ইন্ডিয়া – ইন্ডিজ ৭৪ -৭৫ দ্বিতীয় পর্ব

১৯৭৪ সাল একেবারে শেষের দিকে চলে এসেছে। তৃতীয় টেস্ট শুরু হবে ইডেনে, চলবে দু বছর। মানে শুরু হবে ১৯৭৪ এর ২৭শে ডিসেম্বর আর শেষ হবে ১৯৭৫ এর পয়লা জানুয়ারি।

ইডেনে প্রথম দিন –বিরাট স্লিপ বেষ্টনী

এখানে হারলেই সিরিজ হার। ৩- ০। গাভসকার সুস্থ হতে পারলেন না। তবে ফিরে এলেন পতৌদি। সুধীর নায়েক রয়ে গেলেন। বাদ পড়লেন বেঙ্কটরাঘবন, যিনি নাকি গত টেস্টে অধিনায়ক ছিলেন। এই টেস্টে দলে এলেন নবাগত অংশুমান গায়কোয়াড়, কানিৎকারের জায়গাতে। চন্দ্রশেখর দলে ফিরলেন। পার্থসারথি শর্মাও রইলেন দলে। আবিদ আলি ও সোলকারের জায়গাতে এলেন এক নতুন বোলিং জুটি – মদনলাল ও আর এক নবাগত করসন ঘাউড়ি। বলতে গেলে টীমের প্রায় খোল নলচে পালটে ফেলা হল। পতৌদির প্রত্যাবর্তন টীমকে প্রাণদান করেছিল। তিনি বোঝালেন, যদিও কঠিন প্রতিপক্ষ, তবু শক্ত হাতে মোকাবিলা করলে জয় অসম্ভব নয়।
পতৌদি টসে জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিলেন। চতুর্থ ইনিংসে বংশী মালির করা ইডেন পিচে বল ঘোরার সম্ভাবনা আছে। আর স্পিনার ত্রয়ী থাকাতে সুবিধে পাওয়ার সম্ভাবনাও রইল। কিন্তু টসে জেতার সৌভাগ্য বেশীক্ষণ রইল না। কারণ এন্ডি রবার্টস।
সুধীর নায়েক ও ইঞ্জিনিয়ার এলেন ইনিংসের সূচনা করতে। শীতকালের সকাল। ইডেনের দর্শকেরা তখনো বসার আসন ঝেড়ে ঠিকঠাক বসতে পারেননি। এন্ডি রবার্টসেরর দ্রুতগামী প্রথম বলেই ব্যাট ছুঁইয়ে ক্যাচ দিয়ে ফিরে গেলেন সুধীর নায়েক। এলেন পার্থসারথি শর্মা। কিন্তু গত টেস্টের ফর্ম দেখাতে পারলেন না।

এর পরেই আবার রবার্টসের বলে ইঞ্জিনিয়ারের বিদায়। ফল ৩২ রানে তিন উইকেট হারিয়ে বেশ বিপদেই পড়ে গেল ভারত। বীরবিক্রমে বল করছিলেন রবার্টস। যোগ্য সঙ্গত করছিলেন বার্নাড জুলিয়েন এবং ভ্যানবার্ন হোল্ডার। বিশ্বনাথ (৫২) ও পতৌদি (৩৬) মিলে কিছুটা হাল ফেরালেন, নবাগত গায়কোয়াড়ও কিছুটা সঙ্গ দিলেন (৩৬)।

পতৌদির ইনিংসে একটা দারুণ ব্যাপার ঘটেছিলো। তাঁর চোয়ালে রবার্টসের বল লাফিয়ে উঠে আঘাত করে, ফলে তাঁকে কিছুক্ষণ বাইরে থাকতে হয়। পরে ফিরে এসে তিনি রবার্টসকে পরপর চার মেরে প্রতিশোধ নেন। এটা কিন্তু ভারতীয় টীমকে বেশ সাহস যুগিয়েছিল। শেষ হাসি অবশ্যই রবার্টস হেসেছিলেন, তাঁকে বোল্ড করে।

আর এক তরুণ মুগ্ধ করলেন, তিনি মদনলাল। ৪৮ রানের এক লড়াকু ইনিংস উপহার দিলেন। তিনি ও প্রসন্ন মিলে বেশ কিছুটা টানলেন। মোটামুটি সম্মানজনক ২৩৩ রানে শেষ হল ভারতের প্রথম ইনিংস। মাত্র ৫০ রান দিয়ে পাঁচ পাঁচটি উইকেট নিলেন রবার্টস।

ব্যাট করতে নেমে কিন্তু বিশেষ সুবিধে করতে পারলো না ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ফ্রেডেরিকস শতরান করলেও আর কেউই সেভাবে তাঁকে সহায়তা করতে পারলেন না। বিগত দিল্লি টেস্টের নায়ক ভিভ রিচার্ডস পা হড়কে পড়ে গিয়ে রান আউট হলেন। ব্যাটের পর বল হাতেও সফল হলেন মদনলাল, ৪টি উইকেট নিয়ে,- ফ্রেডেরিকস, গ্রিনিজ আর কালীচরণের মূল্যবান উইকেটগুলি তাঁর ঝুলিতেই গেল। মাত্র ৭ রানে এগিয়ে ২৪০ রানে ইনিংস শেষ।
বলতে দ্বিধা নেই, এই প্রথম কিন্তু ভারত সিরিজে একটু সম্ভাবনাময় অবস্থায়। টিমের পরিবর্তনগুলো যেন ঠিকঠাক কাজে আসছিল। অভিশপ্ত ১৯৭৪ সালও শেষের দিকে। একটু হলেও আশার সঞ্চার হচ্ছিল মনে মনে। শেষ ইনিংসে বল ঘুরবে, তিন স্পিনার আছে। দ্বিতীয় ইনিংসে যদি একটু ভাল ব্যাট করা যায়!

নাঃ!! এই ইনিংসেও ব্যর্থ হলেন নায়েক। আবার ব্যর্থ শর্মাও, এবারেও রান আউট। ইঞ্জিনিয়ার আর বিশ্বনাথ বেশ খেলছিলেন, ইঞ্জিনিয়ার আউট হওয়ার পর ক্রমাগত উইকেট পড়তে শুরু করল। পতৌদি, গায়কোয়াড় এবং মদনলাল। তৃতীয় দিনের শেষে ভারতের রান ৬ উইকেটে ২০৬, ক্রিজে অপরাজিত বিশ্বনাথ, ৭৫ ও অনভিজ্ঞ কারসন ঘাউড়ি।

চতুর্থ দিনের খেলার শুরুতে ভারতীয় সমর্থকেরা আশা নিরাশাতে দুলছিলেন। অগাধ ভরসা তাঁদের বিশ্বনাথের ওপর, কিন্তু নবাগত কারসন? তিনি কি টিঁকতে পারবেন? কারসন কিন্তু টিঁকে গেলেন, এমনকি একটি ছয় মারলেন। আর অসামান্য ইনিংস খেললেন বিশ্বনাথ। সপ্তম উইকেটের জুটিতে তাঁরা যোগ করলেন অমূল্য ৯১ রান। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে বিশ্বনাথের প্রথম শতরান এল খুব প্রয়োজনীয় মুহূর্তে। ১৩৯ রানে হোল্ডারের বলে তিনি যখন আউট হন, ভারতের রান আট উইকেটে ৩০১। ভারতের ইনিংস শেষ হল ৩১৬ রানে। ৩০৯ রানের লিড।
কেউ কেউ মনে করতে পারেন, এই সময় এন্ডি রবার্টসকে লম্বা স্পেলে বল করতে না দিয়ে ভুল করেছিলেন লয়েড। বিশ্বনাথকে বেশ বিড়ম্বনাতে ফেলেছিলেন রবার্টস। আবার পরে রবার্টস এসেই আউট করেন কারসনকে।
বিশ্বনাথের এই ইনিংস ভারতীয় দলের মনোবল অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল। এই প্রথম ভারতীয় ব্যাটিং ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুরন্ত পেস বোলিংকে ঠিকমতো মোকাবিলা করতে পারলো।
বিশ্বনাথের এই অনবদ্য ১৩৯কে শতাব্দীর সেরা এক ইনিংস বলে আখ্যা দিয়েছিলেন মতি নন্দী। প্রতিবেদনে লিখেছিলেন-

দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নামলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। মাত্র পাঁচ রানে প্রথম উইকেট। দুরন্ত ফর্মে থাকা গ্রিনিজকে ফেরাতেই যেন গর্জে উঠল ইডেন গার্ডেনস। কিছুক্ষণ বাদে চলে গেলেন প্রথম ইনিংসের শতরানকারি রয় ফ্রেডেরিকস। কিন্তু রিচার্ডস আর কালীচরণ কিন্তু দিব্যি খেলে যাচ্ছেন। দিনের একেবারে শেষের দিকে মদনলালের বলে বোল্ড হলেন রিচার্ডস।
৩১শে ডিসেম্বর, ১৯৭৪। বছরের শেষ দিন। চতুর্থ দিনের শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩ উইকেটে ১৫৬। ৪৮ রানে অপরাজিত কালীচরণকে খুব আত্মবিশ্বাসী লাগছিল। সঙ্গে লয়েড। তাই সেই সন্ধ্যাতে বর্ষশেষের উৎসবের মধ্যেও খচখচে কাঁটা বিঁধে রইল সকলের মনে। নতুন বছর, ১৯৭৫, কিভাবে শুরু করবে ভারতবাসী? চোখে জল না মুখে হাসি?

ভালই শুরু করলেন লয়েড ও কালীচরণ। বল হাতে চন্দ্রশেখর এলেন, তিনি দুর্দান্ত হয়ে উঠতে পারেন জেনে তাঁকে তো বেশভালমতোই প্রহার করলেন লয়েড। পতৌদি কিন্তু নাছোড়, অটল বিশ্বাস তাঁর চন্দ্রশেখরের ওপর। আবার তাঁকে ডাকলেন, ফলও পেলেন হাতে নাতে। ব্যাট ও প্যাডের ফাঁক খুঁজে নিয়ে চন্দ্র বোল্ড করলেন লয়েডকে।
আশায় নেচে উঠেছে ইডেন, কিন্তু এখনো কালীচরণ আছেন, আছেন জুলিয়েনের মত অলরাউন্ডার, মারের মত উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান। কিন্তু আবার ত্রাতা হলেন চন্দ্রশেখর।

বিধ্বংসী চন্দ্রশেখর

এবারে তাঁর বলেই স্লিপে বিশ্বনাথের হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট হলেন কালীচরণ। ব্যস, সব্বাই ভাবতে শুরু করল নববর্ষ সত্যিই সুসংবাদ নিয়ে আসছে ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য। তখনো ১৩১ রান বাকি, মোটামুটি সব প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যানরাই প্যাভিলিয়নে। এরপরে বেদী ও চন্দ্র যৌথভাবে ২২৪ রানে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে শেষ করে দিলেন। জয় এল ৮৫ রানে।

জয়ের পর ইডেনের ছবি

সব্বাই একমত হলেন যে ভারত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে সর্বাধিক কৃতিত্বের ভাগীদার গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ। দুই ইনিংসে তাঁর সর্বমোট রান ১৯১ যা ভারতীয় রক্ষণকে মজবুত করেছিল। চন্দ্র ও বেদীর স্পিনের আক্রমণ ও পর্যুদস্ত করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজকে।
আগেই দেখেছি আমরা ১৯৭৪ সাল শুধু ওয়াদেকরের নয়, ভারতেরও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একটি খারাপ বছর বলে চিহ্নিত। ১৯৭৫ এর প্রথম দিন তাই এক উজ্জ্বল আশা নিয়ে এল।

আরো আশার কারণ ছিল। পরের টেস্ট হবে তখনকার মাদ্রাজ, অধুনা চেন্নাইতে। চীপকের পীচ বরাবর স্পিনারের অনুকূলে। বেদী, প্রসন্ন, চন্দ্রশেখর ত্রয়ী বেশ ফর্মে আছেন। বিশ্বনাথ, ইঞ্জিনিয়ার, পতৌদি ও মনে হচ্ছে রানের মধ্যে ফিরছেন। আর সুনীল গাভাসকার যদি ফেরেন, শুরুর সমস্যাও মিতে যাবে। কাজেই বেশ আশা নিয়েই চীপকে এসে উপস্থিত হল উদ্দীপ্ত ভারতীয় দল।

জানুয়ারির ১১ তারিখে শুরু হল চতুর্থ টেস্ট। ইতিমধ্যে একটি ম্যাচে পূর্বাঞ্চল কে ইনিংসে হারিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজও বেশ দৃপ্ত। ভারতীয় টীমে কিন্তু গাভাসকার ফিরতে পারলেন না, চেন্নাইতে প্র্যকটিশের সময় আবার আহত হলেন। সুধীর নায়েক বাদ পড়লেন, দলে এলেন একনাথ সোলকার। পার্থসারথি শর্মার জায়গাতে দলে এলেন অশোক মানকাদ। আগের চারটি ইনিংসের দুটিতে ভাল খেলেছিলেন পার্থসারথি শর্মা, শুধুমাত্র ইডেনের ব্যর্থতাতে তাঁকে বাদ দেওয়াটা একটু দৃষ্টিকটু। তবে তাঁর শ্লথ গতি (দুটি পরপর রান আউটের উদাহরণ) ও খারাপ ফিল্ডিং ও হয়তো কিছুটা দায়ী থাকবে।
সিরিজ হারের ভাবনা কিন্তু তখনো মাথায় ঝুলছে। এই টেস্ট হারলেই শেষ। এবারেও পতৌদি টসে জিতে গেলেন। চতুর্থ ইনিংসের কথা মাথায় ব্যাটিং নিলেন, কিন্তু অবস্থা আরো খারাপ হল।
দুর্দান্ত বল করলেন এন্ডি রবার্টস। একে একে সব ভারতীয়রাই বিদায় নিলেন। বিশ্বনাথ যখন ব্যাট করতে এলেন ভারতের রান ৪ উইকেতে ৪১। কিন্তু তখনো দুরবস্থা শেষ হল না, মধ্যাহ্নভোজনের সময় ভারতের রান দাঁড়াল, ৭৬ / ৬।
বিষেণ সিং বেদী যখন ব্যাট করতে আসেন, তখন রান ছিল ১১৭ / ৮। বেদীকে ক্রিজে নিয়ে মাত্র ৪৩ মিনিটে বিশ্বনাথ জুড়েছিলেন ৫২ রান যার মধ্যে বেদীর মাত্র ১৪। বেদী নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন, যে অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তাঁর এরকম একটি অনির্বচনীয় ইনিংস দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। এমনকি শেষ উইকেটে চন্দ্রশেখরকে নিয়ে তিনি যোগ করলেন ২১ রান। এর মধ্যে চন্দ্র করেছিলেন মাত্র একটি রান। যতই খেলা গড়াতে লাগলো এই রানগুলির মাহাত্ম্য বোঝা যেতে লাগলো। মাত্র ১৯০ রানে ভারতীয় ইনিংস শেষ হল, তার মধ্যে বিশ্বনাথের রান অর্ধেকেরও বেশী। তাঁর পর দ্বিতীয় স্থানে অশোক মানকাদ – ১৯। এন্ডির সংগ্রহ ৭ উইকেট, বিনিময়ে ৬৪ রান।

ক্রীড়া সাংবাদিক রাজু ভরতন এই ইনিংস সম্পর্কে বলেছেন, “ক্লাস, ক্লাস, সিয়ার ক্লাস!” ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সঙ্গে সফররত সাংবাদিক টনি কোজিয়ার লিখলেন,

উপরোক্ত অনুচ্ছেদটিতে প্রাণবন্ত বিবরণ আছে কিভাবে বিশ্বনাথ দুর্দমভাবে এন্ডির মোকাবিলা করেছিলেন। নিজের দেশের শ্রেষ্ঠ ফাস্ট বোলারের ওপর আধিপত্য বিস্তারের যে বন্দনা কোজিয়ার করেছেন, বিশ্বনাথের ব্যাটিং প্রতিভার তা উজ্জ্বলতম সাক্ষ্য।

চেন্নাই (তৎকালীন মাদ্রাজ) এর চীপক স্টেডিয়ামে বিশ্বনাথের ঐতিহাসিক ইনিংস

বিশ্বনাথের এই ইনিংস সম্পর্কে বেশ কিছু গল্প আছে। বিশ্বনাথ যতক্ষণ ব্যাট করছিলেন অধিনায়ক পতৌদি নাকি সিগারেট খেয়ে চলেছিলেন টেনশন কাটাতে। ইনিংস শেষ হবার পরও রাজ সিং ডোঙ্গারপুর বিশ্বাস করতে পারছিলেন না এরকম অবিশ্বাস্য এক ইনিংস তিনি চোখের সামনে দেখলেন। পতৌদি নিশ্চয় খুব খুশীই হয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালে ২০ বছরের প্রায় কিশোর এই ছেলেটিকে প্রায় জোরজার করেই তিনি দলে নেন, আজ ফল তিনি পাচ্ছেন হাতে নাতে।
ইদানীং আক্রমণাত্মক শারীরিক ভাষা এবং চরিত্র নিয়ে অনেক কিছু কথা শোনা যায়। অস্ট্রেলিয়া নাকি এই জন্যই ক্রিকেটে অনেক অগ্রগতি করেছে। তার মধ্যে নিশ্চয় কিছু সত্যতা থাকবে, তবে বিশ্বনাথের এই ইনিংসটিতেও অদম্য আক্রমণ ছিল, তিনি রবার্টসেরর বিষদাঁত ভেঙে ভারতকে মনোবল যুগিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর হাবভাব বা শারীরিক ভাষায় তা আদৌ প্রকাশ পায়নি। সব আক্রমণ কেন্দ্রীভূত ছিল তাঁর ব্যাটে। আজকের তরুণ প্রজন্মের অনেকের এই ইনিংস থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।

ব্যাট করতে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজও কিন্তু সুবিধে করতে পারছিল না। পরপর চার উইকেট হারিয়ে বেশ বিপদে পড়ে গেলে হাল ধরলেন রিচার্ডস ও লয়েড। খুব সুবিধে হল না, তাতেও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২০০ পৌঁছতে পারলো না। ভারতের থেকে মাত্র ২ রান এগিয়ে ১৯২ রানে শেষ হল তাদের প্রথম ইনিংস। প্রসন্ন ৫টি, বেদী ৩টি উইকেট নিয়ে গুঁড়িয়ে দিলেন প্রায় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। এবারে দ্বিতীয় ইনিংসে যদি কিছু করা যায়, তাহলে শেষ দিনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিপদে পড়ে যাবে।

হা হতোস্মি!! আবার যেন প্রথম ইনিংসের ছায়া – প্রথম উইকেট ৪০ রানে পড়লেও কিছুক্ষণের মধ্যেই ৮৫ / ৫। এবারে বিশ্বনাথকে যোগ্য সঙ্গ দিলেন গায়কোয়াড়, বিশ্বনাথ ৪৬ রানে আউট হবার পরও গাভরি আর গায়কোয়াড় মিলে বেশ প্রতিরোধ দিলেন। সব মিলিয়ে উঠল, ২৫৬ রান। জেতার জন্য লক্ষ্য রইল ২৫৪ রান।

এতক্ষণে চেন্নাই পিচ বেশ সজীব হয়ে উঠেছে। আবার পতৌদির সেই অলৌকিক নির্ভরতা স্পিনার ত্রয়ীর ওপর। তাঁরা তাকে হতাশ করলেন না। যেন ইডেনের শেষদিনের পুনর্নির্মাণ! নিয়মিত হারে উইকেট পড়তে লাগলো ওয়েস্ট ইন্ডিজের, প্রসন্ন (৪), বেদী (৩) ও চন্দ্রর (২) মুখ তুলে দাঁড়াতেই দিলেন না সফরকারী দলটিকে। মাত্র ১৫৪ রানে ফুরিয়ে গেল তারা, ১০০ রানের ব্যবধানে।
আবার দুই ইনিংস মিলিয়ে বিশ্বনাথের সর্বোচ্চ – ১৪৩। এখন যদি পরপর দুটি টেস্টে এরকম কেউ খেলতেন, কি সাঙ্ঘাতিক হৈ চৈ যে হত!! কত রকম মিডিয়া কভারেজ। একদিক থেকে ভালই ছিল। এই গণ্ডগোলের থেকে দূরে থেকেই নিজেদের কাজটা তাঁরা নির্বিঘ্নে করতে পারতেন।

পরের লক্ষ মুম্বাই।
সিরিজ ২ – ২। সুতরাং পঞ্চম টেস্ট হবে নির্ণায়ক। সবাই মেনে নিলেন অধিনায়ক হিসেবে পতৌদি ভারতীয় দলকে উজ্জীবিত করতে পেরেছেন। বিজয় মার্চেন্ট বললেন, “পতৌদির নেতৃত্বে অভূতপূর্ব লড়াই করে আবার নিজের সমতায় ফিরিয়ে এনেছে ভারতীয় দল। এরকম প্রত্যাবর্তন অবিশ্বাস্য – বিশ্বনাথের অসাধারণ ব্যাটিং, স্পিনারদের সাফল্য এবং সর্বোপরি পতৌদির নির্ভীক অধিনায়কত্বেই এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছে।” মনে রাখতে হবে এই বিজয় মার্চেন্টই কিন্তু পতৌদিকে অধিনায়ক পদ থেকে অপসারিত করার মূলে ছিলেন। কাজেই তাঁর এই স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দন সত্যিই স্মরণীয়।

সিরিজ ২ – ২,  যে স্টেডিয়ামে খেলা হবে তাও নতুন। দীর্ঘদিনের ব্র্যাবোর্ন স্টেডিয়ামের বদলে এবারের টেস্ট খেলা হবে ওয়াংখাড়ে স্টেডিয়ামে। এই সিরিজে বেশ কিছু নতুনত্বের মত এও এক। ছ দিনের টেস্ট রাখার সিদ্ধান্তটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ভারত ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ দু দলই চাইছিলেন সিরিজের বেশ জমজমাট নিষ্পত্তি হোক।

টেস্ট শুরুর আগেই বহু প্রত্যাশিত সুখবর এসে গেল। সুনীল গাভাসকার পুরোপুরি সুস্থ হয়ে এবারে খেলতে পারবেন। তিনিই শুরু করবেন ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। বাদ গেলেন অশোক মানকাদ।

প্রথম টেস্টের পর বাদ পড়েছিলেন ব্রিজেশ প্যাটেল।  চীপক ও ওয়াংখাড়ে টেস্টের মাঝে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল রঞ্জী চ্যাম্পিয়ন কর্ণাটকের সঙ্গে একটি ম্যাচ খেলেছিল, আমেদাবাদে। সেই ম্যাচে দুই ইনিংসেই ভাল খেলেছিলেন ব্রিজেশ প্যাটেল। মদনলালকে সরিয়ে তিনি এবার এলেন দলে।

ওয়াদেকরের তুলনাতে অধিনায়ক হিসেবে পতৌদি কত অন্যরকম তা নিয়ে অনেক তর্ক চলতে পারে। কিন্তু তাঁর তুলনাতে পতৌদির টসভাগ্য অনেক ভাল। এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে একেবারে শেষ টেস্টে টসে জিতলেন লয়েড এবং ব্যাটিং নিলেন। সিরিজের মোড় ফেরানোর জন্য এই টস জয়ের ভূমিকা থাকবে। লয়েড যদি টসে হারতেন আর ভারত যদি প্রথমে ব্যাট করত, লয়েডের কাছে আগের দুটি টেস্টের চতুর্থ ইনিংসের দুঃস্বপ্ন ভিড় করে আসতো নিশ্চয়। কারণ, আগের দুটি টেস্টেই চতুর্থ ইনিংসে নিধন হয়েছেন লয়েড বাহিনী। উপরন্তু এই স্টেডিয়াম আবার নতুন! পিচ কদিন টিকবে বলা মুশকিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যানেজার জেরি আলেকজান্ডার পিচ নিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁর আপত্তি জানান। পিচ নাকি “অপ্রস্তুত”!! কিন্তু তা যে ভুল তা পরে প্রমাণিত হয়ে যায়।

ভারতীয় স্পিনাররা এই উইকেটে একেবারে সুবিধে করতে পারছিলেন না। বিষেণ সিং বেদী কোমরের ব্যথায় কাবু হয়ে পড়েছিলেন, তাঁকে অনেকক্ষণ মাঠের বাইরে থাকতে হয়। ফিরে এসেই অবশ্য তিনি ফর্মে থাকা শতরানকারি রয় ফ্রেডেরিকসকে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু ভারতীয় স্পিনাররা সম্ভবত ক্লান্ত ছিলেন বা পিচ থেকে ঠিক সুযোগ না পাওয়াতে কার্যকরী হতে পারছিলেন না। এর ওপর তিন তিনবার লয়েড জীবন ফিরে পান ফিল্ডিং দাক্ষিণ্যে। কালীচরণের ক্যাচ মিস করেন গাভরি, তিনি ৯৮ রান করে গেলেন। সব মিলিয়ে, প্রথম দিন খুব হতাশায় কাটলো ভারতীয়দের। দিনের শেষে গ্রিনিজ, ফ্রেডেরিকস আর কালীচরণের উইকেট হারিয়ে ৩০৯।

দ্বিতীয় দিনের প্রথম ওভারেই যখন লয়েডের ক্যাচ ছাড়লেন ভারতের শ্রেষ্ঠ ফিল্ডার সোলকার, তখনই বোঝা যাচ্ছিল সর্বনাশ হতে চলেছে। এরপরে আর তাঁকে ঠেকানো যায়? দ্বিতীয় দিনেও অনেকক্ষণ ব্যাট করল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এর মধ্যে আবার লয়েডের অধিনায়কোচিত অপরাজিত ডবল সেঞ্চুরি ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিতে চলল। এটি ছিল টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর প্রথম ডবল সেঞ্চুরী। লয়েডের ডবল সেঞ্চুরিতে মুগ্ধ এক দর্শক লয়েডকে অভিবাদন জানানোর জন্য দৌড়তেই পুলিশরা উত্তেজিত হয়ে তাকে ধাওয়া করে ধরে ফেলে প্রবল পিটুনি দেয়! মাঠে আগুন জ্বলে উঠল, একেবারে আক্ষরিক অর্থেই। প্রায় নব্বই মিনিট খেলা বন্ধ থাকলো। দ্বিতীয় দিনের শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান ছিল ৫২৮, পাঁচ উইকেট হারিয়ে। পরের দিনেও মেরে খেলতে থাকলেন লয়েড, এমনকি উইকেটকিপার ডেরেক মারেও। তৃতীয় দিনে মারের শতরানের অপেক্ষা করছিলেন লয়েড। ৯১ রানে তিনি আউট হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ইনিংস ঘোষণা করেন তিনি ৬ উইকেটে ৬০৪ রানের মাথায়।

অনেকদিন পর গাভাসকার আবার ইনিংস শুরু করলেন ইঞ্জিনিয়ারকে সাথে নিয়ে। ইঞ্জিনিয়ার শূন্য রানে ফিরে গেলেও খুব ভাল খেলছিলেন একনাথ সোলকার এবং গাভাসকার। খেলা শেষ হতে মাত্র মিনিট পাঁচেক বাকি, ৮৬ রানের মাথায় গাভাসকর বোল্ড হলেন ল্যান্স গিবসের বলে। মাত্র দু ওভারের মত বাকি ছিল, তাড়াহুড়ো করে শতরান পূর্ণ করার আশায় উইকেটটা জলাঞ্জলি দিলেন। এই উইকেটের মূল্য বেশ ভালই চোকাতে হয়েছিল ভারতকে।
পরের দিন সোলকার তাঁর জীবনের একমাত্র শতরানটি পূর্ণ করলেন। তারপরেও ছন্দে খেলতে লাগলো ভারত সোলকার আর নাইট ওয়াচম্যান প্রসন্ন আউট হয়ে গেলেও ভালই ইনিংস এগোচ্ছিল। বিশ্বনাথ যেন আবার একটি দুর্দান্ত ইনিংস খেলতে যাচ্ছিলেন। মাত্র ৪ উইকেট হারিয়ে যখন তাঁরা ৩৫০ রানের গণ্ডী পার হয়ে গেলেন, মনে হচ্ছিল সহজেই ফলোঅন (৪০৫) বেঁচে যাবে। বিশ্বনাথ ও এগোচ্ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে তাঁর দ্বিতীয় শতরানটির দিকে। এবারে সঙ্গীর সমস্যা নেই, গায়কোয়াড় ভালই সঙ্গ দিচ্ছেন।
বাধ সাধলেন লয়েডের তুতো ভাই ল্যান্স গিবস। যে পিচে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছিলেন ভারতের তিন স্পিনার, সেখানে তিনি বিধ্বংসী ভূমিকা নিলেন। বিশ্বনাথ গেলেন ৯৫ রানে, এরপরেতে একে একে প্যাটেল, গায়কোয়াড় ও পতৌদি। ফলো অন বাঁচানো যাবে কিনা খুব সন্দেহজনক হয়ে উঠলো, শেষমেশ গাভরি আর বেদী সেই কাজ সমাধা করলেন। গিবসের দখলে ৭ উইকেট।

১৯৮ রানে এগিয়ে থেকে বিধ্বংসী ব্যাটিং করল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। যে পিচে গিবস এত কার্যকরী হচ্ছিলেন, সেই পিচেই আবার বেদম পিটুনি খেতে লাগলেন ভারতীয় স্পিনাররা। বেদী, প্রসন্ন এত মার খেলেন যে ভয়ে আর চন্দ্রশেখরকে ডাকতেই পারলেন না পতৌদি। রিচার্ডস মাত্র আধঘণ্টা খেলে করলেন ৩৯, লয়েড বেধড়ক পিটিয়ে করলেন ৩৭। মাত্র চল্লিশ ওভারে ২০৫ রান করে ইনিংস ঘোষণা করলেন লয়েড। ভারতের সামনে জয়ের লক্ষ ৪০৪ রান। এটি পঞ্চম দিন, খেলা ছয় দিনের অতএব হাতে আছে এখনো প্রায় পুরো দেড় দিন।
একই চিত্রনাট্য যেন বারংবার অভিনীত হচ্ছিল এই সিরিজে। ব্যাঙ্গালোর, দিল্লি, কলকাতা, চেন্নাই – প্রথম ইনিংসে ভারত – ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রায় পাল্লা দিয়েছিল সমানে সমানে। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাঙ্গালোর, দিল্লীতে এগিয়ে ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আর কলকাতা, চেন্নাইতে – পতৌদি বাহিনী। এখানেও যেন প্রথম দুই টেস্টের পুনরাবৃত্তি। দ্বিতীয় ইনিংসে আবার বিপর্যয়। শুরুতেই আবার শূন্য হাতে ফিরলেন ইঞ্জিনিয়ার। আগুনের গতিতে বল করছিলেন রবার্টস। অচিরেই গাভাসকর বধ হলেন। সবচেয়ে বড় বিপদ, যাঁর ওপর সবচেয়ে বেশী ভরসা ছিল সেই ত্রাতা বিশ্বনাথও হোল্ডারের একটি চমৎকার বলে বোল্ড হলেন। পঞ্চম দিনের শেষে ভারতীয় দল দাঁড়িয়েছিল ৩ উইকেটে ৫৩ রানে। বোঝাই যাচ্ছিল যে ভারতের বাঁচার আশা ক্ষীণ।

ভারতের ইনিংসকে সম্মানজনক অবস্থাতে পৌঁছে দিয়েছিলেণ কর্নাটকি তরুণ – ব্রিজেশ প্যাটেল। তাঁর অপরাজিত ৭৩রান ছিল একমাত্র সম্মানজনক ব্যক্তিগত অবদান। একটি মজার ঘটনাও ঘটেছিল। ব্রিজেশের এই ইনিংসে মুগ্ধ হয়ে এক তরুণী তাঁকে চুম্বন করার জন্য দৌড়ে ছিলেন। পুলিশ তাকে তাড়া করে, ধরে ফেলার আগেই তিনি অবশ্য শুভকাজ সম্পন্ন করেন।

দুই কর্তৃপক্ষ যে ৬ দিন খেলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা যে সত্যিই কাজের ছিল বোঝা গেল যখন ষষ্ঠদিনেই লাঞ্চের আগেই খেলার ফয়সালা হল। অধিনায়ক হিসেবে জীবনের প্রথম সিরিজে বিজয়ী হলেন ক্লাইভ লয়েড। এই সিরিজ জয়ে ব্যাটসম্যান হিসেবেও তাঁর উজ্জ্বল ভূমিকা ছিল।
১৯৬৬ – ৬৭র সিরিজে তাঁর টেস্ট জীবন শুরু হয় ভারতেই। সফল হয়েছিলেন। সাত বছর পরে আবার তাঁর অধিনায়ক জীবন শুরু হল সে ভারতেই, একই রকম সফলভাবেই। শুধু অধিনায়ক রূপে নয়, ব্যাট হাতেও তিনি চূড়ান্ত সফল।

এই সিরিজ থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিন্তু ঝুলি ভরে অনেক কিছু নিয়ে গেল।

ও:ইন্ডিজে চার তারকার জন্ম হল যাঁরা আগামী দশ বছর রাজত্ব করবেন – রবার্টস, গ্রিনিজ, কালীচরন, রিচার্ডস। অধিনায়ক লয়েড তাঁর জয়যাত্রা শুরু করলেন এই সিরিজ দিয়েই। ওঃ ইন্ডিজ ক্রিকেটে শেষ বারের মত স্পিন বোলিং এর আধিপত্য দেখল। এন্ডি রবার্টসের নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস বোলিং এর আধিপত্যের শুরু হল। পরে পরেই এসে গেলেন হোল্ডিং, গার্নার আর ক্রফট। ১৯৭৫ এ ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের স্থপতি তাঁরাই। তারপরে মার্শাল, বিশপরা।

বিশ্বত্রাস ওয়েস্ট ইন্ডিজ পেস বোলিং

ভারতীয় ক্রিকেটে পতৌদি যুগের অবসান। মুম্বাই টেস্টের দুই ইনিংসেই করা ৯ আর ৯ রান যেন তাঁকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল, “নয় নয় এ মধুর খেলা”!! শেষ পাঁচটি ইনিংসে তাঁর রান কখনোই দুই অঙ্কে পৌঁছতে পারেনি। স্বভাবতই তিনি অবসর ঘোষণা করলেন।

হেরে গেলেও ভারত কিন্তু খুব বড় লড়াই করেছিল। তখন গাভাসকারকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ওপেনিং ব্যাটসম্যান বলা হত। তাঁর অভাবে ভারতের সূচনা প্রত্যেক টেস্টে খুবই খারাপ হত।

রাজিন্দর গোয়েল, ভাগ্য যাঁর সহায় ছিল না

এছাড়া ভারতের দুর্বলতা ছিল টীম নির্বাচনে। প্রথম টেস্টে বেদীকে ও দ্বিতীয় টেস্টে চন্দ্রশেখরকে বাদ দেওয়া মোটেই সমীচীন ছিলনা। রাজিন্দর গোয়েলকে প্রথম টেস্টে দলে রেখেও খেলানো হলনা। আশ্চর্যজনক ব্যাপার! রাজিন্দরের অসামান্য সাফল্য ছিল রণজীতে, তখন তিনি পুরোপুরি ফর্মে। কিছুদিন আগের দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রাজিন্দর জানিয়েছেন যে তিনি প্রায় নিশ্চিত ছিলেন যে ব্যাঙ্গালোর টেস্টে তিনি খেলছেন, কিন্তু আগের দিন রাত্রে জানতে পারেন তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত নয়। তিনি বলেন তাঁর জন্ম হয়েছিল ভুল সময়ে। আমরা একমত।

তিনি যদি ভাল বল করে ভারতকে জেতাতেন তাহলে আর বেদীকে ফেরানো জেতনা – এটাই কি যুক্তি? কোনটা বড় – ভারতের জয় না বেদীর প্রত্যাবর্তন? এতই যদি বেদী নির্ভর তাহলে তাঁকে তো একটা ওয়ার্নিং দিয়ে প্রথম টেস্টে রাখা যেত। দ্বিতীয় টেস্টে তাঁকে অধিনায়ক করা যেত, পতৌদি ও গাভাসকারের অনুপস্থিতিতে। চন্দ্রশেখরকে বাদ দিতে হত না।

  • দ্বিতীয় টেস্টের দিন সকালে অবধি কেউ জানে না, কে অধিনায়ক?
  • পঞ্চম টেস্টে গাভরী চার উইকেট নিয়েছিলেন, সঙ্গে মদনলালকে পেলে তাঁর আক্রমণ আরো জোরদার হতে পারতো।
  • পার্থসারথি শর্মা একটি টেস্টে খারাপ খেলেই বাদ পড়ে গেলেন।
  • প্রথম টেস্টের পর আবার পঞ্চম টেস্টে দলে ফিরলেন ব্রিজেশ প্যাটেল।
  • এত বেশী পরিবর্তন টীমের পক্ষে হজম করা খুব মুশকিল। প্রত্যেক টেস্টে ব্যাটিং অর্ডার পাল্টাচ্ছে। এখন আমরা ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে এত চিন্তা ভাবনা করি, তখন তো সেরকম কিছু ছিল না। ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিন্তু প্রায় এক টীম নিয়ে লড়ে যাচ্ছে। এইরকম অবস্থায় টীমের কি আর সেরকম সদর্থক মনোভাব আশা করা যেতে পারে!
অজিত ওয়াদেকর

আমাদের মতে, আরো একটি বিশেষ কারণ ছিল, ওয়াদেকরের প্রতি বোর্ডের নির্মম আচরণ। ০ – ৩ এ যে দল হেরেছিল, তাতে তো অনেকেই ছিলেন যাঁরা আশানুরূপ খেলতে পারেননি, তাহলে ওয়াদেকরের ওপর খাঁড়ার ঘা কেন? সাম্প্রতিক কালে ০-৮ এ হেরেও তো বহাল ছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। আর, অধিনায়কত্ব ছাড়লেও তিনি দলে থাকতে পারতেন, ৩ নম্বর স্থান নিয়ে একটু নিশ্চিন্ত থাকা যেত, যেমন ৪ নম্বরে নিশ্চিত ছিলেন বিশ্বনাথ। স্লিপে ফিল্ডার হিসেবেও তিনি খুবই নির্ভরযোগ্য ছিলেন।

আমরা সকলেই জানি ব্যাটিং অর্ডারে ৩ নম্বর স্থানটি কিরকম গুরুত্বপূর্ণ। সেই সিরিজে ঐ স্থানটিতে কোন স্থায়ী ব্যাটসম্যান ছিল না, শুধু পরীক্ষা নিরীক্ষাই হয়ে গেল। হেমন্ত কানিৎকার, একনাথ সোলকার, পার্থসারথি শর্মা, অংশুমান গায়কোয়াড়, অশোক মাকড়, – সবাইকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করা হল। ৪ নম্বর স্থানটিতে বিশ্বনাথ ব্যাটিং এ প্রায় একাই হাল ধরেছিলেন, কারণ গাভাসকার আহত ছিলেন। ০-২ তে পেছিয়ে পড়ে ২-২ হয়েও আবার ৩-২তে হেরেছিল ভারত। এই সময়ে ৩ নম্বরে ওয়াদেকর থাকলে ব্যাটিং অনেক স্থায়িত্ব পেত। দ্বিতীয় টেস্টে আহত পতৌদির জায়গাতে তিনি অধিনায়কত্ব করলে দল কিছুটা দিশা পেত। তৃতীয় টেস্টে পতৌদি স্বমহিমাতে ফিরে আসেন। টীমকে বোঝান যে তারা জিততে পারে এবং আহত অবস্থায় এন্ডি রবার্টসকে পরপর চার মেরে সাহস যোগান। সেই সময় খেলার মোড় ঘোরে। দ্বিতীয় টেস্টে যদি তিনি অনুপস্থিত না থাকতেন, হয়তো ফলাফল অন্যরকম হত।

গতস্য শোচনা নাস্তি। এই সিরিজের পর ভারতের ব্যাটিং এর মূল স্থপতি হিসেবে গাভাসকার ও বিশ্বনাথের নাম স্থায়ী হয়ে গেল। পরবর্তী প্রায় ৬-৭ বছর তাঁরা দুজনেই ছিলেন মূল স্তম্ভ। স্পিনার ত্রয়ীও একই ভাবে রইলেন বোলিং এর পুরোভাগে। মদনলাল ও কারসন গাভরির মাধ্যমে ভারতের এক নতুন মিডিয়াম পেস জুটির সম্ভাবনা দেখা দিল। তবে কপিলদেব নিখাঞ্জর মত প্রতিভা যদি তাঁদের একজনেরও থাকতো, পাল্লা ভারতের দিকে ঝুঁকে যেত।

পাওনা গণ্ডার কথা বাদ দিলেও যেভাবে ভারত ০-২ থেকে ফিরে এসে ২ – ২ করে প্রায় জেতার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল, সেটাই এই সিরিজের এক বিরাট প্রাপ্তি। আর একটি ব্যাপার উল্লেখ করা প্রয়োজন। এই সিরিজে প্রসন্ন, চন্দ্রশেখর, বিশ্বনাথ, এবং ব্রিজেশ প্যাটেল – চারজন কর্ণাটক খেলোয়াড়ের নিয়মিত উপস্থিতি কর্ণাটকের ক্রিকেটকে মজবুত করলো। পরবর্তীকালে আমরা কর্ণাটকের যে দাপট ভারতীয় ক্রিকেটে দেখেছি তার শুরু সম্ভবত এই সিরিজেই।

চার কর্ণাটকি – রনজি জয়ের মূল স্থপতি

এর আগে অনুরূপ উপস্থিতি থাকত বোম্বের খেলোয়াড়দের। আগেই বলা হয়েছে, ১৯৭৪ সালে প্রথমবার প্রসন্নর নেতৃত্বে তারা রঞ্জী জয় করে। এর পরে আজ অবধি তারা প্রায় আটবার রঞ্জী ট্রফি জয় করেছে। সেই হিসেবে কর্ণাটকের কাছে এই সিরিজ নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। KSCA প্রতিষ্ঠা ও ব্যাঙ্গালোরে টেস্ট খেলার শুরু হওয়াতে তা তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে নিঃসন্দেহে খুব উৎসাহিত করে থাকবে। তাই এর পর কর্ণাটক ভারতীয় ক্রিকেটকে একের পর এক ক্রিকেটার দিয়ে চলল।

সব কিছুকে ছাড়িয়ে এই সিরিজে অতুলনীয় অবদান রেখে গেলেন পাঁচ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার ছোটখাটো এক কর্ণাটকি ক্রিকেটার – গুন্ডাপ্পা রঙ্গনাথন বিশ্বনাথ। ইডেন ও চীপকে ধ্বসের মুখে তাঁর প্রবল প্রতিরোধ ভারতীয় টিমকে নতুন ভাবে লড়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। ঐ শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে প্রায় একাই সিরিজ রক্ষা করতে চলেছিলেন তিনি। শেষ টেস্টের প্রথম ইনিংসে যদি তিনি ৯৫ রানের সঙ্গে আরো কিছু রান যোগ করে আর একটু দাঁড়িয়ে যেতেন, খুব সম্ভাবনা ছিল শেষ টেস্ট ড্র করে ভারতের কাছে ৭০ – ৭১ এ অর্জিত রাবারটি রেখে দেওয়ার। গাভাসকরও তাঁর যোগ্য সঙ্গ দিতে পারতেন। আর তিনে যদি থাকতেন ওয়াদেকর? তিনি কি একটু গভীরতা আনতে পারতেন? তাহলে বিশ্বনাথ চার নম্বরে আরো বেশী প্রত্যয়ী হয়ে আরো বেশী কিছু রান রাখতে পারতেন।

যদির কথা নদীর পারে। না হলেও, সমগ্র ভারতের ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে বিশ্বনাথের জায়গা পাকাপাকি হল এই সিরিজ থেকেই। যদিও পরে অনেক সিরিজে, অনেক টেস্টে তিনি ভারতের রক্ষাকর্তা রূপে দেখা দেবেন, নিঃসন্দেহে এই সিরিজেই তাঁর সর্বোত্তম প্রদর্শন।

প্রখ্যাত ক্রীড়া সাহিত্যিক শ্রী অরুণ আইন এক কিশোর পত্রিকার ১৯৭৫ সালের জানুয়ারী মাসে একটি অনু উপন্যাসই লিখে ফেলেন – ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচ’। শেষ করছি তার শেষাংশ দিয়েই।

সিরিজের রাজা – গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথ
  1. Days Well Spent: A Cricketing odyssey – Rajan Bala
  2. Sunny Days – An Autobiography – Sunil Gavaskar
  3. Straight Drive – Sunil Gavaskar
  4. Spin Punch – Dilip Doshi
  5. Twenty Years at the Top – by Sir Donald Bradman and Gary Sobers
  6. Sir Vivian: The Definitive Autobiography –
  7. India’s captains – Partap Ramchand
  8. শারদীয়া আনন্দমেলা – ১৯৭৪
  9. Cricinfo – Articles and statistics of 1974 – 75 Series
  10. Indian Cricket: A Complete History (1976) – N. S. Ramaswami
  11. Wisden Cricket Almanac – 1970 – 1974
  12. কিশোর ভারতী – বিশেষ পৌষালী সংখ্যা – জানুয়ারী, ১৯৭৪

Leave a comment