তাঁর শতবর্ষ পূর্তি হতে আর এক বছরেরও কম সময় বাকি। সম্প্রতি প্রখ্যাত লেখক সৌরভ মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত – এক পুরনো বিবাদ’ লেখাটিতে হেমন্তের গানের জনপ্রিয়তার কথা বোঝাতে গিয়ে একটি মূল বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
তিনি বোঝাতে চেয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কখনোই রবীন্দ্রনাথের গানকে ‘ঠাকুরের গান’ তকমা দিয়ে আলাদা করে রাখতে চাননি, যেভাবে অন্য গীতিকারদের গানকে তিনি তাঁর সম্পূর্ণ নিবিড় মনোনিবেশের সঙ্গে পরিবেশন করতে চেয়েছেন, তেমনি রবীন্দ্রসঙ্গীতকে। লিখছেন –

“পেশাদারিত্ব আর আন্তরিকতার নিখুঁত মিশেল আর অতি নাটক বর্জনের সংযম। যেমন সলিলের গান, গৌরীপ্রসন্নর গান, মুকুলের গান, তেমনই তিনি ‘রবীন্দ্রনাথের গান’ গেয়েছেন ‘ঠাকুরের গান’ নয়” – ১
আমরা সম্পূর্ণ একমত। বিভিন্ন গীতিকার, মুকুল দত্ত, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার বা মিল্টু ঘোষকে তিনি গীতরচনাতেও অনুপ্রাণিত এবং প্রভাবিত করেছেন, এমন কথাও বিভিন্ন আলাপচারিতায় জানতে পারি। বস্তুতঃ তাঁর সাহিত্যিক সত্ত্বাকে তিনি গানের জগতে এসে বিসর্জন তো দেননি, বরং তার পূর্ণ সদ্ব্যবহারকরে আধুনিক বাংলা গানকে অনেক পথ এগিয়ে দিয়েছেন। আলোচনা করা যেতে পারে একটি গানের গায়ন নিয়ে।
তাঁর এই বছর জন্মদিন ও পড়েছিল “আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে”! সেই মেঘদূতের দিন। সেই কথা মনে রেখেই
পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ও তাঁর গীত একটি অতি বিখ্যাত গান – ‘ওগো মেঘ তুমি উড়ে যাও’!
এই গানটি সম্পর্কে তথাগত ভট্টাচার্য লিখছেন –
“উজ্জয়িনীর এক কবি সার্ধ সহস্রাব্দ আগে মেঘকে দূত করে পাঠিয়েছিলেন স্বর্গপুরী অলকায় প্রিয়ার কাছে বিরহী যক্ষের হৃদয় বেদনা বহন করে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু আধুনিক মননের মনোবেদনার গঠন অনেক জটিল ও গভীর-মূল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর “উত্তরাধিকার” কবিতায় নতুন প্রজন্মকে দিয়ে যাবার জন্য তাঁর যৌবনের সম্পত্তির তালিকা তৈরী করতে গিয়ে অন্যতম সম্পদ হিসেবে গণনা করেছিলেন “দুঃখবিহীন দুঃখ”-কে, আর পুলক তাঁর রচনায় তুলে ধরলেন, প্রেমহীনতার নয়, প্রেমের বেদনাবিহীনতার বেদনাকে। নিঃসঙ্কোচে বলা যায়, সমসাময়িক বাংলা গানের প্রচলিত ভাব ধারার চেয়ে এই ভাবনা বহুদূর এগিয়ে।” -২

এই ধরনের মননশীল গানের জনপ্রিয়তার জন্য হেমন্তের অবদানও প্রচুর। ওপরে যে কথা লিখেছেন সৌরভ, হেমন্ত যখন পুলক গীতিও গাইতেন নিজেকে উজাড় করে দিতেন। “পেশাদারিত্ব আর আন্তরিকতার নিখুঁত মিশেল আর অতি নাটক বর্জনের সংযম।”
ওগো মেঘ, তুমি উড়ে যাও কোন ঠিকানায়?
কে তোমায় নিয়ে যায় দূর অজানায় –
বলো না আমায়!
গানের শুরুতেই যেন এক দুঃখী অথচ কৌতুহলী উচ্চারণ, –
“——–কোওওন ঠিকানায় / —-দূঊঊর অজানায়”।
তুমি যাচ্ছ, আমি দেখছি। মন যেতে চায় – কিন্তু যেতে পারিনা। তাই এক অদ্ভুত আকুতি – ‘বলো না আমায়’!
কি আবদার! উচ্চারণের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। রাবীন্দ্রিক ভাষায় যা ছিল –
‘যক্ষের যে মেঘ নগনদী নগরীর উপর দিয়া উড়িয়া চলিয়াছে পাঠকের বিরহকাতরতার দীর্ঘ নিশ্বাস তাহার সহচর হইয়াছে’ –
গানে তা যেন মূর্ত হয়ে গেল। এর পরে বেদনা আরো গভীর হতে থাকে – সেই ‘দুঃখহীনতার দুঃখ’।
আমি নই সেই বিরহী, আমার কাউকে বলার কিছু নেই।
তবু যেন কি বেদনা জমে ওঠে হৃদয়ে –
মনে হয় আমার কেউ কেন নেই ওই অলকায়।
গভীর মনঃসংযোগ করে শুনলে ‘আমি নই সেই বিরহী’ এর সঙ্গে ‘আমার কাউকে বলার কিছু নেই’ – দুটি গায়নের তফাৎ অনুভূত হয়। প্রথমাংশে গভীর বেদনা হলেও দ্বিতীয়াংশে যেন প্রচ্ছন্ন অভিমান। বিশেষতঃ –‘ব-লা-র কিছু নেই’- কি অপূর্ব উচ্চারণ। পরে আবার ‘কেউ কেন নেই ওই অলকায়’ – এই অংশে তীব্র বেদনার অনুভূতি।
তবু আজ এই লগনে তোমায় একটি বারতা জানালাম- ‘বারতা’ জানানোর কথাটা তুলনাতে সুস্পষ্ট উচ্চারণ। আবার পরেই পরিমিত ভাবে ঢলে পড়ছেন বেদনার ভারে। এবারে আরো প্রগাঢ়-
ব্যথা যদি নাই পাই, এ জীবনে কি পেলাম!
সেই প্রেম কোথায়?
যে সে আমার মনকে কাঁদায়!
আহা! ‘দুঃখহীনতার দুঃখ’।
“ব্যথা যদি নাই পাই, এ জীবনে কি পেলাম!”
কণ্ঠে যেন এমন মর্মস্পর্শী, সর্বব্যাপী, আবেদন আমাদের অন্তরাত্মা কে স্পর্শ করে যায়।
কি পরিমাণ অবদান রেখে গেছেন এই মানুষটি। মেধা, মনন ত ছিলই। তার সঙ্গে ছিল তীব্র পরিমিতিবোধ এবং গভীর অথচ অনুচ্চারিত আত্মপ্রত্যয়। তাঁর সুরারোপিত বিখ্যাত গানটিতে গৌরীপ্রসন্ন ভারী সুন্দর লিখেছিলেন –
তুমি যে আমার দিশা, অকুল অন্ধকারে,
দাওগো আমারে ভরে, নীরব অহংকারে।
হেমন্ত আমাদের সেই “নীরব অহংকার”! সব “কোলাহল বারণ” করে “কেবলমাত্র গানে গানেই” তিনি আমাদের সঙ্গে “প্রাণের আলাপ” করান। সে গান, রবীন্দ্রনাথের হোক বা অন্য কারুর, সেই ভাবনা তাঁর কাছে অত গুরুত্বপূর্ণ নয়, গায়নের মাধ্যমে গানে প্রাণ সঞ্চার করে শ্রোতার মনপ্রাণ আকুল করাই একমাত্র উদ্দেশ্য।
আসুন শুনি গানটা আর বারে বারে অনুভব করি।
১ https://banglalive.com/hemanta-mukherjee-rabindrasangeet-feature/
চমৎকার। গানটি আমার খুবই প্রিয়। অসাধারণ সুরারোপ ও পরিবেশনা। লেখাটির জন্য অভিনন্দন।
LikeLiked by 1 person
সুন্দর আলোচনা! বর্তমান প্রজন্মের কাছে বাঙলা সংস্কৃতির এইসব মনিমুক্তা গুলি তুলে ধরা অতি প্রয়োজনীয়।
LikeLike
সুন্দর আলোচনা! বর্তমান প্রজন্মের কাছে বাঙলা সংস্কৃতির এইসব মনিমুক্তা গুলি তুলে ধরা অতি প্রয়োজনীয়।
LikeLiked by 1 person
An excellent article! Refreshing thoughts with renewed convictions
LikeLiked by 1 person
খুব ভাল লাগল পড়ে। হেমন্ত বাবুর প্রতি শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেল।
একটা জিনিষ না বললেই নয়,উনি মানুষ চিনতেন। লতা জী কে গানের জগতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তার অবদান কে না জানে। লতা জীর কন্ঠে হেমন্ত বাবুর সুর অনবদ্য রইবে অনাদিকাল।
LikeLike
খুব ভালো লাগলো , এত সুন্দর এবং প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা ..অনেক কিছু জানতে পারলাম
LikeLike