেখাটা। ভক্ত পাঠক লেখকদের এক পরম প্রাপ্তি। তুমি যে ওঁর তেমন একজন পাঠক বুঝতে পেরেছিলেন, তাই রাগেন নি। সত্য কারের বড় লেখকরা constructive criticism বা গঠন মূলক পাঠ প্রতিক্রিয়াকে ‘আপনি কী ভাল লেখেন’ গোছের লঘু প্রশংসার থেকে বেশি দাম দেন । তুমি যে ওঁর সিরিয়াস পাঠক ধরে ফেলেছিলেন আর তোমার খোলা মনের স্টাইল টা এ লেখায় আমাদের মন কাড়ল ।
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ দিদি।
LikeLike
চমৎকার লাগলো।লেখকের সৌভাগ্য তোমার মত মননশীল,মনোযোগী পাঠক পাওয়া।
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ দিদি।
LikeLike