প্রায় চার দশকেরও আগে তাঁর লেখার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। আনন্দমেলা পত্রিকা রূপে আত্মপ্রকাশ করার আগে সোমবারের আনন্দবাজারে একটি ছোট্ট আকারে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ পেত তাঁর একটি কিশোর উপন্যাস – “তিন নম্বর চোখ” ! আর দেব সাহিত্য কুটীরের শারদীয়া গুলিতে প্রকাশিত হত তাঁর একটি গ্রাম্য ছেলের নায়ক হওয়ার কাহিনী, তার ও নাম নীলু। “নীল দৈত্য, নীল মানুষের দুঃখ, –ইত্যাদি”।
তবে সত্তর দশকের একেবারে গোড়ার দিকে শারদীয়া আনন্দমেলাতে প্রকাশিত হল – “ভয়ংকর সুন্দর” –
কাকাবাবু ও সন্তুকে নিয়ে লেখা প্রথম উপন্যাস – সন্তুর জবানিতে! ব্যাস, আপামর কিশোর কিশোরী সেই ভয়ংকর সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে গেল। এরপর আনন্দমেলা মাসিক পত্রিকা হয়ে শুরু হল – তাতে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ হতে লাগলো কাকাবাবুর দ্বিতীয় উপন্যাস, এবার লেখকের জবানিতে – “সবুজ দ্বীপের রাজা“। তাঁর সুন্দর লেখনী আমাদের নিয়ে চলল আন্দামানে। এরপর বড় হয়ে আসতে আসতে পরিচয় হতে লাগলো অন্য উপন্যাস গুলির সঙ্গে – প্রতিদ্বন্দী, অর্জুন, কালোরাস্তা সাদা বাড়ী, স্বর্গের নীচে মানুষ, জীবন যে রকম —।
কিন্তু সবচেয়ে বড়ো চমক অপেক্ষা করেছিল আমাদের জন্য সত্তর দশকের শেষ দিকে। এই বারে তিনি একেবারে ঘটিয়ে বসলেন একটি অসাধারণ কাণ্ড – বাংলার ‘তথাকথিত’ নবজাগরণ এর সময়কাল নিয়ে সৃষ্টি করে ফেললেন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ গদ্য কীর্তি – “সেই সময়”! ‘তথাকথিত’ এই জন্যই যে সে নবজাগরণ সত্যিই ঘটেছিল কিনা সেই অনুসন্ধিৎসা থেকেই এই উপন্যাসের সৃষ্টি, – এটা স্বয়ং স্রষ্টারই স্বীকারোক্তি। ওঃ, আমাদের মত যারা ধারাবাহিক ভাবে সেই উপন্যাসটি পড়েছেন বা বলব পড়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন তাঁরাই জানেন সাপ্তাহিক দেশ আসার জন্য কি আকুল প্রতীক্ষা আর এলেই গোগ্রাসে পড়ে ফেলেই আবার পরের সাতদিনের জন্য দুরূহ প্রতীক্ষা। বাংলা ভাষায় ঐতিহাসিক উপন্যাস এই প্রথম নয় – রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, – আর শরদিন্দু কি অসাধারণ সব উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু সুনীল যেন সব কিছু ওলটপালট করে দিলেন। সুনীল নিজে শরদিন্দুর ঐতিহাসিক উপন্যাসের বিরাট ভক্ত কিন্তু, যেবার একটি শারদীয়া পত্রিকাতে “তুঙ্গভদ্রার তীরে” প্রকাশিত হয়, সনাতন পাঠকের কলমে তাঁর একটি দুর্দান্ত আলোচনা পড়বার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে। তাতে তিনি লিখেছিলেন এই উপন্যাসটি তিনি পড়েছেন খুব আস্তে আস্তে, উপভোগ করে, ছোটবেলাতে নিম্নবিত্ত কোন কিশোর যেমন মহার্ঘ্য মিষ্টান্নের স্বাদ গ্রহন করে, আস্তে আস্তে, আশংকায় যে এই শেষ হয়ে গেল বুঝি।
“সেই সময়” পড়তে পড়তে মনে হত যেন আমরা ছবি দেখছি, ভাষা চিরকালই সুনীলের বহমান, কিন্তু এখানে তিনি তাঁর আগের সবকটি গদ্য কে ছাপিয়ে গেলেন। হয়তো আদতে কবি বলেই কবিতার মাধমে যে ছবি আঁকার যে সহজাত ক্ষমতা তিনি অর্জন করেছিলেন তার পূর্ণ প্রকাশ ঘটল এর মধ্যে। এখানে একটু শরদিন্দু আর সুনীলের একটু তুলনামূলক আলোচনার লোভ বাংলা সাহিত্যের কোন ‘সনাতন পাঠক’ই হয়ত এড়িয়ে যেতে পারবেন না!
তবে আমাদের আলোচনা সীমিত থাকবে পুরোপুরি পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গী তে – তাকে বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণী দৃষ্টিকোণের থেকে না মেলানোই ভাল কারণ স্বল্প পরিসরে তা প্রতিভাত করা খুব দুরূহ।
শরদিন্দুর সবকটি ঐতিহাসিক উপন্যাস সাধু গদ্যেই রচিত। তাঁর রচনার প্রেক্ষাপট একেবারে চতুর্থ শতাব্দী থেকে শুরু করে মূলতঃ একাদশ বা পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে এসে থেমেছে। তাঁর সেই সব উপন্যাসের চরিত্রগুলি আমাদের কাছে সে ভাবে পরিচিত ছিল না। তা সত্বেও একটি চরিত্র ও তাঁর গল্প আমাদের বেশ কাছের, তিনি “কুমারসম্ভবের কবি” কালিদাস। সেই চরিত্রচিত্রন নিয়ে একটু আলোচনা করা যেতেই পারে। উপন্যাসে কালিদাসের বিবাহের পর তাঁর স্বরূপ প্রকাশ হয়ে গেছে এবং রাজার আদেশে প্রহরীরা তাঁকে নির্বাসন দিয়েছে। কালিদাস বনে ঘুরছেন, এর পরের অংশটি উদ্ধৃত না করলে বোঝানো সম্ভব নয়-
“বন শেষ হইয়া শুষ্ক মরুভূমি। দ্বিপ্রহরে কালিদাস এই মরুভূমির ভিতর দিয়া চলিয়াছেন। বালুকণা উড়িয়া আকাশ সমাচ্ছন্ন করিয়াছে; এই তপ্ত বালুঝটিকা উপেক্ষা করিয়া দিগভ্রান্তের মত কালিদাস যাইতেছেন , তাঁহার চোখে মুখে এক দুর্লভ দুরাকাঙ্খা জ্বলিতেছে।
বালু-কুজ্ঝ্বটিকার ভিতর দিয়া একটি ভগ্ন দেবায়তনের উচ্চ-বহিপ্রাচীর দেখা গেল। কালিদাস সেই দিকে অগ্রসর হইয়া চলিলেন, প্রাচীরের নিকটবর্তী হইয়া তিনি একটি প্রস্তরখন্ডে পা লাগিয়া পড়িয়া গেলেন।
প্রাচীর ধরিয়া কোন ক্রমে উঠিয়া দাঁড়াইয়া তিনি ক্ষণকাল ক্লান্তিভরে চক্ষু মুদিত করিয়া রহিলেন। তারপর চোখ খুলিয়া দেখিলেন তিনি প্রাচীরের যে-স্থানে বাহুর ভর দিয়া দাঁড়াইয়া আছেন উহা একটি বিরাট মূর্তির ঊরুস্থল। কালিদাস ঊর্ধে চাহিলেন, প্রাচীরে খোদিত বিশাল শঙ্কর-মূর্তি যেন এই বহ্ণি শ্মশানে তপস্যারত। কালিদাস নতজানু হইয়া মূর্তির পদমূলে মাথা রাখিলেন, তারপর গলদশ্রু চক্ষু দেবতার মুখের পানে তুলিয়া ব্যাকুল প্রার্থনা করিলেন – ‘দেবতা, বিদ্যা দাও’-
সূর্যাস্ত হইতেছে। দিগন্তহীন প্রান্তরে কালিদাস একাকী দাঁড়াইয়া যুক্তকরে বলিতেছেন – সূর্যদেব তুমি জগতের অন্ধকার দূর করে দাও। আমার মনের অন্ধকার দূর করে দাও। বিদ্যা দাও।
উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দির। কৃষ্ণপ্রস্তরনির্মিত মন্দির আকাশে চূড়া তুলিয়াছে; চূড়ার স্বর্ণত্রিশূল দিনান্তের অস্তরাগ অঙ্গে মাখিয়া জ্বলিতেছে। সন্ধ্যারতির শঙ্খঘন্টা ঘোর রবে বাজিতেছে। মন্দিরের বহিরঙ্গনে লোকারণ্য, স্ত্রী পুরুষ সকলে জোড়হস্তে তদগত-মুখে দাঁড়াইয়া আছে। আরতি শেষ হইলে সকলে অঙ্গনে সাষ্টাঙ্গ প্রণত হইল। অঙ্গনের এক কোনে এক বৃদ্ধ প্রণাম শেষ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, যুক্তকরে মন্দিরের পানে চাহিয়া প্রার্থনা করিল – ‘মহাকাল, আয়ু দাও’।
অনতিদূরে একটি নারী নতজানু অবস্থায় মন্দির উদ্দেশ করিয়া বলিল – ‘মহাকাল, পুত্র দাও’।
বর্মশিরস্ত্রাণধারী এক যোদ্ধা উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল – ‘মহাকাল, বিজয় দাও’।
বিনত ভুবনবিজয়িনীনয়না একটি যুবতী লজ্জাজড়িত কন্ঠে বলিল – ‘মহাকাল, মনোমত পতি দাও’।
দীনবেশী, শীর্ণমুখ, কালিদাস অবরুদ্ধ কন্ঠে বলিলেন – ‘মহাকাল, বিদ্যা দাও’।
“ধ্যানগম্ভীর ঐ যে ভূধর, নদী জপমালা ধৃতপ্রান্তর” এক ভারতবর্ষের একটি অপূর্ব ছবি। কালিদাস ও শরদিন্দুর প্রতি সম্মানে ও শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা নত হয়।
সুনীল শুরু করলেন একেবারে উনবিংশ শতাব্দীতে। চরিত্রগুলি আমাদের বহু পরিচিত – অর্থাৎ তাদের সম্পর্কে আমরা বেশ কিছু পড়েছি। পরিচিত চরিত্র নিয়ে কাজ করতে গেলে যেমনই তা জনপ্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা তেমনই তাতে বিতর্কের মেঘের প্রবল সম্ভাবনা। কিন্তু সেখানেই সুনীল – পদ্যের জগতে তো তিনি যথেষ্ট কিছু করেই ছেড়েছেন, এবার চ্যলেঞ্জ নিয়ে নিলেন গদ্যে। তাতে ঘটনা যা ঘটল তা হল এইরকম – আগের উপন্যাসের চরিত্রগুলি ছিল চরিত্র, এখানে যেন মনে হল তারা একেবারে জীবন্ত মানুষ, একেবারে ধরাছোঁয়ার মধ্যে। নবীনকুমার তো রইলেনই, কিন্তু আমাকে আরো বেশী মুগ্ধ করেছিল যাঁর চরিত্রচিত্রন তিনি হলেন মাইকেল মধুসুদন দত্ত। নিজে কবি বলেই কবিদের চরিত্রের প্রতি কি একটু বেশী পক্ষপাত! নীলকর সাহেবের অত্যাচারে কাতর হয়ে দীনবন্ধু যখন মধুসূদনকে এদের নিয়ে কিছু লিখতে বললেন, মধুসূদন তা প্রত্যাখান করে দীনবন্ধুকে নিজেই লিখতে অনুপ্রেরণা জাগালেন –
“মাই ফ্রেন্ড, ইউ বেটার ট্রাই ইয়োর হ্যান্ড — নীল চাষীদের অবস্থা দেকে আপনার মনে হয়েছে এই বিষয় নাটক লেখার যোগ্য – এই মনে হওয়াকেই বলে ইন্সপিরেসন। বড় বড় লেখকরা এই ইন্সপিরেসন দ্বারাই চালিত হন, সুতরাং আপনি আর দ্বিধা কর্বেন না। কাগজ, কলম নিয়ে বসে পড়ুন গে”!
মধুসূদনের সেই স্পর্শে, রোমাঞ্চিত, অনুপ্রাণিত দীনবন্ধু রচনা করে ফেললেন – নীলদর্পন। এরপর সে নাটকের ইংরেজী অনুবাদের ভার নিলেন মধুসূদন স্বয়ং। কিন্তু তাঁকে সে কাজে সাহায্য করবেন গঙ্গানারায়ণ আর তাঁর চাই বারো বোতল বীয়ার। এরপর একদম কাহিনী থেকেই তুলে দিচ্ছি –
“পঞ্চম অঙ্কে এসে মধুসূদন বললেন, এ কি রে বাপু, সব্বাইকে মেরে ফেলেছে যে! এ যে বাবা হ্যামলেটকেও ছাড়িয়ে গেল! পোস্টমাস্টারবাবুটি প্রথম নাটক লিখেই শেকস্পীয়ার। হা, হা, হা, হা! তারপর বল গঙ্গা, আদুরী কি বলল, ফাইন ক্যারাকটার দিস আদুরী, আই লাইক দিস গার্ল- ওরে বাপরে এই বিন্দুমাধব আবার খুব সংস্কৃত ঝাড়ে যে!
নাটকের শেষ বাক্যটি লেখা মাত্র মধুসূদন নেশায় জ্ঞান হারিয়ে সে টেবিলের ওপরই শুয়ে পড়লেন”!
এই অসাধারণ জীবন্ত, বর্ণনার পর আমরা কি সুনীল আর মধুসূদন দুজনকেই ভালো না বেসে পারি!
পরবর্তী কালেও তিনি ‘পূর্ব-পশ্চিম’ উপন্যাসে আবার একই আবহ সৃষ্টি করলেন। এখানে পূব বাংলা ও পশ্চিম বাংলা মিলে মিশে গেল। জীবন্ত হয়ে উঠল আমাদের চোখের সামনে সেই “একাত্তরের দিনগুলি”! সঙ্গে রয়ে গেলো কিছু পুব দেশ ও পশ্চিম এর কিছু অনুষঙ্গ। অতীন যখন বাবার শরীর খারাপের খবর পেয়েও অফিসের চাপে আসতে পারছে না তখন কয়েকটি বাক্যেই সুন্দর ফুটিয়েছিলেন এই ভাবনার তফাৎটি। এরপর এল ‘প্রথম আলো’ । বাংলা সাহিত্যে এই প্রথম নায়ক রূপে অবতীর্ণ হলেন বাংলার শ্রেষ্ঠ লেখক, রবীন্দ্রনাথ – সঙ্গে উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর তাবড় মনীষিদের ভিড়।
আবার আমরা ডুবে গেলাম – আবার সেই আকুল প্রতীক্ষা। ততদিনে দেশ পাক্ষিক হয়ে গেছে, আমি ব্যাঙ্গালোরে, যেখানে দেশ একটু অনিয়মিত, কাজেই অপেক্ষা আরো বেড়ে গেল। আর রাণু ও ভানু তে আবার সেই মুগ্ধতা ফিরে এল। উপরোক্ত বিখ্যাত উপন্যাসগুলি যখন ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ হচ্ছিল, বহু পাঠক তাঁদের মতামত জানাতেন। বেশ কিছু শানিত অভিযোগের তীর নিক্ষিপ্ত হত লেখকের উদ্দেশে, লেখক মশাই কিন্তু বেশ স্নিগ্ধ ভাবে সে সব অভিযোগের জবাব দিতেন। গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় কেন যে সেই চিঠি গুলি ও তার উত্তর সামগ্রী গ্রন্থিত হল না তা আমার কাছে এক বিস্ময়। হলে তা ভাবীকালের লেখক ও পাঠক উভয়ের কাছেই এক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকতে পারত। যদিও ‘লেখকের কথা’ তে কিছু প্রসঙ্গ সংযোজিত হয়েছে তাও মনে হয় চিঠি আর তার উত্তরগুলি পরপর পড়তে পারলে আরো ভালো লাগতো।
আর নীললোহিতের সঙ্গেই তো আমরা “সতের বছর” আর “একুশ বছর” পার করে “সাতাশে” এসে আটকে গেছি, মার্গারেটকে দেখেছি “সুদূর ঝর্ণার জলে” বা “তোমার তুলনা তুমি” তে আমির খাঁ সাহেবের সঙ্গ লাভ করেছি, “নিরুদ্দেশের দেশে” পাড়ি দিয়েছি বন্দনাদিদের সাথে কয়েকদিন কাটানোর আশায়।
বেশ সাত আট বছর আগের কথা, জয়মহল পুজো কমিটির উদ্যোগে ব্যাঙ্গালোরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল একটি বঙ্গ সম্মেলন। সেখানে একদিন “দেশ” পত্রিকার একটি বৈঠক ছিল – তাতে হর্ষ দত্তর সঙ্গে “দেশ” পত্রিকার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন আমাদের “নীললোহিত” – শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এর পর পরই আরেকটি সভা ছিল – যাতে ব্যাঙ্গালোরের প্রবাসী বাঙ্গালীদের মুখোমুখি হয়েছিলেন – স্বয়ং সুনীল আর যা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন শ্রীরঞ্জন ঘোষাল। প্রারম্ভিক ভূমিকাতেই রঞ্জনদা একটি ভারী সুন্দর কথা বলেছিলেন – “আমরা তাঁর জীবনের নারী-নক্ষত্র চিনি – তিনি স্বাতী”। আশ্চর্য্যের ব্যাপার – এবারে শারদীয়া দেশ ও আনন্দবাজার – দুটি পত্রিকাতেই তাঁর কবিতা স্বাতীকে ঘিরে! তিনি কি কিছু আশংকা করতে পেরেছিলেন!
সুনীল কবিতা দিয়ে শুরু করলেও তাঁর নিজের ভাষাতেই “গদ্যের জগতে তিনি এত বেশী দাপাদাপি করেছেন যে কবিতা পিছিয়ে গেছে”। তিনি বিশ্বাস করতেন যে গদ্যের ভাষাতে কাব্যময়তার খুব বেশী স্থান নেই, তা অনেক ঋজু হওয়া উচিত। সেবার সুযোগ পেয়ে তাঁকে এই নিয়ে প্রশ্ন করেছিলামঃ
আমি – আপনি সাধারনতঃ উপন্যাসে বেশী কাব্যময়তার পক্ষে নন, কিন্তু তা সত্বেও “সপ্তম অভিযান” নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন যেখানে একটি নারী চরিত্র ছিল, সে কবি। বেশ কিছু কবিতাও ছিল – দারুণ লেগেছিল। কিন্তু পরে এরকম উপন্যাস আর কেন লিখলেন না!
সুনীল – ওগুলো একবারই হয়। দ্বিতীয়বার হয় না। আপনি কি আমার “মায়াকাননের ফুল” পড়েছেন?
আমি – হ্যাঁ, সেখানে আপনি ক্রিয়াপদ ঠিক সেভাবে ব্যবহার করেননি কারন বাংলা ক্রিয়াপদের ভান্ডার খুব সমৃদ্ধ নয়।
সুনীল – ওই রকম উপন্যাস ও আমি দুবার লিখিনি, কারন ওগুলো দ্বিতীয়বার লিখতে নেই!
অসাধারণ উত্তর!! সুনীলের লেখার মধ্যে অসম্ভব প্রাণশক্তি, গদ্য ও কবিতাতে তো বটেই এমনকি তাঁর সাক্ষাৎকার, প্রবন্ধগুলির মধ্যেও। কিন্তু খুব দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করেছি সাম্প্রতিক কালে তিনি একটু যেন হতাশ হচ্ছিলেন, একটু উদ্বিগ্নও যার মূল কারণ তাঁর প্রিয় বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ। কিছুকাল আগে একটি টিভি চ্যানেলের সাক্ষাৎকারে তো বলেই ফেললেন – “একশ বছর পর আমার লেখা কি আর লোকে পড়বে, আমার তো ভয় হয় একশ বছর পরে বাংলা ভাষাটাই আর থাকবে না”! সত্যি বলতে কি অসম্ভব একটা ব্যথা অনুভব করেছিলাম, এই কি আমাদের পরিচিত চরম সাহসী, পরম আশাবাদী সুনীল যিনি দুঃসময়ে ও রবীন্দ্রনাথের মতই “দূর দিগন্তে ক্ষীণ শশাঙ্ক বাঁকা” দেখেছেন!!
আমি জানি আমার মত শত সহস্র সুনীল অনুরাগী তাঁর এই হতাশাকে উড়িয়ে দিয়ে বাংলা ভাষাকে জীবিত রাখার প্রয়াসে ব্রতী হবেন। আর প্রযুক্তি ও তার হাত প্রসারিত করে দিয়েছে, ইউনিকোড এবং ইন্টারনেট – এদের সাহায্যে আমরা সহজেই বাংলা ভাষাকে অনেক দূর নিয়ে যেতে পারব। ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদের কল্যাণে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র প্রমুখের সমগ্র রচনাবলী এখন সেখানে সহজলভ্য, আমরা নিশ্চই আশা করব অচিরেই সেখানে স্থান করে নেবেন আমাদের প্রিয় লেখকের সব লেখাগুলি। সুনীলের লেখার যাঁরা সত্ত্বধারী, তাঁরা যদি একটু আগ্রহী হন তা হলে তা খুবই সম্ভব। যেহেতু সুনীলের জনপ্রিয়তা খুবই বেশী, তাই তার নেট সংস্করণ ও তার বহুল প্রচার খুবই সমাদরে গৃহীত হবে বলে আমার বিশ্বাস।
বিশেষতঃ বাংলার বাইরে, সারা বিশ্বব্যাপী সুনীলের বিশাল অনুরাগীবৃন্দ, যাঁদের হাতের কাছে এই বই গুলি তাহলে তাঁদের সুনীল চর্চায় এক নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে। তাঁর নিজের লেখার মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার এই প্রয়াস ই হবে সুনীলের প্রতি আমাদের শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধার্ঘ্য। যদিও তিনি আদপেই মৃত্যু পরবর্তী জীবনে বিশ্বাসী ছিলেন না, তবুও আমাদের কল্পনা করে নিতে দোষ কি আমাদের এই প্রচেষ্টা দেখে সিগারেটটা ঠোঁটে চেপে তিনি হয়তো বলে উঠবেন – “বেঁচে থাকাটা নেহাত মন্দ ছিল না”!!
পুনর্মুদ্রিত – প্রথম প্রকাশ – অক্টোবর, ২০১৩। ‘অবসর’ পত্রিকা।
ভাস্কর,
তোমার লেখা আমার বরবরের ভাল লাগা।
এ লেখা যেন হঠাৎ শেষ হয়ে গেল, আরো জানতে ইচ্ছে করে সুনীল আর তাঁর লেখা নিয়ে। সুনীল অনুরাগী আমিও কিন্তু সব পড়ে ওঠা হয় নি। তোমার লেখায় অনেক কিছু জানলাম। ধন্যবাদ।
মিঠুয়া
LikeLiked by 1 person