১ – গোড়ার কথা

আচ্ছা, ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর মুহূর্ত কোনটি? নিঃসন্দেহে ১৯৮৩ সালে অপ্রত্যাশিত ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়।
তবে সেটা টেস্ট ক্রিকেটে নয়, একদিনের খেলা তে। টেস্ট ক্রিকেটেও নিঃসন্দেহে অনেক স্মরণীয় মুহূর্ত আছে। ১৯৭১ এ বিদেশে পরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর ইংল্যান্ড বিজয়, ১৯৭৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ৪০৬ রান করে চতুর্থ ইনিংসে জয়, ১৯৮১ তে গ্রেগ চ্যাপেলের অস্ট্রেলিয়াকে মাত্র ১৪৩ রানের লক্ষ পূরণ করতে না দেওয়া, ২০০১ এ ইডেনে ফলো অন করে বিশ্বজয়ী অস্ট্রেলিয়াকে কাত করা, আবার সেই একই জুটি দ্রাবিড় – লক্ষণের কেরামতিতে ২০০৩-৪ অস্ট্রেলিয়াতে টেস্ট জয় আর সিরিজ না হেরে ফেরা, এমনকি ২০২১ এর ঐতিহাসিক অস্ট্রেলিয়া সিরিজ জয়!
নাঃ! সেগুলির কোনটিই নয়। আমাদের লেখার বিষয় একটি অন্য সিরিজ, যা তাৎপর্যপূর্ণ হলেও সেভাবে আলোচিত নয়। ভারত আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে এক কিরকম আত্মীয়তা আছে। হাজার হলেও ওরাও তো অনেকেই ভারতীয় বংশোদ্ভূত, নামেই পরিচয়। সেই কানহাই, রামাধীন, কালীচরণ থেকে আজকের চন্দ্রপল বা হালের সুনীল নারাইন। আর দলটিও বেশ রোমাণ্টিক! উইলো কাঠে সুরের আগুন ঝরাত তারা। তাদের খেলার মধ্যে ছিল কাব্যিক সুষমা। যে কারণে এখন ওঃ ইন্ডিজ সিংহাসনচ্যুত হলেও তাদের জন্য মানুষের মন দুর্বল। অস্ট্রেলিয়ার জন্যে কি কোনদিন হবে?
তবে আমাদের এই কাহিনি তাদের সেই সোপানে চড়ার ঠিক আগের মুহূর্তের ইতিহাস।
১৯৭৪-৭৫ সালে ভারত সফরে আসে নতুন এক ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। তারুণ্যে, প্রতিভাতে উজ্জ্বল। তাদের নেতৃত্বে এমন একজন, বিশ্বক্রিকেটে যাঁর দাপট থাকবে পরের এক দশক। তিনি ক্লাইভ লয়েড। রবার্ট ক্লাইভের পর আর এক ‘ক্লাইভ’ যিনি ভারতে তাঁর রাজপাট শুরু করবেন।

অপরদিকে ভারতীয় ক্রিকেট। ১৯৭১ – ৭৩ এর সোনালী দিনের সফল অধিনায়ক অজিত ওয়াদেকর ১৯৭৪ সালে ইংল্যান্ডে চূড়ান্ত ব্যর্থ। তাঁর অপসারণের দাবি উঠেছে। কিন্তু দলের হাল ধরবেন কে? বিষেন সিং বেদীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আছে। সুনীল গাভাসকর – নাঃ! কারণ তাঁর চেয়ে অনেকেই সিনিয়র দলে। ভেঙ্কটরাঘবন? উঁহু! একটি নাম ভাসছে আকাশে বাতাসে!! কর্তারা খুঁজছেন এমন কাউকে যিনি ঐ ইংল্যান্ড সফরে দলে ছিলেন না, অর্থাৎ রাহুমুক্ত।
মনসুর আলি খান পতৌদি। ভারতের সবচেয়ে নবীন বয়সে তাঁর অধিনায়কত্ব পাওয়ার রেকর্ড এখনো অটুট। ১৯৬৮ সালে তার হাত ধরেই ভারতের প্রথম বিদেশে সিরিজ জয়। ৩৬ বছর, ১০৫ টি ম্যাচ, ৪৩টি ম্যাচ বিদেশের মাটিতে খেলার পর তাঁর নেতৃত্বে নিউজিল্যান্ডে প্রথম জয় ভারতের। শুধু টেস্ট জয় নয়, একেবারে সিরিজ জয় – ৩ – ১ এ। ১৯৭১ এ নেতৃত্ব হারিয়ে ১৯৭৩ এ আবার দলে ফিরেছেন।

এই দুই প্রবীণ ও নবীন অধিনায়কের লড়াই আর দুটি দলের উচ্চমানের এবং উচ্চমনের ক্রিকেট প্রদর্শন এই সিরিজটিকে একটি অন্যমাত্রা দান করেছিল। আমাদের মনে হয়েছে ভারত ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ – দুই দলের ভবিষ্যৎ পথ চলাতে এই সিরিজের এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকবে। কিন্তু তা সেভাবে আলোচিত নয়।
মনে রাখতে হবে ১৯৭৫ এ প্রথম বিশ্বকাপ খেলা হয়, ওয়ান ডে খেলা জনপ্রিয় হয়। তার আগে আন্তর্জাতিক মানের খেলা বলতে শুধুই টেস্ট ছিল। কেমন ছিল সেই খেলা গুলি? যে খেলোয়াড়েরা খেলেছিলেন সেই সিরিজে, কি ছিল তাঁদের অতীত আর ভবিষ্যৎ? এই সিরিজের প্রভাবই বা কি ছিল – ভারত ওয়েস্ট ইন্ডিজ, এই দুই দলের ভবিষ্যতে?
অনেক ক্রিকেট অনুরাগীই মনে করেন যে রুদ্ধশ্বাস, সংঘাতপূর্ণ ক্রিকেট এই টেস্ট সিরিজে দেখা গিয়েছিল তা এই ধ্রুপদী আঙ্গিকের খেলার এক মস্ত বড়ো বিজ্ঞাপন।
আজ তাই একটু ফিরে দেখা। আর সে দেখা হবে নিতান্তই ক্রিকেট অনুরাগীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই। আমরা তথ্য সেটুকুই রাখতে চাই যা আমাদের আলোচনার সহায়ক, কিন্তু ভারী হয়ে উঠবে না। খেলোয়াড়দের প্রতিভা ও প্রদর্শন বা ক্রিকেটীয় মনোভাবের আলোচনাও থাকবে সেভাবেই। আমাদের অকপট স্বীকারোক্তি, এই সংক্রান্ত বিশেষ খুঁটিনাটি তাত্ত্বিক আলোচনা আমরা রেখে দিতে চাই ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের জন্যই। তবে এই লেখা পড়ে যদি তাঁদের আবার সেই সিরিজ নিয়ে ভাবার কথা মনে হয়, নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করব।
২ – সত্তরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল
এর আগের মোকাবিলাতে ভারত ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়েছিলে, নেতৃত্বে অজিত ওয়াদেকর। ১-০ তে গ্যারি সোবার্সের সেই দলকে হারিয়ে সিরিজ জয় করে ভারতীয় দল।
সোবার্স ছিলেন অসাধারণ মাপের খেলোয়াড়। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং – তিনটিতেই অসামান্য নৈপুণ্যের অধিকারী। কিন্তু লয়েডের মনে হত অধিনায়ক হিসেবে তিনি সেরকম সফল হতে পারেননি। তাঁর দলের সব খেলোয়াড়রাই যে তাঁর মত প্রতিভাশালী হবে তা প্রত্যাশিত নয়। বিভিন্ন ধরনের খেলোয়াড় নিয়ে খেলতে গেলে যে ধরনের নেতৃত্বের প্রয়োজন তা তাঁর ছিল না। ১৯৭১এ ভারতের কাছে হার সম্ভবত তারই পরিনতি। দল ও কেমন যেন ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। রোহন কানহাইকে কয়েকবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সেরকম উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। আর কানহাই তখন তাঁর পড়ন্ত বেলাতে।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড এক নতুন নেতার সন্ধান পেলেন। সোবার্স ও কানহাইয়ের পর স্বাভাবিক ভাবেই দায়িত্ব এসে গেল তাঁর ওপর। তারুণ্যে ভরপুর এই দলের অধিনায়ক এক তরুণ – ক্লাইভ লয়েড।
খেলোয়াড় হিসেবে অনন্য প্রতিভার জন্য তাঁকে সম্মান করলেও অধিনায়ক হিসেবে লয়েডের কাছে একদম মনঃপূত ছিলেন না স্যর গারফিল্ড সোবার্স। সেই সময়ে প্রায় টীম মীটিং হতোই না। লয়েডের মতে সোবার্স ভাবতেন যে তিনি একাই দলকে টেনে নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু হাজার হোক, ক্রিকেট তো একটা দলগত খেলা। খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর ক্লাইভ লয়েড সাংবাদিক রাজনবালার কাছে এই ব্যাপারে অনেক খোলাখুলি কথা বলেন। তাঁর “Days Well Spent: A Cricketing odyssey” বইটিতে সেই সাক্ষাৎকারের কথা আছে। লয়েড বলেছেন সোবার্সের তুলনাতে বরং কানহাই অধিনায়ক হিসেবে অনেক যোগ্য ছিলেন। তিনি সবাইয়ের পরামর্শ শুনতেন, ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতেন। খেলাটা রীতিমতো ভালো বুঝতেন। সেই কারণেই ১৯৭৫ এ প্রথম বিশ্বকাপে লয়েড অধিনায়ক থাকলেও কানহাই সেই টীমের সদস্য ছিলেন। ফ্রাঙ্ক ওরেল সম্পর্কে লয়েডের একটিই আক্ষেপ, ‘তিনি কোন সুযোগ্য উত্তরাধিকারী পাননি”! লয়েড সোবার্সের তথাকথিত “স্পোর্টিং স্পিরিটে’র ও বিরুদ্ধে ছিলেন। ১৯৭১ এ পোর্ট অব স্পেন এর শেষ টেস্টে এক ঘটনাতে তিনি রীতিমতো হতাশ হয়েছিলেন সোবার্সের আচরণে। টসের ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরণ আছে সোবার্সের আত্মজীবনী –“Twenty Years at the Top” –বইটিতে।
সিরিজে তখন ভারত ১ – ০ এগিয়ে আছে। এই অবস্থাতে শেষ টেস্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ। টসে গেলেন দুই অধিনায়ক, ওয়াদেকর ও সোবার্স। সোবার্স ওপরে মুদ্রাটি ছোঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওয়াদেকর ডাক দেন এবং সোবার্সের ধারণা তিনিই জেতেন। তিনি ওয়াদেকরকে বলেন তিনি ড্রেসিংরুমে অন্যান্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেবেন। ড্রেসিংরুমে এসে কথা বলছেন, হঠাৎ তিনি লাউডস্পিকারে ঘোষণা শোনেন যে ভারত টসে জিতেছে এবং তারা ব্যাট করবে। যে গ্রাউন্ড স্টাফেরা তাঁর সঙ্গে টসের সময় ছিল, তাদের একজন সোবার্সকে বলেন – ’আমরা টসে জিতেছিলাম না?’ সোবার্সও তাই জানতেন, কিন্তু আর তর্ক না করে তিনি মেনে নেন। এটাতে তীব্র আপত্তি ছিল লয়েডের, তাঁর ধারণা ছিল বিভ্রান্তি থাকলে সোবার্সের আবার টস করানো নিয়ে জোর দেওয়া উচিত ছিল। সোবার্স পরে ওয়াদেকরকে এই নিয়ে জিজ্ঞেস করেও উত্তর পাননি। প্রসঙ্গতঃ সুনীল গাভাসকার কিন্তু আবার ঐ টস বিতর্কে সোবার্সের খেলোয়াড়োচিত সদর্থক ভূমিকাতে প্রশংসাতে পঞ্চমুখ। এ থেকে অবশ্য একটি কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ টীম এই সময় এক সন্ধিক্ষণের মুখে দাঁড়িয়েছিল। উল্টোদিকে সোবার্সও লয়েড সম্পর্কে বলেছেন যে তাঁর পক্ষে অধিনায়কত্ব অনেক সহজ ছিল। দলে চারজন ফাস্ট বোলার, তাদের ঘুরিয়ে যাও। অবশ্য এই ফাস্ট বোলারদের দিয়ে আক্রমণভাগ তৈরী করাতে লয়েডের ভূমিকারও যোগ্য তারিফ করেছেন তিনি।
খুব নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে কিন্তু ঐ পঞ্চম টেস্টে সোবার্সের আচরণ বেশ অপেশাদার মনে হয়। ঐরকম গুরুত্বপূর্ণ টেস্টে তিনি টস করতে যাচ্ছেন যখন, তিনি জানেন না, টসে জিতলে কি করবেন? আবার ফিরে পরামর্শ করতে হবে? ২০১১ সালে বিশ্বকাপ ফাইন্যালে মুম্বাইতে ভারত শ্রীলঙ্কা ম্যাচে বিভ্রান্তির জন্য আবার টস করা হয়। লয়েডের মন্তব্য যুক্তিযুক্ত।
যাক সে কথা। অধিনায়ক রূপে সেই তাঁর প্রথম সিরিজ। তাও আবার বিদেশে। ১৯৭১ সালের সেই হারানো খেতাব জয় করতে। সঙ্গে আরো একঝাঁক নতুন তারকা – লরেন্স রো, ভিভিয়ান রিচার্ডস, গর্ডন গ্রিনিজ, এন্ডি রবার্টস, আলভিন কালীচরন, – পরবর্তী সাত ও আটের দশকে তাঁরা শাসন করবেন ক্রিকেট বিশ্বকে। তখনো দলে রয়ে গেছেন রয় ফ্রেডেরিকস। বিধ্বংসী ওপেনার রূপে তিনি ফাস্ট বোলারদের কাছেও বিশ্বত্রাস। আর ফ্রেডি ট্রুম্যানের ৩০৭ উইকেট ভাঙার লক্ষে অবিচল বর্ষীয়ান স্পিনার ল্যান্স গিবস। আছেন। উইকেট রুখক হিসেবেও দলে আছেন অভিজ্ঞ ডেরেক মারে। নতুন-পুরনো মিলিয়ে বেশ দারুণ দল।

এই আসা নিয়ে বেশ উৎসাহ সৃষ্টি হয়েছিল ভারতেও। অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত ক্রিকেট নিয়ে কিছু লেখা লিখতেন। ও: ইন্ডিজ যে দল ভারতে আসবে, সে দলের এক সদস্য আলভিন কালীচরণ ছিলেন নতুন প্রতিভা।

ভারতে আসার কিছুদিন আগেই ওয়েস্ট ইন্ডিজে সফররত ইংল্যান্ড দলের টনি গ্রেগের সঙ্গে তিনি ঝামেলাতে জড়ান। গায়না টেস্টে দিনের শেষ বল খেলে কালীচরণ ভেবে নেন খেলা শেষ হয়ে গেছে। প্যাভিলিয়ন এর দিকে হাঁটা দেন। সেই সুযোগে গ্রেগ তাঁকে রান আউট করে আবেদন করেন। নিরুপায় আম্পায়ার আউট দিতে বাধ্য হন। ব্যস, শুরু হয় তাণ্ডবলীলা। পরিস্থিতিএত ঘোরাল হয়ে যায় যে আম্পায়ার আউটের সিদ্ধান্ত পালটে ফেলে কালীচরণকে আবার ব্যাট করতে দেন।সফরের প্রাক্কালে, ১৯৭৪ সালের একটি ছোটদের শারদীয়া পত্রিকাতে এই ঘটনা লিখে অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত লিখেছিলেন, “এই ঘটনায় সুকুমার রায়ের ছড়া মনে পড়ে না?
ওরে ও কালীচরণ,
তোমার কি নেই রে মরণ,
কোন সাহসে লোক খেপিয়ে,
আম্পায়ারের কান মলাও!"
আমরা যারা ঐ সময়ে কিশোর ছিলাম, এখনো অনুভব করতে পারি সেই সিরিজের রোমাঞ্চ। এন্ডি রবার্টস তখন সবে খেলা শুরু করেছেন। এন্টিগুয়া দ্বীপের তিনিই প্রথম বাসিন্দা যিনি টেস্ট খেললেন। সবচেয়ে দ্রুত গতির বোলার। সেই বছর (১৯৭৪) মার্চ মাসে ইংল্যান্ডের মাটিতে কানহাইয়ের অধিনায়কত্বে তাঁর টেস্ট অভিষেক হয়েছে। কিন্তু তার আগেই ধুন্ধুমার লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। বিশ্বে সবচেয়ে বেশী জোরে বল করেন, প্রায় ঘণ্টায় ৯৫ মাইলের কাছাকাছি বলের গতি। সব ব্যাটসম্যানরাই তাঁকে বেশ ভয় করে চলেন। ৬ফিট ২ইঞ্চি উচ্চতার মানুষটি খুব সিরিয়াস, খেলার সময় তার মুখে হাসি কেউ কভু দেখেনি।

১৯৭৪ সালে আর এক অসামান্য প্রতিভার উন্মেষ হয়েছিল, তিনি লরেন্স রো। প্রথম যে টেস্ট খেলেন রবার্টস, সেই খেলাতে ট্রিপল সেঞ্চুরি করেন লরেন্স রো। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দারুণ খেলেন তিনি। দুর্ভাগ্যবশত চোখের সমস্যার জন্য তাঁর টেস্ট ক্রিকেটে ইতি হয়।
রয় ফ্রেডেরিকস এর সঙ্গে ইনিংস শুরু করবেন আর এক তরুণ, গর্ডন গ্রিনিজ। ইংল্যান্ড কাউন্টিতে ব্যারি রিচার্ডসের সঙ্গে তাঁর ওপেনিং জুড়ি খুব সুনাম কুড়িয়েছে। তিনি অবশ্য প্রথম টেস্ট খেলবেন এই সিরিজেই।
দলের আর এক সদস্য হলেন ভিভিয়ান রিচার্ডস, পরের আরো বছর পনেরো (১৯৭৪ – ১৯৯১) যিনি সব বোলারদের কাছে ত্রাসের সৃষ্টি করবেন। ১৯৯৯ সালের মে মাসে উইজডেন তাঁকে বিগত পঁচিশ বছরের (১৯৭৪ – ১৯৯৯) শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট খেলোয়াড় ঘোষণা করবে। অথচ এই সিরিজে তিনি এলেন অতিরিক্ত ব্যাটসম্যান হিসেবে। লরেন্স রো চোখে আঘাত পেয়ে ফিরে না গেলে তাঁর খেলাই হয়তো হত না। সুতরাং যে দলের অতিরিক্ত ব্যাটসম্যান হলেন ভিভিয়ান রিচার্ডস, সে দলের শক্তি আন্দাজ করাই যেতে পারে।



৩ঃ সত্তরে ভারতীয় ক্রিকেট
ইতিমধ্যে ভারত আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ এর মধ্যে ১৯৭১ সালে ক্রিকেট যুদ্ধে এক নতুন তারকার জন্ম হল। সুনীল গাভাসকার, ৫ টেস্টে ৭৭১ রান করে তিনি বাঙালীর নয়নের মনি। অবশ্য তার আগেই এসেছেন আরো একজন, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ। ১৯৬৯ সালে আবির্ভাবেই সেঞ্চুরি করেছেন। তাঁর আগে যে সকল ভারতীয়রা প্রথম টেস্টে সেঞ্চুরি করেছিলেন, তারা কেউই আর দ্বিতীয় সেঞ্চুরির মুখ দেখেনি। এঁদের মধ্যে অন্যতম লালা অমরনাথ। সেজন্য সুনীল গাভাসকার যখন প্রথম টেস্টে ভাল খেলেও সেঞ্চুরি করতে পারেন নি, হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল ভারতীয় দর্শক। বিশ্বনাথ কিন্তু ১৯৭২-৭৩ এ সফররত ইংল্যান্ড দলের বিরুদ্ধে আবার সেঞ্চুরি করে প্রচলিত অভিশাপ খণ্ডন করলেন।

সুনীল ও বিশ্বনাথ
এছাড়া আছেন চার স্পিনার, চন্দ্র – বেদী – প্রসন্ন – ভেঙ্কট। চারজন স্পিনারের তখন বিশ্বব্যাপী সুনাম। চারজন অবশ্য সবসময় একসঙ্গে খেলতে পারতেন না।
তবে ১৯৭৪ সালে কিন্তু ভারতীয় দলে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে গেছে। অবসর নিয়েছেন সেলিম দুরাণী, দিলীপ সরদেশাই, চান্দু বোরদে। তারমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তৎকালীন ভারতীয় অধিনায়ক অজিত ওয়াদেকরের “স্বর্গ হতে বিদায়”।
১৯৭১ এ যে দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ইংল্যান্ড সফর করে ইতিহাস সৃষ্টি করে সে দলের অধিনায়কত্বের দাবিদারও কিন্তু ছিলেন পতৌদি। ১৯৭১ সালে ওয়াদেকরের ভাগ্য সহায়ক ছিল, তিনি তাই পতৌদিকে টপকে সফরকারী ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব পেয়ে যান। ১৯৭০ – ৭১ এ পতৌদির জনপ্রিয়তা কিছুটা কমে গেছিল। তাহলেও পতৌদির সমর্থন একেবারে যে ছিল না তা নয়। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান বিজয় মার্চেন্ট ছিলেন ওয়াদেকরের সমর্থক। তাই ওয়াদেকরের হাতেই নেতৃত্ব চলে গেল।
সেটি ছিল তাঁর এবং ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে সফল বছর। ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ইংল্যান্ডে পরপর জয়ী হয়ে ভারতবর্ষের ক্রিকেট ইতিহাসের চেহারাই পালটে গেল। ১৯৭২– ৭৩ ভারত সফররত ইংল্যান্ড দলের বিরুদ্ধে ও তিনি জয়ী হলেন।
কিন্তু ‘চিরদিন সমান নাহি যায়’। এল ১৯৭৪ সাল। ওয়াদেকরের জীবনের সবচেয়ে সাংঘাতিক সময়। অধিনায়ক রূপে ওয়াদেকর, রঞ্জী ট্রফি, ইরানী ট্রফি আর দলীপ ট্রফি হারলেন। বহুদিন বাদে জেতা তো দূরের কথা, ফাইন্যালেই জেতে পারল না মুম্বাই। রঞ্জী ট্রফির সেমি ফাইন্যালেই প্রথম ইনিংসের কম রানের সুবাদে ওয়াদেকরের নেতৃত্বে বোম্বে কর্ণাটকের কাছে হারল। কর্ণাটকের সেই প্রথমবার রঞ্জী জয়। জয়ের মূল স্থপতি – গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথ। দলে ছিলেন ব্রিজেশ প্যাটেল, প্রসন্ন (অধিনায়ক) এবং চন্দ্রশেখর।
এরপর ইংল্যান্ড সফরে চূড়ান্ত ব্যর্থ ভারতীয় দল। ফলে পদত্যাগ করলেন বা বলা যায় করতে বাধ্য হলেন অজিত ওয়াদেকর। এর আগে তাঁকে পশ্চিমাঞ্চল দল থেকে বিস্ময়কর ভাবে বাদ দেওয়া হয়। কারণ তিনি নাকি তখন “Out of form”। আর অপমানিত না হতে চেয়ে তিনি প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট থেকে অবসর ঘোষণা করলেন।

অজিত ওয়াদেকর
সুনীল গাভাসকারের “Sunny Days”, রাজন বালার “Days Well Spent: A Cricketing odyssey” বা পরতাপ রামচাঁদ এর “India’s captains” এই বিষয়ে বেশ বিস্তারিত বিবরণ আছে।
এদিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল আসছে, কাকে অধিনায়ক করা যাবে? ভেঙ্কটরাঘবন দলে সেভাবে নিশ্চিত নন, বেদীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা।
ওয়াদেকরের বিদায়ের ফলে অধিনায়কত্বের অন্যতম দাবিদার হতে পারতেন বিষেন সিং বেদী। ইংল্যান্ড সফরে তিনি ছিলেন সহকারী অধিনায়ক। কিন্তু ১৯৭৪ এর সেই ভয়ংকর সফরে তিনি ওয়াদেকরের সঙ্গে যে আচরণ করেন তা একেবারেই খেলোয়াড়সুলভ ছিল না। তাই তিনি প্রথম টেস্টে শাস্তি স্বরূপ বাদ পড়ে যান।
এটা কিন্তু খুব সাংঘাতিক ব্যাপার ছিল। একথা সত্যি, ১৯৭৪ এর সেই সফরে ওয়াদেকরের প্রতি বেদীর মনোভাব মোটেই খেলোয়াড়সুলভ ছিলনা। তবে সেখানে এত সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল, যার ফলেও তাঁদের সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। মানা গেল, সেজন্য তাঁকে অধিনায়ক হিসেবে মনোনয়ন না দেওয়া যুক্তিযুক্ত। কিন্তু তিনি তখন ভারতের সেরা বোলার, তাঁকে বাদ দিয়ে ঐরকম শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ টীমের মোকাবিলা করাটা তো মুশকিল হবেই। নাঃ, এটা একটু হয়তো বেশীই বাড়াবাড়ি হয়েছিল। দ্বিতীয় টেস্টে তিনি অবশ্য ফিরে আসেন স্বমহিমাতে।
পতৌদির তখনকার অবস্থার একটু খবর নেওয়া যাক। ১৯৭১ এ তিনি দল থেকে বাদ পড়ার পর আবার দলে ফিরতে সচেষ্ট। “কামব্যাক” নায়ক কথা তখন খুব বেশী শোনা যেত না। ১৯৭৩ সালটি তাঁর জীবনে বেশ আশার বার্তা নিয়ে এল। সফররত ইংল্যান্ড দলের বিরুদ্ধে দক্ষিণাঞ্চলের হয়ে তিনি একটি শতরান করে ফেললেন। ব্যস, আবার দরজা খুলল। পরবর্তী দুটি টেস্টে খেলার সুযোগ পান। এবং কাজে লাগান।
চীপকের তৃতীয় টেস্টে যখন ভারত ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয়, তখন সিরিজ ১-১। এই টেস্টে ভারত চার উইকেটে ইংল্যান্ডে কে হারায় এবং সেই জয়ের মুখ্য স্থপতি – নবাব। প্রথম ইনিংসের তাঁর সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ৭৩ রানই জয়ের ভিত গড়ে। অসম্ভব প্রত্যয়ী ও দৃপ্ত ইনিংস ছিল সেটি। তিন তিনটি ছয় মারেন তিনি আর চতুর্থ ছয়টি মারতে গিয়েই বাউন্ডারির ধারে ক্যাচ আউট হন। আর দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৮৬ রান তাড়া করতে গিয়ে ৬ উইকেট হারিয়ে যখন বেশ বিপদে পড়ে ভারত, মাথা ঠাণ্ডা রেখে তিনি আহত গাভাসকারকে সঙ্গী করে প্রয়োজনীয় রান তুলে সিরিজে ভারতকে ২-১ এ এগিয়ে দেন।
পরের দুটি টেস্টে ও তিনি মন্দ খেলেননি। তাই স্বাভাবিক ভাবে ওয়াদেকরের বিদায়ের পর অধিনায়কত্বের তিনি একজন দাবিদার। আরো একটি ব্যাপার তাঁর পক্ষে গেল, তিনি ১৯৭৪ এর সেই অভিশপ্ত দলে ছিলেন না। জনশ্রুতি তাঁকে যখন প্রথম দুটি টেস্টের জন্য ভেবে কর্মকর্তারা ডাকেন, স্বভাবোচিত রাজকীয় ভঙ্গিমাতে তিনি হাতের তালু খোলা বন্ধ করে তিনি জানান দেন হয় পাঁচটিই নয়তো শূন্য – এর মধ্যে কোন কিছুতে তিনি আগ্রহী নন। তাঁর এই আত্মপ্রত্যয় ও স্বাভিমান খুব স্বাভাবিক। তিনি তো আর আনকোরা নতুন অধিনায়ক নন, পুরো ষাটের দশক ভারতীয় দলের নেতৃত্ব তাঁর হাতেই তো ছিল।
সিরিজ শুরু হল ব্যাঙ্গালোরে, ১৯৭৪ সালের ২২শে নভেম্বর, ১৯৭৪। এটি ব্যাঙ্গালোরে অনুষ্ঠিত প্রথম টেস্ট। এর আগে সাধারণতঃ টেস্ট হত দিল্লী, কলকাতা, কানপুর, চেন্নাই (ম্যাড্রাস), মুম্বাই (বোম্বে) তে। এই প্রথম কানপুর বাদ গিয়ে টেস্ট খেলা শুরু হল ব্যাঙ্গালোরে। ১৯৭৪ সালে কর্ণাটকের প্রথম রঞ্জী ট্রফি জয় কিছু ভূমিকা রেখে থাকবে সম্ভবতঃ। আর এটিই হয়তো ভারতের ক্রিকেটে কর্ণাটকের উত্থানের শুরু। আরো একটি খুব কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার ছিল। প্রথম বার ভারতীয় দলের সহ-অধিনায়ক নির্বাচিত হলেন সুনীল গাভাসকর, কিন্তু তাঁকে ব্যাপারটি গোপন রাখতে বলা হল।
৪ঃ প্রথম টেস্ট, ব্যাঙ্গালোর – ব্যর্থতা
২২শে নভেম্বর, ১৯৭৪। সমগ্র ব্যাঙ্গালোরবাসীর জীবনে একটি মনে রাখার মত দিন। তাদের শহরের স্টেডিয়ামে তারা এই প্রথমবার টেস্ট খেলা দেখতে পাবে। চার মেট্রো শহর, মুম্বাই, কলকাতা, চেন্নাই ও দিল্লী – এর সঙ্গে তাদের নামও যুক্ত হয়ে গেল। এর আগের বার অবধি পঞ্চম টেস্ট হলে খেলা পড়তো কানপুরে। এবার ব্যাঙ্গালোর তাদের দাবী জানিয়ে সফল।
স্টেডিয়াম কিন্তু পুরোপুরি ভাবে প্রস্তুত নয়। তাহলেও শহরবাসীর উৎসাহের অন্ত নেই। আর হবে নাই বা কেন?

১৯৫৮-৫৯ সাল থেকে ১৯৭২-৭৩! পরপর ১৫ বছর রণজি ট্রফির শিরোপা পেয়েছে বম্বে (অধুনা মুম্বাই)। এই মরশুমেই (১৯৭৩-৭৪) এরাপল্লী প্রসন্নের নেতৃত্বে কর্ণাটক প্রথম রঞ্জী চ্যাম্পিয়ন। সেমি ফাইনালে তারকা খচিত বম্বে টীমকে তারা হারিয়েছে। ফাইন্যালে রাজস্থানকে। এই খেতাব জয়ে মুখ্য ভূমিকা ছিল গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, এরাপল্লী প্রসন্ন, ভাগবৎ চন্দ্রশেখর ও ব্রিজেশ প্যাটেলের। তাঁরা সকলেই টেস্ট টীমের সদস্য! উত্তেজনাতে ফুটছেন শহরবাসী। ভাবা যায়, প্রথমবার তাঁরা ঘরের মাঠে টেস্ট খেলা দেখবেন আর সেই দলে চার-চারজন ঘরের ছেলে। আগের বছরেই (১৯৭৩) পয়লা নভেম্বর মহীশূর নাম পালটে হয়েছে কর্ণাটক আর হাতে নাতে ফল ফলতে শুরু করেছে। কর্ণাটকের ক্রিকেট সংস্থা, KSCAর জন্মও হল সেবছরেই। সম্ভবত এই খেতাব জয়ই তাদের টেস্ট ম্যাচের দাবি কে আরো জোরদার করে তুলেছিল। যদিও গাভাসকার ছোট করে আক্ষেপ করেছেন যে সেমি ফাইন্যালে বিশ্বনাথকে এলবি আউট দেওয়া হয়নি, এমনকি ব্রিজেশ ও আম্পায়ারের দাক্ষিণ্য পেয়েছিলেন। তবে এও মেনে নিয়েছেন একবার জীবন ফিরে পেয়ে ভিশি আর প্যাটেল বোম্বের বোলিংকে একেবারে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিলেন। প্রথম ইনিংসে এগিয়ে থাকার সুবাদে বোম্বে হেরেছিল কর্ণাটকের কাছে।
যাইহোক, ব্যাঙ্গালোর টেস্টে দল তৈরী হল। বাদ পড়লেন বিষেন সিং বেদী। কারণ আগের ইংল্যান্ড সফরে অধিনায়ক অজিত ওয়াদেকরের প্রতি তিনি সম্মান প্রদর্শন তো করেনই নি, বরং প্রায় দুর্ব্যবহার করেছেন। তাই তাঁকে ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে ভারতীয় নির্বাচকমণ্ডলীর এই ‘কড়া’ পদক্ষেপ।
প্রতীক্ষারত ব্যাঙ্গালোরবাসীর আশাতে আক্ষরিক অর্থেই ‘জল’ ঢেলে দিলেন প্রকৃতি। প্রবল বৃষ্টিতে খেলা শুরু হতে হতে লাঞ্চ টাইম পার। পাঁচ বছর পরে অধিনায়ক হিসেবে টসে জিতলেন পতৌদি, কিন্তু ব্যাটিং নিলেন না। সম্ভবত বৃষ্টিস্নাত পিচে এন্ডি রবার্টস, হোলডার, কিথ বয়েজদের মুখোমুখি হওয়া নিয়ে সংশয় ছিল।
ইনিংস সূচনা করলেন অভিজ্ঞ রয় ফ্রেডরিকস আর প্রথম টেস্ট খেলতে নামা গর্ডন গ্রিনিজ। ফ্রেডরিকস আহত হয়ে চলে গেলেও এলেন আলভিন কালীচরন। সোলকারের বলে গ্রীনিজের ক্যাচ ফেললেন প্রথম স্লিপে দাঁড়ান প্রসন্ন। প্রাণ পেয়ে তিনি ও কালীচরণ দুজনে মিলে দুর্ধর্ষ ইনিংস খেললেন। আরো সাংঘাতিক কিছু ঘটতে যাচ্ছিল, এই সময় ভুল বোঝাবুঝিতে রান আউট হলেন গ্রিনিজ। জীবনের প্রথম ইনিংসে টেস্ট শতক থেকে বঞ্চিত হয়ে। অবশ্য তাঁর ভাগ্য ছিল ‘সুপ্রসন্ন’, শুধু প্রথমে নয়, পরে আরো একবার তাঁর ক্যাচ ফেলেছিলেন প্রসন্ন। জীবনের প্রথম ইনিংস খেলতে নামলেন স্যর ভিভিয়ান রিচার্ডস। তাঁর ভাগ্য ‘অপ্রসন্ন’, কারণ চন্দ্রশেখরের বলে তাঁর ক্যাচ ফেললেন না প্রসন্ন। প্যাভিলিয়নে ফিরে গ্রিনিজ নিশ্চয় রিচার্ডস কে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। প্রথম দিনে খেলার শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান ছিল ২ উইকেতে ২১২। পরের দিন কিন্তু হঠাৎ করে ধ্বস নেমে গেল। কালীচরণ ছাড়া কেউ দাঁড়াতেই পারলেন না, চন্দ্র-প্রসন্নর বোলিং এর সামনে। কালীচরণ যখন প্রসন্নর বলে ইঞ্জিনীয়ারের হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট হলেন তখন ২৮৯ ইনিংস শেষ হল ওয়েস্ট ইণদিজের ইনিংস। তাঁর অসাধারণ একটি শতরান (১২৪) অতিথিদের মুখরক্ষা করল, নইলে কপালে দুঃখ ছিল। এক স্পিনার সহায়ক পিচে, বাঁহাতি ব্যাটসম্যান হিসেবে ভেঙ্কট – প্রসন্নর মত বিশ্বসেরা অফ স্পিনার জুড়ির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় দিনে ৭৭ রানের মধ্যে তাঁর একার ষাট রান। অন্যদিকে ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতা তাঁর মনঃসংযোগে চির ধরাতে পারলো না। এই ইনিংসের গুরুত্ব ধীরে ধীরে বোঝা যেতে লাগলো।
ভারতের প্রথম ইনিংস তুলনাতে খারাপ ছিল না। রিচার্ডস এর আত্মজীবনীতে জানা যায়, প্রথম ব্যাটিং এ ব্যর্থ হলেও ফিল্ডিং এ কিন্তু তিনি চূড়ান্ত সফল। সিলি মিড অনে দাঁড়িয়ে গাভাসকর, ইঞ্জিনিয়ার, দুই ওপেনারকেই তিনি ক্যাচ ধরে ফেরান। গাভাসকরের ক্যাচটি প্রায় অবিশ্বাস্য – গাভাসকর চার মেরেছেন ভেবেছিলেন, উলটে ফেরত যেতে হল!! রিচার্ডস মনে করেন ঐ ক্যাচ দুটির জন্যই তিনি পরের টেস্টে চান্স পেয়ে থাকবেন। দ্বিতীয় দিনের শেষে ভারতের রান ২ উইকেটে ৪৩। পরের দিন নবাগত হেমন্ত কানিৎকার, বিশ্বনাথ, প্যাটেল, প্রসন্ন, আবিদ আলির কাঁধে ভর করে ভারত পৌঁছে গেল ২৬০ রানে, মাত্র ২৯ রানের তফাতে।
কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসেও রিচার্ডস আবার ব্যর্থ, ব্যর্থ কালীচরণও। কিন্তু গ্রিনিজ তাঁর প্রথম টেস্টকে স্মরণীয় করে রাখলেন। প্রথম ইনিংসে হাতছাড়া হয়েছিল শতরান, দ্বিতীয় ইনিংসে তো করলেনই, লয়েডের সঙ্গে জুটি বেঁধে সাংঘাতিক খেললেন। আর লয়েড? একদম শুরুতে একটি হাফ চান্স তিনি দিয়েছিলেন, প্রসন্ন দৌড়ে এসে ধরতে পারলে কি হতো কে জানে। কিন্তু তারপরেই অধিনায়কোচিত ইনিংস কাকে বলে তিনি দেখালেন। সেঞ্চুরি করতে নিয়েছিলেন মাত্র ৮৪ টি বল, ২২টি চার, দুটি ছয় নিয়ে ১৫৪ বলে ১৬৩ রান। সেই সময় এরকম আক্রমণাত্মক ইনিংস কম দেখা যেত। লয়েড চতুর্থ দিনের শেষে যখন ইনিংস ঘোষণা করলেন, তখন জেতার জন্য ভারতের দরকার ৩৮৬ রান। কিথ বয়েসের ক্যাচ ধরতে গিয়ে আহত হয়ে পতৌদিকে মাঠ ছেড়ে যেতে হয়েছে, তিনি আর খেলায় ফিরবেন না। এমনকি পরের টেস্টেও না। আহত ইঞ্জিনীয়ারও, ভেঙ্কটের বলে কীপিং করতে গিয়ে মুখে আঘাত পেয়েছেন তিনি। তাঁরা মাঠ ছেড়ে চলে গেছেন। অধিনায়কের দায়িত্ব সুনীলের হাতে। সুনীল প্রথম অধিনায়কত্ব শুরু করে আক্ষরিক অর্থেই শূন্য হাতে ফিরে এলেন। বয়সের একটি লেট আউট সুইংগারে শেষ মুহূর্তে ব্যাট সরাতে না পেরে কীপার ডেরেক মারের হাতে সহজ ক্যাচ দিয়ে ফিরে গেলেন তিনি। এরপর ভারতের মনোবল প্রায় ভেঙে গেছিল। চতুর্থ দিন খেলার শেষে স্কোর দু উইকেটে ৩৬। পতৌদি, ইঞ্জিনীয়ার ব্যাট করতে পারবেন না, কাজেই বাঁচার আশা ক্ষীণ। খেলার শেষদিনে বিশ্বনাথ আউট হওয়ার পরে তাসের ঘরের মত হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। মাত্র ১১৮ রানে শেষ হয়ে গেল, লয়েড তাঁর বিশ্ববিজয় শুরু করলেন ২৬৭ রানে জিতে।
নাঃ! ব্যাঙ্গালোরের মানুষের স্বপ্ন সফল হল না। চার চারজন ঘরের ছেলে, কিন্তু কেউ সেভাবে উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারলেন না। তাঁরা ভাবলেন গ্রীনিজের ক্যাচদুটো যদি প্রসন্ন না ছাড়তেন আর পতৌদি আর ইঞ্জিনীয়র দ্বিতীয় ইনিংসে আহত না হতেন, তাহলে হয়তো-!! শঙ্কিত ছিলেন অবশ্য আরো একজন,- নবাগত ভিভ রিচার্ডস। একসঙ্গে শুরু করলেন তিনি ও গর্ডন গ্রিনিজ, গ্রিনিজ দু ইনিংসেই সফল, কিন্তু রিচার্ডস ব্যর্থ। দুবারই তিনি আউট হয়েছিলেন চন্দ্রশেখরের বলে। প্রথম টেস্টের মধুর স্মৃতি বলতে তাঁর কাছে ঐ দুটি অবিস্মরণীয় ক্যাচ।
আর একটি বেশ সন্দেহজনক ব্যাপার ছিল। প্রথমবার টেস্ট দলে স্থান পেলেন রাজিন্দর গোয়েল, তিনি দলে থাকলেও তাঁকে দ্বাদশ ব্যক্তি রাখা হয়। সম্ভবতঃ তিনি ভাল খেলে ফেললে বেদীকে দলে ঢোকানো মুশকিল হতে পারে এই ঝুঁকি আর নিতে চাননি নির্বাচকরা।
৫ঃ দ্বিতীয় টেস্ট, দিল্লি – চূড়ান্ত আত্মসমর্পণ
প্রথম টেস্টে ভারত হেরে গেলেও খুব অসম্মানের হার ছিল না। এমনকি শেষ ইনিংসে তাদের অদ্ভুত আত্মসমর্পনের পেছনে ছিল পতৌদি ও ইঞ্জিনিয়ারের আঘাত। কাজেই দ্বিতীয় টেস্টে ভারতীয় সমর্থকদের মনে বেশ আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু আশঙ্কাও ছিল। দ্বিতীয় টেস্ট শুরু হবে দিল্লীতে। আহত অধিনায়ক পতৌদি খেলতে পারবেন না। কাজেই নেতৃত্ব পেলেন গাভাসকার।
কিন্তু সেই সময় যখন খারাপ থাকে সবকিছুই উল্টোদিকে ঘুরতে থাকে। মহারাষ্ট্র বনাম বোম্বের রঞ্জী ম্যাচ চলছে। পাণ্ডুরং সালগাঁওকরের একটি লাফিয়ে ওঠা বলে আঘাত পেলেন গাভাসকার। আর প্রাথমিক পরীক্ষার পরেই দুঃসংবাদ এল, হাতের হাড় ভেঙেছে। ফলত দ্বিতীয় টেস্টে তিনি খেলতে পারবেন না। ফলে দল এবং অধিনায়ক নির্বাচনে সমস্যাতে পড়ল ভারতীয় বোর্ড। এদিকে প্রথম টেস্টের পর নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে দলে ফিরেছেন বিষেন সিং বেদী। এইখানে একটি বড় ভুল করে বসলেন কর্মকর্তারা।
ফিরোজ শা কোটলা তে টেস্ট শুরুর দিনেই জানা গেল- অধিনায়ক নির্বাচিত হয়েছেন ভেঙ্কটরাঘবন আর তাঁকে ও বেদীকে জায়গা দিতে দল থেকে বাদ পড়েছেন কে – ‘ভাগবৎ চন্দ্রশেখর’, বিগত টেস্টে যিনি সারাক্ষণ সমস্যাতে রেখেছিলেন ভিভিয়ান রিচার্ডসকে। অবশ্য ভারতীয় কর্মকর্তারা সম্ভবত বুঝে গিয়েছিলেন রিচার্ডস এসেছেন ক্রিকেট বিশ্বজয় করতে, কাজেই তাঁকে বেশীদিন আটকে রাখা যাবে না।
গাভাসকারের জায়গাতে ইঞ্জিনিয়ারের সাথে ইনিংস শুরু করতে এলেন সুধীর নায়েক। ১৯৭৪ এ ইংল্যান্ডে বেশ কমাস আগে তার নাম জড়িয়েছে এক অদ্ভুত ঘটনাতে। কোন এক দোকানে জিনিষপত্র কেনার সময় বিল বিভ্রাটে তাঁর নাম জড়ায়। সেই ভয়ংকর ট্যুরের শেষ টেস্টটিতে তিনি প্রথম খেলেন। মন্দ খেলেননি, দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁর লড়াকু ৭৭ রান মনে রেখেই আহত গাভাসকারের জায়গাতে স্থান দেওয়া হয়েছিল।
পতৌদির জায়গাতে দলে এলেন পার্থসারথি শর্মা। রাজস্থানের চমৎকার ব্যাটসম্যান। অবশ্য ফিল্ডিং এবং রানিং বিটুইন দ্য উইকেটস বেশ দুর্বল। দুজনেই কিন্তু সম্ভাবনা জাগিয়েছিলেন। প্রথম শুরু করে ৪৮ রান করেন নায়ক। একটু নড়বড়ে হলেও খুব গুরুত্ববহ রান। শর্মা করলেন, ৫৬ রান। ২২০ তে সমাপ্ত ভারতীয় ইনিংসের সর্বাধিক রান এল তাঁর ব্যাট থেকেই।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংসের শুরুতেই সাফল্য পান ভারতীয়রা। আহত ফ্রেডেরিকসের পরিবর্তে শুরু করতে নামা উইকেটকিপার মারে প্রথমে শূন্য রানে ফিরে যান। প্রথম দিনের শেষে তাদের রান ১ উইকেটে ৪। তারপরেও পরপর উইকেট পড়ে গিয়ে ১২৩ / ৪। আবার লয়েড খেললেন এক অধিনায়কোচিত ইনিংস। আর ফিরোজ শা কোটলার মাটিতে জন্ম নিলেন এক নতুন তারকা। ভিভিয়ান রিচার্ডস। চন্দ্রশেখরের অনুপস্থিতিকে পূর্ণমাত্রায় কাজে লাগালেন তিনি। প্রথম দিকে স্পিনের বিরুদ্ধে তাঁকে একটু নড়বড়ে দেখাচ্ছিল, ১২ রানের মাথায় সম্ভবত তিনি আউট ছিলেন, একটা জোরালো ক্যাচের আবেদন নাকচ হয়। কিন্তু তারপরে যে ইনিংস তিনি খেললেন তাতে বোঝাই যাচ্ছিল প্রথম টেস্টের ব্যর্থতাকে তিনি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছেন। অবিশ্বাস্য ইনিংস! ১৯২ নট আউট – যাতে ৬ ছয়, ২০টি চার। প্রায় একাই তিনি তফাৎ গড়ে দিলেন দুই দলের মধ্যে। একসময় বেশ খারাপ অবস্থায় পড়ে গিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ছয় উইকেটে ২৪৮। কিন্তু জুলিয়েন আর কিথ বয়েসের সাহায্যে তিনি টেনে নিয়ে গেলেন দলকে। ৪৯৩ রানে শেষ হল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারতের থেকে ২৭৩ রানে এগিয়ে। ১৯২ তে অপরাজিত রইলেন রিচার্ডস।

দ্বিতীয় ইনিংসে ভারত ভালই শুরু করেছিল। সুধীর নায়ক এবং কানিৎকার আউট হলেও ইঞ্জিনিয়ারের ৭৫, বিশ্বনাথের ৩৯ আর পার্থসারথি শর্মার ৪৯ রানে ভর করে এগোচ্ছিল। একসময়ে রান ছিল ২০৪, তিন উইকেটের বিনিময়ে। বিশ্বনাথ আগেই আউট হয়েছিলেন, গিবসের বলে শর্ট লেগে লয়েডের হাতে ক্যাচ দিয়ে। ইঞ্জিনিয়ার খেলছিলেন খুব স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে, পার্থসারথিও। পার্থসারথির আর ইঞ্জিনিয়ারের জুটি শতরান করে। তবে শর্মার রানিং বিট্যুইন দ্য উইকেটের দুর্বলতা ক্রমসঃ প্রকট হচ্ছিল। ইঞ্জিনীয়ার তাঁকে একটু বুঝিয়েও ছিলেন। কিন্তু হা হতোস্মি! ব্যক্তিগত ৪৯ রানের মাথায় পার্থসারথি শর্মা অর্ধশত রান পুরো করতে গিয়ে তাড়াহুড়ো করলেন – ফল রান আউট। এই রান আউট ইঞ্জিনিয়ারের মনঃসংযোগে ও চিড় ধরায়। তৃতীয় দিনের শেষে ভারত পাঁচ উইকেটে ২৩৯। কিন্তু গিবস তখন বল ঘোরাতে শুরু করেছেন। চতুর্থ দিনে বৃষ্টি হয়ে খেলা সুরু হয় লাঞ্চের পরে। পিচ ঢাকা ছিলনা, খেলার শর্তানুযায়ী। ব্যস, পিচে ক্ষতর সৃষ্টি হয়। স্বমূর্তি ধারণ করেন ল্যান্স গিবস। দ্বিতীয় ইনিংসে ছটি উইকেট তাঁর, এই ম্যাচে মোট শিকারের সংখ্যা আট। আর তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ল ভারত। ২৫৬ রানে শেষ হয়ে গেল। হার হল এক ইনিংস ও ১৭ রানে।
দিল্লির পিচে স্পিন ধরাতে ভারতের নির্বাচকদের মনে হয়ে থাকবে তাঁরা চন্দ্রশেখরকে না রেখে ভুল করেছিলেন। ভিভ নিঃসন্দেহে বিশ্বত্রাস হয়েছিলেন, কিন্তু সেইসময় তাঁর পক্ষে চন্দ্রশেখরকে মোকাবিলা করা হয়তো একটু হলেও দুষ্কর হত। বিশেষতঃ ছয় উইকেটে ২৪৮ এ তারা ধুঁকছিল, তখন চন্দ্রশেখর থাকলে ভারতের আক্রমণ আরো ধারালো হতে পারতো। পরবর্তী দুটি টেস্টে চন্দ্রশেখরের ভূমিকা ছিল খুব উজ্জ্বল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই মতামত বেশ যুক্তিযুক্ত বলা যেতে পারে।