যদিও আমার জন্ম কলকাতার একটি হাসপাতালে, কিন্তু আমার বড় হয়ে ওঠা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার একটি মফঃস্বল শহরে যা কলকাতার থেকে মাত্র ১৫-১৬ কিলোমিটার দূরত্বে। কিছুদিন আগে অবশ্য সেটির পিন-কোড পরিবর্তিত হয়ে কলকাতার পিনে পরিণত হয়েছে, কিন্তু কলকাতাবাসীদের কাছে সেইসময় আমরা ‘দোখনো’ বলে পরিচিত হতাম। আর আমাদের বাল্যকালে না ছিল মিনিবাস, দূরপাল্লার বাস – না ছিল শেয়ার অটো বা ট্যাক্সি। কাজেই আপাতনিকট কলকাতাতে যাতায়াত করার উপায় বলতে ট্রেন বা বাস যা ঐসময়তে সেরকম ভাবে সুলভ ছিলনা। ফলে কলকাতা যাত্রার পরিকল্পনা করতে হত একটু সময় হাতে রেখে।হয়তো সেই কারণেই কলকাতা আমাদের কাছে বেশ আশ্চর্যের জায়গা ছিল।

বড় বড় পার্কগুলি ছিল বিশেষ দ্রষ্টব্য। মামারবাড়ি ছিল দক্ষিণ কলকাতার শরৎ বসু রোডে, কাছেই দেশপ্রিয় পার্ক।
কি দারুণ লাগতো ঐ পার্কের ফুচকা, আইসক্রিম, ভেলপুরি, ঝালমুড়ি! আমাদের কৈশোরে তখন ও রোলের এত রমরমা হয়নি, কিন্তু উল্টোদিকের সুতৃপ্তিতে মোগলাই পরোটা বা কবিরাজি কাটলেটের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। আমাদের মফস্বলী মনে তার আকর্ষণ ছিল অপ্রতিরোধ্য। হাতে আইসক্রিম নিয়ে খেতে খেতে দেশপ্রিয় পার্কের টেনিস খেলা দেখা ছিল এক দারুণ অভিজ্ঞতা। আমাদের পাড়ায় ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, – এসব খেলার চল থাকলেও টেনিস নৈব নৈব চ। তাই বিস্ময় বোধ ছিল বেশী। আর ট্রাম লাইন ধরে হাঁটলেই ট্র্যাঙ্গুলার পার্ক, গড়িয়াহাট – অন্যদিকে রাসবিহারীর মোড়, যে কোন অনুষ্ঠানেই সেই রাস্তা গুলো কিরকম সেজে উঠতো। মনে আছে, আমাদের খুব কৈশোরে, কলকাতার রাস্তা জল দিয়ে ধোয়া হত। খুব ভোরে উঠে সে দৃশ্য দেখার আনন্দ আজও মনে পড়ে। রবিবারে রবিবারে ফাঁকা ফাঁকা রাস্তাওলা কলকাতাতে কোন আত্মীয়বাড়ী যাওয়াও এক বেশ মধুর অভিজ্ঞতা।
১৯৭৭ সালের মাঝামাঝি রাজনৈতিক পালাবদলের মাধ্যমে বাঙ্গালীর জীবনে খুব বড়ো রকমের পরিবর্তন এল। আমার মফস্বলের স্কুলের পালা চুকিয়ে ভর্তি হলাম কলকাতার এক বিখ্যাত স্কুলে। সেখানে আমিই একমাত্র ছাত্র ছিলাম যে অনেকদূর থেকে পড়তে আসত। সহপাঠী, সহপাঠিনীরা বেশ অবাক হত। কিন্তু সেই সময় ট্রেনে ডেইলী প্যাসেঞ্জরি জীবনে অনেক অভিজ্ঞতার জন্ম দিল। আসতে হত সোনারপুর থেকে বালিগঞ্জ।
মনে আছে স্কুলের কোন কোন ফাংশনে যোগ দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব য়ে দূরত্বের কারণে আর ভয়ংকর ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়তাম বন্ধুদের ওপর। কিন্তু সে সময়ই সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি ভালবাসার সূত্রপাত।
সেই স্কুলে গ্রীষ্মাবকাশের ঠিকআগের দিন একটা ছোট ধরনের সাহিত্য আলোচনা হত – কবিতা পাঠ, গান, আলোচনা ইত্যাদি।
১৯৭৮ সালে প্রথম বন্ধুবান্ধবদের কাছে শুনে পৌঁছে
গিয়েছিলাম রবীন্দ্রসদনে ২৫শে বৈশাখের প্রভাতী নুষ্ঠানে।
অনেক গান শুনেছিলাম, বিখ্যাত গায়ক গায়িকাদের গলায়।
কিন্তু সবচেয়ে যা আকর্ষণ করেছিল তা হল কাজী সব্যসাচীর আবৃত্তি। দুটি মাত্র কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন – একটি – তাঁর পিতৃদেবের উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণী-
আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু / আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু/
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে / উড়িয়ে দে তোর বিজয়-কেতন।
আর অন্যটি –
আমি ছেড়েই দিতে রাজি আছি সুসভ্যতার আলোক,
আমি চাই না হতে নববঙ্গে নব যুগের চালক।
পরবর্তীকালে এই কবিতাদুটি এক বিখ্যাত স্মৃতি হয়ে থেকেছে। আর নীলাদ্রিশেখর বসু আবৃত্তি করেছিলেন আরো একটি অনবদ্য কবিতা – শিলং নিবাসী রবীন্দ্রনাথের কাছে দুটি ছোট মেয়ের আবদার মেটানোর জন্য লেখা একটি শিলং ভ্রমণকাহিনী – শুরুটি যার এইরকম –
ছন্দে লেখা একটি চিঠি চেয়েছিলে মোর কাছে / ভাবছি বসে এই কলমের আর কি তেমন জোর আছে।
এত সুন্দর করে মজার চিঠিটি পড়েছিলেন তিনি যে আজো সেই অনুরণন শুনতে পাই। রবীন্দ্রনাথকে জানতাম খুব গম্ভীর কবি বলে, এই মজার কবিতা সে ভাবনাতে এক অন্য মাত্রা যোগ করেছিল। কি দারুণ ঐ দুটি লাইন –
আমার মতে জগৎটাতে ভালোটারই প্রাধান্য / মন্দ যদি তিন চল্লিশ, ভালোর সংখ্যা সাতান্নো।
অনেক পরে বুঝেছি – ৪৩% আর ৫৭%!! মনে পড়ছে এই মজার রবীন্দ্রনাথকে আরো বেশী করে প্রতিভাত করতে তিনি সম্ভবতঃ যোগ করেছিলেন আরো একটি কবিতা –
কলকত্তামে চলা গয়ো রে সুরেনবাবু মেরা, / সুরেনবাবু , আসল বাবু , সকল বাবুকো সেরা।
এই কবিতার লাইনগুলি এত মজা করে তিনি আবৃত্তি করেছিলেন – আজো ভাবলে হাসি চেপে রাখা দায় হয় –
সর্বদা মন কেমন কর্তা, কেঁদে উঠ্তা হির্দয় / ভাত খাতা, ইস্কুল যাতা, সুরেনবাবু নির্দয়!
এক অদ্ভুত ভালোলাগা নিয়ে ফিরেছিলাম।
স্কুলের পালা চুকিয়ে যাদবপুরের ইঞ্জিনীইয়ারিং এর চার-চারটি বছর ছিল একই সঙ্গে বিজ্ঞান-কারিগরী আর শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমাজ সচেতনতা, খেলাধুলো শেখার এক আদর্শ পীঠস্থান। মাউন্টেনীয়ারিং ক্লাব, সাইন্স ক্লাব, ফোটোগ্রাফি ক্লাব, ফিল্ম ক্লাব, ড্রামা ক্লাব, গীতি সংসদ – কিছুরই অভাব ছিলনা। আমাদের এক বন্ধু মজা করে বলেছিল- পড়াশুনোর জন্য এবার একটা ক্লাব খুলতে হবে!! বিনা পয়সায় বা খুব অল্প পয়সাতে উচ্চমানের নাটক, গান, সিনেমা দেখার দারুণ এক সুযোগ এসে গেল। ব্যারিকেড, টিনের তলোয়ার, জগন্নাথ, মারীচ সংবাদ, সমাবর্তন, অমিতাক্ষর, হারানের নাতজামাই – কত যে ভালো নাটক দেখার সুযোগ হল! আর ফিল্ম ফেস্টিভালে পরিচয় হল বিশ্ববন্দিত পরিচালকদের সিনেমার সঙ্গে। কুরোসোওয়া, ফেলিনি, ডিসিকা, বার্গম্যান, আইজেনস্টাইন – কত যে নাম। একবার সত্যজিৎ রায় এলেন সমাবর্তন উৎসবে, চোখের সামনে সেই মহাপুরুষকে দেখার আশ্চর্য অনুভূতি। যাদবপুর নিয়ে আলাদা লেখা আছে, তাই ইতি টানি।
আশা ছিল চাকরী জীবন কলকাতায় হলে এই উৎসব জীবনভোর চলবে! কিন্তু বিধি বাম। প্রায় ২৯ বছর আগে সেই যে কলকাতা ছাড়তে হল, তারপর থেকেই প্রবাসী বাঙ্গালীর তকমা লেগে গেল চিরতরে। বছরে একবার কলকাতায় যাওয়া, সেই সুযোগে অল্প সময়ের মধ্যে দুদ্দাড় করে কিছু ভালো অনুষ্ঠান দেখা, কলেজ স্ট্রীট থেকে বই কেনা, স্মৃতির জায়গা গুলো একটু ঘুরে দেখা। এর মধ্যেই নব্বই এর দশকের গোড়ার দিকে সুমনের আবির্ভাব। তাঁর গানে কলকাতার ছবি পেয়ে মন ভরে যেত।
“গড়িয়াহাটার মোড়, মিনি-মিনি বাস ট্রাম” কিংবা
“তার সুরটা চেনাচেনা বলেই ছোঁয়াচ লাগে / কলকাতাতে সন্ধে হবার একটু আগে” বা
“প্রথমবার লুকিয়ে টানা / প্রথম সিগারেট / প্রথমবার নিজামে গিয়ে/ কাবাব ভরপেট/
এই শহর জানে আমার/ প্রথম সবকিছু / পালাতে চাই যতো, সে আসে / আমার পিছু পিছু”।
আহা, সুমন কিভাবে এত সহজ সুন্দরভাবে কলকাতা আর কলকাতাপ্রেমী বাঙ্গালীর ছবি আঁকলেন!
প্রবাসী বাঙ্গালীদের একটি বিস্তর সমস্যা, সবসময় কলকাতার মানুষের কর্মবিমুখতার নমুনা শুনতে হয়। বন্ধের রাজনীতির সমালোচনা শুনতে শুনতে প্রায় কান ঝালাপালা। এর সঙ্গে আছে মিছিল, মিটিং, জনস্রোত। সেই অভিযোগের অনেকটাই সত্যি, তাই প্রতিবাদের জায়গা কম। কিন্তু মাঝেমাঝেই কলকাতা থেকে ফিরে আসা অবাঙ্গালীদের কাছে কলকাতার উষ্ণ সম্পর্কের কথা শুনে ভালো লাগে।
সম্প্রতি আরো আনন্দের কারণ হালে দেখা একটি হিন্দি ছবি – সুজয় ঘোষের “কহানী” ! এই ছবিতে কলকাতা বেশ নতুন ভাবে উঠে এসেছে এবং তা আপামর বাঙ্গালী ও অবাঙ্গালী দর্শকদের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছে। বাঙ্গালী পরিচালক, বাঙ্গালী চরিত্র, বাঙ্গালী অভিনেতা ও সর্বোপরি শুধু পটভূমিকা নয়, একেবারে মুখ্য চরিত্ররূপে কলকাতার এক অভিনব আত্মপ্রকাশ!
নতুন কলকাতার কি শুরু হওয়ার এই “কাহিনী”!! আমরা আশায় বুক বাঁধি।*
প্রথম প্রকাশ – আনন্দবাজার ইন্টারনেট সংস্করণ – ২১শে নভেম্বর, ২০১৩। নীচে লিংক-
আমার কলকাতা – ই – আনন্দবাজারে
*(লেখাটি ২০১৩র – তারপরেও দেখছি বাংলা ও বাঙালীদের রমরমা চলছে বলিউডের সিনেমাতে – বরফি, পিকু, তিন এবং আরো অনেক ছবিতে- আশা প্রকাশ খুব খারাপ হয়নি)
দারুণ ভাষ্করদা। ছবির মতন লেখাটি।
LikeLiked by 1 person
হৃদয়ের খুব কাছাকাছি লেখাটা, অসম্ভব ভাল লাগল।
LikeLiked by 1 person
Daroon laglo! Aber kolkata ke ektu touch korlum.
LikeLiked by 1 person
Bhaskar, excellent, I am really proud of you…
LikeLiked by 1 person
জীবন খাতার পাতায় পাতায় তোর এই লেখাটার শীরোনাম দিলাম…………..
শুভেচছা সহ …….বীরেনদা
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ বীরেনদা।
LikeLiked by 1 person
খুবই সুন্দর পরিবেসনা। পড়তে পড়তে পেছনে ফেলে আসা দিনে চলে গিয়েছিলাম। মনটা কেমন নস্টালজিক হয়ে উঠলো।
LikeLiked by 1 person
অসংখ্য ধন্যবা!
LikeLiked by 1 person
আজো ইচ্ছে করে সব পালটে দিই
LikeLike