রাজকুমার ও রাজপুর

                                         

পৃথিবী জুড়ে কোভিডাতঙ্ক চলছেই। অফিস, পাড়া-পড়শী, বন্ধুবান্ধব, – সম্পর্কে বিভিন্ন খবর আসছিলো, এবারে একেবারে ঘরের লোক। আমাদের সেজমামা কোভিডে আমাদের ছেড়ে গেলেন।

ভাইবোনেদের মধ্যে সর্বপ্রথম বিদায় নেন, আমার মা। তারপর বড়োমামা, এবারে সেজমামা। কিন্তু এই বিদায়টি বড়ো মর্মান্তিক। যে মামাবাড়িতে খুব ছোটোখাটো অনুষ্ঠানে শতাধিক লোকের আগমন হতে পারতো, আজ সেজমামার বিদায়ের পাত্রখানি ভরে রাখার বেলায় নামমাত্র কিছু লোকেরই সমাগম হতে পারবে। কারণ তো সবাইয়ের জানা।

সেজমামার অদ্ভুত দুর্বলতা ছিল রাজপুরের ওপরে। মোটামুটি প্রতি সপ্তাহেই আগমন হত। ‘সেজদাভাই’ আমার মায়ের যাকে বলে বিরাট সহায়। যে কোন ব্যাপারে কাজ করতে হলেই ডাক পড়তো। সেজমামার চাকরি ছিল হিন্দুস্থান টুলস কোম্পানিতে। আজ অবশ্য সে কোম্পানি আর নেই, তবে স্টপেজটি রয়ে গেছে। কামালগাজি আর নরেন্দ্রপুরের মধ্যে। ফোন করে খবর দিলেই হতো।

সেই ফোন থেকেই এই স্মৃতিকথার শীর্ষক। তখন আমাদের বাড়ীতে ফোন ছিল না, বেশ দূরে ক’টি মাত্র বাড়িতে গিয়ে ফোন করে আসতে হত। আমি যেতাম, কাকার কিছু কাজ থাকলে কোন সময় কাকাও যেত। সকলেই জানে যে আমার কাকা শ্রী বিমল কুমার বসু আমার সাহিত্যগুরু এবং পথপ্রদর্শক। কাকার রসবোধ ছিল অতুলনীয়। একবার এরকম শীতকালে আমরা একটি বাড়িতে ফোন করতে গেছি। কাকা ফোন করে সেজমামা কে ডাকছে – ‘বলুন রাজকুমার ঘোষকে ডেকে দিতে। রাজপুর থেকে ফোন আছে।’

তা ডাকতে গেছে – এদিকে রিসিভারে হাত রেখে কাকা আমাকে চুপিচুপি বলছে,’ঠিক জমল না রে! রাজপুরী থেকে ফোন, রাজকুমার কে ডাকুন – এরকম হলে কি চমৎকার হত?’ বোঝ!

ঐ যে বলছিলাম, মায়ের সহায়। কিন্তু সেজমামার হাতে পড়ে আমার মা’র মতন তেজস্বিনী মানুষকেও নিগ্রহ সহ্য করতে হয়েছে। সে ভারী মজার ব্যাপার।

সেসময় শীতকালে পরীক্ষা হয়ে গেলে আমরা বেশ কিছুদিন এসে মামাবাড়িতে থাকতাম। এই ঘটনা প্রায় ষাটের দশকের শেষের দিকে। রাজপুর থেকে আসার সময় আমরা নলেন গুড়, মোয়া, সন্দেশ ইত্যাদি নিয়ে যেতাম। ল্যান্সডাউনের শহরবাসীরা এই সমস্ত ‘দোখনো’ মিষ্টি খুব পছন্দ করতেন। তখন দাদুও বেঁচে। সম্ভবত দাদু ক’দিন পরে আসবেন।

আমাদের বাড়ি থেকে মামাবাড়ি যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় ছিল ৮০বি বাস। একেবারে দেশপ্রিয় পার্কে নামা যেত। মা’র খুব পছন্দ, কিন্তু আমার কাছে ছিল বিভীষিকা। কারণ বমির ভয়। তাই মাঝে মাঝেই ট্রেনে আসা হত। সেবারেও ট্রেনে আসা হবে। বাড়ি থেকে রিক্সা করে সোনারপুর স্টেশন, রিক্সা থেকে নেমে সেজমামা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটছে, মোয়ার হাঁড়ি নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে। মা’র সবেতেই তাড়াহুড়ো, দিদিভাইয়ের হাত ধরে টানতে টানতে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ঢুকে গেছে। সেজমামার টিকিট কাটা হয়ে গেছে, একহাতে মোয়ার হাঁড়ি, অন্যহাতে আমার হাত শক্ত করে ধরা। ইতিমধ্যে ট্রেন এসে গেছে, মা চীৎকার করছে, ‘সেজদাভাই, চলে এস।’ সেজমামা হাত নেড়ে বলছে , ‘পরে, পরে’! কিন্তু থোড়াই শুনবে মা সেকথা। মা হড়বড় করে দিদিভাইকে নিয়ে উঠে গেল, সেজমামা বলছে, ‘শিবু, নেমে পড়!’ আর ট্রেন ছেড়ে দিল। সেজমামা হতাশ হয়ে প্ল্যাটফর্মের খালি বেঞ্চিতে বসে আমাকে বলল, ‘শিবু ভালো না, বাজে, বাজে’! সেজমামার কথায় সমস্যা ছিল। কিন্তু তাকে পূর্ণতা দান করে দিত শারীরিক অভিব্যাক্তি,- মুখ, চোখ লাল হয়ে গেছে, সারা শরীর জুড়ে, আপাদমস্তক, অসম্ভব বিরক্তি।

যথারীতি পরের ট্রেনে আমরা এসে বালিগঞ্জ স্টেশনে এসে নামলাম। নেমে দেখি মুখ শুকনো করে মা আর দিদিভাই একটা বেঞ্চে বসে আছে। আমি এগিয়ে যেতেই সেজমামা আমার হাত জোর করে ধরে এক হ্যাঁচকা টান, ভাবখানা এমন যে এরা আমাদের ফেলে চলে গেছে, মনে নেই?

এদিকে বালিগঞ্জ স্টেশনে ট্যাক্সিতে ওঠার পর থেকেই মা কিন্তু ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছে তার অভিমানী দাদাকে বোঝানোর। ‘ট্রেনে উঠে নামা অসম্ভব ছিল!’ কিন্তু ভবী ভোলবার নয়। মামাবাড়ীতে ঢুকেই কোনক্রমে মোয়ার হাঁড়ি রেখে গটগট করে সোজা দিদুকে বিরাট অভিযোগ, “মা, শিবু খুব বাজে! আমাকে আর কোনদিন আনতে বলবে না।” বলে কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা দোতলায়। দিদু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে, আমি কোনক্রমে হাসি চেপে তখন বুঝিয়ে বললাম। দিদু ঘাড় নেড়ে বললো,’হ্যাঁ, আমার বড়মেয়ে বড্ড হড়বড়ে!

সেজমামার সাবধানতা অবলম্বন সাংঘাতিক ছিল। একদিন বাবা অফিস থেকে ফিরেই মা’র ওপর চোটপাট! ‘এই সেজদাভাই এর জন্যে পকেটমার হল!’ বাবার একটু পরে মাথা ঠাণ্ডা হলে জানা গেল যে বাবার কিছু পাওনা টাকা সম্ভবত দিদু দিয়েছিল। সেই টাকা নিয়ে বাবা মামারবাড়ির উল্টোদিকের ফুটপাতে বাসের জন্য দাঁড়িয়েছিল। সেজমামা নাকি বারংবার, বাবার নিষেধ সত্ত্বেও সবাইকে শুনিয়ে বাবাকে টাকার ব্যাপারে সাবধান করে যাচ্ছিল, এমনকি কোথায় না রেখে, অন্য কোথায় রাখা উচিত তাও দেখাচ্ছিল। বাবার ধারণা, সব পকেটমারেরা দাঁড়িয়ে দেখে নিয়েছে আর তারপর পকেট মেরেছে। যদিও সাধারণতঃ যার পকেটমার হয় দোষ তারই হয়, এক্ষেত্রে বাবার ধারণা একটু অন্যরকম ছিল।

মামাবাড়ির গেট বন্ধ করার দায়িত্ব থাকতো সেজমামার ওপর, কারণ ঐ সাবধানতা। গেট বন্ধ করে তিনবার চেক করে তালা নাড়িয়ে দেখে তবে শান্তি। কিন্তু একবার একটু মুশকিল হয়েছিল। ঠিকমতো গেট এ তালা লাগানো হয়নি। তার কারণও ছিল।

সেই সত্তরের দশকে মামারবাড়িতে কুলফি নিয়ে আসতো একজন, তার নাম ভবেশ। দুরকমের কুলফি, সাদাটা একদম সহজ সরল। আর একটা সবুজ রঙের। সেটাতে সিদ্ধি থাকতো। সিদ্ধির মাত্রাজ্ঞান না থাকলে বেশ সমস্যা হয়। সেবারেও তাই হয়েছিল, আগের দিন রাত্রে যে সিদ্ধি খাওয়া হয়েছিল তাতে পরিমাণ একটু বেশী ছিল। পরের দিন সেজমামা বললো যে কুলফি খেয়ে মাথাটা একটু কিরকম করছিল, তালা হাতে নিয়ে চাবি লাগাতে গেলে তালা সরে যাচ্ছিল! ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মাথা নাড়িয়ে তালার থেকে চাবির পালিয়ে যাওয়ার সে বর্ণনা বেশ মনোগ্রাহী। 

ভাবতে অবাক লাগে সেজমামার বিয়ের সময় মা ছিল না। দাদুর কাছে গিয়েছিল। বিয়ে হয়ে গেছে, যেদিন বৌভাত আমরা ছোটরা সব সামনের উঠোনটাতে খেলছি। ছোড়দাদু, বাবা, মেশোমশাই, ফুলমামা – এরা সবাই সেখানে বসে তাস খেলছে। ওমা! হঠাৎ দেখি টুকটুক করে মা, ছোটমামা ও দাদু ঢুকছে। কি হৈ চৈ! হঠাৎ ঠিক করে তারা চলে এসেছে। প্রায় সারা বাড়ি জুড়ে আনন্দের উৎসব শুরু হয়ে গেল।

সেজমামা সস্ত্রীক আমার ব্যাঙ্গালোরের বাড়িতেও ঘুরে গেছে। মা’কে নিয়ে এসেছিল আমার ছেলের অন্নপ্রাশনে। মা বললো, সেজমামা নাকি মা’র কাছে আবার দুঃখপ্রকাশ করেছে, এত দূরে কেন মা ছেলেকে পাঠিয়েছে। দুদিন, দুটো ট্রেন, দু-হাজার কিলোমিটার – কি দরকার ছিল?

আজ অবশ্য সেজমামা অনেক দূরেই চলে গেছে, তার প্রিয় বোনের আর দাদার কাছেই। শেষযাত্রা আমাদের কাছে বড়ই বেদনাবহ হয়ে রইল। এখন এত ভারাক্রান্ত অবস্থা, কারুর মন ভালো নেই, আর দুঃখের কথা শুনতে বা শোনাতে ভালো লাগেনা। তারচেয়ে বরং এই মজার আর আনন্দের স্মৃতিগুলোই সম্বল থাকুক।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s