নিজের কুষ্ঠি তে লেখা ছিল, আমার জন্মদিন ২০শে নভেম্বর, রাত ২ঃ ৩৩ মিনিটে। সেই উপলক্ষে ছোটবেলাতে জানতুম আমার জন্মতারিখ ২০শে নভেম্বর। সেই অনুযায়ীই পালন হত, বড়দের স্মৃতি অনুযায়ী। মাধ্যমিক পরীক্ষার এডমিট কার্ডে প্রথম দেখলাম, ২১শে নভেম্বর রয়েছে জন্মদিন। ইংরেজি মতে অবশ্য তাই ঠিক, সুতরাং পরবর্তী কালে সর্বসম্মত ভাবে এটাই রয়ে গেছে।
তবে জন্মদিনের সবচেয়ে বড় অম্ল মধুর স্মৃতি আমার কাছে রয়ে গেছে তা ঐ ২০শে নভেম্বরেরই। ১৯৭৬ সালের।
আমরা ছিলাম নতুন শিক্ষাব্যবস্থার দ্বিতীয় ব্যাচ। ১৯৭৬এ একসঙ্গে শেষ উচ্চ মাধ্যমিক আর প্রথম মাধ্যমিক হয়। আমাদের বছরে, ১৯৭৭এ, একেবারে পরিবর্তন। বঙ্গের কুর্সিতে নতুন সরকার আর নতুন শিক্ষাক্রম।
তা সে যাই হোক। মোট কথা হল, বাড়িতে দুজন শিক্ষার্থী, আমি ও আমার খুড়তুতো বোন। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই শুরু হবে আমাদের টেস্ট পরীক্ষা। তার মধ্যেই জন্মদিনের বিড়ম্বনা। নম নম করেই সারা হত, কাল হল আমার পিসতুতো দাদা বেহালা থেকে সেদিনই আমাদের বাড়ীতে এসে। হঠাৎ করে সকলের ইচ্ছে হল, ‘বালিকা বধূ’ আবার এসেছে, জন্মদিন উপলক্ষে আবার সব্বাই মিলে দেখে এলে কেমন হয়। বাড়ীতে তখন আমার মাতৃদেবীর কাছে আজ্ঞা নিয়ে আমরা রওয়ানা হলাম।
এবার এই বইটি ও সিনেমা নিয়ে আমার ব্যক্তিগত কিছু কথা জানিয়ে রাখি। আমাদের ‘রাজপুর সাধারন পাঠাগার’ থেকে নিয়ে এই বইটি আমার আগেই পড়া ছিল। ১৯৬৭ সালে যখন এই সিনেমা মুক্তি পায়, আমরা ভাই বোনেরা কেউই দেখিনি। কিন্তু আমাদের বাড়িতে একটি গ্রামোফোন ছিল, তার সঙ্গে যে গোটা পঞ্চাশেক ৭৮ আরপিএম এর রেকর্ড ছিল তার একখানি ছিল ‘বালিকা বধূ’র। একই ব্যাপার ছিল বিমল কর প্রণীত ‘খড়কুটো’ সম্পর্কেও। “ছুটি” সিনেমার রেকর্ডও ছিল আমাদের বাড়ীতে। তার গানও আমরা শুনতাম।
তবে ‘বালিকা বধূ’র দুটি গান আমরা বারবার শুনতাম, মনে প্রায় গেঁথে গিয়েছিল, ‘আজি এসেছি, আজি এসেছি’ আর ‘লাগ লাগ লাগ লাগ রঙের ভেল্কি লাগ’! গান দুটি গেয়েছিলেন রবীন বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁর তখন খ্যাতি মূলতঃ দ্বিজু বাবুর গানের গায়ক রূপেই। সবচেয়ে ভালোলাগা গান নিঃসন্দেহে – ’আজি এসেছি’!
বরযাত্রীর দল যাচ্ছে গানটি গাইতে গাইতে, গানটি ছিল শরৎরূপী অনুপকুমারের গলায়। নায়কের ভগ্নীপতি শরত সম্পর্কে লেখকের উক্তি – ‘শরৎ ভ্রাতা শরৎ প্রকৃতির মতই সহাস্য প্রকৃতির ছিল’! অনুপকুমার একেবারে মাতিয়ে দিয়েছিলেন। গানে সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাড়ির হর্নের এক অনবদ্য প্রয়োগ দেখিয়েছিলেন, যাঁরা ছবিটা দেখেছিলেন, তাঁদের মনে আছে, কী মোক্ষম ছিল সেই প্রয়োগ! – আহা!! এর সঙ্গে সুমধুর বাঁশী। ছবিটা না পাওয়া গেলেও গানটি আছে ইউটিউবে, শোনাই যেতে পারে।
কাজেই আমাদের সব ভাইবোনেদের প্রবল দুর্বলতা ছিল সিনেমাটির ওপর। এর কিছুদিন আগেই আবার গড়িয়ার কাছে একটি হলে এসেছিল। আমার মায়ের তত্ত্বাবধানে দেখেও এসেছিলাম। আর যাকে বলে অভিভূত হয়েছিলাম।
আমাদের বাড়িতে আমাদের সর্বোচ্চ অভিভাবক ছিলেন আমাদের মেজজেঠু। অবিবাহিত এই মানুষটি আমাদের সংসারের জন্য প্রাণপাত করেছেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে পড়াশুনো ছেড়ে সংসারের জোয়াল কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। কাজেই ভাইপো ভাইঝিদের পড়াশুনোর যাতে কোনরকম ক্ষতি না হয় তার জন্য তিনি ছিলেন বদ্ধ পরিকর। আমরা ছোটবেলাতে তটস্থ থাকতাম তাঁর ভয়ে। ঐ যে গ্রামোফোন, সেটি শোনার জন্যও অপেক্ষা করতে হত কখন তিনি তাঁর প্রাতঃকালীন আড্ডা দিতে যাবেন। আবার তাঁর ফেরার পথে পাহারাও বসানো থাকতো, পালা করে ১ জন, তাঁর ফেরার পথে নজর রাখতো। কারণ গ্রামোফোন তুলে রেকর্ড গুছিয়ে ওপরে ঢাকাঢুকি দিয়ে রাখতে প্রায় মিনিট সাতেক লাগতো। কাজেই তাঁকে দেখা গেলেই চটপট কাজ আরম্ভ হয়ে যেত। মা, কাকিমাদের আমাদের অনুমতি দেওয়ারও একটিই শর্ত ছিল, মেজজেঠুর কানে যেন না যায়। আমাদের মামারা বেশ হুজুগে ছিলেন, শহর কলকাতা থেকে পরীক্ষা টরীক্ষার সময়েও নির্দ্বিধায় আড্ডা দিতে চলে আসতেন। তখন অবশ্য পড়াশোনা নিয়ে এরকম লাগামছাড়া উন্মাদনা ছিল না। আমরাও খুব আনন্দ পেতাম।
কিন্তু মেজজেঠু বেশ অসন্তুষ্ট হতেন, সন্ধ্যাবেলা অতিথিদের সঙ্গে গল্প করার একটাই তাঁর বিষয় ছিল, ‘এই মফস্বলে যাতায়াত বড় সমস্যার, তাড়াতাড়ি রওয়ানা হওয়াই ভাল।” আমাদের মামাবর্গও বেশ বুদ্ধিমান ছিলেন, কোনরকম তর্ক না করে, ঘাড় নেড়ে নেড়ে সায় দিতেন। কিন্তু দিব্যি আড্ডা মেরেই উঠতেন। আমাদেরও খুব রাগ হত তখন মেজজেঠুর ওপর। কিন্তু পরে বুঝেছি। এখন অনুভব করি, তাঁর এই কঠোর অনুশাসনে আমরা উপকৃতই হয়েছি।
তা গেলাম তো সিনেমা দেখতে, আবার নাইট শোতে! মুগ্ধ হয়ে ফিরে দেখি বাড়িতে সাঙ্ঘাতিক অবস্থা! মেজজেঠু একেবারে প্রায় ভিভ রিচার্ডস সদৃশ সংহার মূর্তি ধারণ করে অন্যান্য অভিভাবকদের কচুকাটা করছেন। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম। বাড়ীতে দু-দুজন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী, সামনেই টেস্ট পরীক্ষা – এখন কেন সাধনাচ্যুত হয়ে রাতে সিনেমা দেখা? পড়াশোনার তো ক্ষতি হবেই, শরীর খারাপ হয়ে পরীক্ষা দিতে অসুবিধে হলে কে দেখবে?
সবচেয়ে করুণ অবস্থা আমার পিসতুতো দাদার! ভাইবোনেদের আবদার মেটাতে গিয়ে এমন অবস্থার মুখে পড়তে হবে কেউ ভেবেছে? “পায়ে পড়ি মেজমামা, তুমি যে বাড়ীতে কে তা জানতো?” আর বছর চারেক পর শ্রদ্ধেয় সত্যজিৎ সৃষ্টি করেছিলেন যে গানটি সেটিই মনে পড়ে যায়।
কিন্তু তাতে অবশ্য আমাদের সিনেমার প্রতি মুগ্ধতা বা সেই সন্ধ্যার তীব্র ভালোলাগা এতটুকুনও কমেনি। আমার পিসতুতো দাদা, যার খুবই প্রিয় ছিল অনুপকুমার, খাওয়ার পরে সিগারেট খেতে খেতে অনুপকুমারের সেই ‘বালিকা বধূ’র বিখ্যাত সংলাপটিই উচ্চারণ করে ফেলেছিল, “পৃথিবীটাই এরকম, চাঁদও আছে, মশাও আছে।“
এখনো আমরা মনে করি সেই অনুপম স্মৃতির কথা। প্রায় ৪২ বছর পরও তা অমলিন। কেন লিখলাম তা বলতে গেলে মনে পড়ে যাবে “বালিকা বধূ” অনু উপন্যাসের প্রথম অনুচ্ছেদের অমোঘ লাইন –
“সেকালের টাকা অবশ্য একালে অচল, বোধকরি এই পুরাতন গ্রাম্য কাহিনীটিও আর চলে না। তথাপি লিখিতে সাধ জাগিল।”
মুগ্ধতা রেখে গেলাম। এ কাহিনী ঠোঁটে হাসি ও মনে একরাশ আলো রেখে যায় 🙂
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ সই!
LikeLike
পৃথিবীটাই এরকম, চাঁদও আছে, মশাও আছে –
Tomar lekhae kono mosha nei – shudhui chNad …
bhishon mishti lekha
LikeLiked by 1 person
অনেক, অনেক ভালোবাসা!
LikeLike
অনেক, অনেক ভালোবাসা
LikeLike
ছবিটির নায়ক ছিলেন নবাগত পার্থ মুখোপাধ্যায় । তাঁর দিদি তখন আমাদের বাড়ীতে সদ্য বিবাহিতা বধু । বাড়ীর প্রথম বধুসমাগম । কন্যাহীনা বাবার অত্যন্ত স্নেহধন্যা । বাবার অনেক সখের মধ্যে একটি ছিল পিয়ানো । পিয়ানোয় শাস্ত্রীয় সব গৎ । কখনো সখনো রবীন্দ্রসঙ্গীত । নবাগতা বধু আবার সুচিত্রা মিত্রের রবিতীর্থের স্নাতিকা । জমলো ভালো । বাবার অন্য সখ, সিনেমা আসক্তি, প্রতি রবিবারে একটি সান্ধ্য শো অবধারিত । তো সেদিন পার্থ নিয়ে গেলেন তাঁর নতুন ছবি দেখাতে । মনে আছে, ছবি দেখে এসে ঘরভর্তি বৈঠক । দাদা, বৌদি, পার্থ সহ তাদের বাড়ীর অনেক সদস্য, আর আমরা বালক ও সদ্য কিশোরের দল । বাবা বললেন, যতক্ষণ চা-জলখাবার আসছে, একটু পিয়ানো শোন । নিজের থেকে কখনো শোনাতেন না । অতিথিরা তাই উৎসুক । বাবার পিয়ানোয় বেজে উঠল – আজি এসেছি, এসেছি বঁধু হে । সেইদিনই প্রথম বাজালেন । এবং সুরে তালে লয়ে এক্কেবারে নিখুঁত । মুগ্ধ পার্থ বলেছিলেন, হেমন্তদাকে শোনাবেন । কিন্তু সে আর হয়ে ওঠেনি ।
স্মৃতি উসকে দেবার জন্য ধন্যবাদ ।
LikeLiked by 1 person
অজস্র ধন্যবাদ! অসাধারণ মন্তব্য!
LikeLike
পুরানো টাকা অচল হতে পারে কিন্তু পুরানো কাহিনী অচল হয়না ভাস্করদা | বয়েস বাড়ার সাথে সাথে পুরনোর টানেই তো পিছু ফিরে দেখা . . .
LikeLike
সত্যিই তাই!!
LikeLike
পুরাতনের ভিত্তিতেই জন্ম হয়
আজকের নুতন,
পুরাতনের মিষ্টি মধুর স্বপ্নতেই রয়
আগামীকালের আশার আলোরন,
সেই সময়ের দৌনন্দিন ছবি প্রস্ফুটিত
করেছে এই লেখা,
অমর থাকুক যেন “বালিকা বধুর”
প্রথম ভালবাসা।
LikeLike