ভূতের গল্প নাম্বার ওয়ান

সে অনেকদিন আগের কথা। চল্লিশ বছরেরও আগের কথা। তখন আমরা যাকে বলে কিশোর।

সাতের দশকের মাঝামাঝি সময়। তখন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের ভাষায় বলতে গেলে – ‘বাঙ্গালী কিশোর কিশোরীরা একপ্রকার সুখে ছিল। পড়াশুনার এত দৌরাত্ম্য শুরু হয় নাই, অভিভাবকরাও রীতিমতো দয়ালু ছিলেন। স্কুলেও ভালো ছুটিছাটা পাওয়া যাইত, শিক্ষকেরা পড়ানোর মাঝে মাঝে ছাত্রদের সহিত খেলা, গোয়েন্দা এমনকি ভূতের গল্প অবধি করিয়া থাকিতেন”!

সত্যিই তাই। এতটুকু বাড়িয়ে বলছিনা। আমাদের সহ প্রধানশিক্ষক ছিলেন আনন্দবাবু। টকটকে ফর্সা রং, রেগে গেলে একদম লাল। বেশীরভাগ সময়েই রেগে থাকতেন, চড় চাপড় পড়া ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক। তা সেই আনন্দবাবুই এক বর্ষার দিনে আমাদের ভূতের গল্প শুনিয়েছিলেন – ত্রৈলোক্যনাথের – ‘লে লুল্লু’! বোঝো ব্যাপারখানা।

সে যুগে ভুতের রমরমা। ছোটদের তখন রূপকথা, ভূ্‌ত, দেশপ্রেমের গল্প আর খেলাধুলো দিয়েই মন ভোলানো যেত। বিজ্ঞানমনস্কতার চরম অভাব তাদের মধ্যে।  তারমধ্যে ভূত আবার হটকেক।

এখনকার যিনি ভূতসম্রাট সেই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও তখন দুরুদুরু বক্ষে কিশোর সাহিত্যের আঙিনাতে পা রাখছেন। কোন সমালোচক বলেছিলেন, শীর্ষেন্দু হাতে কলম নিলেই নাকি ভূতেরা কলমের ফাঁকে সুড়সুড়ি দিতে থাকে। কিন্তু শুরুতে এমন ছিল না। আর হবেনাই বা কেন, তার আগে বাংলা সাহিত্যে ভূতের গপ্পো লিখে গেছেন তাবড় তাবড় লেখকেরা। রবিঠাকুর থেকে শুরু – বিভূতিভূষণ, পরশুরাম, মনোজ বসু, ত্রৈলোক্যনাথ, উপেন্দ্রকিশোর, হেমেন্দ্র রায় – কত নাম করবো। তারও আগে সেই ঠাকুরমার ঝুলি রাক্ষস, খোক্কস। কাজেই নীরেন চক্কোত্তি মশাই যখন তাঁকে কিশোরদের জন্য লেখা দিতে বলেছিলেন, তাঁর নাকি বেশ হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ১৯৭৫ এর শারদীয় আনন্দমেলাতে যা একখানা নামালেন না – আহা! একেবারে আকাশে বাতাসে তাঁর আগমনীবার্তা ঘোষিত হয়ে গেল। বিভিন্ন পুজো প্যান্ডেলে, পাড়ার রোয়াকে, মাঠে ময়দানে আর স্কুল খোলার পর ক্লাসে ক্লাসে – আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল – ‘গন্ধটা খুব সন্দেহজনক’!

Gandha1.PNG

সে নামই ছিল গল্পটির। ঘটনাস্থল ছিল দোমোহানি। গল্পটির শুরু এভাবে –

“সেবার আমার দিদিমা পড়ল ভারি বিপদে।

দাদামশাই রেল কোম্পানিতে চাকরি করতেন, সে আজ পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা। আমার মা তখন ছোট্ট ইজেরপরা খুকি। তখন এতসব শহর-নগর ছিল না; লোকজনও এত দেখা যেত না। চারধারে কিছু গাছগাছালি, জঙ্গলটঙ্গল ছিল। সেইরকমই এক নির্জন জঙ্গুলে জায়গায় দাদামশাই বদলি হলেন। উত্তরবাংলার দোমোহানীতে।

এরপরে যা ঘটে চলল তা একেবারে তাজ্জব কাণ্ড। কানাঘুষো শুনেছিলেন দিদিমা, কিন্তু একেবারে চাক্ষুষ করলেন নিজের ঝি এর মধ্যে দিয়ে। পরিপাটি কাজ করে ঝি একেবারে হাওয়া, আক্ষরিক অর্থেই। তাকে আর খুঁজেই পাওয়া গেল না।

পালিত গিন্নি মুচ্‌কি হাসি হেসে বললেন, ‘ওদের ও-রকমই ধারা। ঝি-টার নাম কই বলুন তো?’

দিদিমা বললেন, ‘কমলা।’

পালিত গিন্নি মাথা নেড়ে বললেন ‘চিনি, হালদার বাড়িতেও ওকে রেখেছিল।’

দিদিমা অতিষ্ট হয়ে বললেন, ‘কি ব্যাপার বলুন তো?’

পালিত গিন্নি শুধু শ্বাস ফেলে বলেন, ‘সব কি আর খুলে বলা যায়? এখানে এই হচ্ছে ধারা। কোন্‌টা মানুষ আর কোন্‌টা মানুষ না তা চেনা ভারি মুশকিল। এবার দেখেশুনে একটা মানুষ ঝি রাখুন।’

 ব্যস! সেই শুরু। এর পরের দিদিমার ছেলে মেয়েদের সঙ্গে যারা খেলা করে তাদের মধ্যে কুজন যে ‘এনারা’ আর কজন ‘তেনারা’ বোঝা ভারী মুশকিল। ফুটবল খেলাতেও তারা দোমোহনীর দলে ভিড়ে গিয়ে প্রতিপক্ষকে পর্যুদস্ত করে। তবে সবচেয়ে মজা হল প্রগেসর ভট্টাচার্যকে নিয়ে। তিনি ম্যাজিক দেখাতে এসেছিলেন দোমোহানিতে। তিনি ম্যাজিক দেখানোর সময়ে এমন সাহায্য পেলেন তা আর বলার নয়। বিখ্যাত ম্যাজিক চোখ বেঁধে খেলা দেখানো শুরু করার আগেই চকটা লাফিয়ে উঠে ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে ফেললে –

‘প্রফেসর ভট্টাচার্য ইজ দি বেস্ট ম্যাজিশিয়ান অব্‌ দি ওয়ার্লড’। তারপরে রাত্রে খেতে বসে দাদামশাইয়ের সঙ্গে তাঁর যা কথাবার্তা হল –

 ‘আপনার খেলা গণপতির চেয়েও ভালো। অতি আশ্চর্য খেলা!’

ভট্টাচার্যও বললেন, ‘হ্যাঁ, অতি আশ্চর্য খেলা। আমি এরকম আর দেখিনি।’

দাদামশাই অবাক হয়ে বলেন, ‘সে কী! এ তো আপনিই দেখালেন।’

তাঁকে খুবই বিস্মিত মনে হচ্ছিল।

Gandha2.PNG

 তবে একটা জায়গাতেই গড়বড় হল। দাদামশাইয়ের বাবা এসেই মনে করলেন জায়গাটা একদম সুবিধের নয়। গন্ধবাতিক মানুষটি বাতাস শুঁকতেন, লোকের গা শুঁকতেন। প্রতিশোধ নিতে একটা ভূত ও তাঁর গা শুঁকে ছিল। তারপর বলল

‘এ তো ভালো কথা নয়? গন্ধটা বেশ সন্দেহজনক। আপনি কে বলুন তো! অ্যাঁ! কে?’

এই বলে লোকটা হাসতে হাসতে অদৃশ্য হয়ে গেল।”

 দাদামশাইয়ের বাবা এত অপমানিত হয়েছিলেন, যে কদিন দোমোহানিতে ছিলেন আর কোনদিন গন্ধের কথা বলেননি।

কি যে অপূর্ব গল্প! আর শারদীয় আনন্দমেলাতে ছবিসহ পরে পুরো পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। আগে পরে অনেক ভূতের গপ্পো পড়েছি, কিন্তু এটা হল গিয়ে ‘এক নম্বর, এক নম্বর’!

fb_img_1541502054403.jpg

 শীর্ষেন্দু যখন ব্যাঙ্গালোর এসেছিলেন,

তাঁর পাশে দাঁড়ানোর সৌভাগ্য হয়েছিল।

রইল সেই ছবিও।

4 thoughts on “ভূতের গল্প নাম্বার ওয়ান

  1. গন্ধটা খুব সন্দেহজনক – পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি। কারণ আমার বয়স তখন ছয়। পরে শীর্ষেন্দুবাবুর অনেক গল্প পড়লেও ভূতে আকর্ষণ না থাকায় খুব কম ভূতের গল্প পড়েছি। তবে আপনার এই চমৎকার লেখাটা পড়ে এখন ভূতের গপ্পো পড়তে ইচ্ছে করছে।

    Liked by 1 person

  2. ami onar akjon bhakto….golper boi tamon na porleo sunday suspenser madhyome onar lekha anek golpo porar souvagyo hoyeche…..riya banerjee

    Liked by 1 person

Leave a comment