বেতারের পরী

আমরা যারা ষাটের দশকে মফস্বলের মধ্যবিত্ত বাড়িতে বড় হয়েছি, তাদের নিয়মিত মনোরঞ্জনের সামগ্রী বলতে ছিল মাত্র দুটি – মাসিক কিশোর পত্রিকা ও রেডিও।
শীতকালে পরীক্ষার পর বা গরমের ছুটিছাটায় আমরা অবশ্যই নাটক, সার্কাস, সিনেমা ইত্যাদি দেখতে পেতাম। কলকাতা শহর জুড়ে বিভিন্ন মেলায় ও আমাদের পা পড়ত। সে অবশ্য মরশুমি মেলা আমাদের ওখানেও ছিল। কিন্তু নিয়ম করে যারা আমাদের মনোরঞ্জন করত তারা ঐ – শুকতারা, কিশোর ভারতী, সন্দেশ, কিছু পরে আনন্দমেলা আর অবশ্যই রেডিও।
রেডিওতে আমরা নাটক শুনতে অনুমতি পেতাম। রবীন্দ্রজয়ন্তীর সময় আরও বেশি করে রেডিওতে গান, আবৃত্তি, গল্পপাঠও শুনতাম। এছাড়া ছিল বিভিন্ন খেলার ধারাবিবরণী। আসলে ঘরে বসে ঐ ছোট্ট মার্ফি রেডিওর মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসা আওয়াজ শুনেই আমাদের সারা পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় ঘটত। আরও পরিচয় ঘটত বিভিন্ন তারকার সঙ্গে – কাজি সব্যসাচী, শম্ভু মিত্র, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিকাশ রায়, কেয়া চক্রবর্তী, পার্থ ঘোষ, গৌরী ঘোষ, জগন্নাথ বসু, ঊর্মিমালা বসু, তৃপ্তি মিত্র এবং হ্যাঁ – এবং শাঁওলি মিত্র।
সেই ১৯৭০ সালে (সম্ভবতঃ) ডাক ঘর নাটকে শাঁওলি মিত্রের গলা শুনেছিলাম। তারপর ১৯৮৩ সালে পাকাপাকি ভাবে কলকাতা ছাড়ার আগে পর্যন্ত ঐ পুরো সময়টাই শাঁওলির গলা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখত। সেই মুগ্ধতার বিবরণ দেওয়া খুব শক্ত। তাও ক’টি উদাহরণের মাধ্যমে সেকথা বোঝানোর চেষ্টা করব।

ডাকঘরের অমল

‘ডাকঘর’ নাটকটি আমার প্রথম শোনা নাটক। তখন আমার বয়স ৬ কি ৭। কিন্তু তাও শাঁওলির গলার সেই সুমধুর কন্ঠের সেই অমলের গলা বেশ মনে পড়ে। তখনও নাটকটি আমি পড়িনি। আর পরের বছর আমাদের পাঠ্যে একটু অংশ অন্তর্ভুক্ত ছিল – “অমল ও দইওয়ালা।” সেটি পড়ার আগেই অবশ্য শাঁওলির গলায় সেই – “না, না, আমি কক্‌খনো পণ্ডিত হব না। আমি তোমাদের রাঙা রাস্তার ধারে তোমাদের বুড়ো বটের তলায় গোয়ালপাড়া থেকে দই নিয়ে এসে দূরে দূরে গ্রামে গ্রামে বেচে বেচে বেড়াব। কী রকম করে তুমি বল, দই, দই, দই — ভালো দই। আমাকে সুরটা শিখিয়ে দাও।” উফফ! নাটকের ঐ জায়গাটা কেমন মন কাড়া! আর শাঁওলির গলাতেও অদ্ভুত এক কান্না মেশানো থাকত। তখন জানতামও না এটি কোন বালকের নয়, এক মহিলার গলা। একটু পরেই অবশ্য বড়দের কাছে জেনেছিলাম তাঁর নাম শাঁওলি। তাঁর পিতামাতা খুব বড় অভিনেতা অভিনেত্রী, যাঁদের নাম শম্ভু ও তৃপ্তি মিত্র।

P3 সিরিজ

এর পরে পরেই আমার নিয়মিত শাঁওলির গলা শোনার সুযোগ হল P3 সিরিজ থ্রিলার কাহিনিগুলিতে। সেই সময় খুব জনপ্রিয় ছিল জেমস হেডলি চেজের থ্রিলারগুলি। বঙ্গানুবাদেও তাদের নামগুলি ছিল রীতিমত রোমহর্ষক – ‘শকুনের চোখে পলক পড়ে না’, ‘হাতের মুঠোয় পৃথিবী’ বা ‘বিষাক্ত অর্কিড।’ ইতিমধ্যে শাঁওলির সঙ্গে জুটি বাঁধার জন্য এসে গেছেন গৌতম চক্রবর্তী। ঐ সিরিজের সবগুলিতেই তাঁরাই ছিলেন নায়ক নায়িকা। সিরিজের সব থেকে মনে রাখা গল্প – বিষাক্ত অর্কিড। ইংরেজি মূল কাহিনি ছিল – একটি অর্ধোন্মাদ, ধনী মেয়েকে নিয়ে। এই উপন্যাস সম্পর্কে লেখক শেখর বসুর কাছ থেকে জানতে পারছি-

বিশ শতকের গুটিকয়েক বিখ্যাত থ্রিলারের একটি হল জেমস হেডলি চেজের ‘নো অর্কিডস ফর মিস ব্লান্ডিশ।’ জর্জ অরওয়েল, গ্রাহাম গ্রিনের মতো বড় মাপের লেখকরা কিন্তু এই বইটিকে নিছক ক্রাইম স্টোরি হিসেবে দেখেননি। তাঁদের বিচারে এটি উঁচু মানের উপন্যাস। এক ধনকুবেরের মেয়ে ব্লান্ডিশকে  অপহরণ করে একটি দল। কিন্তু চোরের ওপর বাটপাড়ি করে আর একটি দল। এই দলের মাথা স্লিম গ্রিসন, তার হোস্টেজ হয়ে যায় এই মিলিয়ন ডলার গ্লামারাস মেয়েটি। মুক্তিপণ আদায় করে অপহরণকারী, কিন্তু মেয়েটি আর ফিরতে রাজি নয়। দুর্বৃত্ত স্লিমের প্রেমে পড়ে গিয়েছিল সে। স্লিম স্যাডিস্ট, সাইকোপ্যাথ;  শুধু সেক্স আর ভায়োলেন্স নয়, মনস্তাত্ত্বিক নানা টানাপোড়েন আছে কাহিনিতে। শেষে আত্মহত্যা করেছিল ব্লান্ডিশ। বিচিত্র সব বাঁক, বিশ্লেষণ আর মনোজগতের রহস্যময়তায় উঁচু মাপের উপন্যাস হিসেবে এটি চিহ্নিত হয়েছিল। উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার বিশ বছর বাদে সেটি আবার আগাগোড়া নতুন ভাবে  লিখেছিলেন লেখক। লা মঁদের বিচারে এই বইটি শতাব্দীর সেরা একশোটির একটি।”

‘স্লিম’ এর ভূমিকায় গৌতম চক্রবর্তী আর ব্লান্ডিশ হলেন শাঁওলি। বোঝাই যাচ্ছে কেমন জটিল ব্লান্ডিশ চরিত্রটি। শাঁওলি তাঁর অনবদ্য অভিনয়ে জীবন্ত করে তুলেছিলেন চরিত্রটিকে। মেয়েটি যখন স্বাভাবিক – সে যেন আমাদের পরিচিত শাঁওলি – ডাকঘরের অমল, সেই রিনরিনে গলা। আর যখন সে পাগল, আঁচড়ে কামড়ে খুন করতে চায় – যেন সেই শাঁওলিকে আমরা কোনদিন চিনতেই পারিনি। উফফ! রাত ন’টার সময় সম্ভবত হত নাটকটি – ধারাবাহিক ভাবে। এখনো সেই উত্তেজনা অনুভব করতে পারি। আর একটি অনুরূপ নাটক – ‘হাতের মুঠোয় পৃথিবী’তেও শাঁওলির অভিনয়ের কথা মনে পড়ে। একটা কথা উল্লেখযোগ্য – এই চরিত্রগুলিতে আমরা যে শাঁওলিকে পেয়েছি তা কিন্তু আমাদের একেবারেই পরিচিত বাঙালি বা ভারতীয় চরিত্র নয়। আর সেখানেই তাঁর অভিনয়ের বিস্তার।

বোরোলিনের সংসার

‘বোরোলিনের সংসার’ প্রচারিত হত প্রতি রবিবার ১২.৩০ মিনিটে। সাধারণতঃ বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ধ্রুপদী সাহিত্যের গল্প নিয়ে নাটক হত। ভারি চমৎকার নাট্যরূপ দিতেন মিহির সেন। অধিকাংশ দিনই থাকতেন শাঁওলি, বিপরীতে গৌতম চক্রবর্তী। একটি গল্পের কথা মনে পড়ে খুব – গল্পটির নাম ‘ক্রীতদাসীর বন্দিমুক্তি’ – লেখক রতন ভট্টাচার্য। আশ্চর্যের ব্যাপার হল গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮০-৮১ সালের কোন এক শারদীয় পত্রিকায় আর তার কিছুদিনের মধ্যেই চলে এল রেডিওতে নাটক হয়ে। এতেই বোঝা যাবে কেমন ভাল সম্পর্ক ছিল এই দুই মাধ্যমের মধ্যে।
এই গল্পটি ছিল একটি নারীর। এই নারী অবাক হয় যখন তার স্বামী তার আচরণে সন্দেহ প্রকাশ করে। সে বোঝানোর চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। পরে যখন স্বামী ভুল বুঝতে পারে তখন সেই নারী ক্ষুব্ধ হয় এবং স্বামীকে ছেড়ে চলে যায়। শাঁওলির অভিনয়ে এমন এক শান্ত, সহজ অথচ সপ্রতিভ বিদ্রোহের প্রকাশ ছিল যা চরিত্রটিকে সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছিল। যেহেতু গল্পটি আমার আগে পড়া ছিল, খুব ভাল লেগেছিল আর তাই খুবই কৌতূহল ছিল। শাঁওলি পূর্ণমাত্রায় আমার প্রত্যাশা পূরণ করেছিলেন।

রেডিও নাটক

অনেক নাটকের মধ্য থেকে দুটি নাটকের কথা বেশি করে মনে পড়ছে।

কোনি

‘কোনি’ নাটকটির পরিচালক ছিলেন প্রিয় অভিনেতা জগন্নাথ বসু। এই অভিনয়ের একটি সুন্দর বিবরণও দিয়েছিলেন তিনি ‘দেশ’ পত্রিকায়। তাতে একটি ছবি ছিল – শাঁওলি এক গামলার জলে গলা ডুবিয়ে কথা বলছেন। এতে ঐ জলের মধ্য থেকে কথা বলার এফেক্ট এসেছিল। ক্ষিদ্দার ভূমিকায় ছিলেন আমার অতি প্রিয় অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। দু’জনে মিলে নাটকটিকে এক অলৌকিক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রতিটি দৃশ্যই তো বুকের মধ্যে মোচড় দেয়। তবে শেষটি মারাত্মক – শাঁওলি (কোনি)র সেই অবুঝ চিৎকার, অনুযোগ – ‘ কোথায় ছিলে ক্ষিদ্দা – আমি কিচ্ছু বুঝতে পারিনি ক্ষিদ্দা – ভীষণ ব্যথা’ – আর সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই অসাধারণ – ‘ঐ জলের তলায় – ঐ ব্যথাটাই তো আমি রে!’ সত্যি বলছি, আজ প্রায় অর্ধশতাব্দী পরেও যেন সে নাটক আমার কানে বাজে।

মেঘ বৃষ্টি আলো
ঐ যে বলছিলাম, সাম্প্রতিক সাহিত্যের রেডিওতে চলে আসার কথা! তার আর এক উদাহরণ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মেঘ, বৃষ্টি, আলো।’ সম্ভবত ৮০ বা ৮১ সালের কোন শারদীয় পত্রিকায় প্রকাশ আর তার বছর খানেকের মধ্যেই রেডিওতে অবতরণ। এখানে নায়কের ভূমিকাতে প্রিয় অভিনেতা জগন্নাথ বসু (শান্তনু) আর নায়িকা অনুরাধার চরিত্রে শাঁওলি। নায়িকা অনুরাধা একটু অন্যরকম, তার জীবনে সেরকম ভাবে প্রেম আসেনি। তার প্রাণের বান্ধবী জয়শ্রী আর শান্তনুর প্রেম তার কাছে পৃথিবীর পবিত্রতম বিষয়। বিয়ের সব কিছু ঠিক – এক দুর্ঘটনাতে সব কিছু বদলে যায় – তিনটি জীবন অদ্ভুত ভাবে পরিবর্তিত হয়। অনুরাধা ও শান্তনু আবিষ্কার করে, জয়শ্রী নয় তারা দুজনেই আসলে দুজনকে গভীরভাবে ভালোবেসেছে, নিজেদের অজান্তেই। দারুণ করেছিলেন জগন্নাথ বসু ও শাঁওলি মিত্র। নাটকের একদম শেষে যখন শান্তনু অনুরাধাকে জানাচ্ছে তার ভালোবাসার কথা আর অনুরাধা বিভ্রান্ত – অপূর্ব অভিনয় ছিল শাঁওলির। একদম যেন বুকের ভেতরে দাগ টেনে দিত। যেমন কন্ঠস্বর, স্বরক্ষেপণ – তেমনই আবার চরিত্রের গভীরে অবগাহন।

পরে অবশ্যই শাঁওলিকে দেখেছি। সিনেমাতে যুক্তি তক্কো গপ্পে। ব্যাঙ্গালোরে আরও সামনাসামনি ‘নাথবতী অনাথবৎ’ নাটকে। সেগুলি সকলেই দেখেছেন। সেই নাটকের একটা অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিই।
নাটক চলাকালীন কোন এক জায়গায় সম্ভবতঃ একটু গণ্ডগোল হয়, দর্শকদের কথাবার্তা শোনা যায়। শাঁওলি নাটক থামিয়ে খুব বিনীত ভাবে বললেন যে এখানকার প্রেক্ষাগৃহের শব্দব্যবস্থা এতই উঁচুমানের যে শুধু তাঁর কথা যে দর্শকরা শুনতে পাচ্ছেন তা নয়, দর্শকদের কথাও তাঁর কাছে এসে পৌঁছচ্ছে। দর্শকরা একটু শান্ত হলেই তিনি আবার শুরু করবেন। করলেনও। ঠিক যেখানে শেষ করেছিলেন, সেখান থেকেই। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি!

তবু বলব, আমার কাছে, আমার সেই মফস্বলী জীবনে বেড়ে ওঠা রেডিও পূর্ণ জীবনে শাঁওলি কিন্তু থেকে গেলেন সেই ’বেতারের পরী’ হয়েই। বিভিন্ন চরিত্রে তাঁর অভিনয় আমাকে এখনও ভরিয়ে রাখবে। জানিনা এই অভিনয় গুলি আজ আর পাওয়া যাবে কিনা, না হলে আমাদেরই ক্ষতি।


আজও ‘কোনি’ পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল সেই সেই অবরুদ্ধ কন্ঠের চিৎকার – ‘ক্ষিদ্দা, ক্ষিদ্দা, তুমি কোথায়?’

14 thoughts on “বেতারের পরী

  1. ভাস্কর – তোর শাঁওলি স্মৃতি রোমন্থন সত্যি ভারি সুন্দর লাগল😚

    Liked by 1 person

  2. অসাধারন পুঙ্খানুপুঙ্খতা দিয়ে আঁকা সেই ছেলেবেলার মননে ছুঁয়ে, রয়ে যাওয়া “বেতার পরীর” স্মৃতি কথার চিত্রকে তোমার লেখনীতে রূপদান করেছো… শ্রদ্ধেয়া ৺শাঁওলী মিত্রর প্রতি তোমার শ্রদ্ধার্ঘে। এমন আলাদা আলাদা ফ্রেমে বাঁধানো অনবদ্য স্মৃতিচারণ আমর আগে কখুনো পাঠ করার সুযোগ হয়নি। এমন একটি লেখা উপহার দেবার জন্য অশেষ ধন্যবাদ ।।

    Like

Leave a comment