তাঁর শেষ পরিচয় – পূর্ণতার সঙ্গে

আজ (কোন পঞ্জিকা মতে গতকাল) রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিন।

যে মানুষটি তাঁর ছোটবেলা থেকেই মৃত্যুর সঙ্গে পরিচিত হয়ে চলেছিলেন বারেবার, বহুবছর আগে এই দিনেই মৃত্যুর সঙ্গে তাঁর শেষ পরিচয়।

 

 

তাঁর জীবনের মত মৃত্যুর উপলব্ধি আর কারুর হয়েছে বলে জানা নেই। আশ্চর্য, তা সত্ত্বেও তাঁর পথচলা থামেনি। খুব ছোটবেলাতেই মাতা, মাতৃস্বরূপ বৌদি, বাবা, নিজের ছেলে, মেয়ে, অনুজ সাহিত্যিক, বন্ধু – তাঁর জীবনে মৃত্যুমিছিল বড়ই দীর্ঘ। প্রিয় অনুজ কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যুতে তিনি লিখেছিলেন,

যে খেয়ার কর্ণধার তোমারে নিয়েছে সিন্ধুপারে
আষাঢ়ের সজল ছায়ায়, তার সাথে বারে বারে
হয়েছে আমার চেনা; কতবার তারি সারিগানে
নিশান্তের নিদ্রা ভেঙে ব্যথায় বেজেছে মোর প্রাণে
অজানা পথের ডাক, সূর্যাস্তপারের স্বর্ণরেখা
ইঙ্গিত করেছে মোরে।

তাঁর এই লেখার মধ্যেই রয়ে গেছে তাঁর সমস্ত মৃত্যুভাবনা। এই পংক্তির প্রতিটি শব্দই যেন তাঁর মৃত্যুদর্শনের প্রতিনিধি। ‘যে খেয়ার কর্ণধার’’ – এই শব্দচয়নের মধ্যেই রয়ে গেছে তাঁর সেই ভাবনা – ‘বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে’! এই অনুভূতি তাঁর সম্পূর্ণ বাস্তব, কোনই কল্পনা নয়। কারণ ১৯২২ সালে যখন এই কবিতা তিনি লিখছেন, তার আগেই অনেক নিকটজনের মৃত্যু ঘটেছে তাঁর জীবনে, যাঁদের মধ্যে আছেন তাঁর প্রাণাধিকা পুত্রকন্যা, শমীন্দ্রনাথ, রেণুকা ও মাধুরীলতা। সুতরাং – ‘তার সাথে বারে বারে / হয়েছে আমার চেনা; কতবার তারি সারিগানে / নিশান্তের নিদ্রা ভেঙে ব্যথায় বেজেছে মোর প্রাণে’  কথাগুলি একেবারেই কাল্পনিক নয়, বরং তা তাঁর জীবন থেকে উৎসারিত। ‘ওরে আয়, আমায় নিয়ে যাবে কে রে দিনশেষের শেষ খেয়ায়’ –

তাঁর মৃত্যুদর্শন মুগ্ধ করেছিল এক পাশ্চাত্য মনস্তত্ববিদকে। তাঁর নাম এলিজাবেথ কুবলার। তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে পড়ে দেখা যেতে পারে তাঁর জীবনী – https://www.biography.com/people/elisabeth-kubler-ross-262762

মৃত্যুর ওপর তিনি গভীর গবেষণা করেছেন। তাঁর এই সংক্রান্ত একটি সুবিখ্যাত বইও আছে – “On Death And Dying”!

এতে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন মৃত্যু নিয়ে, শেষযাত্রার পাঁচটি ধাপ নিয়ে। সেখানে তিনি তাঁর লেখাটিকে সমৃদ্ধ করেছেন প্রতি স্তরে কবিগুরুর উদ্ধৃতি দিয়ে। বইটির শুরুই হয়েছে –‘বিপদে মোরে রক্ষা কর’ দিয়ে।

এখানে একটি প্রশ্ন আসে। আমরা অনেকেই মনে করি বাংলা সাহিত্যের ঠিকমতো প্রচার হয়নি, সেভাবে বিজ্ঞাপিত হলে তা অনেক বেশী সমাদৃত হত। কুবলারের রবীন্দ্র অনুপ্রেরণা সম্ভবত তার এক প্রমাণ। এক পাশ্চাত্য মৃত্যু-মনস্তাত্ত্বিকের এভাবে রবীন্দ্র মনস্ক হওয়া আমাদের কাছে বেশ শ্লাঘার ব্যাপার। অনুপ্রেরণারও। অর্থাৎ বাংলার সাহিত্য ঠিকভাবে অনুদিত হলে এবং বিজ্ঞাপিত হলে তার জনপ্রিয়তার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

যাক সে সব কথা। আজ ব্যাঙ্গালোরের আকাশ বড়ই মেঘলা। মনে হচ্ছে যেন বহু বছর আগের সে দিনটি ফিরে এসেছে। আরো এক দিনের কথা মনে পড়ে।

সাতের দশকের মাঝামাঝি। তখন সদ্য কলকাতা দূরদর্শন চালু হয়েছে। এরকম এক বাইশে শ্রাবণ এক অনুষ্ঠান ছিল, – দেখান হচ্ছিল তাঁর স্মৃতি বিজড়িত বিভিন্ন জায়গাগুলি – শান্তিনিকেতন, পদ্মার দুই ধার, শিলাইদহ, পতিসর।

 

সঙ্গে ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মায়াবী কন্ঠের গান – সেটিই আমার ২২শে শ্রাবণের শ্রেষ্ঠ স্মৃতি। 4

বহুদিনের বাক্যরাশি      এক নিমেষে যাবে ভাসি–

একলা বসে শুনব বাঁশি অকূল তিমিরে॥

 এবার   নীরব করে দাও হে তোমার মুখর কবিরে।

https://www.youtube.com/watch?v=MAa2wXPFor0

ছবিগুলি সবই ইন্টারনেট থেকে নেওয়া।

 

14 thoughts on “তাঁর শেষ পরিচয় – পূর্ণতার সঙ্গে

  1. অসাধারণ তথ্যসমৃদ্ধ বিন্যাস । ভেসে যেতে বাধ্য করলি । বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে….. । ভালো থাকিস রে ।
    সোমনাথ ব্যানার্জি

    Liked by 1 person

  2. তোমার post-টা পড়ে Elisabeth Kübler-Ross -এর ব‌ইটা প‌ড়ার ইচ্ছে জেগেছে। Thank you, Bhaskar.
    ∆ভাস্করদা

    Liked by 1 person

  3. আবারও খুব ভাল লাগল তোমার অন্য পোস্টগুলির মত। এলিজাবেথ কে আর সম্বন্ধে আরও জানার কৌতূহল রইল। এই প্রসঙ্গে মনে হল রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর গল্পটির মধ্যে জানুস করচক তাঁর সমাধান খুঁজে পেয়েছিলেন ইহুদি শিশুদের পরিণতি নিয়ে WWII তে। এ নিয়ে নারায়ণ সান্যাল লিখে গেছেন তাঁর শেষ বই ‘মৃত্যরমা’ তে। ফন্টের জন্য বানান ভুল কিছু মনে করনা। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া চলবে কি করে, বল? আমরা যে কত ভাগ্যবান তাঁর লেখা মূল ভাষায় পড়তে পারি। পরের প্রজন্ম বা বাংলা যারা শিখলনা তাদের জন্য বড় দুঃখ হয়।

    Liked by 1 person

  4. ভাস্করীয়।
    আর কি বলব। তথ্য বাহুল্য লেখাটিকে এতটুকু ভারাক্রান্ত করেনি, বরং মনে হচ্ছিল বড় দ্রুতই ফুরিয়ে গেল।
    সংরক্ষণযোগ্য রচনা।

    Liked by 1 person

  5. পড়ে খুব ভালো লাগল।
    বারেবার অগ্নিদগ্ধ হবার পরেই তো রবি ঠাকুরের লেখা বাশীর সুর এত মিঠে,

    Like

  6. সংক্ষিপ্ত, সৎ; একটি নিবেদিত স্মরণ …

    Like

Leave a Reply to bhaskarbose1960 Cancel reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s