বাংলা গানে খেয়ালরসের ছোঁয়া

বাংলা সাহিত্যে তাঁকে বলা চলে ‘ক্ষণিকের অতিথি’। কিন্তু এত অল্প সময়ে এমন অসামান্য সাহিত্য সেবা আর কেউ করেছেন বলে জানা নেই।

তাঁর ‘আবোলতাবোল’ গ্রন্থের ভূমিকায় সুকুমার রায় স্বয়ং জানিয়েছিলেন এটি খেয়ালরসের গ্রন্থ। 

‘যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব, তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার। ইহা খেয়াল রসের বই। সুতরাং সে রস যাঁহারা উপভোগ করিতে পারেন না, এ পুস্তক তাঁহাদের জন্য নহে।’

তাঁর মৃত্যুর প্রায় শতবর্ষ পরেও এই খেয়ালরস আমরা উপভোগ করে চলেছি। কোন কোন কবি তাঁর থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কিছু কিছু কবিতা রচনা করে মাঝে মধ্যে আমাদের চমকে দিলেও সেই ধারাবাহিকতা কেউই দেখাননি। এই তালিকাতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সম্ভবতঃ রোকনুজ্জামান খান রচিত ‘হাট্টিমাটিম টিম / তারা মাঠে পাড়ে ডিম।’

সুকুমারের কবিতা যে গানে রূপান্তরিত হতে পারে তা অনুভব করেছিলেন শ্রদ্ধেয় জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ।

ভাবলে অবাক হতে হয়, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতজ্ঞ এই মানুষটি একটি নয়, তিন-তিনটি গানে সুর দিয়ে সুন্দর যন্ত্রানুষঙ্গের সাথে আকাশবাণীর রম্যগীতির অনুষ্ঠানে পরিবেশন করলেন। এই তিনটি কবিতা হল – ‘গন্ধবিচার’, ‘রোদে রাঙা ইটের পাঁজা’, ‘দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম’। কবীর সুমন তাঁর একটি লেখাতে (১) জ্ঞানপ্রকাশের সঙ্গীত পরিচালনার এক মনোগ্রাহী বিবরণ দিয়েছেন, উৎসাহীরা পড়ে দেখতে পারেন। সুতরাং বাঙালী গীতিকবিরা, যাঁরা এই গানগুলি শুনেছিলেন, তাঁরা যে অনুপ্রাণিত হবেন তা আর আশ্চর্য কি! ইচ্ছে করলে ‘রোদে রাঙা ইটের পাঁজা’ গানটি শুনেও দেখতে পারা যায়।

গন্ধবিচার – https://www.youtube.com/watch?v=nR_sK0ttE6Q&t=108s

বিষয়টিতে আমার প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেন গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর ‘কথায় কথায় রাত হয়ে যায়’ আত্মজীবনীতে। ২রা মে শুধু সত্যজিৎ রায়েরই জন্মদিন নয়, পুলকবাবুরও জন্মদিন। প্রত্যেক জন্মদিনে পুলকবাবু সত্যজিৎকে শুভেচ্ছা জানালে পুলকবাবুকে প্রতি-শুভেচ্ছা জানিয়ে সত্যজিৎ অনুরোধ করতেন, ‘পুলক, এবার আবার ‘আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না’র মত আর একখানা গান চাই।’ পুলকবাবু জানাতেন এই গানের অনুপ্রেরণা স্বয়ং সত্যজিতের পিতৃদেব সুকুমার রায়। সত্যিই তো এই গানে তো সেই ‘আজগুবি’, ‘উদ্ভট’ ‘খেয়ালরসের’ ছড়াছড়ি।

আমরা যারা ষাটের দশকে বড় হয়েছি তারা জানি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়মিত মজার ছড়া লিখতেন। তা প্রকাশিত হত দেব সাহিত্য কুটীরের কিশোরদের জন্য প্রকাশিত পূজাবার্ষিকীতে। আমার ভাতৃপ্রতিম বন্ধু তথাগত ভট্টাচার্যর কাছ থেকে থেকে জানতে পারছি, তাঁর জনপ্রিয় গানের আগেই এই কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল ইন্দ্রনীল নামক পূজাবার্ষিকীতে, ১৯৬৮ সালে। কবিতাটি পড়লেই বোঝা যাবে কি পরিমাণ সুকুমারী প্রভাব রয়েছে।

কবিতার নাম ছিল – রাঁধুনী মিঠুয়া। ইন্দ্রনীল পূজাবার্ষিকীতে যা ছাপা হয়েছিল তা এইরকম –

তবে পরের বছর, ১৯৬৯ সালে, ‘প্রথম কদম ফুল’ ছবির জন্য গানে রূপান্তরিত হতে গিয়ে ‘উচ্ছের ছেঁচকি’ হয়ে গেছে ‘প্যারিসের ছেঁচকি।’ এটি সম্ভবতঃ ইস্তাম্বুল, জাপান, কাবুলের সঙ্গে অসংলগ্ন প্রাসঙ্গিকতা রাখার জন্য। ‘চ্যাং ব্যাং খলসে’ – এটি ছিল শিশু কিশোরদের জন্য। সিনেমার প্রয়োজনে প্রাপ্তবয়স্ক ‘বীর হাজরা’ আর ‘কুন্তী’র উদ্ভব।

“শোনো ভাই কুন্তী, নিয়ে এসো খুন্তি / ওহে বীর হাজরা, থাক হাড় পাঁজরা / 
আস্ত মাছেই করি ডেভিল অগুন্তি।
মোটেই হবেনা ভুঁড়ি যত খুশি খান না / 
আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না।”

সুতরাং এই ‘আজগুবি চাল’ আর ‘অসম্ভবের ছন্দ’ যে সত্যজিতের মনোরঞ্জন করবে তা আর আশ্চর্য কি! অনেক সুকুমার সৃষ্ট চরিত্রের মতই এ গানও আশ্চর্য ভাবে আজও জনপ্রিয়। এমনকি কোন বিষয়ে চরম বৈসাদৃশ্য দেখলে আমরা অনেক সময় আজও বলে উঠি – ‘উফফ! যা হয়েছে না! মিলে মিশে একেবারে প্যারিসের ছেঁচকি!’

তবে আধুনিক বাংলা গানের যে কোন আলোচনাতে যাঁকে বাইরে রাখা অসম্ভব তিনি নিঃসন্দেহে সলিল চৌধুরী। আগে যে হাট্টিমাটিম টিম ছড়াটির কথা বলেছি তা অবলম্বনে তিনি একটি মজার গান রচনা করেছিলেন।

"হাট্টিমাটিম হাটিম হাটিম  /  মাঠে মাঠে পেড়েছে ডিম
ফুটে সে ডিম হল বাচ্চা সেদিন  / তার নাম সিং ভাঙ্গা গরবড়ি সিং।
গরবড়ি সিং যেখানেই যায় / যাকে পায় তাকে ধরে সুড়সুড়ি দেয়
না যদি হাসে, ভীষণ কেঁদে হঠাৎ ধুলোয় পড়ে গড়াগড়ি দেয়।
বলে "শুনে যাও, আমার বাবার নাম গরবড়ি সিং।।"

এই গান শুনলে আমাদের মনে বিচিত্র চরিত্ররা ভিড় করে – সেই যে কাতুকুতু বুড়ো! গানে রয়েছে – ‘না যদি হাসে, ভীষণ কেঁদে হঠাৎ ধুলোয় পড়ে গড়াগড়ি দেয়। অনেকটা যেমন ছিল কবিতাতে –

বিদ্‌ঘুটে তার গল্পগুলো, না জানি কোন্‌ দেশী, / শুনলে পরে হাসির চেয়ে কান্না আসে বেশি ।

অন্য আর একটি গান শোনা যাক –

"ঠিক দুপুরে কেউ কখনো রায়পুরিতে যেও না 
যদি বা যাও খ্যান্তপিসির সুক্ত রান্না খেও না।
ভুক্তভোগী আমরা জানি / দুপুরবেলায় কি হয়রানি
দোক্তা দিয়ে যুক্ত করে সুক্ত রাঁধে পিসি 
আর উচ্ছে গুঁড়ো থেঁতো করে দাঁতে লাগায় মিশি"

এই গান শুনলে হলফ করেই বলতে পারি আমাদের মন ছুটবে সেই ‘বোম্বাগড়ে’। সেখানে সব অদ্ভুত কাণ্ড ঘটছে যে

“সিংহাসনে ঝোলায় কেন ভাঙা বোতল শিশি?
কুমড়ো নিয়ে ক্রিকেট খেলে কেন রাজার পিসী?
রাজার খুড়ো নাচেন কেন হুঁকোর মালা পরে?
এমন কেন ঘটছে তা কেউ বলতে পার মোরে?”

সলিল অবশ্য ছোটদের গানেই থামেননি। অনুপ্রাণিত হয়েছেন ‘একুশে আইন’ ব্যঙ্গ থেকেও। ননসেন্স এর ছদ্মবেশে রাজনৈতিক বিদ্রূপ হিসেবে লিজেন্ড হয়ে আছে। সুকুমারের ‘একুশে আইন’ ও যে খেয়ালরসের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ব্যঙ্গ তাও আমরা বুঝি।

আর সলিলের গানে পাই 


 শোনো ভাই ইস্কাবনের দেশে গিয়েছিলাম।
সেথা গোলমেলে সব কান্ড দেখে এলাম।
(সমবেত)
(আহা বল শুনি বল শুনি; শুনি।)
সেথা মাস দিয়ে ভাই দিনকে গোনে
বছর দিয়ে মাসে।
আর বয়স যতই বাড়ে ততই
বয়স কমে আসে।
-----
সেথায় ইস্কুলেরা পালিয়ে বেড়ায়
ছাত্র থাকেন বসে
আর টিকির মাথায় পণ্ডিত ঝোলেন
পরম পরিতোষে।
সেথায় শ্যামকে চড়ায় শূলে রে ভাই
গোবর্ধনের দোষে।
দেখে পালিয়ে চলে এলাম বলে
সেলাম বাবা সেলাম।
(সমবেত)

(https://www.youtube.com/watch?v=ygg9iWqows4)

আরেক উল্লেখযোগ্য গীতিকার হলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। ছবির নাম লুকোচুরি। ছবির মূল চরিত্রে আর এক খামখেয়ালী প্রতিভা – কিশোরকুমার। তার এক জনপ্রিয় গান হল –

সিং নেই তবু নাম তার সিংহ ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব
গায়ে লাগে ছ্যাঁকা ভ্যাবাচ্যাকা হাম্বা হাম্বা টিকটিক টিকটিক
দাও ভাই নাকে এক টিপ নস্যি খাও তারপরে একমগ লস্যি
লাগে ঝুরি ঝুরি সুড়সুড়ি হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো ছিকছিক ছিক ছিক।

মনে পড়ে নিশ্চয়ই – “সিংহের শিং নেই, এই তার কষ্ট / হরিণের সাথে মিলে শিং হল পষ্ট।

সুকুমারের বিখ্যাত হাঁসজারু কবিতা নিঃসন্দেহে উঁকি মেরেছিল গৌরীবাবুর মাথায়।

এরপরেও আমরা দেখি চূড়ান্ত খামখেয়ালীপনা –

দুই পায়ে পরে নাগরা যাও নয় হেঁটে আগ্রা
জামতলা আমতলা নিমতলা পথে পাবে
নয় নয় এ তো ঠাট্টা খাও পেট ভরে গাঁট্টা
কাঁচকলা কানমলা খাও তুমি কত খাবে
টক টক টক টক টরেটক্কা আর কত দূরে বোগদাদ মক্কা
গায়ে লাগে ছ্যাঁকা ভ্যাবাচ্যাকা হাম্বা হাম্বা টিকটিক টিকটিক।

এখানে আবার সেই ‘খাইখাই’ কবিতার (‘খাও তবে কচুপোড়া খাও তবে ঘন্টা ‘) অনুপ্রেরণা রয়েছে।

গোলগাল বিশু নন্দী দিনরাত আঁটে ফন্দি 
 ঝুড়িঝুড়ি ভুরিভুরি বড় বড় কথা বলে
তাগড়াই বেঁটে বড়দা খায় পান সাথে জর্দা
কুলবাজি ডিগবাজি রকবাজি শুধু চলে।

মনে পড়ে নিশ্চয়ই, ছন্দের মাধুর্যে আর খামখেয়ালীপনাতে – ‘ফন্দি’ আর ‘নন্দী’র অন্ত্যমিল দেখে,

আরে আরে, ওকি কর প্যালারাম বিশ্বাস? ফোঁস্ফোঁস্অত জোরে ফেলো নাকো নিঃশ্বাস (সাবধান)

আর একেবারে শেষে এসে –

এ বাড়ির খেঁদি চায় ভুরু কুঁচকে 
ও বাড়ির খেঁদা হাসে মুখ মুচকে
গায়ে লাগে ছ্যাঁকা ভ্যাবাচ্যাকা হাম্বা হাম্বা টিকটিক টিকটিক।

এখানে সেই বিখ্যাত কবিতার অনুপ্রেরণা –  

প্যাঁচা কয় প্যাঁচানী, খাসা তোর চ্যাঁচানি / শুনে শুনে আন্‌মননাচে মোর প্রাণমন !

এই গানটিতে আজগুবিপনার যে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন গৌরীপ্রসন্ন তা সত্যিই অনবদ্য। শোনা যায় যে সুরটি নাকি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় একটি বিদেশী গানের আদলে তৈরি করেছিলেন। আর এর সঙ্গে কিশোরকুমারের বেলাগাম, প্রাণবন্ত অভিনয়। সব মিলিয়ে আমাদের কাছে আজো এই গানের আবেদন এতটুকুও ম্লান হয়নি।

এরপরে বলতে হয় আর এক গীতিকারের কথা। তাঁর নাম শ্যামল গুপ্ত। তাঁর সঙ্গে দারুণ হৃদ্যতা ছিল গায়ক মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের। সুতরাং মায়ামৃগ ছবির জন্য গান রচিত হল দুজনের মিলিত প্রয়াসেই, সুরকার মানবেন্দ্র। গাইলেনও তিনি নিজে। সিনেমার নায়ক মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র । সুতরাং সেই খামখেয়ালী গানে কিছুটা ডাক্তারি শাস্ত্রেরও অনুপ্রবেশ ঘটলো –

ক্ষতি কি না হয় আজ পড়বে,
মেটেরিয়া মেডিকার কাব্য
নয়তো বা ফার্মাকোলজিটাই 
নিয়ে আজ লেকচারে নামব, লেকচারে নামব || 
তারপর দৃষ্টির ছুরিতে মনের ডিসেকশন শিখবে,
কিংবা ষ্টেথিসস্কোপ লাগিয়ে নোটবুকে সিম্ টম্ লিখবে।
ওরাল জবাবগুলো হওয়া চাই রীতিমত কানে সুখশ্রাব্য |

অন্য গানগুলির মত কিন্তু এই গানটির সময় কিন্তু মজার নয়, বেশ রোমান্টিক। নায়ক গাড়ীতে করে নায়িকাকে মাখো মাখো প্রেমের গান (‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ বা ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’ ধরনের) না শুনিয়ে এরকম আজগুবি গান শুনিয়ে মন জয় করছে। সম্ভবত নায়ক নায়িকাও ছোটবেলাতে আবোলতাবোল পাঠ করেই যৌবনে প্রবেশ করেছে, কাজেই তাদের রসাস্বাদনে কিছুমাত্র অসুবিধে হয় না। একই কথা প্রযোজ্য তাবড় দর্শককুলের জন্য। ভাবলে অবাক হতে হয় শ্যামল গুপ্তের লেখা এই গানটি নাকি মানবেন্দ্রর প্রথমে আদৌ পছন্দ হয়নি, রেগেমেগে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। পরে মনে হয়েছিল, আরে এটা দারুণ গান হবে। তখন দুই বন্ধু মিলে আবার খুঁজে কুড়িয়ে এনেছিলেন। এই গানটির জনপ্রিয়তা আমার নিজের চোখের দেখা। একবার মানবেন্দ্র ফাংসনে গান গাইতে এসেছেন। তখন তিনি তাঁর অন্যান্য বিখ্যাত গান ছাড়াও নজরুলগীতিতে খ্যাতির তুঙ্গে। কিন্তু দর্শকাসন থেকে গুঞ্জন উঠছে – এই বিশেষ গানটির জন্য। শেষে যখন শুরু করলেন, তখন দর্শকরা ও একযোগে গলা মেলালেন, সঙ্গে তুমুল হাততালি – নয়তো বা ফার্মাকোলজিটাই, নিয়ে আজ লেকচারে নামব, লেকচারে নামব, লেকচারে নামবো -ও –ও। মানবেন্দ্র গান শেষ করে বললেন – ‘’উফফ, যত্তো পাগলের কাণ্ড।’

সবশেষে আবার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর আত্মজীবনীতে জানিয়েছেন সবচেয়ে বেশি সময় নিয়ে তিনি যে গানটি রচনা করেছেন, তা হল ‘শঙ্খবেলা’ ছবির একটি গান – আমি আগন্তুক, আমি বার্তা দিলাম। এই ছবির দৃশ্য ছিল একটি পার্টিতে মদ্যপান করে নায়ক গান গাইবে। ঘটনাটি ষাটের দশকের। এই সময় মাতাল নায়কের মধ্যে দেবদাসের অনুপ্রেরণাতে দুঃখের বা গভীর জীবনদর্শনের গান গাওয়ার প্রচলন ছিল। কিন্তু প্রযোজক পরিচালকের ইচ্ছে ছিল নতুন কিছু করার। লেগে গেলেন সুরকার ও গীতিকার – সুধীন দাশগুপ্ত এবং পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। পুলক রচনা করলেন এক অনবদ্য গান যার পরতে পরতে ছড়িয়ে রইল কৌতুকাভাস। রবিঠাকুরের সেই কবিতা, ‘আমি আগন্তুক, আমি জনগণেশের প্রচণ্ড কৌতুক”র অনুকরণে গানটির শুরু আর গানের শরীর জুড়ে ‘প্রচণ্ড কৌতুক”!

আমি আগন্তুক
আমি বার্তা দিলাম
কঠিন অঙ্ক এক কষতে দিলাম
আমি আগন্তুক, আমি বার্তা দিলাম
To you to you and you and you and to everyone here
কঠিন অঙ্ক এক কষতে দিলাম
A plus b minus c whole square equal to কী?
‘কলেজ স্কোয়ার’

এরপরে চূড়ান্ত পাগলামি – যাকে বলে কূলকিনারাহীন অসম্ভবের ছন্দ।

এখনো কলম্বাস ডিম গুলো ভেঙে ভেঙে চলছে
আমেরিকা আমেরিকায় মোমবাতি সে বরফে গলছে
উইলসন জনসন হাতে নিয়ে মেগাটন কি ভাবছে?
ভিয়েতনাম?
এখনো কলম্বাস ডিম গুলো ভেঙে ভেঙে চলছে
আমেরিকা আমেরিকায় মোমবাতি সে বরফে গলছে 
 এদিকে ট্রাউট মাছে ভরে গেলো বিপাশা ঝিলাম

উফফ! কোথায় কলম্বাস, উইলসন, ভিয়েতনাম, কোথায় আবার বিপাশাতে ট্রাউট মাছ! মনে পড়ে যায় । এই প্রসঙ্গে কলম্বাসের ডিম ভাঙার গল্পটাও মনে করতে পারি। কলম্বাসের বন্ধুরা কোন বিষয় নিয়ে বলেছিলেন যে এতো বেশ সোজা। কলম্বাস তখন একটা ডিম হাতে ধরিয়ে বলেছিলেন সেটাকে সোজা করে টেবিলের ওপর রাখতে। কেউ পারে না, কলম্বাস তখন ডিমটা হাতে নিয়ে ভেঙে টেবিলের ওপর বসিয়ে বললেন, এবারে দেখ। বন্ধুরা বললেন, বেশ সোজা তো! স্মিত হেসে কলম্বাস বললেন – “হ্যাঁ, দেখিয়ে দিলে সোজা।” তাই এখানে আমেরিকার কথায় কলম্বাস, ডিম এসে গেল। তারপর বেলাগামভাবে – ভিয়েতনাম, উইলসন, বোমা, মেগাটন—–!!

অর্থাৎ কিনা, এই মনে কর্ রোদ পড়েছে ঘাসেতে, / এই মনে কর্‌, চাঁদের আলো পড়লো তারি পাশেতে

আর মাছ যখন আছে

Fishy ব্যাপারে বেশ Fishy
আমি আগন্তুক
আমি বার্তা দিলাম
কঠিন অঙ্ক এক কষতে দিলাম
মাঝখানে গোটা দুই স্টেডিয়ামে ফুটবল নেই
সাহারার দুপুরেতে কেন গায়ে কম্বল নেই
আল্পসের চূড়োতে উটপাখী উড়ছে
ভডকার ডুবজলে সিগারেট পুড়ছে
তার টুপি হল দেহে নিলাম
ঠোঁট থেকে লিপস্টিক কোন ফাঁকে কোথায় যে লাগছে
দু জোড়া দুষ্টু চোখ লক্ষীটি হয়ে রাত জাগছে
Mon dieu! not bad expression!
এতদিনে বনলতা ভুলে গেছে কোথায় ছিলাম
Here I am!

অনবদ্য, অনুপম সৃষ্টি। বিভিন্ন অসংলগ্ন জিনিসকে একসাথে এনে যে মজাদার খেয়ালরসের সৃষ্টি করা যায় তা সুকুমার তাঁর সৃষ্ট জগতে আমাদের বারংবার দেখিয়েছেন। তাঁর অনুজ কবিরাও যে সেই পথ একেবারে ছাড়েননি তা আমাদের সৌভাগ্য।

একটা কথা মনে রাখতে হবে। গানের জগতে কবিতার মত এত স্বাধীনতা নেই। শুধু গীতিকার লিখলেই হবে না, তাকে যোগ্য সুরকারের হাতে গান হয়ে উঠতে হবে। সেই গান প্রাণ ঢেলে গাওয়ার জন্য প্রতিভাবান আগ্রহী গায়কের প্রয়োজন। এরপরেও আছেন সিনেমার প্রযোজক, পরিচালক, নায়ক, নায়িকা। এতজন শিল্পীর মিলিত ফসলই হতে পারে এই সৃষ্টি।

এই শিল্পী স্রষ্টাকুল আমাদের কাছে ধন্যবাদার্হ। সুকুমার সৃষ্ট সেই অসম্ভবের ছন্দের জগৎ যে তাঁরা কিছু পরিমাণে হলেও আমাদের বাংলা গানে ফিরিয়ে আমাদের মনোরঞ্জন করেছেন, বাংলার শ্রোতারা সেই কারণেই তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবেন।

আজকের আধুনিক গানে মাঝে মাঝেই এইরকম প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে, কিন্তু এটা আমরা জানি যে এখনকার গানে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু বেশ কয়েক দশক আগেও যে কতিপয় এইরকম প্রয়োগ হয়েছিল তা জেনে আমাদের আশ্চর্য হতে হয়।

http://archives.anandabazar.com/archive/1120930/30rabipro2.html

ছবিগুলি সবই ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।

6 thoughts on “বাংলা গানে খেয়ালরসের ছোঁয়া

  1. অভিনব বিষয় এবং সন্ধানী দৃষ্টি রচনাটিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।

    Liked by 1 person

  2. ভারী কৌতুহলোদ্দীপক লেখা। গানগুলো শুনেছি, কিন্তু এইভাবে ভাবিনি কখনো। লেখককে অভিবাদন।

    Liked by 1 person

  3. উফ লেখাটি একেবারে ডিলা গ্র্যাণ্ডি – গানগুলো শুনেছি কিন্তু ভাবনাটা একেবারে অন্য মাত্রা দিয়েছে । গানগুলো নতুন করে শুনতে যে কি ভাল লাগছে 😃♥️

    Liked by 1 person

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s