বিধানচন্দ্রের জীবনের অনেক ঘটনাই আমাদের জানা। বিভিন্ন লোকের স্মৃতিচারণ ও আলাপচারিতাতে তাঁর বেশ কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েছে। যেমন ‘ঈশ্বর পৃথিবী, ভালবাসা’ তে শিবরামের জবানবন্দী।
শিবরাম একবার পড়লেন খুব টানাটানিতে। তখন দেশবন্ধুও নেই। কি করেন? বিধান রায়ের খুব নাম । কিন্তু এমনি এমনি তো আর যাওয়া যায় না। অসুস্থতার ভান করে চিকিৎসা করাতে গেছিলেন বিধান রায়ের কাছে।
তা ডাক্তারবাবু তাঁকে দেখেই চিনতে পেরেছেন। বললেন,
-কংগ্রেস মণ্ডপে তোমাকে যেন দেখেছি মনে হচ্ছে।
– হ্যাঁ, ভলান্টিয়ারি করতাম আমরা।
– বেজায় চেঁচাচ্ছিলে তোমরা, তাই মনে আছে। — কি হয়েছে তোমার?
– কোষ্ঠবদ্ধতা। কিছুতেই কোষ্ঠ পরিষ্কার-
– বুঝেছি। যা খাচ্ছ তা হজম হচ্ছে না।
ওষুধ দিলেন। কিন্তু শিবরামের শরীর সারলো না,- অসুখই নেই সারবে কি করে? আবার শিবরাম দ্বারস্থ হলেন ডাক্তারের। একটু আশ্চর্যই হলেন ডাক্তার রায়। আবার ওষুধ দিলেন। এবার আরো জব্বর দাওয়াই। কিন্তু সারলো না। আবার গেলেন। এবার ডাক্তারবাবু বুঝলেন কিছু সমস্যা আছে।
শুধোলেন – ‘তুমি কর কী শুনি?
– কী করবো
– কাজটাজ কিছু করো না?
– লেখা লেখির কাজ করি-
– কী লেখো ? হিসেবের খাতা?
– এই গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, —
– টাকা পাও?
– ছাপতেই চায় না কেউ। টাকা দেবে? ছাপলেই বর্তে যাই?
– এইবার ধরেছি তোমার ব্যারাম। এই তার ওষুধ। ধরো।
বলে ড্রয়ার থেকে খান কয়েক নোট বার করে দিলেন দশ টাকার– খেলে পরে তবেই তো বেরোবে। আহারের পরেই না বাহার।’
নারায়ণ সান্যাল ও তাঁর ‘পঞ্চাশোর্ধে’ বইতে লিখেছেন একদিনের একটি অবিস্মরণীয় সাক্ষাৎকারের কথা। তখন তিনি কর্মরত মেদিনীপুরের এক প্রত্যন্ত দিগড়ি গ্রামে। সেখানে একটি হাসপাতাল বানানো হবে। সেখানেই একদিন সদলবলে হাজির বাংলার নয়া রূপকার। তারিখটিও মনে রেখেছেন, কারণ ডাইরি লেখার অভ্যাস ছিল। ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৫১।
সান্যাল মশাই সদ্য বিবাহিত। তিনি বিয়ের আগে হাফ প্যান্ট পরের কাজের তত্ত্বাবধান করতেন। বিয়ের পর জানা গেল ভদ্দরলোকে ‘হাফপ্যান্ট’ পরে না, কিন্তু ধুলো বালি লাগার ভয়ে ফুল প্যান্টকে গুটিয়ে নিয়ে আসতেন প্রায় হাঁটু অবধি। সেই অবস্থাতেই দেখা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। গাড়ীতে প্রায় তাঁর কোলে বসেই এলেন কর্মস্থলে। সরেজমিনে তদন্ত করলেন, মুখে মুখে অঙ্ক করে তাক লাগিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর সচিবের কাছে অপ্রিয় হতে পারেন জেনেও সান্যালমশাই গড় গড় করে আদ্যন্ত সত্যি কথা বললেন। কারণ ‘মানসাঙ্কে বিধানচন্দ্রকে ফাঁকি দেওয়ার মত দুঃসাহস তাঁর ছিল না’। সবশেষে মুখ্যমন্ত্রীর চোখ পড়লো ইঞ্জিনিয়ারের গোটানো ফুল প্যান্টের দিকে। অবাক চোখে প্রশ্ন করলেন – ‘হাফ প্যান্ট পর না কেন?’ সান্যালমশাই নিরুত্তর। সলাজ ভঙ্গীতে গোটানো ফুলপ্যান্ট খুলতে শুরু করেছেন।
কাহিনিটি শেষ করেছেন এক অমোঘ বাক্য দিয়ে – ‘না, অকৃতদার মুখ্যমন্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করিনি কেন আমার এ কৃচ্ছসাধন।’
তবে সবচেয়ে মর্মস্পর্শী কাহিনিটির লেখক যিনি তিনি দেশ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেই বেশি খ্যাত, ‘সাগরময় ঘোষ’। তাঁর রচিত ‘একটি পেরেকের কাহিনী’ উপন্যাসটির প্রথম সংস্করণ আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল খুব ছোট বয়সে। ৭১ – ৭২ সালে। কাহিনিটি পূর্ব বঙ্গ থেকে আসা একটি ছোট ছেলের যার নাম বৈদ্যনাথ। তাঁর পরশ পেয়ে কি অদ্ভুত ভাবে পাল্টে গিয়েছিল ছেলেটির জীবন।
একটি পেরেক পায়ে ফুটে টিটেনাস হয়ে প্রায় মরতে বসেছিল বৈদ্যনাথ। ডাক্তার রায় তাঁকে শুধু সারিয়েই তোলেননি, নতুন জীবন দান করেছিলেন। বৈদ্যনাথও নিজের চেষ্টায়, অধ্যবসায়ে তাঁর স্নেহের যোগ্য হয়ে উঠেছিল। প্রায় একদম পরিবারের লোক হয়ে উঠেছে, স্নেহভাজন তো বটেই, এমনকি বিধানচন্দ্র তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছেন।
ইতিমধ্যে দেশ স্বাধীন হয়েছে। বিধানচন্দ্র এখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। বৈদ্যনাথ চাকরি করছে একটি ওষুধ কোম্পানিতে। তার প্রচুর উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এই ওষুধ কোম্পানী এক এংলো সাহেব বৈদ্যনাথকে একদম দেখতে পারেন না। কথায় কথায় D: রায়ের লোক বলে অসম্মান করেন।
বৈদ্যনাথ হঠাৎ করে ধরে ফেললো ঐ এংলো সাহেবের কুকীর্তি। প্রচুর হিসেবে জল মিশিয়ে কোম্পানিকে ফাঁকি দিচ্ছেন। রিপোর্ট ও পেশ করলো। হবি তো হ, এই সময়, রিপোর্ট পেশের পরেই বৈদ্যনাথকে যেতে হল তার দেশের বাড়িতে। ফিরে সে দেখে তার নামে চার্জশীট। বুঝতেই পেরেছিল কার কীর্তি। তর্ক বিতর্কেও সে মাথা ঠিক রেখেছিল। কিন্তু সাহেব যখন আবার D: রায়ের নাম জড়ালেন, সে আর মাথার ঠিক রাখতে পারলো না – ব্যাগ থেকে পিস্তল বের করে এই সাহেবের মাথায় তাক করে খাস চাঁদপুরী ভাষায় চেঁচিয়ে উঠলো – ‘আইজ তরে শ্যশ করুম কুত্তার বাচ্চা’।
এ যেন হঠাৎ দুর্বিপাক! গ্রেপ্তার হল বৈদ্যনাথ। D: রায় তার সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। রাইটার্স বিল্ডিং এ ডেকে জানালেন যে বৈদ্যনাথ তাঁর নাম ডুবিয়েছে। তিনি আর কোন কথাই শুনতে চান না। মাথা নীচু করে বেরিয়ে এল সে।
কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র নয় বৈদ্যনাথ। আবার সে লড়লো ভাগ্যের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত দেখা করতে পারলো। জানালো তার পিস্তল বার করার উদ্দেশ্য ছিল লোকটাকে খুনই করার কারণ সেই সাহেব D: রায়ের নামে কুৎসা করেছিল।
এরপরে উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন মুখ্যমন্ত্রী –‘এই জন্যে তুমি মানুষ খুন করতে গেলে? এ ব্যাপারে তুমি খুন করার জন্য বাংলা দেশেই হাজার হাজার লোক পাবে। বহুকাল ধরে আমার নামে অনেক কুৎসাই রটনা হচ্ছে। ইদানীং তোমাদের মুখ্যমন্ত্রী হবার পর সেটা বেড়েছে বই কমেনি।’
বৈদ্যনাথ মানতে নারাজ। তাঁর ঈশ্বরকে গালি গালাজ করবে? যাই হোক, আবার বৈদ্যনাথের জীবন শুরু হল। সেই জীবনে পদে পদে রইল তাঁর ঈশ্বরের আশীর্বাদ।
চলে এল ১৯৬২ সালের জুন মাস। অসুস্থ বিধানচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে এল বৈদ্যনাথ। খুশী হলেন মুখ্যমন্ত্রী, আবার জানালেন তাঁর মনে হচ্ছে –‘শেষের সে দিন ভয়ংকর’। বৈদ্যনাথ তাঁকে কাজ ছেড়ে বিশ্রাম করতে বললে তিনি জানালেন – ‘দেখো বৈদ্যনাথ, আমার আরোগ্যের একমাত্র উপায় এইসব কাজ নিয়ে থাকা। স্বপ্ন আমি দেখিনা, কিন্তু সংকল্প আমার অনেক। তার কিছু পালন করতে পেরেছি, এখনো অনেক বাকি!’
এই সুযোগে তিনি তাঁর ডাক্তারিতে সাফল্যের রহস্যটিও জানালেন।
‘আসলে ব্যাপারটা কি জান? — মানুষের রোগ থাকে মনে, শরীরে নয়। মনটাকে যদি রোগমুক্ত করা যায় শরীরও সুস্থ হয়ে ওঠে। আমার চিকিৎসাবিদ্যার চাবিকাঠি ছিল সেইটিই।”
কিছুদিন পরেই, ১লা জুলাই, ১৯৬২ তে চলে গেলেন তিনি। তাঁর সেই মৃত্যুদিনেই এই কাহিনীর শুরু লেখককে গল্পটি বলেছিলেন জনৈক বিশুদা।
অদ্ভুত, মর্মস্পর্শী ভাষায় লিখেছেন সাগরময়। লেখাটি শেষ করেও আবার মাঝে মাঝে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে কোন কোন পাতায়। সাধে কি ১৯৯০ সালে ‘দেশিকোত্তম’ পাওয়ার পর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘সাগরদা, এখনো সময় আছে লেখক হওয়ার।’
এই বইটি এবং অন্যান্য ঘটনাগুলি মিলিয়ে কি একটি জীবনী চিত্র করা যেতে পারে না বাংলার রূপকারের ওপর? বাংলার মানুষকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যে তাঁদের জীবনেও এমন একজন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন যাঁর মৃত্যুদিনে সারা কলকাতা উত্তাল হয়ে উঠেছিল যেমন হয়েছিল ২২শে শ্রাবণের দিনে?
আধুনিক বাংলার জন্মদাতার কোন প্রত্যাশা হয়তো নেই, কিন্তু বঙ্গবাসীর এই চাহিদা থাকা খুব স্বাভাবিক। ভিন্নমতের মানুষও যে তাঁর কর্মের জোরে সকলের শ্রদ্ধার পাত্র হতে পারেন, বিধানচন্দ্রের জীবন তাঁর এক অত্যুজ্জ্বল উদাহরণ।
ভাল লাগল
LikeLiked by 1 person
ধন্যবাদ, উদয়ন দা।
LikeLike
সুন্দর । এইসব মানুষের কথা এখনকার প্রজন্মের কাছে পৌঁছনো খুবই প্রয়োজনীয় বলে মনে করি ।
এই প্রবাদপ্রতিম পুরুষ প্রসঙ্গে অনেক কাহিনীই প্রচলিত । দুটি এখানে উল্লেখ করছি, যদিও সত্যাসত্য যাচাই করিনি । তাই শুরুতেই disclaimer দিয়ে রাখলাম ।
প্রথমটি সম্প্রতি জানলাম । একদিন মুখ্যমন্ত্রী ডঃ রায় গাড়ীতে চলেছেন মহাকরণে । পথে দেখলেন বিরোধী নেতা জ্যোতি বসুকে । উদভ্রান্ত চেহারা, উস্কোখুস্কো চুল, হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে চলেছেন । গাড়ী থামিয়ে ডেকে পাঠালেন ।
“কোথায় চললে হে ?”
” আপনারা অন্যায্যভাবে ট্রামের ভাড়া বাড়িয়েছেন । তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা আছে । সেখানেই যাচ্ছি ।”
“কিন্তু দেখে তো মনে হচ্ছে কিছু না খেয়েই বেরিয়েছো । খালি পেটে প্রতিবাদ করে কি বিধান রায়কে হঠাতে পারবে ? গাড়ীতে কিছ খাবার আছে । খেয়ে যাও ।”
জ্যোতিবাবু রাজি হলেন না । তাঁর দেরী হয়ে যাবে ।
কিন্তু বিধান রায়ও ছাড়বার নন । “দেখো, ভূখা প্রতিবাদ আমার কানে পৌঁছবে না । একটু লুচি তরকারি আছে, খেয়ে নাও । দেরী হবে না । আমি তোমাকে গাড়ী করে পৌঁছে দেবো ।”
সেদিন তরুণ বিরোধী নেতাকে খাইয়ে গাড়ীতে পৌঁছে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তাঁরই বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য ।
দ্বিতীয়টি আমার মামার মুখে শোনা । তিনি নিজেও পেশায় ডাক্তার ছিলেন । বিধানবাবুর গুরুতর অসুস্থতায় যে ডাক্তাররা তাঁর চিকিৎসা করছিলেন, তাঁদের মধ্যে মামার বন্ধুও ছিলেন । এই চিকিৎসকরাও সবাই ডঃ রায়েরই ছাত্র । একজন যখন তাঁকে একটি ইঞ্জেকশন দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, ক্ষীণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, সেটি কি । বলা হলো । ডঃ রায় অল্প মাথা নাড়িয়ে বললেন, ” ওতে এখন আর কিছু হবে না হে । বরং ওটা দিয়ে দেখতে পারো ।” এই বলে অন্য ইঞ্জেকশনের নাম বলে দিলেন ।
অর্থাৎ মৃত্যুশয্যাতেও তিনি চিকিৎসা করে চলেছেন । নিজেরই ।
বিরল ব্যাক্তিত্ব !
LikeLiked by 2 people
অসংখ্য ধন্যবাদ এত বড় মন্তব্যের জন্য। বিধান রায়ের বায়োপিক হওয়া খুব প্রয়োজন।
LikeLike
খুব ভালো লাগলো পড়ে ,দাদারাজা ..আমরা অনেক ঘটনা ই জানতাম না এই প্রবাদপ্রতিম মানুষটি সম্বন্ধে …জানতে পারলাম ..খুব খুব ভালো লেগেছে
LikeLiked by 1 person
পেলে “একটি পেরেকের কাহিনী’ পড়ে নিও।
LikeLike
যে দিন লিখেছিলে সেদিন পড়ে উঠতে পারি নি, আজ পড়লাম। অসাধারণ।
LikeLiked by 1 person
অসাধারণ রচনা। মন্তব্য করার আর কিছুই নেই।
LikeLike
Osadharoner osadhsron kahini.MonKe apluto Kore.Jadi Dr.Bidhan Rai r biopic keu korte pare tar jonno somogro bangalee jati kritogyo thakbe
LikeLiked by 1 person
বাহ্!
LikeLike
অনেক ধন্যবাদ শেখর!
LikeLike
দাদারাজা অনেকদিন পরে ফেসবুকে এসে তোমার এই লেখাটি পড়ে ভীষণ ভালো লাগলো। পড়তে পড়তে উপলব্ধ হলো এক অতি দুরদৃষ্টি সম্পন্ন মানব ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের অমূল্য বার্তাকে ফুটিয়ে তুলেছো তোমার লেখনীতে বিভিন্ন সংকলনের মাধ্যমে। আজকের অতি বেগবান জীবন যাত্রার সাথে তাল রাখতে রাখতে সমাজের অনেকাংশেই যেখানে মূল্যবোধ, নীতিবোধ,মানবিকতা, শিষ্টাচারের মান নিম্নগামী হয়ে পড়ছে, সেখানে এই ধরণের লেখার মূল্য আপরীসীম । অনেক ধন্যবাদ এমন একটি লেখার মধ্যে দিয়ে সমৃদ্ধ করার জন্য।।
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ অরু।
LikeLike