প্রথম তাঁকে দেখেছিলাম ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ইডেনে। জীবনের প্রথম টেস্ট খেলা দেখতে গিয়ে। চতুর্থ টেস্টের চতুর্থ দিনে ভারত যখন তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ছে, তিনিই ছিলেন প্রতিরোধের একমাত্র মুখ। ১৬১ রানের মধ্যে তাঁরই ৬২। ইনিংস পরাজয় এড়াতে মুখ্য ভূমিকা ছিল তাঁরই।

আবার যখন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক বিল লরি স্ট্যাকপোলকে নিয়ে প্রয়োজনীয় অনধিক চল্লিশ রান করতে এলেন, সুব্রত গুহর সঙ্গে তিনি প্রারম্ভিক বোলার।
তিনি নাকি লাকি ক্যাপ্টেন! কিন্তু তাঁর টস ভাগ্য খুব খারাপ। প্রায়শই টসে হারতেন। অবশ্য ১৯৭১ সালে সোবার্সের নেতৃত্বাধীন ওঃ ইন্ডিজের বিরুদ্ধে পঞ্চম টেস্টে তিনি নাকি ‘চালাকি’র দ্বারা মহৎ কার্য সম্পন্ন করেছিলেন।
১৯৭১ এ পোর্ট অব স্পেন এর শেষ টেস্টে এক ঘটনাতে লয়েড রীতিমতো হতাশ হয়েছিলেন সোবার্সের আচরণে। টসের ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরণ আছে সোবার্সের আত্মজীবনী –“Twenty Years at the Top” –বইটিতে।
সিরিজে তখন ভারত ১ – ০ এগিয়ে আছে। এই অবস্থাতে শেষ টেস্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ। টসে গেলেন দুই অধিনায়ক, ওয়াদেকর ও সোবার্স। সোবার্স ওপরে মুদ্রাটি ছোঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওয়াদেকর ডাক দেন। সোবার্সের ধারণা ডাকটি ভুল এবং তিনিই জিতেছিলেন। তিনি ওয়াদেকরকে বলেন তিনি ড্রেসিংরুমে অন্যান্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেবেন। ড্রেসিংরুমে এসে কথা বলছেন, হঠাৎ তিনি লাউডস্পিকারে ঘোষণা শোনেন যে ভারত টসে জিতেছে এবং তারা ব্যাট করবে। যে গ্রাউন্ড স্টাফেরা তাঁর সঙ্গে টসের সময় ছিল, তাদের একজন সোবার্সকে বলেন – ’আমরা টসে জিতেছিলাম না?’ সোবার্স ও তাই জানতেন, কিন্তু আর তর্ক না করে তিনি মেনে নেন। এটাতে তীব্র আপত্তি ছিল লয়েডের, তাঁর ধারনা ছিল বিভ্রান্তি থাকলে সোবার্সের আবার টস করানো নিয়ে জোর দেওয়া উচিত ছিল। সোবার্স পরে ওয়াদেকরকে এই নিয়ে জিজ্ঞেস করেও উত্তর পাননি। প্রসঙ্গতঃ সুনীল গাভাসকার কিন্তু আবার ঐ টস বিতর্কে সোবার্সের খেলোয়াড়োচিত সদর্থক ভূমিকাতে প্রশংসাতে পঞ্চমুখ। এই সিরিজেই তিনি সেই স্বপ্নের ইনিংসগুলো খেলেছিলেন।
১৯৭১ এ যে দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ইংল্যান্ড সফর করে ইতিহাস সৃষ্টি করে সে দলের অধিনায়কত্বের দাবিদারও কিন্তু ছিলেন পতৌদি। ১৯৭১ সালে ওয়াদেকরের ভাগ্য সহায়ক ছিল, তিনি তাই পতৌদিকে টপকে সফরকারী ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব পেয়ে যান। ১৯৭০ – ৭১ এ পতৌদির জনপ্রিয়তা কিছুটা কমে গেছিল।তাহলেও পতৌদির সমর্থন একেবারে যে ছিল না তা নয়। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান বিজয় মার্চেন্ট ছিলেন ওয়াদেকরের সমর্থক। তাই ওয়াদেকরের হাতেই নেতৃত্ব চলে গেল।
সেটি ছিল তাঁর এবং ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে সফল বছর। ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ইংল্যান্ডে পরপর জয়ী হয়ে ভারতবর্ষের ক্রিকেট ইতিহাসের চেহারাই পালটে গেল। ১৯৭২– ৭৩ ভারত সফররত ইংল্যান্ড দলের বিরুদ্ধে ও তিনি জয়ী হলেন।
কিন্তু ‘চিরদিন সমান নাহি যায়’। এল ১৯৭৪ সাল। ওয়াদেকরের জীবনের সবচেয়ে সাংঘাতিক সময়। অধিনায়ক রূপে ওয়াদেকর, রঞ্জী ট্রফি, ইরানী ট্রফি আর দলীপ ট্রফি হারলেন। বহুদিন বাদে জেতা তো দূরের কথা, রঞ্জী ট্রফির সেমি ফাইন্যালেই প্রথম ইনিংসের কম রানের সুবাদে ওয়াদেকরের নেতৃত্বে বোম্বে কর্ণাটকের কাছে হারল। কর্ণাটকের সেই প্রথমবার রঞ্জী জয়। জয়ের মূল স্থপতি – গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ। দলে ছিলেন ব্রিজেশ প্যাটেল, প্রসন্ন (অধিনায়ক) এবং চন্দ্রশেখর।
এরপর ইংল্যান্ড সফরে চূড়ান্ত ব্যর্থ ভারতীয় দল। ফলে পদত্যাগ করলেন বা বলা যায় করতে বাধ্য হলেন অজিত ওয়াদেকর। এর আগে তাঁকে পশ্চিমাঞ্চল দল থেকে বিস্ময়কর ভাবে বাদ দেওয়া হয়। কারণ তিনি নাকি তখন “Out of form”। আর অপমানিত না হতে চেয়ে তিনি প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট থেকে অবসর ঘোষণা করলেন। ফলে ১৯৭৪এ যে ওঃ ইন্ডিজ টীম ভারতে এল, তাতে খেলোয়াড় হিসেবেও রইলেন না অজিত লক্ষণ ওয়াদেকর।
এটি ছিল ওয়াদেকরের প্রতি বোর্ডের নির্মম আচরণ। ০ – ৩ এ যে দল হেরেছিল, তাতে তো অনেকেই ছিলেন যাঁরা আশানুরূপ খেলতে পারেননি, তাহলে ওয়াদেকরের ওপর খাঁড়ার ঘা কেন? সাম্প্রতিক কালে ০-৮ এ হেরেও তো বহাল ছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। আর, অধিনায়কত্ব ছাড়লেও তিনি দলে থাকতে পারতেন, ৩নম্বর স্থান নিয়ে একটু নিশ্চিন্ত থাকা যেত, যেমন ৪নম্বরে নিশ্চিত ছিলেন বিশ্বনাথ। স্লিপে ফিল্ডার হিসেবেও তিনি খুবই নির্ভরযোগ্য ছিলেন।
আমরা সকলেই জানি ব্যাটিং অর্ডারে ৩ নম্বর স্থানটি কিরকম গুরুত্বপূর্ণ। সেই সিরিজে ঐ স্থানটিতে কোন স্থায়ী ব্যাটসম্যান ছিল না, শুধু পরীক্ষা নিরীক্ষাই হয়ে গেল। হেমন্ত কানিৎকার, একনাথ সোলকার, পার্থসারথি শর্মা, অংশুমান গায়কোয়াড়, অশোক মাকড়, – সবাইকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করা হল। ৪ নম্বর স্থানটিতে অবশ্য পাকা আসন ছিল বিশ্বনাথের। তিনি ব্যাটিং এ প্রায় একাই হাল ধরেছিলেন, কারণ গাভাসকার আহত ছিলেন। ০-২ তে পেছিয়ে পড়ে ২-২ হয়েও আবার ৩-২তে হেরেছিল ভারত। এই সময়ে ৩নম্বরে ওয়াদেকর থাকলে ব্যাটিং অনেক স্থায়িত্ব পেত। যাদের নাম করলাম, ৩নম্বরে তিনি এঁদের চেয়ে অনেক ভাল খেলতে পারতেন। দ্বিতীয় টেস্টে আহত পতৌদির জায়গাতে তিনি অধিনায়কত্ব করলে দল কিছুটা দিশা পেত।
কিন্তু দেশের প্রয়োজনে আবার এগিয়ে এসেছিলেন। আজহারের মত অধিনায়ককেও সাফল্য পেতে সাহায্য করেছিলেন।
নাঃ! তার সঙ্গে সুবিচার করা হয়নি। আজ ইংল্যান্ডে ভারতীয় দলের দিশাহারা অবস্থা দেখে সে ১৯৭৪ সালের কথা খুব মনে পড়ছিল, তখনই দুঃসংবাদ।
ভালো থাকবেন স্যার! ব্লেজার গায়ে সেই সহাস্য, স্মিতমুখী, অধিনায়ককে আমাদের মনে থাকবে। আমাদের মত যাদের ক্রিকেট প্রদক্ষিণ শুরু হয়েছে সাতের দশকের গোড়ায় তারা হয়তো আপনাকে কোনদিন ভুলবে না।

‘৭১ এর সেই দলের দিলীপ সরদেশাই এর নামোল্লেখনা থাকায় বিস্মিত হলাম ।
LikeLike
সুনীল গাভাসকার ও উল্লিখিত হন নি।
লেখার বিষয় ছিল – উত্থান ও পতনে ওয়াদেকর। তিনি কি সত্যিই লাকি?
LikeLike