অক্টোবর
সুজিত সরকার পরিচালক হিসেবে আমার বেশ প্রিয়। প্রথম ছবি “ভিকি ডোনর” থেকেই তাঁর ভাবনা বেশ ব্যতিক্রমী। পরের দুটি ছবি ম্যাড্রাস কাফে এবং পিকু ও আমার বেশ পছন্দের।
ছবির বিষয় ভাবনাটিও বেশ মনোগ্রাহী। একেবারে বর্ষবরণ থেকে শুরু করে অক্টোবর অবধি ছবির বিস্তার। সেই সময় কাল ধরে দুটি খুব অল্প পরিচিত মানুষের ভালবাসার কাহিনী। কিন্তু ভাবনা থেকে কাহিনীর বিস্তারে আমার মন ভরলো না। রয়ে গেল অনেকখানি অতৃপ্তি।
কাহিনীর কেন্দ্রে নায়িকা “শিউলি”! একেবারে দক্ষিণী পরিবারের মেয়ের কেন এইরকম ব্যতিক্রমী নাম, তা নায়িকার মার বয়ানে জানা যায় কাহিনীর শেষে।
নায়ক ড্যান আদতে একটি অস্থিরমতি বিশোর্ধ যুবক। হোটেলে চাকরি পছন্দ না হলেও সে বাধ্য হয় করতে। শিউলি ও তার অন্য বান্ধবীর সঙ্গে তার একটু বেশীই সখ্য! এক আকস্মিক দুর্ঘটনায় প্রায় মৃত্যুশয্যায় শিউলি।
আরো আকস্মিকভাবে ড্যান জানতে পারে নাকি দুর্ঘটনার ঠিক আগেই শিউলি একবার তার কথা জিজ্ঞেস করেছিল। তুমল পরিবর্তন হয় তার মধ্যে।
এই পরিবর্তন আপাতভাবে রীতিমতো অস্বাভাবিক, কিন্তু খুব সযত্নে লালিত করে তাকে দর্শকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করার দু:সাহসিক ও শিল্পসুলভ ঝুঁকি নিয়েছেন পরিচালক। দুর্ভাগ্যবশত সেই প্রচেষ্টা, অন্তত আমার কাছে ফলপ্রসূ হল না।
তবে এখানেই অনেকে বলবেন তাঁদের ভাবনা একেবারে বিপরীত।
আমার আরো যেটা কল্পনার অভাব লেগেছে তা হল একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। ড্যানের কষ্ট বোঝানোর জন্য দর্শককেও সেই একই হসপিটালে বারবার শিউলির পাশেই দাঁড়াতে হবে, এরকম কোন মানে আছে কি? কোন শিল্পমাধ্যমে দর্শকের সমবেদনা আদায় করার এই চেষ্টা আমার কাছে আদৌ শিল্পসম্মত মনে হয়নি।
যে কোন ভাল ছবিতেই পার্শ্ব চরিত্রদের গুরুত্ব অনেক। তারা মূল চরিত্রকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। বেশীদূর নয়, সুজিতের আগের ছবিগুলোর কথা মনে রাখলেই হবে। এখানে তারা খুব দুর্বল – তাদের গঠনে যত্নের অভাব প্রকট। একমাত্র কিছুটা ব্যতিক্রম শিউলির মায়ের চরিত্র। দুর্বলতম পার্শ্ব চরিত্র বলতে শিউলির কাকা ও ড্যানের মা। প্রায় জোর করে তাদের ঢোকান হল, ফলে তারা কোনই ছাপ রাখতে পারল না।
জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত যে শিউলির জীবনের টানাপোড়ন দেখান হয়েছে, তাতে প্রকৃতির ও অনেক বেশী ভূমিকা থাকতে পারত। দু একটি দৃশ্য ছাড়া তা যেন কেমন অবহেলিত। ড্যানের পরিণত হওয়ার সেরকম সঙ্গত কোন কারণ কিন্তু বোঝা যায়না। সব মিলিয়ে ভিকি ও তার প্রেমিকা বা পিকু ও তার বাবা এবং তাদের চারপাশ আমার কাছে যেভাবে আপন হয়েছিল এখানে তা আদৌ হল না। চরিত্রগুলি যেন রক্তমাংসহীন বিবর্ণ- হয়তো পরিচালক তাই দেখাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি ড্যানের সমব্যথী হয়ে উঠতে পারিনি।
কাহিনীর গতি স্লথ, ফলে গভীর অনুভবের প্রয়োজন ছিল। এছাড়া কাহিনীর কথনে যেন বড় বেশী মুন্সিয়ানার অভাব। ফলে কখনো মনে হয় পরিচালক দর্শকের ধৈর্যের পরীক্ষা নিতে বদ্ধপরিকর।
শেষে একটি প্রশ্ন। ছবিটি সর্বভারতীয় দর্শকের জন্য বানানো কিন্তু “শিউলি” ফুলের তাৎপর্য কি তাঁদের কাছে খুব পরিষ্কার? “ঝরা শেফালী” বা “ক্ষণিকের অতিথি” – এসম্পর্কে তাঁদের কতটা ধারণা আছে? আর জানা না থাকলে মূল বিষয় তাদের কতটা স্পর্শ করবে?