ব্যাঙ্গালোর ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ২০১৯ – প্রথম পর্ব

২২শে জুন, শনিবার ছিল উৎসবের চিত্র প্রদর্শনীর প্রথম দিন। এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল কানিংহাম রোডের সিগমা মল এ। এই মলটিতে তিনটি প্রেক্ষাগৃহ নিয়েই চলেছিল উৎসবের আয়োজন।

প্রথমেই ছিল মৃণাল সেন পরিচালিত ‘ভুবন সোম’ ও ‘আমার ভুবন’ প্রদর্শনী। ‘ভুবন সোম’ শুরু হতে বেশ কিছু দেরী হয় – কারণ যান্ত্রিক গোলযোগ। কিন্তু তারপরে মৃণাল সেনকে নিয়ে যে আলোচনা চক্রটি হয় তা বড়ই মনোগ্রাহী। চেষ্টা করছি নিজের মত করে লেখার।

মৃণাল সেন এর চলচ্চিত্র সংক্রান্ত আলোচনা চক্রটি খুবই সুন্দর হয়েছিল। শুরুতে শিলাদিত্য সেন তাঁর ‘মৃণাল সেনের ফিল্মযাত্রা’ বই থেকে কিছু পাঠ করে শোনান। এরপরে চিন্ময় গুহও শোনান মৃণাল সেন সম্পর্কে তাঁর অনুভূতি।

আদুর গোপালকৃষ্ণান আবার অভিভূত করলেন। আলোচনার শুরুতেই তিনি জানালেন ‘ফিল্ম ফোরামে’র কথা। মুম্বাইতে বাসু চ্যাটার্জী, অরুণ গোভিল প্রমুখরা শুরু করেন এটি। মৃণাল ও তাঁদের সঙ্গে খুবই আলোচনা করতেন। এই সময় অরুণই প্রস্তাব করেন ‘ভুবন সোম’ চলচ্চিত্রের। ‘ভুবন সোম’ নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন মৃণাল নিজেই তাঁর আত্মজীবনী ‘তৃতীয় ভুবন’ বইটিতে।

আদুর জানালেন – তাঁদের কাছে ‘ভুবন সোম’ এক ল্যান্ডমার্ক ছবি। এই ছবি থেকেই মৃণাল শুরু করেন তাঁর পরীক্ষা নিরীক্ষা। পরে তিনি আরো প্রচুর পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। এই পরীক্ষা নিরীক্ষার পর্বে তিনি মৃণালের বেশ কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন। তবে এই পরীক্ষাগুলো হয়তো বেশিমাত্রায় হয়ে যাওয়ার ফলে জনসমাদৃত হয়নি। তাঁর আগেই ফিল্মে এসে গেছেন সত্যজিৎ ও ঋত্বিক। কিন্তু মৃণালের পথ ছিল অন্যরকম। আর মৃণাল তরুণদের সঙ্গে একদম বন্ধুদের মত মিশতেন। আদুর অনেক ব্যাপারেই তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতেন, পরামর্শ নিতেন। একবার যখন আদুরকে ‘তরুণতম’ চিত্রনির্মাতা বলা হচ্ছিল, আদুরের মনে হচ্ছিল এই শিরোপা মৃণালেরই প্রাপ্য। আদুর জানালেন যখনই তিনি কলকাতা যেতেন, নিয়ম করে দেখা করতেন মৃণালের সঙ্গে। ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হতেন। পরেরবার যখন কলকাতা যাবেন, গভীরভাবে অনুভব করবেন মৃণালের অনুপস্থিতি।

কি আশ্চর্য! গিরিশ কাসরাভল্লী শুরু করলেন ‘ভুবন সোম’ দিয়েই কিন্তু একেবারে উল্টো ভাবে। কর্ণাটকের মানুষ গিরিশ সাহিত্যমনস্ক পরিবারের সন্তান। তাঁর চলচ্চিত্রে যোগদান নিয়ে খুব বেশি উৎসাহ হয়তো পাননি পরিবারে। কিন্তু তাও তিনি গিয়ে হাজির হয়েছিলেন পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে, ১৯৬৯ সালে। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে। ‘ইন্টারভিউ’ বোর্ডে ছিলেন স্বয়ং মৃণাল সেন। প্রথম প্রশ্নই ছিল-

  • মৃণাল – ‘ভুবন সোম’ বলে একটি চলচ্চিত্র এখন চলছে। সেটি কি দেখা?
  • গিরিশ – হ্যাঁ, দেখা হয়ে গেছে।
  • মৃণাল – কিরকম লেগেছে?
  • গিরিশ – অত্যন্ত খারাপ। গিমিক সর্বস্ব ছবি। অযথা বিভিন্ন টেকনিক ব্যবহার করা হয়েছে যাতে মূল বিষয়টা পরিষ্কার থাকে না। একদম ভালো লাগেনি।
  • মৃণাল – ছবির পরিচালকের নাম কি জানা?
  • গিরিশ – নিশ্চয়। মৃণাল সেন, যিনি এখন আমাকে ইন্টারভিউ করছেন।
  • মৃণাল – বাঃ, বেশ!! আচ্ছা, সিনেমাটির কি কোন কিছুই ভাল নেই? সবই খারাপ?
  • গিরিশ – নিঃসন্দেহে আছে। ‘সুহাসিনী মুলে’ – অপূর্ব অভিনয় করেছেন।

এরপরে ইন্টারভিউ শেষ হয়ে যায়। বাইরে বেরিয়ে গিরিশ তাঁর বন্ধুদের সঙ্গেও ইন্টারভিউ নিয়ে আলোচনা করেন। মোটামুটি সকলেই স্থির সিদ্ধান্তে এসে যান এবার গিরিশ ফিরে যাওয়ার বন্দোবস্ত করতে পারেন। তাও ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেন সন্ধ্যা অবধি।
যখন সফল ছাত্রদের তালিকা প্রকাশিত হয়, গিরিশের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। তখনই তিনি মৃণালের ব্যক্তিত্বের এই বিশেষ দিকটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন।
গিরিশ স্মৃতিচারণ করছিলেন, বছর পঁচিশেক আগে দূরদর্শন তাঁকে একবার ঋত্বিক ঘটকের ওপর একটি বিশেষ অনুষ্ঠান করতে বলেন। গিরিশ জানান যে তিনি ঠিক নিজেকে ‘ঋত্বিক বিশেষজ্ঞ’ বলে মনে করেন না, কাজেই তাঁর পক্ষে শুধু ঋত্বিককে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। তুলনাতে তিনি যদি সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিক – এঁদের তিনজনকে নিয়ে একটি তুলনামূলক আলোচনা করার সুযোগ পান, তাঁর পক্ষে অনেক সুবিধাজনক হয়। সেই আলোচনার মূল তিনি এখানে জানালেন।
তাঁর মতে সত্যজিৎ একেবারে ধ্রুপদী শিল্পী। আর ঋত্বিক ঘটক ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের অর্থাৎ অধুনা বাংলাদেশের মানুষ। তাঁর সব সিনেমাতেই ছিল বাংলাদেশ। খুবই উচ্চকিত তাঁর কন্ঠস্বর, যেন যে কোন মূল্যেই তিনি দর্শকের মনোযোগ কেড়ে নিতে চান। তাঁর ছবির যে নির্মাণভঙ্গি তাতে হয়তো কিছুটা অসংলগ্নতার ছাপ আছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তা আদ্যন্তভাবে চলচ্চিত্রোপোযোগী।
মৃণাল কিন্তু এই দুজনের থেকে একেবারেই আলাদা। তাঁর ছবির বিষয়বস্তু একেবারেই সমকালীন রাজনীতি ও সমাজ। ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে একটা সুবিধে যে তাঁদের আগে যারা কাজ করেছেন, তাঁদের কাজ থেকে অনেক কিছুই নেওয়া যায়। তুলনাতে মৃণালকে নিজের বিষয়ের জন্য কিন্তু নিজের আঙ্গিক খুঁজে বার করতে হয়েছে, পরীক্ষা করতে হয়েছে। পরীক্ষা সবসময় সফল হয় না, কিন্তু সেটাই এগিয়ে যাওয়ার পথ। একটাই দুঃখের বিষয় যে ভারতীয় চলচ্চিত্রের দর্শক ও সমালোচকদের তিনি সেভাবে পাশে পাননি।
বস্তুতঃ ‘সময়ের সঙ্গে সহবাস’ – মৃণালের এই দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে লিখছেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। ‘তৃতীয় ভুবন’ আলোচনা করতে গিয়ে তিনি লিখছেন –

“আজও এই বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে সময়ের সঙ্গে সহবাসের চিহ্ন; নিজের সময়ের ঠোঁটে চুম্বনের দাগ গোপন করায় মৃণাল সেনের কোনও আগ্রহই নেই। আইরিশ মারডক একবার জঁ-পল সার্ত্র প্রসঙ্গে সুন্দর একটি অভিধা খুঁজে পেয়েছিলেন সেলফ কনশাসলি কনটেমপোরারি। মৃণাল সেনও বস্তুত তাই: আত্মসচেতন ভাবে সমসাময়িক।”

http://archives.anandabazar.com/archive/1110910/10pustak1.html

ভালো লাগলো জেনে যে গিরিশ ও প্রায় একই মতামত পোষণ করেন।
এই দিন বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র দেখানো হয়। তার মধ্যে তিনটি আমার দেখা সম্ভব হয়ে ওঠে – এগুলি যথাক্রমে – অব্যক্ত, তারিখ ও নগরকীর্তন।

অব্যক্ত

‘অব্যক্ত’ হল চারটি মানুষের গল্প – মা ও ছেলের আজীবনের ভুল বোঝাবুঝির কাহিনী যার কারণ একটি ‘অব্যক্ত’ সত্য। সুন্দর ছবিটি – অর্পিতা চট্টোপাধ্যায় ও আদিল হুসেনের অনবদ্য অভিনয়ে সমৃদ্ধ।

তারিখ

তারিখ – এই ফেস্টিভ্যালে দেখা আমার সর্বাধিক প্রিয় ছবি। অদ্ভুত ছবির আঙ্গিকটি। বিষয়টি একেবারে সমকালীন, যার ফলে আঙ্গিকেও সমকালীন ছাপ রয়ে গেছে। ছবির মূল বিষয় কেন্দ্রীভূত হয়েছে সোস্যাল মিডিয়া ও আমাদের জীবনে তার ভূমিকা নিয়ে। তিনটি মূল চরিত্র – অভিনয়ে আছেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, ঋত্বিক চক্রবর্তী ও রাইমা সেন। তিনজনেই অপূর্ব অভিনয় করেছেন। তিনটি মানুষ এই আধুনিক সমাজের তিনটি ভিন্নধারার জীবন যাপনের প্রতিনিধি। তাদের বন্ধুত্ব গভীর কিন্তু তাদের মানসিক গড়নের ভিন্নতা অনেক সময় সেই গভীরতাকে অতিক্রম করে বন্ধুত্বে চিড় ধরায়। শাশ্বত ও রাইমা, ছোটবেলার বন্ধুত্ব দাম্পত্য সম্পর্কে পরিণত হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা এমন অনতিক্রম্য দূরত্বে এসে পৌঁছয়ে যা খুব ট্র্যাজিক।
ছোট পরিসরে এর থেকে বেশি কিছু বলা যাবে না। তবে সবাইকেই অনুরোধ করবো এই সিনেমাটি অবশ্যই দেখতে।
সিনেমার পর ছোট্ট আলাপচারিতাতে পরিচালক চূর্ণী জানালেন এই ছবি নিয়ে তাঁর চিন্তা ভাবনার কথা। তাঁর জীবনের কোন ঘটনার ভিত্তিতেই এই সিনেমার নির্মাণ। কেউ কেউ এই সিনেমার সঙ্গে ঋতুপর্ণর ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’ এর কিছু মিল খুঁজে পেয়েছেন। চূর্ণী জানালেন এই সিনেমা করার পরই তিনি ঋতুপর্ণর ছবিটি দেখেছেন। আর বিষয়টি এতই সর্বব্যাপী, যে এই বিষয় নিয়ে অনেক সিনেমা হয়েছে বা হতে পারে। আমি নিজে কিন্তু সেভাবে কোন মিল পাইনি, এই ছবির আঙ্গিকটিকে আমার অনেক নতুন লেগেছে।

নগরকীর্তন

আর একটি অদ্ভুত ভালো লাগা ছবি। অসম্ভব মর্মস্পর্শীভাবে ছবিটি করেছেন কৌশিক গাঙ্গুলি। বিষয়টি অনেকেই জানেন, সমকামিতা ও তৃতীয় লিঙ্গ সম্পর্কিত। এই ছবিতে রয়েছে একটি ছোট্ট ছেলের নিজের অস্তিত্বের সন্ধান ও তার ট্র্যাজিক পরিণতি। মূল ভূমিকাতে চমকে দিয়েছেন ঋদ্ধি সেন। এত অল্প বয়সে তিনি অভিনয়ে যে পরিণত বোধ নিয়ে এসেছেন তা সত্যি মনোগ্রাহী। সিনেমার পর আলোচনাতে ঋদ্ধি জানালেন যে ছবিটি তৈরী হতে একটু দেরী হওয়াতে তিনি বেশ কিছুটা সময় পেয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে এই ভূমিকার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করে নিতে। ঋত্বিককে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘ঘনিষ্ঠ দৃশ্যে তিনি কি ভাবছিলেন তাঁর বিপরীতে যিনি রয়েছেন তিনি তরুণী নন, একজন তরুণ?” ঋত্বিক জানালেন, তিনি মানসিকভাবে পুরোপুরি এই ভেবেই অভিনয় করেছেন যে তাঁর বিপরীতে তাঁর যে প্রেমিকা, সে একটি তরুণী এবং তাকে তিনি সামগ্রিকভাবেই ভালোবেসেছেন। তাঁর একটুও দ্বিধা ছিল না এব্যাপারে।

এছাড়াও সেদিন ছিল ফেলুদা ও গুপি গাইন বাঘা বাইন নিয়ে আড্ডা। নতুন অভিনেতাদের মধ্যে ঋত্বিক ও আবীর জানালেন তাঁদের প্রথম গুগাবাবা ও সোনার কেল্লা দেখার কথা। শোনা গেল শুটিং চলাকালীন বেশ কিছু মজার অভিজ্ঞতাও।

গুগাবাবা ও ফেলুদা আড্ডা

সব মিলিয়ে দিনটি চমৎকার কাটলো। শুরুর হোঁচট খাওয়ার কথা দিনের শেষে একেবারেই ভুলে যাওয়া গেছিল।

সব ছবিগুলি সংগ্রহ করে দিয়েছেন সত্যজিৎ রায় ফিল্ম সোসাইটির পক্ষ থেকে শ্রী কৃষ্ণেন্দু নাগ। বিশেষ কৃতজ্ঞতা তাঁকে ও সোসাইটিকে।

6 thoughts on “ব্যাঙ্গালোর ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ২০১৯ – প্রথম পর্ব

  1. চমৎকার বৰ্ণনা।
    তবে ফেলুদা ও গুপী গাইন ছবির আলোচনা দেখতে পেল ভালো লাগতো।

    Liked by 1 person

  2. খুব ভাল লাগল। বাঙ্গালোর ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এতগুলো বাংলা ছবি দেখানো হচ্ছে, তাতে বোঝা যায় সেখানকার লোকেরা এই বৈশ্য যুগেও কতটা সংস্কৃতিমনস্ক। এই ধারাটা বজায় থাকুক, এই কামনা করি।

    Liked by 1 person

      1. পল্লব, তোমার মন্তব্যে আমাদের কর্মকর্তারা খুব অনুপ্রাণিত, বিশেষ করে তোমাকে জানাতে বলেছে।

        Like

Leave a comment