“আমার ষোল-সতের বছর ছাত্র জীবনের সবচেয়ে বেশী সময় কাটিয়েছি আমি হরিণাভি স্কুলে, ১৯৭১ – ৭৭, ক্লাস ফাইভ থেকে টেন। ঐ সময়টাই ভিত গড়ার। আজ এত বছর পরে পিছনে তাকিয়ে দেখছি যে ঐ সময় ওখানকার শিক্ষকরা এবং আমার শিক্ষক যতীনবাবু যে ভিত গড়ে দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে তাই সবচেয়ে বেশী কাজে লেগেছে। এই শিক্ষকমন্ডলী সম্পর্কে একটা কথাই আমার মনে হয়। পরবর্তীকালেও আমি আরো দুটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হয়েছি। কিন্তু তা সত্বেও মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করব, হরিণাভির শিক্ষকমন্ডলীর মান ছিল একেবারে আলাদা। অসাধারণ এবং ভালো শিক্ষকের সংখ্যা ছিল খুব বেশী, মাঝারি রকমের শিক্ষক ছিলেন হয়তো কিছু কিন্তু খারাপ শিক্ষকের সংখ্যা একেবারে নগণ্য। পরবর্তীকালে কোন জায়গাতে এই অনুপাতে ভালো শিক্ষক পেয়েছি বলে মনে হয়না।
আমরা যে সময় হরিণাভিতে ভর্তি হই, তখন বাংলার রাজনীতিতে সে এক টলমল অবস্থা। তার ছাপ কিছুটা পড়েছিল স্কুলের নিয়মানুবর্তিতায়, মাঝে মাঝে ক্লাস ছুটি দিতে হত গণ্ডগোলের আশঙ্কাতে। সেই সময় অত ছোটবেলাতেও আমরা বোমাবাজির কথা শুনেছি, রাজনৈতিক মারামারি দেখেছি ছাদ থেকে লুকিয়ে, গুণ্ডাদের ভয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময়েও শিক্ষকেরা অনেক সময় এগিয়ে দিতেন। এছাড়া ছিল ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম! ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীবর্ষ পালনেও বহু অনুষ্ঠান হয়েছিল হরিণাভি স্কুলে। এর পরে এসেছে জরুরী অবস্থা আর তারপরে বাংলাতে শাসকের পরিবর্তন।
খেলার জগতে ও আবার বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটেছিল, সাহিত্যও শিল্প জগতেও। আর হরিণাভির শিক্ষকবৃন্দ ও স্কুল পরিচালন সমিতি এই ব্যাপারগুলিতে ছাত্রদের অংশগ্রহণে খুবই উৎসাহ যোগাতেন। সেই সত্তরের দশকের কথাই লিখতে চলেছি। আশা করছি অন্তত কিছুটা হলেও সেই অনুভব পাঠকমণ্ডলীর সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারব।”
উপরের অংশটি মৎলিখিত স্মৃতিকথার ভূমিকা। যে বইটিতে তা আছে সেটি হল –
‘হরিনাভি স্কুল: ইতিহাসে ও স্মৃতিকথায় দেড়শো বছর’
২০১৫র একেবারে শেষদিক। তখন ‘অবসর’ ওয়েব ম্যাগাজিনের সঙ্গে আমার পরিচিতি বেশ বেড়েছে। এর কিছুদিন আগেই ২০১৩ আর ২০১৪র শিক্ষক দিবসে আমি আমার দুজন প্রিয় শিক্ষককে নিয়ে ফেসবুকে লিখেছিলাম। কয়েকজনের সেই লেখাগুলি ভাল লেগেছিল। সেই উৎসাহে সম্পাদক সুজন দাশগুপ্তের সঙ্গে পরামর্শ করে শুরু করলাম আমার ছাত্রজীবন নিয়ে এক ধারাবাহিক – ‘যাঁদের আমি ছাত্র’
এই লেখার দ্বিতীয় পর্বটি* প্রকাশিত হল ৩০শে নভেম্বর, ২০১৫। সেখানে ছিল হরিনাভি স্কুল ও শিক্ষকদের কথা। সেই লেখা পড়ে আমার ফেসবুক বন্ধু ও সুলেখক দেবতোষ দাস জানালেন তিনিও হরিনাভি স্কুলের ছাত্র এবং পুরোমাত্রায় এই শিক্ষকদের কথা অনুভব করতে পারছেন। তফাতের মধ্যে আমি সাতের দশকের আর উনি আটের দশকের। খুবই ভাল লাগলো।
এর কিছুদিন পরেই আবার দেবতোষ জানালেন যে আমার এক প্রিয় শিক্ষক দেবপ্রসাদ চক্রবর্তীর ছেলে রাজকুমারকে উনি বলেছেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। কারণও জানালেন। স্কুলের প্রতিষ্ঠা ১৮৬৬, আগামী বছর ২০১৬তে সার্ধ-শতবর্ষ। সেই উপলক্ষে একটি গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমি যদি কোন লেখা দিতে পারি।
কদিনের মধ্যেই ফোন এসে গেল রাজকুমারের। জানালেন, প্রত্যেক দশক থেকে দুজন করে লেখককে লিখতে হবে তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা। ঠিক হল আমি আমি লিখবো সাতের দশক নিয়ে। দেবতোষ ও রাজকুমার লিখছেন আটের দশক নিয়ে।
লেখা শেষ হতে হতে বেশ কিছুদিন হয়ে গেল। ২০১৭ তে প্রকাশের কথা ছিল, কিন্তু কিছু কিছু লেখা পেতে দেরী হওয়ায় আর প্রকাশনার স্বাভাবিক কাজ গুলি সেরে ফেলতে একটু দেরী হয়ে গেল। ২০১৮র বইমেলাতে আমার দেবতোষ ও রাজকুমারের সঙ্গে দেখা হল। রাজকুমার জানালেন – প্রায় শেষের মুখে।
অস্বীকার করবো না, একটু অধৈর্য হয়েই পড়ছিলাম। কিন্তু না, আর বেশীদিন না। এপ্রিল বা মে মাসের মাঝামাঝিই শোনা গেল এবার নাকি একবারে এসেই পড়েছে। জুন মাসের গোড়ার দিকেই এসে গেল নিমন্ত্রণপত্র – ৩০শে জুন, ২০১৮ প্রকাশিত হচ্ছে বইটি।
আমি যেতে পারিনি, কিন্তু বইটির ছবি দেখেই মন খুশি হয়ে গেল। সূচিপত্র দেখে তো আরো বেশি, উদ্দীপ্ত যাকে বলে। সঙ্গে যে সুধীজনেরা ছিলেন তাঁদের দেখেও।
কেন এই বই সংগ্রহযোগ্য?
প্রথমতঃ – স্কুলের ঐতিহ্য –
দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। এখানে প্রধানশিক্ষকের দায়িত্ব সামলেছেন শিবনাথ শাস্ত্রী, উমেশচন্দ্র দত্ত। হরিনাভি ডি ভি এ এস হাই স্কুলের আদি-পর্বের ইতিহাস বাংলার নবজাগরণের স্থানীয় আখ্যানের অন্তর্গত।
★ দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের জন্মের দ্বিশতবর্ষে এই বই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘও বটে। দ্বারকানাথের জীবন ও সোমপ্রকাশ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা এই বইয়ে রয়েছে। আলোচকদের মধ্যে আছেন প্রয়াত ইতিহাসবিদ নরহরি কবিরাজ, অধ্যাপক ভাস্কর চক্রবর্তী, অধ্যাপক জীবন মুখোপাধ্যায়।
★ ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ত্রিশের বেশি স্বনামধন্য প্রাক্তনীর সংক্ষিপ্ত জীবনী ‘জীবনীমালা’ পর্বে উল্লিখিত হয়েছে।
★ হরিনাভি স্কুল ও স্বাধীনতা আন্দোলন, হরিনাভি স্কুলে খেলাধুলো, হরিনাভি স্কুল ও কো-অপারেটিভ আন্দোলন, ফেরিওয়ালা ও হরিনাভি স্কুল প্রভৃতি প্রবন্ধ পাঠকের মনোযোগ দাবি করে।
★ বিভূতিভূষণ এই বিদ্যালয়ে দুই বছর শিক্ষকতা করেছিলেন এবং এইখানে বসবাসকালেই তাঁর সাহিত্য রচনার সূচনা। সেই ইতিবৃত্ত এই গ্রন্থের সম্পদ।
দ্বিতীয়তঃ – অভিনব প্রয়াস –
বাংলাভাষায় এমন প্রয়াস সম্ভবত প্রথম। ইতিপূর্বে নানা স্কুলের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উপলক্ষে ‘স্মারকগ্রন্থ’ প্রকাশিত হলেও কোনো বিদ্যালয়ের ইতিহাস রচনার উদ্যোগ বিরল। আলোচ্য গ্রন্থটি এমনতর গবেষণায় পথিকৃতের মর্যাদা পেতে পারে। বাংলার সামাজিক ইতিহাসের এটি একটি সংগ্রহযোগ্য ‘দলিল’।
ত্তৃতীয়তঃ – অনেক ঐতিহ্যশালী বাংলামাধ্যম স্কুলের প্রতিনিধি
প্রাক্তন শিক্ষক ও প্রাক্তন ছাত্রদের স্মৃতিচারণ এই বইয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ। স্মৃতিকথাগুলি শুধু হরিনাভি স্কুলের অভ্যন্তরীণ জীবনই তুলে ধরেনি, সেই সঙ্গে হরিনাভির মতো অসংখ্য সরকার-পোষিত বিদ্যালয়ের এক পরিবর্তনশীল জীবনালেখ্য প্রকাশ করেছে। বিশেষতঃ ছাত্রদের দ্বারা ছয় – ছয়টি দশকের লিপিবদ্ধ এই ইতিহাস যেন উত্তর স্বাধীনতাপর্বের বাংলার শিক্ষাজগতের এক সজীব বর্ণনা। বিভিন্ন বয়সের ছাত্র ও শিক্ষকেরা নিঃসন্দেহে এই আয়নাতে নিজেদের অনেককেই দেখতে পাবেন।
গোড়াতেই যে ভূমিকার কথা বলা হয়েছে, সেটি আমার লেখা সাতের দশকের স্মৃতিচারণ। প্রতেক দশকের লেখার মূলসুর অনেকটাই একইরকম। আলোচ্য গ্রন্থে উল্লিখিত ইতিহাস ও স্মৃতিকথা শুধু হরিনাভি স্কুলের ইতিহাস নয়, হরিনাভির মতো অসংখ্য বাংলামাধ্যম স্কুলেরও কাহিনি।
প্রাপ্তিস্থান –
হরিনাভি স্কুল – 033 – 24779368 E-MAIL – harinavidvashs@rediffmail.com
অনুষ্টুপ – 033-2219 1937 / 2353 8179 / 2370 7613
কোনপ্রকার খবরের জন্য খোঁজ করা যেতে পারে যাঁর কাছে তিনি অন্যতম সম্পাদক, শ্রী রাজকুমার চক্রবর্তী।
ফোন / হোয়াটস এপ – 9434704268 / 70769 28746 Email – rajkrc2009@gmail.com
পূর্ণ তথ্য –
‘হরিনাভি স্কুল: ইতিহাসে ও স্মৃতিকথায় দেড়শো বছর’
সম্পাদনা : মির্জা রফিউদ্দিন বেগ, রাজকুমার চক্রবর্তী, সৌমিক বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশক : হরিনাভি ডি ভি এ এস হাই স্কুল ও অনুষ্টুপ
পৃষ্ঠা সংখ্যা – ৫০২ ( রয়াল সাইজ)
বিনিময় মূল্য – ৪৫০/-
স্কুলের সব ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া। বইসংক্রান্ত ছবিগুলি সম্পাদকমন্ডলীর অনুমতিক্রমে তাঁদের ফেসবুক পোস্ট থেকে।
খুব ভালো লাগলো দাদা।
LikeLiked by 1 person
সৌম্য, পারলে যোগাড় করে নিও বইটা। দঃ ২৪ পরগনার লোকেরা অনেকটাই মেলাতে পারবে।
LikeLike
আচ্ছা দাদা।
LikeLike