মায়ের ‘মিত্তিরসাহেব’

       জীবনে চলার পথে অনেক মানুষই জীবনকে বৈচিত্র্যময় করে তোলেন। এরকম কিছু মানুষকে নিয়েই লিখেছি একটি স্মৃতিকথা – “যাঁদের আমি ছাত্র”! কিন্তু কিছু মানুষ থাকেন, বাবা, মা, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা – যাঁরা এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জীবনে জড়িয়ে থাকেন তাঁদের কথা লিখতে গেলে মনে পড়ে যায় সেই বিখ্যাত গানটি –

Kisi ke itne paas ho
Ke sab se door ho gaye
Ajeeb daastaan hai yeh
Kahan shuru kahan khatam
Yeh manzile hai kaunsi
Na voh samajh sake na hum

       তাই মেশোমশাইয়ের কথা লিখতে গেলেও মনে হয় কোথা থেকে শুরু করি। ১৯৬৯ সাল থেকে দীর্ঘ প্রায় অর্ধ-শতাব্দী ধরে যাঁর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে তর্ক, আলোচনা, গল্প, আড্ডা হয়েছে, – তাঁর কথা বলতে গেলে তো এটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক – কোথায় শুরু আর কোথায় শেষ এই গল্পের!

1

       ১৯৬৯ সালে তাঁদের অপরূপা মেয়ের বিয়েতে বাসরঘরে “আমি জেনে শুনে বিষ করেছি প্রাণ” শুনে লোকজন প্রায় মূর্ছা যেতে বসেছিল আর কি! কিন্তু ১৪১ ল্যান্সডাউনের লোকজন বুঝে গেছিল যে তাদের ভাগ্যাকাশে এবার এক নতুন জ্যোতিষ্কের উদয় হল – আমার মা সেই জ্যোতিষ্ককে ডাকতেন যে নামে, তা হল – ‘মিত্তিরসাহেব’।

       তিনি এসে আমার মত নবমবর্ষীয় বালককে দিয়েই র‍্যাগিং এ হাত পাকিয়েছিলেন। “শোন তোর বাবা না বেশ নীচু পোস্টে কাজ করে শুনে” সেই ক্রুদ্ধ বালক উত্তর দিয়েছিল – “আপনি নিশ্চয় খুব উঁচু পোস্ট, একেবারে ল্যাম্প পোস্ট”? শুনে তিনি আহ্লাদিত হয়েছিলেন, নাঃ, এর সঙ্গে জমবে ভাল। সেই শুরু।

        সেই বছরেই বিল লরীর নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট টীম খেলতে এল আর মেশোমশাইয়ের হাত ধরে আমার প্রথম মাঠে যাওয়া শুরু। তাও আবার খেলার চতুর্থ দিনে – যখন অস্ট্রেলিয়ার হাতে দশ উইকেটে হেরে ইডেনের গ্যালারী দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগলো। তখন কাঠের গ্যালারী ছিল – কাজেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। এদিকে রেডিওতে ধারাবিবরণীতে খবর এসেছে। এর মাঝখানে আমি গ্যালারী থেকে বাথরুমে যেতে গিয়ে পথ ভুল করেছি – সব মিলিয়ে জগাখিচুড়ী অবস্থা। মেশোমশাই কোনরকমে বেরিয়ে এসে আমাকে নিয়ে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে বাড়ি ফিরে হাঁফ ছাড়েন। বাড়ির সবাই ও তাই। এখন বুঝি সেই টেনশনের কারণ। তবে সেই থেকে চোখে দেখা ক্রিকেটের স্বাদ গ্রহণ শুরু।

       শুধু ক্রিকেট কেন, এর দু তিন বছর পর টেনিসের ও টেবিল টেনিসের নিয়ম কানুনও মেশোমশাইয়ের কাছেই শিখি। ফুটবলে তো ছিলই। সেখানে অবশ্য একটা সমস্যা ছিল – আমি ছিলাম আমাদের প্রহ্লাদকুলে একমাত্র দৈত্য – ইস্টবেঙ্গল সমর্থক। সে নিয়ে একবার খুব মজা হয়েছিল।

       তাঁর শ্বশুরবাড়ি, যাকে বলে “পরম বৈষ্ণব” – গোঁসাইজি তাঁদের প্রাণপুরুষ। মেশোমশাই পরে, আমি বড় হতে আমাকে বলেছিলেন যে উনি শুনেছিলেন বাড়ির সর্বকনিষ্ঠ সন্তান, বাবুমামা, নাকি ভগবানের অংশ। এছাড়াও জীবনের প্রথমদিকে তাঁকে গোঁসাইজির সঙ্গে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে হয়েছিল। হাওড়া স্টেশনে নেমে দৌড়োদৌড়ি করে ট্যাক্সি ধরে দেখলেন শাশুড়িরা জোড় হস্তে জানাচ্ছেন – “গোঁসাইয়ের কি কৃপা”!! বোঝ।

2

       তবে শাশুড়ির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল খুব গভীর – আদর করে “বাবা প্রণব” ডাক শুনলেই তিনি বুঝতে পারতেন কোন বিশেষ দুরূহ কাজের আদেশ আসতে চলেছে। কিন্তু দোষ তাঁর নিজেরই, তাঁর পারফর্ম্যান্স এত উঁচুদরের ছিল যে তিনি সাংঘাতিক রকমের আস্থা অর্জন করেছিলেন। শাশুড়ির মেজদিদিও মাঝে মাঝে শাশুড়ির সঙ্গে যোগ দিতেন। দুই শাশুড়ি মিলে মালদহে কোয়ার্টারের বাগানের আম দিয়ে প্রায় জেলির ফ্যাক্টরি খুলে বসেন। অনেক কেঁদে কেটে, কাঠ খড় পুড়িয়ে মেশোমশাই সেই ফ্যাক্টরি লক আউট করান। এসব গল্প মেশোমশাইয়ের কাছে ল্যান্সডাউনে শুনে আমরা ছোট বড় সবাই খুব আমোদ পেতাম।

       আমাকে দিয়ে যে র‍্যাগিং এর শুরু তা পরে আমার অন্যান্য ভাইদের ওপরেও চলেছিল। উল্লেখযোগ্য ছিল বুম্বা ও ভুতুম। বুম্বা প্রচণ্ড দুরন্ত ছিল, প্রায়শই লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে হাত পা ভাঙত। একবার মেশোমশাই মামাবাড়ি আসতেই বুম্বা খুব আগ্রহভরে প্রথম সার্কাস দেখার গল্প শুরু করতেই মেশোমশাই বললেন – এই সার্কাস কি পার্ক সার্কাস ময়দানের কাছে? বুম্বা হ্যাঁ বলতেই প্রায় তাজ্জবের ভঙ্গিতেই বলে উঠলেন – “সেজন্যই আজ ওখানে খুব জ্যাম। আমার গাড়ির ড্রাইভার খোঁজ নিয়ে এসে বললো যে আজ নাকি সার্কাসের বাঁদরটা অসুস্থ থাকার জন্য একটা বাচ্চা ছেলে বাঁদর সেজে কি অপূর্ব খেলা দেখিয়েছে, আসল বাঁদরকেও নাকি ছাড়িয়ে গেছে”!! বেচারি বুম্বা, হাসা উচিত না রাগা উচিত বুঝতেই পারলো না। আর ভুতুমকে পেছনে লাগার অস্ত্র ছিল – “তোর বাবাকে পুলিশে ধরেছে, আজ আর বাড়ি ফিরবে না – কারণ তিনি নাকি প্রকাশ্য স্থানে প্রাকৃতিক কম্মো সারছিলেন”।

       কিন্তু মেশোমশাই একবার নিজের অস্ত্রে নিজে ঘাত হয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালে আমার মাধ্যমিকের পর বেশ কিছুদিন ছুটি থাকায় আমি আর শুভ মাসীদের তখনকার বাসস্থান মেদিনীপুরের নরঘাটে যাই। আমার ভাই শুভ তার আগে দিন তিনেক আমাদের বাড়িতে ছিল এবং গোগ্রাসে “স্বপন-কুমার” পড়ছিল। নরঘাট যাবার সমর তাড়া করে গোটা তিরিশেক স্বপন-কুমার নিয়ে গেল। মেশোমশাই খুব আওয়াজ দিলেন। এদিকে মাসী ফাঁস করে দিল মেশোমশাই নাকি কাগজের আড়ালে লুকিয়ে স্বপন-কুমার পড়ছিলেন, পায়ের আওয়াজ পেয়েই চট করে লুকিয়ে ফেলেছেন। ব্যস, শুভকে আর পায় কে! ছোট পিশেমশাই কে জব্দ করতে পেরে আহ্লাদে আটখানা।

       ১৯৭৯ সালের সেই বিখ্যাত মোহনবাগান – ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ ড্র হওয়ার পর আমি আর মেশোমশাই ৬ নম্বর বাসে করে গড়িয়া থেকে মামাবাড়ি আসছি। সেই ম্যাচ ড্র করা নিয়ে মেশোমশাই বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন যাত্রীদের সঙ্গে। যাত্রাপথ দেখেই বোঝা যায় তাদের অধিকাংশই ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক। তাদের ধারনা জোচ্চুরি করে এগিয়ে থাকা ইস্টবেঙ্গলকে ড্র করাতে বাধ্য করা হয়েছে, মেশোমশাই বললেন – না, দারুণ কামব্যাক করেছে মোহনবাগান। বিপদ বুঝে আমিও মোহনবাগানের সমর্থক হয়ে গেলাম, হাজরা এসে গেলেও টেনে প্রায় নামাতে পারিনা বাস থেকে – কি কাণ্ড!

       আমাদের বাড়ির সব বিয়েতেই মেশোমশাইয়ের উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত – বাড়ির জামাই বা বৌদের আপন করে নিতে তাঁর জুড়ি পাওয়া ভার। আমার বিয়েতে শ্বশুরবাড়ীর তরফ থেকে ক্যামেরা ও ভিডিওর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এদিকে অজয়দা ও ছবি তুলতে চাইছে, কিন্তু একটু মুশকিল হচ্ছে। মেশোমশাই বাম সমর্থক অজয়দার নামকরণ করেদিলেন – “গণশক্তির ক্যামেরাম্যান”!!

        তাঁর যাদবপুরের ও স্কুলের ছাত্রজীবনের গল্প শোনার অভিজ্ঞতাও অনুপম। তা দিয়ে একটা বইও হয়ে যেতে পারে। একখানা নমুনা পেশ করাই যেয়ে পারে।

       যাদবপুরের ছাত্রদের একটি বিশেষ আড্ডা মারার ধরন আছে। প্রত্যেক ছাত্রদের গ্রুপেই দুটি একটি ছাত্র থাকে যাদের দেখলে ব্যাচ বোঝা যায় – সিভিল থার্ড ইয়ার না কেমিক্যাল ফাইন্যাল ইত্যাদি। মেশোমশাইয়ের সিভিল – যারা হল যে কোন কলেজে সবচেয়ে ধুরন্ধর। মেশোমশাইয়ের তখন ফাইন্যাল ইয়ার, সব্বাই সে বিচ্ছু ব্যাচকে চেনে। এদিকে ক্যাম্পাসের মধ্যেই থাকতেন তাঁদের বিভাগীয় প্রধান। তাঁর মেয়েও যাদবপুরের অন্য কোন বিভাগে পড়তো, ছিল রীতিমত হৃষ্টপুষ্ট। তা তিনি যখন মৃদুমন্দ দোদুল গতিতে সেই ব্যাচের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন, কোন বিচ্ছু অতর্কিত মন্তব্য ছুঁড়ে দেয় – “উফফ, জাহাজ, জাহাজ!” কথাটি মেয়েটির কানে গিয়েছিল এবং সেখান থেকে তার বাবার কানে। পরের দিন তিনি ক্লাসে এসেই পড়ানোর আগে গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করলেন –“আচ্ছা, তোমাদের মধ্যে কে সেই গাধা বোট যাকে আমার জাহাজের সঙ্গে বেঁধে দেব?”  ক্লাসে অখণ্ড নীরবতা।

       ১৯৯৫ সালে বাবার মৃত্যুর পর মেশোমশাই ঝিমলির বিয়ে নিয়ে একটু মুশকিলে পড়েছিলেন। বাবা পাত্র অবধি দেখে ঠিক করে গিয়েছিলেন, কিন্তু বিয়েটা আর দেখে যেতে পারেননি। এটা মেশোমশাইকে খুব পীড়িত করেছিল।

       একবিংশ শতাব্দীতে মেশোমশাইকে আমরা সেভাবে আর পাইনি। কিন্তু ২০০৫ সালে ব্যাঙ্গালোরে এসে আমার বাড়িতে কাটিয়ে গেছিলেন, এটাই সান্ত্বনা। ২০১১ সালের পর থেকে মা যখন এখানে থাকতে শুরু করেন, তখনও মার ইচ্ছে ছিল একবার মাসী-মেশোমশাইকে নিয়ে আসার, কিন্তু শারীরিক অবস্থার জন্য তা আর সম্ভব হয়নি।

       প্রত্যেকবার কলকাতা গিয়ে মেশোমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলেই খুব ভাল লাগতো, মাসী আর রূপার বক্তব্য ছিল আমাকে দেখলেই যেন তাঁর চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত। গত ডিসেম্বরে শেষ দেখা।

       ভাল থাকুন মেশোমশাই, যেখানেই থাকুন তাঁদের কাছেও আপনার উপস্থিতি একেবারে টনিকের মত কাজ করবে। আমাদের কাছে রয়ে যাবে “জোনাকির ঝিকিমিকি”র মত সেই স্মৃতিগুলো – “এমন দিনে আপনি কাছে” না থাকলেই বা কি !!

 

6 thoughts on “মায়ের ‘মিত্তিরসাহেব’

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s