সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস – অপর

সম্প্রতি হাতে এল সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের সাতটি উপন্যাস। প্রকাশক অন্তরীপ। সুদৃশ্য প্রচ্ছদ। সুন্দর বাঁধাই। বেশ মনকাড়া।

যে সাতটি উপন্যাস গ্রন্থবদ্ধ হয়েছে তারা হল –

গ্রন্থি, আঁধারনদী, সংক্রান্তি, সাপলুডো, জীবন অথবা, সোনালি মেঘ, রুপোলি ছায়া এবং অপর।

এরমধ্যে বেশ কিছু আমার পড়া এবং সেসম্পর্কে আমার মতামতও লিখে ফেলেছি। এই গ্রন্থটিতে আমার সবচেয়ে বেশি কৌতূহল ছিল একটি উপন্যাস নিয়ে, তার নাম ‘অপর’

কৌতূহলের মূল কারণ ছিল দুটি। প্রথমত এই উপন্যাসটি কোন মুদ্রিত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। তা হয়েছিল একটি ওয়েবজাইনের শারদীয় সংখ্যায়। সেটিতে আমি সাবস্ক্রাইব করব করব করেও আর করা হয়নি এবং পড়া হয়নি। দ্বিতীয়টি হল বইটির বিষয়বস্তু – পরকীয়া প্রেম সংক্রান্ত প্রাপ্তমনস্ক উপন্যাস।
পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলেও তা আমার হস্তগত হয়নি। কাজেই ‘অপর’ উপন্যাসের জন্য অপার কৌতূহল ছিল। ফলে গ্রন্থটি হস্তগত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই উপন্যাসটি পড়ে ফেললাম। এবং মাত্র দুটি পর্বেই। এক পর্বেই সমাপ্ত হতে পারত, কিন্তু স্থানান্তর অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল।
মুগ্ধ হয়েছি উপন্যাসটি পড়ে। সত্যি কথা অনেকদিন পরে একটি উপন্যাস পড়ে এতটা মুগ্ধ হলাম, মন একই সঙ্গে ভারাক্রান্ত এবং তৃপ্ত হল।

উপন্যাসের কাহিনি সেভাবে বলতে চাই না কারণ পাঠকরা তা নিজেরা পরে পড়ে ফেলতে পারবেন। আমি বলে দিলে হয়তো সেটা তাঁদের পক্ষে ‘স্পয়লার’ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা হতে পারে। তবে কাহিনির বিন্যাস নিয়ে কিছু বলাই যেতে পারে।

কাহিনির মূল বটবৃক্ষ হয়ে আছেন প্রৌড় অমিয়নাথ। তাঁর যৌবনের স্খলনের জন্য তাঁর ছেলে ও মেয়ে যথাক্রমে সোমনাথ আর মৃণ্ময়ীর কাছে তিনি পরিত্যক্ত হয়েছেন। সোমনাথের জীবনে বাবার অস্তিত্বই প্রায় নেই, কারণ বাবার স্খলনের ইতিহাস তাকে বারংবার বিব্রত করেছে। তৃণার সঙ্গে তার বিবাহিত জীবন সুখের, সেখানে সে কোনদিন বাবার অবাঞ্ছিত প্রসঙ্গ টানেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার জীবনেও আসে অন্য আকর্ষণ। তৃণার প্রেমের ঔজ্জ্বল্য ম্লান না হলেও আসে পরনারীর প্রতি আকর্ষণ। আধুনিক মনস্কা মণিদীপা তাকে তার মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের বাইরের জীবন সম্পর্কে তীব্রভাবে আকৃষ্ট করে তোলে।
মেয়ে মৃণ্ময়ীর জীবন অবশ্য ঠিক সেভাবে চলেনি। স্বামী ধ্রুব জীবনে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু মায়ের প্রতি সে অসম্ভব পক্ষপাতদুষ্ট, এতটাই যে মৃণ্ময়ীর বাপের বাড়ির প্রসঙ্গ এনে নিজের শিশুসন্তানের কান ভারি করার মত গর্হিত অপরাধেও সে মায়ের পক্ষ নেয়। বিক্ষুব্ধ মৃণ্ময়ীর জীবনেও অন্য আকর্ষণ ডানা মেলতে থাকে। সে খুঁজে বেড়ায় এক ‘অপর’ জীবনকে, যা এই দুঃসহ জীবনের থেকে আলাদা। তাকে ‘দুদণ্ড শান্তি’ র সন্ধান দেবে। পায়ও সেই সন্ধান। কিন্তু তার নিয়তি তাকে অন্যসুরে বাঁধতে চায়।

এই উপন্যাসের প্রত্যেকটি চরিত্রের নির্মাণে অসামান্য মুন্সিয়ানার ছোঁয়া। প্রত্যেকটি চরিত্রই বড় বেশি জীবন্ত, তাদের ভালোবাসা, চ্যুতি, আকর্ষণ, লোভ, তীব্র অপরাধবোধ – সব কিছুই মর্মস্পর্শীভাবে ধরা পড়েছে। বস্তুত সৌরভ এই উপন্যাসে আমার পঠিত তাঁর আগের সামাজিক উপন্যাসগুলিকে ছাড়িয়ে অনেক এগিয়ে গেছেন। বিশেষ করে দু’টি প্রজন্মের মধ্যে ভালোবাসা আর স্খলন, তার থেকে নিরন্তর সংশয় আর অপরাধবোধের টানাপোড়েন এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র সোমনাথের এক অভিনব উত্তরণ দিয়েই কাহিনির পরিসমাপ্তি হয়েছে। অদ্ভুত ঘটনাপ্রবাহে যে সোমনাথ কোনদিন তার পরিবারকে সেভাবে নিজের মনে করতে পারেনি, সেই পরিবারের রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ‘অপর’ ভালোবাসা, দুর্বলতার থেকে উন্নীত হয়ে যে মানুষ হিসেবে তাকে জীবনের পথে বেশ কিছুটা এগিয়ে দিতে পেরেছে, – এটাই আমার পরম প্রাপ্তি মনে হয়েছে। বাবা অমিয়নাথের যে স্খলন তাকে এতদিন ছেলে হিসেবে প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত, পীড়িত করেছিল, সে যেন এখন তাকেও অনেকটা ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখতে পেরেছে।

উপন্যাসের মল্লিকা চরিত্রটিও আলাদা ভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। প্রতারিত মল্লিকা সামাজিক বন্ধন ছিন্ন করে নিজেকে নিয়ে গেছে ছোটনাগপুরের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের নগণ্য স্কুলে। এই অংশের প্রতি আমার পক্ষপাতের কারণ ঐ অঞ্চলগুলি সম্পর্কে আমার বিশেষ দুর্বলতা। বিশেষ করে দাহিগোড়ার বিভূতিভূষণের বাড়ির প্রসঙ্গ, সুবর্ণরেখার চর, তামার কারখানা আমার কৈশোরের অত্যন্ত মধুর স্মৃতি। কিন্তু তা ছাড়াও মল্লিকার প্রবঞ্চনার মধ্যেও জীবনের ঐশ্বর্যকে খুঁজে নেওয়ার অদম্য প্রচেষ্টার মধ্যে যেন নতুন জীবনের সূচনার এক আহ্বান শুনি। নিজের জীবনের দুর্বিপাককে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে, এক অচেনা, নতুন জায়গায় নতুন মানুষ গড়ার তার স্বপ্নকে সাধুবাদ না জানিয়ে থাকা যায় না।

এই উপন্যাসে বিভিন্ন অনুষঙ্গে এসেছে বিশেষ বিশেষ গানের প্রসঙ্গ। অনেকে এগুলি পছন্দ করেন না, কিন্তু আমার এটি বিশেষ পছন্দ। একেবারে রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে শুরু করে আধুনিক এমনকি বিশেষ প্রিয় হিন্দি গানের অন্তর্ভুক্তি আমার মত গানপ্রেমী, আবেগপ্রবণ মানুষকে মুগ্ধ করেছে। কেউ কেউ মনে করেন এতে উপন্যাসের ঋজুতা কমে যায়, আমি একেবারেই ভিন্নমত পোষণ করি। বস্তুতঃ বুদ্ধদেব গুহর ‘মাধুকরী’ উপন্যাসে বহু কবিতার সুচারু প্রয়োগ উপন্যাসটিকে আরো মধুর করেছিল বলেই আমার মনে হয়েছে।
একবিংশ শতাব্দীর উপন্যাসে, তা সে সামাজিক হোক বা রহস্য কাহিনি বা বিজ্ঞানভিত্তিকই হোক না কেন, আমার প্রত্যাশা থাকবে আধুনিক মনন এবং মানবহৃদয়ের অন্তরতম রূপসাগরে ডুব দিয়ে অরূপরতন খুঁজে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা। এই উপন্যাসে সৌরভ সেই চেষ্টাতে সর্বদাই ব্যাপৃত থেকেছেন, পাঠককেও সেই নিবিড় অনুসন্ধানে জড়িয়ে নিতে পেরেছেন।

এখানেই উপন্যাসটির সার্থকতা। প্রত্যেক চরিত্র চিত্রণেই তাঁর অখণ্ড মনোযোগ লক্ষ করা যায়, যেন নির্মাণকালে সেই চরিত্রের সঙ্গে তিনি বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত করেছেন। তাঁদের মন বোঝার চেষ্টা করেছেন, পাঠকের সামনে সেই নিগূঢ় আলাপকে মেলে ধরতে পেরেছেন।

Leave a comment