এক কাছের পরিচালক – বাসু চ্যাটার্জী

বোম্বের বা অধুনা মুম্বাইয়ের ফিল্ম জগতে বাঙালীদের খ্যাতি ছিল একেবারে শুরুর থেকেই। কলকাতার চিত্র পরিচালক, সঙ্গীত পরিচালক, অভিনেতা বা গায়কেরা এবং লেখকেরাও সেখানে খুব বড়ো জায়গা করে নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন শচীন দেব বর্মণ, বিমল রায়, হৃষীকেশ মুখার্জি, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, শক্তি সামন্ত, প্রমুখ। তালিকা অনেক দীর্ঘ, কিন্তু উল্লিখিত কয়েকটি নামের ঔজ্জ্বল্য দেখেই বোঝা যাবে যে তাঁদের উপস্থিতি কত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।

প্রায় সকলেই বিদায় নিয়েছেন। বাকি ছিলেন বাসু চট্টোপাধ্যায়।  সম্প্রতি তিনিও প্রয়াত হলেন।

বাঙালীদের কাছে ট্রিলজি খুব পছন্দের। গ্রন্থের ট্রিলজি খুব জনপ্রিয়। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের রানুর প্রথম ভাগ থেকে তৃতীয় ভাগ। আশাপূর্ণা দেবীর প্রথম প্রতিশ্রুতি, সুবর্ণলতা ও বকুলকথা। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে, মানুষের ঘরবাড়ি, অলৌকিক জলযান। আর সবচেয়ে জনপ্রিয় সম্ভবতঃ শঙ্করের “স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল” – জন-অরণ্য, সীমাবদ্ধ ও আশা – আকাঙ্ক্ষা।

সিনেমার সর্বপ্রথম ট্রিলজি পথের পাঁচালী, অপরাজিত, অপুর সংসার। মৃণাল সেন কৃত কোরাস, ইন্টারভিউ, কলকাতা ৭১। একই ভাবে বাসু চ্যাটার্জি আমাদের দিয়েছিলেন এক অনবদ্য ট্রিলজি রজনীগন্ধা, চিতচোর, ছোটিসি বাত।

নায়ক হিসেবে ছিলেন এক অপরিচিত মুখ – অমল পালেকর। এই তিন সিনেমার পর তিনি হয়ে গিয়েছিলেন বাঙালী মেয়েদের হৃদকম্পন। তা আমি নিজেই প্রত্যক্ষ করেছি।

বিভিন্ন প্রকাশিত লেখাগুলি থেকে জানা যায় তিনি অধুনা বলিউডে প্রবেশ করেন বসু ভট্টাচার্যের ও শৈলেন্দ্রর হাত ধরে। এর আগে তিনি ব্লিৎজ পত্রিকার কার্টুনিস্ট ছিলেন। পরে ফিল্ম সোসাইটির আন্দোলনে যুক্ত হয়ে তিনি সিনেমার প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯৬৯ এ তাঁর প্রথম ছবি ‘সারা আকাশ’ মুগ্ধ করেছিল দর্শকদের। –

তাঁর ছবি মুগ্ধ করলেও সেভাবে বাণিজ্যিক সাফল্য লাভ করেনি। উপরোক্ত ট্রিলজির প্রথম ছবি ‘রজনীগন্ধা’ অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল, এমনকি তার নামকরণ ও পরিবেশকদের আদৌ পছন্দ ছিল না। ছবিটি মুক্তি পেতে বহু দেরি হয়। – ২

মুক্তি পাওয়ার পর অবশ্য অসুবিধে হয়নি। তাঁর আর অমল পালেকরের জুড়ি পরপর তিনটি এমন ছবি উপহার দিলেন যা আজো আমাদের বাঙালী মনের খুব কাছের। এর আগে নায়করা ছিলেন সর্বগুণসম্পন্ন। ‘নায়ক’ সিনেমাতে সাংবাদিক অদিতি সেনগুপ্তর (ভূমিকায় শর্মিলা ঠাকুর) সেই অভিযোগ মনে পড়ে?

সেই সময় হিন্দিতেও রাজেশ খান্নার মত সুপারস্টারের রমরমা। এসে গেছেন অমিতাভ বচ্চন, রয়েছেন ধর্মেন্দ্র। এই সময় এমন একজন অপেক্ষাকৃত দুর্বল নায়কের প্রবেশ ঘটানো  বেশ সাহসী ব্যাপার বলেই মনে হয়েছে। তাঁর আগে হৃষীকেশ মুখার্জীর সিনেমার সাফল্য তাঁকে উদ্দীপ্ত করে থাকবে।

তাঁর অনেক সৃষ্টিই আমার মনের খুব কাছের। এমনকি মিঠুন ও রতি অগ্নিহোত্রীকে নিয়ে তাঁর শেষের দিকের দুটি ছবি, শৌকীন ও পসন্দ আপনি আপনি ও মোটামুটি পছন্দের।

তবে যাঁর জন্য তিনি আমার একদম কাছের মানুষ, তা নিঃসন্দেহে ঐ ট্রিলজি।

প্রথম ছবি ‘রজনীগন্ধা’ তে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। প্রায় দু’বছর লেগে গেল মুক্তি পেতে। তবে ১৯৭৪ সালে মুক্তি পাওয়ার পর বেশ হিট হল। মানুষ পেল এক নায়ককে – যে বেশ দুর্বল। কিন্তু নায়িকাকে জয় করে নিতে পারে তার ভালোমানুষি দিয়ে।

এক সাক্ষাৎকারে অমল ও সেকথাই বলেছিলেন, তিনি আনকোরা এক নতুন নায়ককে এনেছিলেন। ‘দাদার কীর্তি’র কেদারকে মনে পড়ে? শরদিন্দুর এই উপন্যাসটি খুব ছোটবেলার লেখা। প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে। অমল পালেকর অভিনীত চরিত্রগুলি যেন তারই পূর্বসূরি।

এরপর তো বাংলা গল্প – সুবোধ ঘোষের ‘চিত্তচকোর’ অবলম্বনে ‘চিতচোর’! যে কাহিনীর নায়িকা ভুলবশতঃ যাকে নির্বাচন করে সে আসলে মনোনীত পাত্রের অধস্তন কর্মচারী। কিন্তু নায়িকা তার মনস্থির রাখে কারণ ঐ কর্মচারী তার মন জয় করে ফেলেছে। ধীরে ধীরে অমল পালেকর এক সমান্তরাল নায়কের ভূমিকায় সাফল্যের সঙ্গে দর্শকের মন জয় করতে থাকলেন। মনে রাখতে হবে, পাশাপাশি অমিতাভ বচ্চন উঠে আসছেন দারুণ ভাবে। ১৯৭৫ এ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শোলে’ সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তৃতীয় ছবি ‘ছোটিসি বাত’ সাফল্যের মুখ দেখলো। তৈরি করে ফেলল নিজের দর্শকমণ্ডলী।

‘ছোটিসি বাত’ এর কাহিনীতে এক নতুন দিক দেখলো দর্শক যাকে আজকের ভাষায় বলা চলে – ‘Grooming up’. এর জন্ম আট বা নয়ের দশকে। কিন্তু সাতের দশকে সেই ছবিতে এমনভাবে পরিবেশিত হয়েছিল তা বেশ অভিনব ছিল। নায়ক অমল পালেকরকে তাঁর প্রেমিকা বিদ্যা সিনহার যোগ্য করে তুলেছিলেন শিক্ষক বা আজকের ভাষায় মেন্টর অশোককুমার।

এ যেন এক রূপকথার গল্প, যেখানে প্রথমে সমস্যা হলেও শেষ অবধি রাজপুত্র তার রাজকন্যাকে লাভ করে। হ্যাঁ, অনেকে সমালোচনাও করেছেন। এ কাহিনী বাস্তবতা থেকে দূরে, জীবন সংগ্রামের কোন লক্ষণই নেই। দূর তো দূর, নেই তো নেই! আমরা যারা শরদিন্দু প্রেমী, তারা শরদিন্দুর রূপকথার বেজায় ভক্ত। সেই হাসিকান্না গল্পে ছিল না –

“যে মাস্টার চিরদিন দুঃস্থ ও বেকার রহিয়া যায়, তাহার পরিচয় দিবার আগ্রহ আর যাহার থাকে থাক, আমার নাই। আমি রূপকথা বলিতেই ভালবাসি।”

অমল পালেকর ও বাসু চ্যাটার্জির এই রূপকথা আমাদের মন জয় করে রাখবে।

শরদিন্দুর কথাই যখন এল, তখন ব্যোমকেশই বা দূরে থাকে কেন?

নব্বইয়ের দশকে তিনি যেভাবে চিত্রায়িত করেছেন ব্যোমকেশকে তা আজও সাদরে সবাই মনে রেখেছে। কারণ তিনি বুঝেছিলেন, ব্যোমকেশ শুধু গোয়েন্দা নয়, ব্যোমকেশ এক সময়, সংস্কৃতি, মূল্যবোধের প্রতীক। তাই তিনি সেই ব্যোমকেশকে বড় যত্ন করে গড়েছিলেন। শরদিন্দু তাঁর কাহিনিতে যে ছাপগুলি রেখেছিলেন, তাকে তিনি সযত্নে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে রেখেছিলেন তাঁর দূরদর্শনের জন্য রচিত এই সিরিয়ালে। একটু বিস্তারিত আলোচনা করা যেতেই পারে। ব্যোমকেশ সম্পর্কে প্রখ্যাত লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন,

নীরন্ধ্র হলেও ব্যোমকেশ কাহিনির পরতে পরতে বাঙালি জীবনের নানান খুঁটিনাটি উঠে এসেছে। যেসব খুঁটিনাটি এখন পড়তে বসে দেখছি হারিয়ে গেছে। তাই যেন ব্যোমকেশকে বাঙালির আজ আরও নিজের মনে হচ্ছে। মেসবাড়ি, সন্ধে হলে রাস্তায় গ্যাসের আলো, বড়ো ফটকওয়ালা বাড়ির গেটে দারোয়ান, সম্পন্ন বাড়িতে হাউস ফিজিসিয়ান— সেসব গেল কোথায়? ব্যোমকেশের যত কাছে যাই, ফিরে ফিরে পড়ি, আর ওদের দেখা পাই। –

ব্যোমকেশ সিরিয়াল বানাতে গিয়ে এই ছাপগুলির কথা ভীষণভাবে মাথায় রেখেছিলেন বাসু চ্যাটার্জী। একই প্রবন্ধে শ্যামল বলেছেন ব্যোমকেশ ও অজিতের নিরঙ্কুশ বন্ধুত্বের কথা। তারা খবরের কাগজ ভাগ করে পড়ে। নিজেদের মধ্যে চা খেতে খেতে ঠাট্টা ইয়ার্কি করে।

এই ছবি দুটি দেখলে বোঝা যায়, কি আশ্চর্যভাবেই না সেই বন্ধুত্বের মুহূর্তগুলিকে তুলেছেন বাসু চ্যাটার্জি। এরকম দৃশ্য বারেবারে ফিরে এসে আমাদের তাদের দুজনের মধ্যেকার অনন্য রসায়নটি আমাদের বুঝতে সাহায্য করেছে। দুজনের চোখের চাহনির বা বসার ভঙ্গির মধ্যে দিয়েই যেন তাদের চরিত্র প্রতিভাত।

আর ঐ যে ফটকওলা বাড়ীর গেটে দারোয়ান, সে বাড়ীর দাম্ভিক মালিক –

এরপরে যখন সত্যবতীর প্রবেশ হয় তাকেও যেন আমরা ঠিক সেভাবেই পাই যেভাবে শরদিন্দু ভেবেছিলেন। রোগা, কালো মাঝারি দর্শন একটি মেয়ে। অজিত যার সম্পর্কে বলে – “লোকে তাকে কালোই বলবে কিন্তু কুৎসিত বোধহয় বলতে পারবে না।”

এরকম ভাবেই চলেছে তাঁর ব্যোমকেশ নির্মাণ পর্ব।  মনে রাখতে হবে নব্বই দশকে এত উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য তিনি পাননি, দূরদর্শনের বাজেট বরাদ্দও খুব বেশী ছিল বলে মনে হয় না। কিন্তু তাতেও তিনি যে ভাবে এই প্রিয় বাঙালী চরিত্রকে মাদের কাছে নিয়ে এসেছেন তাঁর জন্য আমরা কৃতজ্ঞ থাকবো।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি আমাদের আগের প্রজন্মের ব্যোমকেশ ও সত্যজিৎ প্রেমীরা ‘চিড়িয়াখানা’ দেখে চূড়ান্ত হতাশ হয়েছিলেন। কিন্তু বাসু চ্যাটার্জীর এই প্রচেষ্টাকে তাঁরা সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। এমনকি কেউ কেউ ব্যোমকেশরূপী  রাজিত কাপুরের চেয়ে অজিতের ভূমিকায় কে কে রায়নাকে বেশি পছন্দ করেছিলেন।

পরবর্তী প্রজন্মের ব্যোমকেশ স্রষ্টাদের জন্যও তিনি একটি বেশ সুন্দর উদাহরণ রেখে গেলেন।

কিছুদিন আগে আবার দেখানো হচ্ছিল সিরিজটি। এখন ইউটিউবে এই সিরিজের সব কটি কিস্তিই দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন দূরদর্শন।

যাঁরা ব্যোমকেশ ভালোবাসেন তাঁদের কাছে এই সিরিজটি খুবই প্রিয় হবে বলেই আমার বিশ্বাস।

১- https://www.anandabazar.com/entertainment/obit-of-bollywood-filmmaker-basu-chatterjee-dgtl-1.1158528?ref=related-stry-3

২ – https://www.telegraphindia.com/entertainment/chronicler-of-aam-aadmi-basu-chatterjee-no-more/cid/1778556

অব্যর্থ ব্যোমকেশ – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় চিরায়ত শরদিন্দু – কাফে টেবিল – জানুয়ারি – ২০২০ – পৃঃ ৭০

12 thoughts on “এক কাছের পরিচালক – বাসু চ্যাটার্জী

  1. বাঃ, অনেক কিছু জানতে পারলাম। সত্যিই মনটা বড় খারাপ লাগে, একে একে নিভছে দে উ টি।

    Like

    1. বাহ্ খুব ভালো লাগলো..যে সব ফিল্ম আমরা দেখে বড়ো হয়েছি তার কথা ও বাসু চ্যাটার্জী র মতো ফিল্ম ডিরেক্টর কত বিশাল কাজ করে গেছেন তার একটা সুন্দর জলক লেখাতে পেলুম.
      এরকম আরো লিখে আমাদের পাঠাও

      Like

    2. অনেক ধন্যবাদ, অনিন্দিতা দি! হৃষীকেশ মুখার্জীর সঙ্গে আপনার আর আপনার বাবার সাক্ষাৎকারের ঘটনাও দারুণ।

      Like

  2. Khub bhalo lagllo. Basudake koyekbar meet korechillam eki parai 16 road Santacruz West chilam. Echara Hementada 15 road Geetanjali. Sab asste astte kirakom hoye jachhe. Aapnar lekhate besh lagllo

    Like

  3. একটি গোছানো লেখা। সিনে ক্লাব ধরনের ডিসকোর্স এড়িয়ে কীভাবে বাসু চ্যাটার্জিকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া যায়, তার নিদর্শন। আমরা যখন প্রথম কলেজে ঢুকি তখন থেকে তাঁর বিখ্যাত ট্রিলজির শুরু। আমাদের কলেজ জীবনের সঙ্গে তা শেষ হয়েছিলো। জঞ্জির, দিওয়ার, শোলে যাদের নাগালের বাইরে, তাদের জন্য একজন বিশ্বাসযোগ্য ‘হিরো’ (না অ্যান্টি-হিরো) এনে দিয়েছিলেন তিনি। হালের চাঞ্চল্যটি কেটে গেলে তাঁর এই তিনটি ছবিতে বাসু চ্যাটার্জি গানকে কীভাবে ব্যবহার করেছেন তা নিয়ে ভাববো।

    ভাস্করকে ধন্যবাদ।

    Liked by 1 person

  4. আমি বাসু চ্যাটার্জির ছবির ভক্ত বরাবরই। সত্তর-আশির দশকে হিন্দি ছবির দর্শকদের শুধু নয়, সেই সময় যারা কিশোর বা সদ্য-যুবক, বলতে কি সেই জেনারেশনের মনোবৃত্তি, বিচারধারা, আদর্শ বেশ কিছুটা গড়ে উঠেছে দুই বাসু, সই পরাঞ্জপে, মহেশ ভট্ট বা শ্যাম বেনেগালের হাল্কা রসের সঙ্গে উচ্চ বিচারধারার সুষম মিশ্রণ দয়ে গড়ে তোলা ছবিগুলো দেখে। খুব মনোমত হয়েছে লেখাটা। যা যা আশা করেছিলাম, তা নিয়ে ভাবনার রসদ পেয়েছি।

    Like

Leave a comment