ভারতীয় ফুটবলের অনির্বাণ 'প্রদীপ' শিখা

তাঁর সম্পর্কে বলতে শুরু করলে কথা শেষ হয় না।

প্রথম ফুটবলের স্মৃতি বলতে সেই ১৯৭০ সালের পাস ক্লাব ও ইস্টবেঙ্গল খেলা। শেষ মুহূর্তে গোল করে ইস্টবেঙ্গল এর চ্যাম্পিয়ন হওয়া। আর পাঁড় ঘটি হয়েও আমার ইস্টবেঙ্গল সমর্থক হয়ে যাওয়া।

তিনি কত বড় খেলোয়াড় ছিলেন তা বড়দের কাছে শুনেছি। খেলা দেখার সৌভাগ্য হয়নি, কিন্তু শুনেছি বহু কথা। পরবর্তী কালে প্রকাশিত তাঁর ‘উইং থেকে গোল’ আত্মজীবনীতেও কিছু কিছু পড়েছি।

সেদিন অরুময়ণৈগম তাঁর মৃত্যুর পর লিখেছিলেন,
আমি খুব ভাগ্যবান ছিলাম যে পিকের সঙ্গে খেলতে পেরেছি। আমি লেফট উইঙ্গার আর পিকে রাইট উইঙ্গার। আমরা দুজন দুদিক থেকে সুতীব্র গতিতে ঢুকে বল বাড়াতাম আর চুনী পটাপট গোল করতো

আরো শুনেছি তাঁর বিশিষ্ট বন্ধু ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এই বন্ধুত্ব নিয়ে এক মজার গল্প পড়েছিলাম।

আমাদের বাড়িতে পুরনো সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকা বাঁধানো থাকতো। সেই পত্রিকায় এক সময়ে মুকুল দত্ত লিখতেন খেলোয়াড়দের নিয়ে। কোন এক সপ্তাহে তাঁর বিষয় ছিল শ্রীমতী দীপা চট্টোপাধ্যায়।

সেই প্রসঙ্গে সম্প্রতি লিখেছেন সৌমিত্র –

আমার স্ত্রী ব্যাডমিন্টন খেলত। ওর খেলার যাতে উন্নতি হয়, তার জন্য দীপু ঘোষকে নিয়ে এসেছিলে। শুধু তাই নয়। আমার স্ত্রীকে বলেছিলে, আমি আর বন্ধু দু’জনে মিলে তোমাকে ও দীপুকে হারিয়ে দেব। যদিও তা অসম্ভব ছিল আমাদের পক্ষে। কিন্তু বন্ধু তুমি কখনও পিছিয়ে যাওনি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে গিয়েছো।

এরপর তাঁর কথা শুনতাম পাড়ার দাদাদের কাছেই। তাঁর ভোকাল টনিক তো সেই সত্তরের দশকেই বিখ্যাত হয়েছিল।

১৯৭২ সালে তিনি ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কোচ হলেন। শুরু হল ১৯৭২ – ৭৫। সেই স্বর্ণযুগ। তারপর ১৯৭৬ এ মোহনবাগান, আবার সাফল্য।

এই সময়ে আমি মাঠে খেলা দেখিনি কিন্তু শুনেছি তাঁর খেলোয়াড়দের প্রতি অগাধ ভালোবাসার কথা। প্রত্যেক খেলোয়াড় কে তিনি আলাদাভাবে গড়ে তুলতেন।

সেই গল্প শুনেছি সুভাষ ভৌমিকের মুখে। অনেকেই মনে করতে পারেন ২০০৫ – ২০০৬ সাল নাগাদ একটা অনুষ্ঠান হত টিভিতে – পরম্পরা। সঞ্চালনায় চন্দ্রবিন্দুর অনিন্দ্য। গুরু – শিষ্য পরম্পরা ছিল মূল বিষয়।

একদিন এলেন সুভাষ ভৌমিক ও পিকে। সুভাষ তখন জানিয়েছেন যে ১৯৭২ সালে মোহনবাগান থেকে বিতাড়িত হয়ে তাঁর সমস্ত আত্মপ্রত্যয় একেবারে ভেঙে চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সেইসময় পিকে তাঁকে ডেকে নেন, পুরো নিজ দায়িত্বে তাঁকে আবার তাঁর আত্মপ্রত্যয় ফিরিয়ে দেন। অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে নিজের পুনর্জীবন প্রাপ্তির অধিকাংশ কৃতিত্বই তাঁর প্রদীপদাকে দিলেন। অত্যন্ত মর্মস্পর্শী লেগেছিল সেই সাক্ষাৎকার। বুঝেছিলাম কতটা শ্রদ্ধা অর্জন করলে এমন শিক্ষক হওয়া যায়।

তবে সেই সময়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয় ছিল ভাষ্যকার হিসেবে। তখন বাংলাতে অজয় বসু ও পুষ্পেন সরকার দারুণ ধারাভাষ্য দিতেন। খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন সুকুমার সমাজপতি। অপূর্ব কণ্ঠস্বর!

তা সত্ত্বেও বলবো, চমকপ্রদ কমেন্ট্রি করতেন শ্রী প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় – পিকে! পিকেকে যাঁরা কোচ হিসেবে মাঠে দেখেছেন, তাঁরা মনে করতে পারবেন যে তিনি কোচ হলেও একেবারে খেলার মধ্যে ঢুকে পড়তেন, মাঠে খেলোয়াড়দের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ছোটাছুটি করতেন। একবার বিপক্ষ কোচ অমল দত্তর সঙ্গে এই নিয়ে তাঁর খুব বিরোধ ও বেঁধেছিল।

১৯৭২ – ১৯৭৫, ইস্টবেঙ্গলের কোচ হিসেবে তিনি তখন খুবই সুখ্যাত। তাঁর ‘ভোকাল টনিক’ ময়দানে খুব আলোচ্য বিষয়। তাঁর ধারাবিবরণীর মধ্যেও কিন্তু এই ‘খেলার মধ্যে ঢুকে পড়া’ ব্যাপারটা দিব্যি ছিল।

খেলার মাঠের উত্তেজনা তাঁর কণ্ঠের মধ্যে দিয়ে আমাদের কানে আছড়ে পড়ত – যেমন ভুল পাস করলে তিনি বলে উঠতেন – ‘হায়, হায়, এই ভুল কেউ করে’ কিংবা দারুণ থ্রু পাস দিলে – “অপূর্ব পাস, ডিফেন্সের বুক চিরে –ওঃ, কিন্তু সেখানে কেউ নেই”!! সেই হতাশা বা স্ফূর্তি তাঁর গলায় যেন অদ্ভুত ভাবে ধরা দিত। সম্ভবত: তাঁর খেলোয়াড় বা কোচ সত্ত্বা যেন ছাপিয়ে উঠত তাঁর ধারাভাষ্যকার সত্ত্বাকে। সবচেয়ে মজা লেগেছিল কোন একজন ফরওয়ার্ড, সম্ভবত: সুভাষ ভৌমিক খুব সহজ সুযোগের সদ্ব্যবহার না করতে পারার জন্য তাঁর আক্ষেপপূর্ণ প্রতিবেদন – “কোন ডিফেন্ডার নেই, গোলকিপার মাটিতে পড়ে, সুভাষের পায়ে বল, ফাঁকা গোল – ওঃ, দুঃখের কথা আপনাদের কি বলব, সেই বল কিনা সুভাষ বাইরে মারলেন”!! আমরা মনশ্চক্ষে দেখতে পেতাম যে কমেন্টারি বক্সে তিনি বোধহয় কপাল চাপড়াচ্ছেন বা চুল ছিঁড়ছেন!!

ভাবা যায়? এরকম ভাবে ও ধারাভাষ্য দেওয়া যেতে পারে? আমাদের মত মফস্বলি ছেলেদের ভরসা ছিল শুধুই রেডিও, তাই তাঁর ধারাভাষ্যই আমাদের খেলার মাঠে নিয়ে যেত।

১৯৭৭ সালে অবশ্য তাঁর গতি প্রতিহত হয় লীগের খেলায় মোহনবাগানের পরাজয়ে। তখনও তিনি রেডিওতে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে পরপর দু গোল খেয়ে তাঁর টীম পিছিয়ে পড়েছিল, আর খেলাতে ফিরতে পারেনি। দোষারোপ করেননি খেলোয়াড়দের।

একবার অবশ্য করেছিলেন। “শাক পাতা দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করা যায় না”! বিতর্কিত মন্তব্য। অনেকে বলেছিলেন, ” চচ্চড়ি রেঁধেই দেখান না”!

আর একবার তাঁর ভোকাল টনিক ব্যর্থ হয়েছিল। সল্ট লেকের ভারতীয় টীমের ক্যাম্পে। সেইসময় দেশ ও ক্লাবের খেলা নিয়ে খেলোয়াড়দের তীব্র সংঘাত হয়। কিছু খেলোয়াড় চলে গিয়ে ক্লাবের হয়ে খেলতে চাইলে তিনি বলেন যে ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকীর দেশের ছেলে তোরা, এটুকু করবি না দেশের জন্য?
কেউ জবাব দিয়েছিল, “ক্ষুদিরাম গ্যাস খেয়ে মরেছে, আমরা গ্যাস খেতে রাজি নই!”

এটা তাঁকে সম্ভবত বিরাট আঘাত দিয়েছিল। পরে তাঁর কথাবার্তার মধ্যেই তা ধরা পড়েছিল।

তাঁর বেশ দীর্ঘ বক্তব্য একবার শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমাদের রাজপুরে একটি খেলার ফাইনালে তিনি প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন।

শুরু করেছিলেন খেলার আলোচনা দিয়ে। একটি খুব ভালো গোল হয়েছিল। উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেছিলেন যে এটি খুবই উঁচুমানের। এমনকি ছোটখাটো এমন আলোচনা করেছিলেন তাতে বুঝেছিলাম কত মনোযোগ দিয়ে তিনি খেলা দেখেছেন।

আমাদের পাড়ার প্রতাপ ঘোষ ও উপস্থিত ছিলেন। পিকে বলছিলেন – আমি জানি প্রতাপ খুব হাত দেখাতে ও দেখতে ভালবাসেন। আমি আশা করবো ওর হাত খুব তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে যাক।

প্রসঙ্গত সেই সময় প্রতাপ তাঁর খেলার সঠিক ছন্দে ছিলেন না, সম্ভবত চোট আঘাত নিয়ে কিছুটা ব্যতিব্যস্ত থাকবেন। এর থেকে বোঝা যায়, পিকে তাঁর খেলোয়াড়দের শখ সম্পর্কেও বেশ অবহিত ছিলেন।

এরপরে তিনি বলেছিলেন ফুটবলে আমাদের পতনের কথা। এমনকি এশিয়াতেও আমরা ভাল জায়গায় নেই। এর কারণ আমাদের ভাবতে হবে। কথার মধ্যে আবার মজাও ছিল।

দুঃখ করে বলছিলেন এশিয়ার বেশ কয়েকটি টিম এখন তিন গোল হাতে রেখে আমাদের হারাতে পারে। আমাদের খেলোয়াড়েরা নাকি দ্বিতীয়ার্ধে এত পরিশ্রান্ত হয়ে যায় যে কোন পরিবর্ত খেলোয়াড় এর দেখা পেলেই একাধিক জন জিজ্ঞেস করতে থাকে – “স্যর, আমি?” তখনকার বিখ্যাত স্টপার প্রদীপ চৌধুরী নাকি তাঁর মাথাভর্তি চুলের দিকে তাকিয়ে দুঃখ করেছিল, “স্যর, আপনার মাথায় এখনো কত চুল! সররা মেরে মেরে আমার সব চুল উঠে গেল!”

সবাইকে উৎসাহ দিয়েছিলেন শরীরচর্চায় মনোযোগ দিতে। বলেছিলেন এর সর্বাত্মক ফল আছে। সামগ্রিকভাবে শরীর চর্চার ফলে মানসিক ও সামাজিক একাত্মবোধ ও সম্ভব।

আমাদের খুবই আশ্চর্য লেগেছিল। আশির দশক, তখন উনি এক বড়ো মাপের সেলিব্রিটি। আমাদের মফস্বলের একটি খেলার পুরস্কার বিতরণী উৎসব। কিন্তু তিনি একেবারে আন্তরিকভাবে, প্রায় প্রাণ ঢেলে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আমরা খুব ভাগ্যবান মনে করেছিলাম নিজেদের। ভেবেছিলাম – এই হল সেই বিখ্যাত ভোকাল টনিক।

মনে পড়ে ১৯৯০ সালে রনজি ট্রফি ফাইনালে খেলার জন্য ও বাংলা দলের কাজে লেগেছিল তাঁর ভোকাল টনিক।
তাঁর প্রতিভা গগনচুম্বী, আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু তাঁর আন্তরিকতা, যে কোন ক্ষেত্রেই নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার এক অনবদ্য প্রবণতা – তা তো সবসময়ই আমাদের পথচলার আদর্শ হতে পারে।

প্রণাম প্রদীপবাবু, সার্থকনামা আপনি। আমাদের হৃদয়কে চিরকালই আলোকিত করে রাখুন আপনি।

আঁধারের গায়ে গায়ে আপনার পরশে নিশিদিন আপনারই জ্বালানো আলোকশিখা জলুক প্রাণে।

4 thoughts on “ভারতীয় ফুটবলের অনির্বাণ 'প্রদীপ' শিখা

  1. লেখাটা অাজ পড়লাম। সুখপাঠ্য গদ্যে ভাল লেখা। জানেন, তাঁর খেলোয়াড়সত্তা, কোচিং কৃতিত্ব এইসব নিয়েই সবাই মূলত বলেন। বলাতো উচিতই। কিন্তু একটা জিনিস অনেকে লেখায় অানেন না। অাপনি এনেছেন। তাঁর ধারাবিবরণী।
    ‌ অামার কাছে বাংলার সেরা দুই কোচই সেরা ভাষ্যকার। পুষ্পেনের কন্ঠ বা অজয়ের অপূর্ব ভাষা একটা লেভেল পর্যন্ত ভালো লাগে। তারপর যেন খিদে মেটে না। সেই খিদেটা মেটাতেন এঁরা। অামাদের ছিঁটেফোঁটা ফুটবলবোধ যদি কিছু তৈরি হয়ে থাকে , অন্তত অাধুনিক ফুটবলের গলিঘুঁজি, তার বিজ্ঞানের প্রতি যদি অাকর্ষণ তৈরি হয়ে থাকে সেই প্রাক- স্যাটেলাইট চ্যানেলের যুগে, তার জন্য পত্রপত্রিকাগুলোর ভালো লেখার সঙ্গে এঁদের দুজনের বিশ্লেষণের কৃতিত্বই বেশি। এই মানুষটাই একমাত্র মানুষ যাঁর অত্যন্ত দ্রুত কথায় ক্লান্তি, বিরক্তি অাসত না। মনে হত এত কথার এতটুকুতেও পুনরাবৃত্তি নেই! প্রত্যেকটা শব্দ প্রণিধানযোগ্য। বাকি দিকগুলো অাপনি সুন্দর লিখেছেন। দ্বিতীয়জন অমল দত্ত। তবে পিকের মত সম্পূর্ণ ফুটবল-ব্যক্তিত্ব এদেশে নেই। চুনি কোচিং-এ অাসেননি! তাঁর একটাই অসম্পূর্ণতা! এই দেশ তাঁকে ফুটবল- প্রশাসনে অানেনি! সেটা দেশেরই ব্যর্থতা!

    Liked by 1 person

    1. অনেক ধন্যবাদ। আমাদের ছোটবেলায় ওঁর ধারাবিবরণীর একটা উদ্দাম আকর্ষণ ছিল।

      Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s