আজ হরিণাভি স্কুলের জন্মদিন। কালই আবার সুজনদাও বলছিলেন স্কুলের বাংলা শিক্ষকদের কথা। ভাল বাংলা শিক্ষক না হলে ভালো শেখা হয়না।
একথা আমি খুব মানি। আমার জীবনের বাংলা শিক্ষার শুরু হরিনাভি স্কুলের শিক্ষকদের মাধ্যমেই। এঁদের মধ্যে একজন হলেন দেববাবু, দেবপ্রসাদ চক্রবর্তী।
দেববাবু ছিলেন একেবারে ইনফর্ম্যাল। সব সময় ধুতি পাঞ্জাবী পরতেন। চেয়ারে না বসে উনি টেবিলে বসতেন। আমাদের কল্লোল যুগের সঙ্গে পরিচয় ঘটে দেববাবুর মাধ্যমেই। যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘হাট’ কবিতাটি ছিল আমাদের পাঠ্য। সেই প্রসঙ্গেই ‘চেরাপুঞ্জির থেকে, একখানি মেঘ ধার দিতে পার গোবি-সাহারার বুকে?’ কবিতার কথা জানিয়েছিলেন, জানিয়েছিলেন ‘কল্লোল’ ও ‘কালি ও কলম’ নামক পত্রিকার কথা।
সেই পড়ানোর কথা এখনো মাঝে মাঝে মনে পড়ে। আবার চমকে উঠি কিছু সাম্প্রতিক ঘটনার সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়েও।
কিছুদিন আগে সন্দীপ রায়ের কোন স্মৃতিকথা পড়ছিলাম। ‘আগন্তুক’ সিনেমার একটি প্রসঙ্গ। আমরা সকলেই জানি সত্যজিৎ পত্নী শ্রীমতী বিজয়া রায় ছিলেন ডিটেকটিভ গল্পের পোকা। ‘আগন্তুক’ ছবিতে মামা মনোমোহন মিত্রকে নিয়ে যখন বাড়িতে বেশ একটা রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে, এই সময় দেখা যাবে গৃহকর্ত্রী (ভূমিকায় মমতাশঙ্কর) বিছানাতে শুয়ে একটি বই পড়ছেন। কী বই পড়তে পারেন? এই প্রশ্নের উত্তরে বিজয়া রায় জানিয়েছিলেন বইটি হতে পারে আগাথা ক্রিস্টি রচিত বিখ্যাত উপন্যাস – ‘Peril at End House.’

এই বইটি ই কেন? কারণ তখনকার বাড়ির পরিবেশের সঙ্গে বইটির নাম ও কাহিনির মিল আছে। আগাথা ক্রিস্টির কাহিনিতে যেমন বাড়িতে বিপদের আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল, এখানেও তাই। সেই বিপদ কিন্তু আসল বিপদ নয়, অনেকটা ‘সাজানো বিপদ’, আগন্তুকের কাহিনির মত। আরও একটা সম্পর্ক হল কাহিনিতে যে সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ব্যাপারটা ছিল, ‘আগন্তুক’ ছবির শেষে এসে আমরা জানতে পারি এখানেও তেমন ব্যাপার থাকবে। অর্থাৎ একটা ছোট্ট ঘটনার মাধ্যমে সিনেমার সঙ্গে চরিত্রের পরিণতির কথা বলা হচ্ছে। এমনকি অনেক সময়ই দেখা যায় পরিবেশ অনুযায়ী রবীন্দ্রসঙ্গীত সংযুক্ত করে সেই আবহ ফুটিয়ে তোলা হয়।
এই সাক্ষাৎকার শুনেই আমার মন ছুটে গিয়েছিল প্রায় পাঁচ দশকের আগে দেববাবুর কাছে পড়া সেই এস ওয়াজেদ আলি প্রণীত ‘ভারতবর্ষ’ নামক বিখ্যাত গল্পটির কথা। ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে’ – এই মোক্ষম উক্তির উৎস যে গল্পটি।
কিন্তু দেববাবু আমাকে একটা প্রশ্ন করেছিলেন,
“ভাস্কর, বল দেখি, এখানে রামায়ণের ‘সেতুবন্ধের’ কথা কেন বলা হচ্ছে? রামায়ণ তো অনেক বড়, দু’বারই এক জায়গার কথা কেন বলা হচ্ছে?”
যাঁরা ভুলে গেছেন গল্পটি তাঁদের জন্য গল্পের ঐ অংশটি আবার তুলে দিচ্ছি –

এরপর পঁচিশ বছর পর আবার যখন লেখক কলকাতায় ফিরে এসে সেই মুদিখানার সামনে গেলেন, আশ্চর্য হয়ে দেখলেন সেই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। এমনকি পাঠের অংশটিও এক –

লেখক জানতে পারলেন যে এ বৃদ্ধ সেই প্রাক্তন বৃদ্ধের স্বর্গীয় পিতা মহাশয়। তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। সেইখানেই সেই বিখ্যাত উক্তি – ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে, কোথাও তার পরিবর্তন ঘটেনি।’
দেববাবুর ঐ প্রশ্নের আমি উত্তর দিতে পারিনি। উনি নিজেই বলেছিলেন – ‘নাতিদের সঙ্গে রামায়ণপাঠ দুটি যুগের মধ্যে একটি অদ্ভুত সেতুবন্ধন করছে। ট্র্যাডিশন বা ঐতিহ্য সেটাই। সম্ভবতঃ সেজন্যই লেখকের কাছে রামায়ণের এই অংশের গুরুত্ব অন্যান্য অংশের চেয়ে বেশি। সেতুবন্ধন হল কিনা, জানার কৌতূহল এত তীব্র পঁচিশ বছর পরেও।”
অর্থাৎ দেববাবু তখনই আমাকে বোঝাতে চেয়েছিলেন শিল্পের একটি খুব দামি প্রথা প্রকরণের কথা। যেটা আমি অনেক পরে বড় হয়ে বুঝেছি। তা হল, সাহিত্যে বা সিনেমাতে মূল ঘটনার সঙ্গে পরিপ্রেক্ষিত রচনার জন্য আবহের গুরুত্ব থাকে। যেমন রামায়ণের ‘সেতুবন্ধন’ দুই প্রজন্মের সেতুবন্ধনের সঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ, ঠিক তেমনই নায়িকার ঐ ডিটেকটিভ বইয়ের পাঠ কাহিনির পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। যেমন সিনেমার বিভিন্ন জায়গায় সুসমঞ্জস গানের বা আবহ সঙ্গীতের ব্যবহারে তা আরো মাধুর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। যে দর্শক বা পাঠকরা গভীরে গিয়ে অনুসন্ধান করতে চান, তাদের উদ্দেশে শিল্পীর এই নিবেদন।
সত্যি কথা বলছি সেইসময় এই উত্তরের তাৎপর্য আমি বুঝিনি। সম্ভবতঃ তখন আমার বোঝার মত মানসিকতাও তৈরি হয়নি। কিন্তু স্মৃতিতে রয়েছে সেই হীরকখণ্ডের মত দামি অভিজ্ঞতাটি। তাই সন্দীপ রায়ের ঐ স্মৃতিচারণ আমার মনে সেই স্কুলের শিক্ষকের কাছে অধীত বিদ্যার কথা মনে করিয়ে দিতে পারে।
শুধু রামায়ণের ট্র্যাডিশন নয়, আমাদের দেশেও আশা করি সেই শিক্ষার ট্র্যাডিশনও সমানে চলে থাকবে। এখন মাঝে মাঝেই শুনি যে সেই ঐতিহ্য আর নেই। এখন শিক্ষা রূপান্তরিত হয়েছে ব্যবসায়। স্কুলের চেয়ে ছাত্ররা বেশি শেখে প্রাইভেট টিউটরের কাছেই। কিন্তু মন মানে না। আমরা হয়তো প্রাচীনপন্থী।
তাই মনে করি স্কুলের শিক্ষা স্কুলেই ভাল হয়। ঠিকই বলেছেন সুজনদাও! ভালো শিক্ষক না হলে ‘বাংলা’ কেন কোন শিক্ষাই চিত্তাকর্ষক হয় না। মনে কোন তরঙ্গই রাখে না। আর কিছুদিন পরেই এসে যাবে শিক্ষক দিবস। আমার আবার প্রতিদিনই শিক্ষক দিবস।
প্রত্যেক দিনেই তাঁদের স্মরণ করি।
Bhalo laglo lekha.
LikeLike
Excellent write up. Enjoyed.
LikeLike
মনে পড়ে গেল আমার স্কুলের তিন বাংলার শিক্ষক – রথীন মজুমদার (কবি), সুখেশ আচার্য চৌধুরি ও ডঃ সুনীল দাশ (লেখক, নাট্যকার ও নাট্যপরিচালক) – এঁদের কথা। সুখেশবাবু আমাদের (রবীন্দ্রনাথের) “লিপিকা”-র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে lyrical prose-এর উদাহরণ দিতেন বা “জীবনস্মৃতি”-র ভূমিকা উল্লেখ করে “ঘর ও বাহির” পড়াতেন। সুনীলবাবু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়ানোর কারণে আমার কাছে ঐটা হয়ে উঠেছিল এক প্রবল আকর্ষণীয় বিষয়।
LikeLike
ভালো অনুভূতি সমৃদ্ধ লেখা। ভালো লাগল পড়তে।
LikeLike
Very relevant write up. Enjoyed.
LikeLike
লেখাটি একাধারে স্মৃতিমেদুর ও poignant. পছন্দ হয়েছে ‘ভারতবর্ষ’ গল্পটির প্রসঙ্গ টেনে ঐতিহ্য-প্রবাহের প্রাকৃতিক নিয়মের আলোচনা। পড়তে ভালো লেগেছে যে মাষ্টারমশাই ওই দিকের জানালাটা খুলে দিয়েছিলেন তাঁর খুঁটিনাটি কথা।
স্কুলের শিক্ষকদের অবদান সারা জীবন মনে থাকে। আশ্চর্যরকম স্বচ্ছভাবে মনে থাকে তাঁদের নাম ও পরিধানও। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারি এই ঋণ কোনওদিনও শোধ করা যাবে না । অনেক দেরিতে উপলব্ধি হয় গুরুর স্থান কেন মা-বাবা’রও ওপরে। ততদিনে হয়ত মাষ্টারমশায়রা অনেকে ওপারে চলে গিয়েছেন। সতীর্থদের অনেককে জিজ্ঞেস করেছি কেউ কখনও ফিরে গেছেন কি না তাঁদের স্কুলের মাষ্টারমশাইদের কাছে — গিয়ে সামনাসামনি বলেছেন কি না যে তাঁদের জীবন অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে এঁদের জন্য, সামনে দাঁড়িয়ে এঁদের অপরিশোধনীয় ঋণ স্বীকার করেছেন কি না। দেখলাম কেউই ফিরে জাননি বা যেতে পারেননি এই জরুরি কাজটা করার জন্য। আমিও পারিনি।
এটাই স্কুল শিক্ষকদের জীবনের irony. নিঃস্বার্থভাবে এত কিছু দেয়ার পরও তাঁরা রয়ে যান unsung, uncelebrated heroes.
ভাস্কর সিংহ | ভোপাল | মধ্য প্রদেশ
29-AUG-2021
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ!
LikeLike
স্কুলজীবনের প্রিয় শিক্ষক মহাশয়দেঁর স্মৃতিচারণা ও প্রাসঙ্গীক ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পনের এক সুন্দর প্রবন্ধ।
LikeLike