“সূর্য বলল ইস! আমি উঠলাম ভাগ্যিস
তাই রাত্তির হলো ভোর
মানুষ বলল ধুত! তোর যুক্তি টা অদ্ভুত
আমরা ছিলাম বলেই দিলাম
সূর্য নামটা তোর!”
২৬শে ডিসেম্বর, ২০১৯। কাসারগড়ের কাছেই কানহাগড়ের একটা হোটেলে আমারা রয়েছি। সকাল সাড়ে সাতটা। হোটেল থেকে বেরিয়ে আমরা যখন রওয়ানা হচ্ছিলাম তখন সূর্য আমাদের বাঁদিকে পরিষ্কার দাঁত বার করে হাসছে। ঐ ওপরের গানটার মতই, ‘আমি উঠলাম ভাগ্যিস’!

কিন্তু সে কি জানে তার ভাগ্যে কি রয়েছে আজ? মানুষ জানে অবশ্যই। সকাল ৮টা ৬ মিনিটে শুরু হবে গ্রহণ, সূর্য ঢাকা পড়তে থাকবে আস্তে আস্তে, ৯টা ২৫ থেকে ৯টা ২৮ মিনিট পর্যন্ত থাকবে বলয় গ্রাস? তারপর আবার আস্তে আস্তে সে মুক্তি পাবে? নাঃ, বড্ড তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে, শুরু করা যাক একটু ধীরে ধীরে, একেবারে প্রথম থেকেই।
নভেম্বরের মাঝামাঝি। আমার কাজের ক্ষেত্রে একটি বিষয় হল শক্তি সংরক্ষণ প্রকল্প (Energy Storage)। অপ্রচলিত বা সবুজ শক্তির (Non- Conventional or Green Energy) র জনপ্রিয়তার পথে একটা মূল বাধা, তাদের প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীলতা। সৌরশক্তি যেমন নির্ভর করে পর্যাপ্ত সূর্যালোকের ওপর। সূর্যগ্রহণের সময় হঠাৎ অল্প সময়ের মধ্যে সূর্যালোকের দীপ্তি হ্রাস পাওয়াতে সৌরশক্তির পরিমাণ আচমকাই কমে গেলে সমস্যা হয়। সংরক্ষিত শক্তি সেইসময় কাজে আসবে।
এই নিয়ে খুঁজছিলাম কখন ভারতে সূর্যগ্রহণ হবে। হবি তো হ, চোখে পড়লো তার দুদিন আগেই ঘোষণা হয়েছে, এই দশকের শেষ সূর্যগ্রহণ ২৬শে ডিসেম্বর। পৃথিবীর মাত্র তিনটি জায়গা থেকে দেখা যাবে পূর্ণ বলয়গ্রাস। তাদের একটি কেরালার চেরুভেত্তুর। খবরে লেখা রয়েছে – সূর্যগ্রহণ দেখতে হলে ২৬শে ডিসেম্বর চলে যান চেরুভাত্তুরে। – ১
কোথায় আবার চেরুভাত্তুর? জেলা কাসারগড়। আবার তার কাছেই কানহাগড়ে থাকলে চেরুভাত্তুর খুব কাছেই পড়বে। খোঁজ পাওয়া গেল speace-India ( https://www.space-india.com/ ) বলে একটি সংস্থা কাসারগড় জেলার আধিকারিকদের সঙ্গে মিলে পর্যবেক্ষণ এর সুব্যবস্থা করেছে। -২
হঠাৎই মনে হল, গেলে কিরকম হয়! যেমন ভাবা তেমনি কাজ। বুক করে ফেলা গেল। আরো জানা গেল কাছাকাছি বেকাল দুর্গ ও সমুদ্রতীর আছে। এরাও বেশ দর্শনীয়।
২৫শে ডিসেম্বর, ২০১৯। ক্রিসমাসের দিনই আমরা রওয়ানা দিলাম। Space – India আমাদের জানিয়েছিলেন তাঁদের দল ইতিমধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেছেন। ঘটনাস্থল –
Govt. Higher Senior Secondary School (GHSS) ground, Kuttumath, Cheruvathur, Kasargod District, Kerala, India (Coordinates: 12°13’15.58″N, 75° 9’46.70″E)
তাই পরদিন সকালেই রওয়ানা হচ্ছিলাম। গিয়ে পৌঁছে দেখি বেশ সুন্দর ব্যবস্থা, সাজো সাজো রব।

স্কুলের গেটের সামনেই রয়েছে ক্ষুদে স্বেচ্ছাসেবকের দল। প্রচুর গাড়ী আসাতে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে সক্রিয় পুলিশবাহিনী। কিন্তু বেশ সুশৃঙ্খলভাবে সবাই দলবদ্ধ হয়ে স্কুলের মাঠে দেখতে চলেছে এই দুর্লভ প্রাকৃতিক ঘটনাটি।
ভালো লাগলো এবং মজাও লাগলো ক্ষুদেদের দেখে। কি সুন্দর উৎসাহ নিয়ে দায়িত্ব পালনে আগ্রহী। তাদের আবার প্রথমে একটু প্রথাগত ভাবে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করানোও হল।

তারা সবাইকে জানাচ্ছে যে খালি চোখে বা সাধারণ গগলস পরে সূর্যের দিকে তাকানো ঠিক নয়। তাদের কাছে বিশেষ চশমা আছে, কারুর কাছে না থাকলে তারা যেন সেটি নিয়ে নেয় এবং পরে ফেরৎ দেয়। মাইকেও ঘোষণা হচ্ছিল। আমরা অবশ্য তৈরি হয়েই এসেছি, নিজেদের চশমা নিজেরা নিয়েই এসেছি। এক্স রে প্লেট বা অন্য কিছু দিয়ে দেখা একদমই নিরাপদ নয়। পরীক্ষিত চশমা পাওয়া যাচ্ছে, তাই আমরা নিয়ে এসেছি সকলের জন্য।

এছাড়া রয়েছে বহু সংবাদ মাধ্যম। কেউ কেউ আবার বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজে ব্যস্ত। সব মিলিয়ে বেশ চমৎকার বৈজ্ঞানিক পরিবেশ। সবচেয়ে আরো যা চোখে পড়লো তা হল নারী দর্শনার্থীদের সমাগম। অর্ধেকের বেশি বইকি।

একটি জায়গাতে সুন্দর লাইভ টেলিকাস্টের ব্যবস্থাও আছে। বেশীক্ষণ তো সূর্যের দিকে তাকানো যাবে না, কাজেই দর্শকেরা কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নিতে নিতে টেলিকাস্ট দেখতে পারে। তারপর ‘পরমলগ্নে’ ভেতরে ও বাইরে দুজায়গাতেই দুরকম দৃশ্য উপভোগ করতে পারে।

হিসেব মতোই ঠিক আটটা বারো (৮টা ৬) মিনিটে শুরু হল গ্রহণ লাগা। খুব আস্তে আস্তে বাড়তে লাগলো। আমরা ছবি ধরার চেষ্টা করছিলাম মোবাইল ক্যামেরাতেই, কিন্তু ঠিক আসছিল না। মাঝে ‘একখানা মেঘ ভেসে এল বাতাসে’! একটু মন খারাপ হলেও মেঘের ফাঁকের সূর্যের গ্রহণের ছবি সহজেই ধরা গেল ক্যামেরাতে। এছাড়া আবার বিভিন্ন সংস্থার ল্যাপটপেও ধরা পড়ছিল ছবিগুলি।


ঘড়ির কাঁটা ক্রমশঃ এগোচ্ছে সেই শুভক্ষণের দিকে। আমাদের সময় সূচী ছিল এরকম –
শুরু – ৮.০৬ পূর্ণ বলয় – শুরু ৯টা ২৫ – শেষ – ৯টা ২৮ – গ্রহণমুক্তি – ১১.০৪
আস্তে আস্তে ঘনিয়ে এল সেই মুহূর্ত। সময়ানুসারেই। আর কি আশ্চর্য, আমার বন্ধুর মোবাইল ক্যামেরাতে ভিডিও মোডে ধরা পরে গেল সেই ছবি। তারথেকে তৈরি হল যা তা নীচে দিলাম। পাশে রইল পেশাদারী ক্যামেরার ছবি।

তবে সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার হল সবাই মিলে প্রায় হৈ হৈ করে সেই আনন্দের মুহূর্তের সাক্ষী থাকা। সকালের যে সূর্য পূর্ণ আলোতে ছিল, তা মানুষের মাপা নির্ধারিত সময়েই অদৃশ্য হল আবার দৃশ্যমান হল। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, মানুষের বলার রীতিমত হক আছে যে – “ধুত! তোর যুক্তি টা অদ্ভুত / আমরা ছিলাম বলেই দিলাম / সূর্য নামটা তোর!”
আর শুধু কি নাম, তার চলন ও তো আমরাই ঠিক করি। সবার উপরে মানুষ সত্য! আর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা যাঁরা করছেন, তাঁদের তো চরম উৎসাহ, উত্তেজিত গলাতে শোনা যাচ্ছে, ‘ফার্স্ট কনট্যাক্ট, সেকন্ড কনট্যাক্ট—“!!
১৯৮০ সালে আমরা কলেজে পড়াকালীন একবার ভারতে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। তখন কিন্তু অনেক কুসংস্কার ছিল। যেমন বাইরে বেরোন যাবে না, খাওয়া যাবে না। এখন অনেকটাই কেটে গেছে। এখানে বিজ্ঞান সংস্থার প্রতিনিধিরা ঠিক পূর্ণ গ্রহণের সময় জলপান করে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন সেগুলি কেবলই কুসংস্কার, তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। ভাল লাগলো তাঁদের এই ঐকান্তিক প্রয়াস। এত বড় দেশে কত ভাল কাজ হচ্ছে, আমরা তার কতটুকুই খোঁজ রাখি?
আবার সেদিন সাঁঝবেলাতে আমরা গেছিলাম সমুদ্রতীরে। ঐ সূর্যের সমুদ্রের বুকে মিলিয়া যাওয়া দেখবো বলে। সূর্যাস্ত ছিল সোয়া ছটা নাগাদ। তার একটু আগেই আবার মেঘ এসে গেল – কিন্তু তার আগে পরে ছবি নেওয়া গেছে।

আরো আনন্দ হল ফিরে! যখন জানলাম ভারতে একমাত্র কাসারগড়েই দেখা গেছে সেই সম্পূর্ণ আগুনের আংটি – আকে বলে – ‘perfect-ring-of-fire’! পরে এসে অবশ্য আরো অনেক ছবি দেখেছি, কিন্তু ঐ অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ আলাদা। – ৩
২৬শে ডিসেম্বর, ২০১৯। দিনটা বেশ অন্যরকম কাটলো। সপরিবারে, সবান্ধবে সূর্যের সঙ্গে গোটা দিন কাটানো আমার এই প্রথম। অনেকদিন মনে থেকে যাবে এই দিনটা ।
দুর্দান্ত লেখা। মানসচক্ষে সব দেখলাম। অভিনন্দন দাদা।
LikeLike
জানতাম তোমার ভাল লাগবে। অনেক ধন্যবাদ সৌম্য।
LikeLike
নন কনভেনশন্যাল এনার্জি সংরক্ষণে কাজটা নিয়ে আরেকটু লিখলে উপকার হতো, বড্ড কৃপণতা করলে। এটা তো আর শব্দমাপা বাজারি কাজ নয়, তাই আমাদের উপকার হতো।
কাসারগড়/কানহাগড়ের একটা গুগুল ম্যাপ অ্যাটাচ করতে পারতে।
আগে বাজে কথা কয়ে নিয়ে বলি, অসাধারণ হয়েছে। ভারী আন্তরিক ভঙ্গিতে এই বিরল ঘটনার প্রতিবেদন লিখেছো, খুব ভালো লাগে পড়তে।
LikeLiked by 1 person
ভাস্কর দারুন লেখা হয়েছে। খুব ভালো লাগলো। বিশেষ করে comparing annular eclipse pics।
LikeLike