১৯৮৩ সাল। সেবছর জুন মাসে ভারতে দু দুটো বড় ঘটনা ঘটেছে, আমরা ইঞ্জিনীয়ার হয়েছি, আর কপিলের ভারত বিশ্বজয় করেছে। এক ‘নতুন প্রভাত’ জাগার সময় হয়েছে। ভাগ্যান্বেষণে আমরাও এসে পড়েছি ব্যাঙ্গালোরে। তখনো জানিনা, এখানে আমাদের জন্যেও এক ‘নতুন প্রভাত’ অপেক্ষা করছে।
আমাদের অফিসে তখনো বাঙালীর সংখ্যা বেশী নয়। সেখানে সাত সাত খানি নব্য যুবার আবির্ভাব বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। কথা হলো একটা ক্লাব তৈরী হবে। উদয়ন দা ও অরুণ ভট্টাচার্যদার উদ্যোগে জয়ন্তদাদের বাড়িতে ক্লাবের প্রতিষ্ঠা সভা। সেখানেই প্রথম দেখলাম তাঁকে। প্রভাত কুমার সাহা, যাঁর হাত ধরে অধুনা ‘ঐকতান’ ক্লাবের প্রতিষ্ঠা।

প্রথম দিনেই বেশ সোরগোল ফেলে দিলেন তিনি। ক্লাব হবে। ক্লাবের লাইব্রেরী চাই, ক্লাবের গানের ক্লাস চাই। সামনা সামনা কিছু না বললেও আমরা পরে বেশ হেসেছিলাম। সেই বিখ্যাত প্রবাদ বাক্য, ‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল’ বহুবার আলোচনায় এসেছিল। কিন্তু তখনো জানিনা, কার সঙ্গে আমরা পাল্লা দিচ্ছি। তখনো অবধি আমরা শুনেছি তিনি একজন বৈজ্ঞানিক, ভারতের প্রতিরক্ষা দপ্তরের যে প্রযুক্তি গবেষণা শাখাটি আছে তাতে তিনি নিযুক্ত। তাঁর চর্চার বিষয় হল ব্যাটারি। কিন্তু সেই ব্যাটারি চর্চা যে তাঁর প্রাণশক্তিকে এতটা বাড়িয়েছে কে জানতো।
বছর দুয়েকের মধ্যেই লাইব্রেরি হয়ে গেল, তাঁর বাড়ির গ্যারেজেই। কলকাতা থেকে চারটি বাংলা পত্রিকা আসা শুরু করলো, বেশ কিছু বই ও এল। জোড়া তাড়া দিয়ে হলেও উদবোধন তো হল। হার মানার সেই শুরু।
তখনো আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান, আবৃত্তি বা গীতিনাট্য করি। সাহাদা ধরলেন – নাটক করতে হবে। আবার আমরা উড়িয়ে দিলাম। নাটকের ঝঞ্ঝাট কি কম? লাইট, সাউন্ড, মেক আপ, ড্রেস, সর্বোপরি স্টেজ – সাহাদাও ছাড়বেন না। কলকাতায় পাড়ায় পাড়ায় লোকে নাটক করে, তাদের কি সামর্থ্য? আমরা পারবো না? এই বলে বলে তিনি অরিন্দমদাকে বুঝিয়ে ফেললেন যে নাটক করা সম্ভব। ব্যস, শুরু হল রিহার্সাল। সরস্বতী পুজোতে নাটক হবে। হবে কোথায়? স্টেজ চাই তো। হবে, হবে, তাঁর বাড়ীর ছাদ আছে কি করতে? ব্যস, সেই প্রথম নাটক হল – মনোজ মিত্রের ‘বাবুদের ডালকুকুরে’! নাটক সফল হওয়ার পর সাহাদার খুশী দেখে কে! আকর্ণ বিস্তৃত হাসি – মানে অনেকটা সেই –‘হয় হয়, যানতি পারনা’ গোছের।
আমরা মোটামুটি বেশ খুশি ছিলাম ছোট ক্লাব নিয়ে।ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি দুর্গাপুজোর কথা। একবিংশ শতকের গোড়া থেকেই কিন্তু সাহা দা ভেবে যাচ্ছেন দুর্গাপুজোর কথা। আমাদের ঘোর আপত্তি। নিজেদের পুজো হলে পুরো আটকে যাব। এদিকে সাহাদা আবার কয়েকজনকে ধরে ভায়াবিলিটি স্টাডি করেছেন – রিপোর্ট অনুযায়ী – দুর্গাপুজো সম্ভব। আমরা আর সাহাদার ধারও মাড়াচ্ছি না, আবার যদি বুঝিয়ে দেন – ফেঁসে যাব না!

সাহাদা কিন্তু আশা ছাড়েননি। বলে না, পুরুষস্য ভাগ্যং! ইতিমধ্যে উদয়ন দা এসে হাজির চেন্নাই থেকে। ব্যস, যে সলতেটা ধুকধুক করে জ্বলছিল, সেটা বেশ জোরে জ্বলে উঠলো। ২০১০ থেকে শুরু হল পরিকল্পনা, সাহাদা একটা বড় মোটা সাইজের লম্বা খাতা নিয়ে মিটিং করতে শুরু করলেন। প্রথম পুজোতে শুরু করা হয়েছিল ১ লাখ আশি হাজারের বাজেট ধরে। সাহাদা প্রত্যেক মিটিং এ খাতা নিয়ে গুণতে শুরু করলেন। ক্লাবের তখন ল্যাপটপে একাউন্টিং শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু সাহাদাও হিসেব রাখছেন আলাদা করে। শেষ মেশ স্বপ্ন সম্ভব হল, প্রায় চার লাখ টাকার বাজেটে ভালভাবেই সম্পন্ন হল ঐকতানের প্রথম পুজো।
তারপর থেকে বাজেট বেড়েছে, পুজোর জাঁকজমকও বেড়েছে – হৈ হৈ করে এগিয়ে চলেছে পুজো। আর সাহাদার পুজো নিয়ে গর্ব ও দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। প্রত্যেক স্যুভেনিরে সাহাদা লেখা দিতেন, অন্যদের ও উৎসাহ দিতেন। বিগত তিরিশ বছরে খুব, খুব কম হয়েছে যে ক্লাবের অনুষ্ঠান হয়েছে আর সাহাদা অনুপস্থিত।
বিগত কয়েক বছর ধুনুচি নাচ প্রতিযোগিতা হচ্ছে – আমরা নড়বড়ে বলে প্রতিযোগিতাতে যোগ দিই না। কিন্তু সাহাদা নির্দ্বিধায়, প্রবল উৎসাহে এই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে আমাদের প্রভূত আনন্দ দিতেন।

সাহাদার জন্মদিন পালন ছিল বেশ হৈ চৈ ব্যাপার – ছেলে বুড়ো সবাই মিলে হুজ্জুতি করা হত। কেক কাটা, ছবি তোলা, খাওয়া দাওয়া – সাহাদা আসলে মনে করতেন জন্মদিন ভালভাবে পালন করলে বছরটা ভালো কাটবে।

সাহাদা আমার সব ফেসবুক পোস্ট পড়তেন, মন্তব্য করতেন। লাস্ট মিটিং এ যখন দেখা হল, আমাকে বললেন, তোমার তো রিটায়ারমেন্টের পর বাঁধা কাজ, লেখালেখি করবে। আমি বললাম, কিন্তু সেটা আর আসছে কই? হাসলেন, ‘উফফ, তুমি আর পাল্টাবে না’!!
কি আকস্মিক তাঁর চলে যাওয়া। সেদিন খবরটা যখন পেয়েছি, বিশ্বাস করতে পারিনি। অনেকেই পারেননি, কারণ সকাল সাতটায় যে মানুষটা একটা ফেসবুক পোস্ট দিয়েছেন – তার ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই তিনি আর নেই!

আবার ভাবি, যে মানুষটা এত আনন্দ করে বেঁচেছিলেন তাঁর যাওয়াটা ও হয়তো এরকমই রাজকীয় হত। সেই যে রবিঠাকুরের ভাষায় –
পথিক আমি, পথেই বাসা–/
আমার যেমন যাওয়া তেমনি আসা।
ভাসাও আমায় ভাঁটার টানে অকূল–পানে,
কে বলে ‘যাও যাও‘– আমার যাওয়া তো নয় যাওয়া।
অনবদ্য ভাস্কর দা। সাহাদা সেদিন ও ছিলেন, আজ ও আছেন। আমাদের ই মাঝে।
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ মলয়
LikeLike
Khub sundor bhabe sahada Katha likhechho…Aste Aste choker samne sahada purnango chhobi. fute uthte dekhlam
LikeLiked by 1 person
khub bhalo laglo pore.
LikeLiked by 1 person
ভাস্কর:
জীবনের একেকটা পর্যায়ে একেকজন মানুষ হঠাৎই ঢুকে পড়েন আমাদের অনুপ্রাণিত করতে, উজ্জীবিত করতে; কাজ শেষ হয়ে গেলে নি:শব্দে বিদায় নেন। তোমাদের সাহাদাকে সে’রকমই একজন মানুষ হিসেবে দেখতে পাই। যাবার আগে উনি তোমাদের তৈরী করে গেলেন।
∆ ভাস্করদা
LikeLiked by 1 person
সত্যিই তাই। এই প্রবাসে এসে যে বাঙালি সংস্কৃতির স্বাদ নিয়মিত পাই, তার অনেকটা ওঁর জন্য।
LikeLiked by 1 person
ভাস্কর
স্মৃতিচারণ খুব মনোরম, তোমার লেখায় অতীত যেন চোখের সামনে ভাসছে।
জয় দা
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ জয় দা।
LikeLike