এক বন্ধু আবার সেই পুরনো বিতর্ক উসকে দিয়েছেন। ‘তুমি রবে নীরবে’ গানটিতে দেবব্রত বিশ্বাস ‘সফল স্বপন’ কথাটি ভুল করে ‘সকল স্বপন’ গেয়েছেন। এই নিয়ে বিশ্বভারতীর অনুমোদনেও সমস্যা হয়। তাঁর কথার উত্তর ঠিক একবাক্যে বোঝানো শক্ত।
তাই এই লেখার প্রস্তাবনা।
এই দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বিখ্যাত লেখক শ্রী সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। তাঁর ‘চিরসখা হে’ নামক বহুল প্রচারিত রচনাটিতে তিনি লিখেছিলেন
আর একটু পরেই তিনি দ্বিতীয়বার আমাদের জয় করে নিলেন ‘তুমি রবে নীরবে’ গেয়ে। জীবনে প্রথম সবিস্ময়ে খেয়াল করলাম দ্বিতীয় স্তবকে তিনি ‘মম জীবন যৌবন, মম সফল স্বপন’ গাওয়ার সময় ঈষৎ পালটে ‘সকল স্বপন’ গাইলেন, আমাদের সুন্দরীতমাদের অনেকেই ভেবেছিলেন ভুলে হল এরকম। পরে শুনেছি জর্জ বিশ্বাসের বিশ্বাস ছিল যে প্রেমিকার সৌরভ ছাড়া তো স্বপ্ন সফলতায় পৌঁছতেই পারে না; সুতরাং ‘সকল স্বপন’ হবে (এখন প্রমাণ হয়েও গেছে যে রবীন্দ্রনাথের পান্ডুলিপিতে ‘ক’ ও ‘ফ’ খুব প্রভেদ না রাখায় এই মুদ্রণ বিভ্রাট ঘটেছিল) যা থমকে আছে প্রিয় নারীর সুগন্ধের প্রত্যাশায়।
আজ আর বলতে দ্বিধা নেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিশ্বে তিনি সর্বাধিক ভাবে সেরিব্রাল। অচলায়তনের বাসিন্দা হতে তিনি অস্বীকার করেছিলেন; বিশ্বভারতীর নায়েব গোমস্তাদের সতর্ক বাণী সত্ত্বেও খরাতপ্ত তৃষাদগ্ধ প্রাণের এই প্রদেশে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ঋষ্যশৃঙ্গের মতো মৌন তপস্বী যার আগমনে ঘোষিত হয় সমাগতোরাজবদুন্নত ধ্বনি – গানের বারিধারা – আমাদের নব মেঘদূত।
কিন্তু আমরা তা মেনে নাও নিতে পারি। আমাদের অনুসন্ধানের এটি একটি অনুপ্রেরণা মাত্র।
পুরো গানটি আলোচনায় এনে দেখা যাক-
তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম
নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমানিশীথিনী-সম ॥
মম জীবন যৌবন মম অখিল ভুবন
তুমি ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী-সম ॥
জাগিবে একাকী তব করুণ আঁখি,
তব অঞ্চলছায়া মোরে রহিবে ঢাকি ।
মম দু:খবেদন মম সফল স্বপন
তুমি ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী-সম ॥
লক্ষ করলে দেখা যাবে, গানটির প্রথম পরিচ্ছদ টি – জয়ের কথা, আনন্দ ও যৌবনের সমার্থক, তাই জীবন যৌবন ও গৌরবের কথা বলা হয়েছে। সেখানে জীবন যেন পরিপূর্ণ, তাই পূর্ণিমানিশীথিনী-সম – সেজন্যই “গৌরব”। পরের পরিচ্ছদটিতে পরাজয় ও ব্যর্থতার কথা, দুঃখবেদন এবং করুণ আঁখি – সবই তারি প্রতীক। যখন ব্যর্থতা ঢেকে ফেলে, তখনই প্রয়োজন ছায়ার। সেই দুঃখের দিনে অন্য কেউ নেই, কেবল তুমি ই আমার পাশে তাই – জাগিবে একাকী তব করুণ আঁখি! এবং সে দুর্দিনে কিন্তু “গৌরব” নয়, প্রয়োজন স্নিগ্ধ “সৌরভের” যা পীড়িত মনকে আবার অনুপ্রাণিত করবে।
অসাধারণ তুলনা! এই কাব্যিক অনুভুতি একমাত্র রবীন্দ্রনাথেই সম্ভব। কিন্তু খটকা একটি মাত্র শব্দে – মম সফল স্বপন এর সফল শব্দটিতে! যেখানে ব্যর্থতার কথা এবং করুণ আঁখির একাকী জেগে থাকার কথা সেখানে কি সফল কথাটী খুব সুপ্রযুক্ত! সফল স্বপন কে কি অঞ্চলছায়া দিয়ে ঢাকার কি কোন প্রয়োজন আছে, তা তো সাফল্যে সততঃ উজ্জ্বল! এমনকি সফলতার সঙ্গে সৌরভের তুলনায় গৌরব বেশী ই মানায়। বরং যে স্বপন বিফল, আঁচলের ছায়ায় আশ্রয়ের প্রয়োজন তো তারই। সেই ভাবে দেখতে গেলে মনে হয় হয়তো বিফল কথাটা খুব কাব্যিক নয়, কিন্তু “সকল” হলে হয়তো ভালো হত কারণ তা সফল এবং বিফল দুই স্বপ্নকেই বোঝাতে পারে। এমনকি আঁচল দিয়ে যখন ঘিরে থাকে, তার মধ্যে যে একটা সম্পূর্ণতার আভাস থাকে তা বোঝাতে “সকল” শব্দটি অনেক সুপ্রযুক্ত বলে আমার মনে হয়।
এই কথা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম শ্রী সুমিত রায়ের সঙ্গে। তাঁকে জানিয়েছিলাম আমার দ্বিধার কথা। তাঁর সাইট gitabitan.net তিনি এই আলোচনাটি জুড়ে দেন।



ইতিমধ্যে আমাদের হাতে এসে গেছে রবীন্দ্র পাণ্ডুলিপির আবিষ্কৃত রূপ। তাতে দেখা যাচ্ছে সঞ্জয় ঠিকই লিখেছেন, ‘ক’ ই আছে। ‘;ফ’ মুদ্রণপ্রমাদ। একই জায়গায় লিখিত অন্য ‘ক’ গুলিকে দেখলে চিনতে আদৌ অসুবিধে হয় না।

এতগুলি ব্যাপারে নিশ্চিত না হওয়া গেলে আরো দুটি দিক থেকে ভেবে দেখা যেতে পারে। প্রথমত গানে প্রথম অনুচ্ছেদ এ –
মম জীবন যৌবন মম অখিল ভুবন
আর দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ এ
মম দু:খবেদন মম সফল স্বপন
এই দুটি লাইন যদি আমরা বারংবার ভাবি তাহলে বুঝতে অসুবিধে হয়না যে প্রথম লাইনটির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দ্বিতীয় লাইনটিতে স্বপন র আগে যে বিশেষণটি বসবে তা হবে ‘অখিল’ শব্দের সমার্থক অর্থাৎ সম্পূর্ণতার প্রতীক। তাই ‘সকল’ সুপ্রযুক্ত।
এবার খোদ রবিঠাকুরের লিখনশৈলীর দিকে চোখ ফেরানো যাক। আমরা জানি প্রত্যেক লেখকের একটি নিজস্ব শৈলী থাকে। দেখা যাক তিনি তাঁর অন্য গানে ‘সফল’ শব্দের কিরকম প্রয়োগ করেছেন। গীতবিতান খুঁজলে যা পাওয়া যা তা হল মোটামুটি এইরকম – মূলত তা ক্রিয়া রূপে, বিশেষণ রূপে নয়।

তুলনাতে যদি আমরা দেখ বিশেষণ রূপে ‘সকল’ শব্দের প্রয়োগ, তা বহুল পরিমানে। নীচে দেওয়া গেল –

সব কিছু মিলিয়ে দেখলে আমাদের মনে হয় ইঙ্গিত ভীষণভাবে ‘সকল’র দিকেই। সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, দেবব্রতর লেখা, রবিঠাকুরের পাণ্ডুলিপি এবং সর্বোপরি তাঁর নিজস্ব শৈলী সেই সাক্ষ্যই দেয়। এই প্রসঙ্গে আবার আমাদের মন জয় করে নেন দেবব্রত বিশ্বাস। সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের ভাষাতে বলি –
তানসেন গান গাইলে নাকি বৃষ্টি নামত! কিন্তু আহিরিটোলার প্রখর মধ্যদিনে আমি নিজে দেখেছি দেবব্রত বিশ্বাস রেডিওতে ‘বহুযুগের ওপার হতে আষাঢ়’ গাইছেন আর আকাশ জুড়ে নীলাঞ্জনছায়া| এমনকী তিনি ‘আষাঢ়’ শব্দটি উচ্চারণ করলে, উজ্জ্বয়িনী বা বিদিশা নয়, আমাদের কালীঘাটেও বৃষ্টি নামত। তারপর থেকেই আমার মনে হয় আর কোন বাঙালি গায়ক কি ‘আষাঢ়’ শব্দের উচ্চারণ জানেন? এরকম যাদুবিদ্যা তিনি নানা সময়ে দেখাতেন।
সত্যিই তাই। তাঁর যাদুবিদ্যাতে আমরা নতুন করে আবিষ্কার করে চলেছি । কথা অনেক হল এবারে গান শোনার পালা। তিনি ‘নীরবে’ আমাদের হৃদয়ে থেকে যান – ‘পূর্ণিমা নিশীথিনী সম’।
https://www.youtube.com/watch?v=WjQbzBx7KTs
এখানে আরো লক্ষ করলে দেখা যাবে, তিনি গাইছেন ‘নিভৃত, নিবিড়’ – একেবারে পাণ্ডুলিপির সঙ্গে মিলিয়ে। পরবর্তীকালে সবাই যদিও ‘নিবিড়, নিভৃত’ গেয়েছেন উচ্চারণের ক্রম নির্ধারণের সুবিধার জন্য।
Ashadharon bishleshon. Mon vore gelo. Khub i shotyi ehong Debabrata Biswaser er konthe ei gaanti jeno kothar sharmormo ti mele dhorechen.
LikeLike
অনেক ধন্যবাদ, ভাস্কর!
LikeLike
খুব ভালো লাগল। আমার মনে হয় সকল টাই ঠিক। খুব গভীর বিশ্লেষন করেছেন লেখক।
LikeLike
অনেক ধন্যবাদ, অনিন্দিতা দি।
LikeLike
কবির নিজস্ব লিপিতে প্রমাণিত হয়ে গেছে। না হলেও বিশেষ ক্ষতি ছিলোনা। তাঁর বিশেষণ ও ক্রিয়াপদ ব্যবহারের একটা নির্দিষ্ট বিন্যাস রয়েছে। তার বিশ্লেষণটি খুব বিশদে এসেছে এখানে। ভালো লাগলো।
LikeLiked by 1 person
শিবাংশু দা, “বিশেষণ ও ক্রিয়াপদ ব্যবহারের একটা নির্দিষ্ট বিন্যাস”!! কি সুন্দর বলেছেন কথাটা।
LikeLike
অসাধারণ লাগলো 🙏🙏🙏
On Thu, 13 Feb, 2020, 9:53 pm ভাবনা আমার পথ খুঁজে চলে, wrote:
> bhaskarbose1960 posted: ” এক বন্ধু আবার সেই পুরনো বিতর্ক উসকে দিয়েছেন।
> ‘তুমি রবে নীরবে’ গানটিতে দেবব্রত বিশ্বাস ‘সফল স্বপন’ কথাটি ভুল করে ‘সকল
> স্বপন’ গেয়েছেন। এই নিয়ে বিশ্বভারতীর অনুমোদনেও সমস্যা হয়। তাঁর কথার উত্তর
> ঠিক একবাক্যে বোঝানো শক্ত। তাই এই লেখার প্রস্তাবনা। এই ”
>
LikeLiked by 1 person
খুব ভালো আর প্রাসঙ্গিক একটি লেখা। লেখককে অন্তর থেকে সাধুবাদ জানাই। তবে দেবব্রত বিশ্বাসের যে রেকর্ডের প্রসঙ্গে এ লেখাটি তৈরি, সেই রেকর্ডের নামটিই এখানে রেফারেন্স হিসেবে তুলে দেওয়া উচিৎ ছিল। যে রেকর্ডিংটি এখানে দেওয়া হচ্ছে, সেটা অনেক পরে গাওয়া কোন অনুষ্ঠানের লাইভ রেকর্ডিং।
LikeLiked by 1 person
আপনার পরামর্শ মতো করে দিয়েছি। অনেক ধন্যবাদ।
LikeLike
আপনি সত্যি বড্ড ভালো লেখেন
LikeLiked by 1 person
অজস্র ধন্যবাদ। এভাবেই পাশে থাকুম।
LikeLike
রবীন্দ্রসঙ্গীত খুব ভালো লাগে। এত খতিয়ে দেখার বিদ্যাবুদ্ধি আমার নেই সেকথা অকপটে স্বীকার করে বলছি আপনি এমন প্রাঞ্জলভাবে এবং বিভিন্ন প্রমাণসহ ‘সকল’ কে ‘সফল’ ভাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুরাগীদের জ্ঞানের আলোতে আনলেন তার জন্য অশেষ ধন্যবাদ। আর শ্রদ্ধেয় দেবব্রত বিশ্বাস… ওয়েল, কে কবে আষাঢ় এর ঢ় কে এমনভাবে নাভিমূল থেকে উচ্চারণ করেছে জানিনা, শুনিনি। অনেক ধন্যবাদ আবারও।
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ!! আপনার মত পাঠকের জিন্যই লেখা সার্থক মনে হয়।
LikeLike
I wrote some comments. They are not shown here.
LikeLiked by 1 person
Okay, thanks.
LikeLiked by 1 person
এখন আশাকরি দেখতে পাচ্ছেন।
LikeLike