কুবের আলয় ছাড়ি’ উত্তরে আমার বাড়ি,
গিয়া তুমি দেখিবে সেথায়—
সম্মুখে বাহিরদ্বার, বাহার কে দেখে তার,
ইন্দ্রধনু যেন শোভা পায় |

পার্শ্বে এক সরোবর, দেখা যায় মনোহর,
পদ্ম সনে অলি করে ঠাট |
তাহার একটি ধারে, অপরূপ দেখিবারে,
পরকাশে মণি-বাঁধা ঘাট |
মেঘদূতের এই অনুবাদটি যিনি করে ছিলেন তিনি রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শ্রী দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে ১৮৬০ সালে তৎকৃত অনুবাদটিই ছিল মেঘদূতের প্রথম অনুবাদ। মধুসূদন তাঁর ‘মেঘদূত’ অনুবাদে প্রভাবিত হয়ে বাংলা কাব্য রচনায় মন দেন।

তাঁর পড়াশুনো ছিল খুবই বিস্ময়কর। কিন্তু স্বভাবে তিনি ছিলেন বেশ অগোছালো। ‘গৃহিনীপনা’র লেশমাত্র ছিল না তাঁর মধ্যে।জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির আনাচেকানাচে ছড়িয়ে আছে ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’-এর ফেলে-দেওয়া পাতা, গাছের তলায় পড়ে-থাকা আমের বোলের মতো। তাঁর ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’ নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
তাঁর নানা কাজের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য কাজ হল ‘উপসর্গের অর্থবিচার’ বলে একটি ক্ষুদ্র পুস্তকের প্রণয়ন। এতে তিনি সমস্ত সংস্কৃত ও বাংলা উপসর্গের বহুল চর্চা করেন।

তিনি সেভাবে চর্চিত না হলেও সম্প্রতি প্রকাশিত হল নরেশচন্দ্র সাহার দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর/ সৃজনে ও মননে (সিগনেট প্রেস)
এর আগে সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকার চতুর্থ ভাগ চতুর্থ সংখ্যা ও পঞ্চম ভাগ দ্বিতীয় সংখ্যায় লেখাটি প্রকাশিত হয়। সেইসময় শ্রীযুক্ত রাজেন্দ্রচন্দ্র শাস্ত্রী মহাশয় সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকার পঞ্চম ভাগ চতুর্থ সংখ্যায় “উপসর্গের অর্থ বিচার নামক প্রবন্ধের সমালোচনা’ লেখেন। সেই সমালোচনার উত্তরে একটি লেখা লেখেন রবীন্দ্রনাথ।
ভারী চমৎকার সেই লেখাটি। দু একটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। ‘উপ’ এই উপসর্গের প্রয়োগ সম্পর্কে লিখছেন-
‘উপ উপসর্গে উচ্চ এবং নীচের মধ্যে একটি যোগ রাখিয়া দেয়, অব উপসর্গে সেই সম্বন্ধটি নাই। কূল ও শাখার তুলনায় উপকূল উপশাখা যদিচ নিম্নশ্রেণীয়, তথাপি উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। নিম্নে বসা মাত্রকেই উপাসনা বলে না, পরন্তু আর-কাহারো সহিত সম্বন্ধ স্থাপন করিয়া তাহার হয়ে নিজেকে আসীন করাই উপাসনা শব্দের উপপত্তিমূলক ভাবার্থ।’
আর এক জায়গাতে তিনি লিখছেন –
‘আ উপসর্গের অর্থ নিকটলগ্নতা; ইংরেজি উপসর্গ ত (তথতদয, তড়রননস), জর্মান an (ankommen অর্থাৎ আগমন), লাটিন ad, ইংরেজি অব্যয় at সংস্কৃত আ উপসর্গের প্রতিরূপ।‘
আহ্বান শব্দের অর্থ হল কাছে “কাছে আসার ডাক”। সহজ বাংলাতে আয় ক্রিয়াপদটির ব্যবহার ও অনেকটা সেইরকম। হিন্দীতে ‘আ’ ও তাই। এই ‘আ’ উপসর্গটি সংস্কৃতে ও বাংলাতে বিশেষভাবে উপস্থিত। এই উপসর্গের মাধ্যমেও আমরা শুনি – “কাছে আসার ডাক”। আমরা জানি এক একটি উপসর্গ একটি শব্দকে নতুন দিক নির্দেশ দেয়। যেমন – ‘উপকার’ মানে কারুর ভাল করা, ‘প্রতিকার’ – মানে দমন বা নিবারণ আর ‘অপকার’ – উপকারের এর বিপরীত।
যেমন উনি বললেন, ‘আ’ উপসর্গটির অর্থ – ‘নিকটলগ্নতা’- বা সহজ করে বললে কাছে টানার ইচ্ছা। পতন অর্থে পড়া, অধঃপতন – নীচে পড়া আর আপতন মানে – কাছে এসে পড়া। আমরা কারুকে ‘আকর্ষণ’ করলে তাকে কাছে টানতে চাই। যে কাল বা সময় আমাদের খুব কাছে, তাকে আমরা বলি – ‘আপাততঃ’। গমন মানে যাওয়া কিন্তু সেই গমন যদি কাছে আসার জন্য হয় তাকে বলি আগমন। যে বিপদের আমাদের কাছে আসার সম্ভাবনা তাকে বলি – ‘আসন্ন’ আর ‘আপদকালে’ সেই বিপদ যখন ঘরে ঢুকে পড়ে তখন সক্রোধে বলি – ‘কি আপদ’!
মজার কথা হল এই ‘আ’ উপসর্গটির ‘নিকটলগ্নতা’ পরিমুখটি আজীবন রবীন্দ্রনাথ নিজের কাছে রেখেছেন, হয়তো বা নিজের অজান্তেই। এক অনির্বচনীয় উদাহরণে তার উজ্জ্বল উদ্ধ্বার করেছেন।
শেষের কবিতার নায়ক কথার তুবড়ি অমিত রায়, লাবন্য ও কেতকীর ভালবাসাকে আলাদা করে যতিশংকরকে বুঝিয়েছেন এই একটি উপসর্গের মাধ্যমে –
“যে ভালোবাসা (লাবন্যর) ব্যাপ্তভাবে আকাশে মুক্ত থাকে, অন্তরের মধ্যে সে দেয় সঙ্গ; যে ভালোবাসা (কেতকীর) বিশেষভাবে প্রতিদিনের সব-কিছুতে যুক্ত হয়ে থাকে, সংসারে সে দেয় আসঙ্গ। দুটোই আমি চাই”। 

আকাশ সুদূর, তাই আকাশের ভালোবাসা দেয় ‘সঙ্গ’, আর সংসার খুব কাছের, তাই সে ভালোবাসা দেয় ‘আ-সঙ্গ’।
কমলহীরের আলোয় দ্যুতিময় এই বাক্যটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেই আশ্চর্য ও অফুরাণ রবীন্দ্রনাথকে।
তিনি একই সঙ্গে আমাদের ‘ঘড়ায় তোলা জল’ এবং ‘ওড়ার আকাশ’ – তাঁর কাছে আমরা সদা-সর্বদাই পেয়ে থাকি –
‘সঙ্গ’ আর ‘আসঙ্গ’ – উভয়ই।
যাঁরা রবীন্দ্রনাথের সেই লেখাটি পড়তে উৎসুক, তাঁদের জন্য রইল এই লিঙ্ক –
ব্যতিক্রমী লেখা। মনের মণিকোঠায় সঞ্চিত করে রাখলাম।
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ পল্লব
LikeLike