কৈশোরের মফস্বলী শীত

এবার ব্যাঙ্গালোরে বেশ ছ্যাঁকছ্যঁকে ভাব। ঠাণ্ডা সেভাবে কোনদিনই পড়ে না, বরং বর্ষাকালে তুলনামূলকভাবে বেশী শীত করে। আমাদের মফস্বলে শীতের প্রকোপ কিন্তু বেশ ভালই ছিল।

আমাদের রাজপুরে কালীপুজোর সময় থেকেই বেশ শীতশীত ভাব। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পরীক্ষা শেষ আর ছুটির শুরু। অভিভাবকরাও তখন এতআড়বুঝো ছিলেন না, দিব্যি খেলতে দিতেন ঐ সময় – নো পড়াশোনা –শুধু খেলা। মনে পড়ে শেষদিন পরীক্ষা দিয়ে ফিরছি। কি আনন্দ! ফেরার পথে দেখতাম মাঠেবসে কাকু, জেঠুরা রোদ পোয়াচ্ছেন। কেউ কেউ বলতেন, ‘কি রে, মেরে দিলি? যাঃ, চুটিয়ে আনন্দ কর”! অনেকদিন পর এডিনবার্গ শহরে রোদ পোয়ানোর দৃশ্য দেখে কেন জানিনা আমাদের সেই ছোটবেলার দৃশ্য মনে পড়ে ছিল। নীচে দেখুন ছবিটা, ঠিক মনে ঐ রাস্তা দিয়ে আমরা স্কুল থেকে ফিরছি। 

তাই, আমাদের শীতকাল ছিল শুধুই আনন্দ – ছুটি, খেলা আর মজা। সকাল শুরু হত কাকভোরেউঠে মর্নিং ওয়াক কাম দৌড়নো দিয়ে। 

আহা, তখন কোন অসুবিধে হতনা চোখ খুলতে, কারণ পড়াশুনো নেই।  প্রায় জনা দশ পনেরো বন্ধু মিলে শুরু। একটু বেশী ভোরে উঠলে আবার খেজুর রস অপহরণ পর্বও থাকতো কোন কোন দিন।

এই সময় আমাদের ওখানে খেজুর রসের রমরমা। সে ছবি ভোলার নয়! ভোরে সূর্য ওঠা দেখতেপেতাম। ফিরতে ফিরতে বিভিন্ন বাড়ীর জানলা থেকে আকাশবাণীর প্রভাতী গানের সুর ভেসে আসতো – ‘ভোরের আলোয় পড়লো তোমায় মনে’, ‘কি মিষ্টি, দেখমিষ্টি’ বা ‘ভোর হল ঐ জাগ মুসাফির’! ফিরে এক বাড়িতে বসে যেত চায়ের আসর। বাড়িতে তখনো চা খাওয়ার অনুমতি নেই, কিন্তু সেই কাকুর বাড়িতে গরম চা আর বিস্কুট ছিল খুব লোভনীয়।

সকাল শুরু ক্রিকেট দিয়ে, দুপুরেও ক্রিকেট আর গাদি খেলা। সঙ্গে ঘুড়ি উড়ানো। আমাদের ঘুড়ি বিশ্বকর্মা পুজোতে হত না, হত শীতের উত্তুরে হাওয়াতে। এরপর বিকেলবেলা আবার নানারকম খেলা। একটা খেলা ছিল – কিং কিং বাপিট্টু। সেটাতে টেনিস বল দিয়ে জোরে গায়ে মারা হত। কি দারুণ টিপ ছিল আমাদের কয়েকজন বন্ধুর! উফফ, হাফপ্যান্ট পরা তখন আমরা, যে জায়গায় লাগত একেবারে রক্ত জমে যেত। অন্তত দিন দুয়েক ব্যাথা তো থাকবেই। অন্য খেলাগুলি সম্পর্কে লোকের ধারনা থাকলেও গাদি খেলাটির মত চিত্তাকর্ষক খেলাটি নিয়ে অনেকের বিশেষ জানা নেই, লেখা যাক দু চার কথা। 

গাদি কোর্ট হত আয়তাকার,  লম্বায় প্রায় ৪০ – ৫০ ফুট, আর চওড়ায় প্রায় ১৫ -২০ ফুট। মাঝে কোদাল দিয়ে লম্বালম্বি মাটি তুলে অগভীর নালার মতো একটা প্রায় এক ফুট চওড়া দাগ দেওয়া হত। আবার সমদূরত্বে আড়াআড়ি পাঁচটা সমান্তরাল একইরকম দাগ দেওয়া হত। এটা হত ছ’জনে খেলার কোর্ট। কোর্টের প্রথম ঘরকে বলা হত গাদিঘর, আর তার পাশের অর্থাৎ শেষ ঘরটিকে বলা হত নুন ঘর। আক্রমণকারী দলের সবাইকে গাদি ঘর থেকে পর্যায়ক্রমে এক একটা ঘর পেরিয়ে উলটো প্রান্তের ঘরে পৌঁছে আবার সেই ঘর পেরিয়ে নুন ঘরে পৌঁছে শেষে গাদি ঘরে পৌঁছোতে হত। নুন ঘর পেরিয়ে গাদি ঘরে পৌঁছোতে পারলে তবেই আক্রমণকারী দল পয়েন্ট পেত। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়েরা ঘিরে রাখত প্রতিটি ঘর। কোনও দলে খেলোয়াড়ের সংখ্যা কম হলে কোর্টের ঘর কমিয়ে নেওয়া যেত। দু’দলে খেলোয়াড়ের সংখ্যা হত সমান। 

সে জয়ী দল সাধারণতঃ আক্রমণে যেত। তাদের লক্ষ্য হত রক্ষাকারী দলের প্রহরীদের ছোঁয়া বাঁচিয়ে এক একটা ঘর পেরোনো। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় ছুঁয়ে দিলেই আক্রমণকারী দলের সেই খেলোয়াড় ‘মোর’ হয়ে যেত।

রক্ষণকারী দলের সবচেয়ে দক্ষ খেলোয়াড় দাঁড়াত মাঝের লম্বালম্বি ঘরে। সে কোর্টের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ওই দাগ বরাবর যেতে পারত। আমার নিজের এই ঘরে দাঁড়ানোর বেশ সৌভাগ্য হয়েছে। এর ভূমিকা অনেকটা দাবা খেলার মন্ত্রীর মত। তাকে হিসেব রাখতে হত বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়ের দুর্বল মুহূর্তের ওপর। মানে তাকে পুরোপুরি ‘চতুর’ হতে হবে অর্থাৎ দৃষ্টি রাখতে হবে চারদিকে। যদি সে দেখে আক্রমণকারী দলের কোন খেলোয়াড় কে সে শিকার (মোর) করতে পারবে সে তৎক্ষনাৎ দৌড়ে দিয়ে সেই ঝুঁকি নিতে পারে। 

আর কথায় কথায় চড়ুইভাতি বা বনভোজন। বনভোজনে আমাদের গন্তব্য ছিল বেশ কিছুদূরে হাজি চণ্ডীর মাঠ। সেই মাঠে তখন চাষ হত, আলপথ দিয়ে আমরা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যেতাম ফাঁকা সমতল জায়গাতে। হাতে সরঞ্জাম, কড়া খুন্তিআবার আগুন জ্বালার ব্যবস্থা – আবার ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন খেলার সরঞ্জাম আর ঘুঁড়িও। পাশেই ট্রেন লাইন, সোনারপুর – লক্ষীকান্তপুর বা ডায়মণ্ডহারবারের ট্রেন যাতায়াত করতো মাঝে মাঝেই। সেখানে আবার এক খেলা ছিল। পয়সা রেখে ট্রেঙ্কে তার ওপর দিয়ে চলে যেতে দেওয়া আর তারপর বন্ধুদের সেই চ্যাপটা পয়সা দেখিয়ে বাহবা নেওয়া। বেশ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ! 

বিকেলের পড়ন্ত রোদের সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের পিকনিক শেষ হত। আবার সব নিয়ে ফেরা!

আমাদের শীতকালীন ভলিখেলার গল্প সবচেয়ে মজার। অন্যান্য খেলার সঙ্গে ভলির তফাৎ টা এই যে এটি এমন একটি গ্রুপগেম যা খুব ছোট জায়গার মধ্যে খেলা সম্ভব। পাচ- ছজন বা কখনো সাতজন (তেতুলপাতায় নজন না হলেও) এর দল, বেশ জমাটি খেলা হত। এই খেলাটি হত সাধারণতঃ শীতকালে যখন ফুটবলের চল কমে যেত আর ক্রিকেট সাধারণতঃ দুপুরেই শেষ হয়ে যেত। ব্যাডমিন্টনের চেয়ে হাওয়া এই খেলাকে অনেক কম সমস্যা করতো। বড়োদের খেলা গুলি বেশ ভাল ছিল, সার্ভিস, ফিঙ্গারিং, নেটের খেলা, দুর্ধর্ষ প্লেসমেন্ট আর সর্বোপরি স্ম্যাশ ও সেই স্ম্যাশের প্রতিরোধ – সবই ছিল খুব চমকপ্রদ। দর্শক হিসেবে আমাদের কাছে আরো সুখশ্রাব্য ছিল – খেলোয়াড়দের নিজেদের একে অপরের উদ্দেশে নির্গত অমৃতবচন – “ওরে ওদিকে একটা খনি রয়েছে, ওখানেই প্লেস কর!” খনিকে সরানো হলে আবার পেছন থেকে নেটের খেলোয়াড়দের উপদেশ -“একটু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখ বাবা, খনি সরে গেছে”! একজন বড় মাপের খেলোয়াড় ছিলেন ‘ভোম্বলদা’! বড় ব্যবধানে হারতে হারতে সহ -খেলোয়াড়দের ভরসা দিতেন – “ভয় নেই রে, তোদের ভোম্বলদা আছে”! সঙ্গে সঙ্গে হয়ত তীর্যক মন্তব্য ভেসে এল – “ওরে ভয় নেই, কিন্তু ভরসাও যে নেই”! মন্তব্যকারী সম্ভবতঃ ভোম্বলদার সমবয়সী, কারণ আর কারোর সাহস হবে না। আবার কোন খেলোয়াড় যে চেষ্টা করলেই বড় খেলোয়াড় হতে পারবে না তাও জানা যেতঃ- ‘মুলো যতই লম্বা হোক, থোড় হয় না”!

ছোটবেলাতে ভলিবলের ‘লাভ – অল’ ডাকটিও বেশ অভিনব ছিল, স্বল্প ইংরেজী জ্ঞানে এর তাৎপর্য খুঁজে বার করতে পারতাম না। যে ‘টাইম-আউট’ আই পি এল এ বিখ্যাত, তার সঙ্গে পরিচয় সে কৈশোরে ভলিতেই। বাঁহাতের তালুর তলাতে ডান হাতের তর্জনী রেখে সময়-ভিক্ষা আমাদের কাছে বেশ মজাদার ব্যাপার ছিল। কোন কারণে বড়রা না এলে তুমুল উৎসাহে ছোটদের খেলা শুরু হত – চিল-চীৎকার করে পয়েন্ট কল করা হত – কি অদ্ভুত শিহরণ জাগানো আনন্দ “হোব্বল” এলেই, তারপর ই তো “গেম্বল”! এরপরে যে দল জিতে যেত তারা উদ্বাহু হয়ে নাচত – “ভোম্বল, ভোম্বল”!! অর্থাৎ জয় টা আমাদের সেই খ্যাতিমান খেলোয়াড়কে উৎসর্গ করা যিনি বলাবাহুল্য তখন অনুপস্থিত। শীতের বিকেলে কম আলোতে সেই নাচ এখন খুব মধুর স্মৃতি। হোব্বল যে “Hope – Ball” আর গেম্বল যে “Game- Ball” – সেটা জানতে বেশ কিছু বছর লেগেছিল।

রাতগুলিও বেশ মধুর – তখন টিভির প্রচলন হয়নি। রেডিওর নাটক আর বিজ্ঞাপনের অনুষ্ঠান ই আমাদের মন ভরাতো। তবে গল্পের বই নিয়ে লেপে ঢোকার আলাদা আনন্দ ছিল। সেই সাতের দশকে শিশু সাহিত্যও ছিল একেবারে রমরমা অবস্থায় – বাংলা তো ছিলই, আর ছিল অনুবাদ সাহিত্য। রোজ বই শেষ করা আর পরের দিনই ছোটা পাড়ার লাইব্রেরী। সেখানে আবার বড়দের সঙ্গে আড্ডা, বই নিয়ে নিজেদের মতামত, একটু বড় বড় ভাব করা। সব মিলিয়ে সেই মধুর দিনগুলোর উত্তাপ এখনো আমাকে জুড়ে আছে।

সেই সময়ের পুরনো খেলা গুলি সম্পর্কে জানতে গেলে নীচের লিংকে যেতে পারেন। গাদি খেলার বিবরণ আমি সৌম্যকান্তি জানার লেখা থেকেই পেয়েছি। অন্যান্য ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া। 

http://www.abasar.net/khela_Soumya.htm
http://ganashakti.com/bengali/features_details.php?featuresid=1094

8 thoughts on “কৈশোরের মফস্বলী শীত

  1. ভীইইইইইষণ ভাল লাগল!! গাদি খেলাটা ভুলেই গেছিলাম, মনে পড়ল! শীতের রোদের মত মিষ্টি লেখা!!

    Liked by 1 person

  2. আমিও ছোটবেলায় ট্রেনের চাকার নীচে coin ফেলে চ্যাপ্টা করেছি।

    Liked by 1 person

  3. কিং খেলেছি অনেক ছোটবেলায়। বিখ্যাত টেনিস বলের কালশিটে যুক্ত দাগ নিয়ে বাড়ী ফেরা।

    Liked by 1 person

  4. খুব সুন্দর লেখা… পড়তে পড়তে সমান্তরালভাবে আমাদের ছোটবেলার স্মৃতিকথার ছবি মনে মনে চলতে থাকছিলো। বড় নস্ট্যালজিক অনুভূতির অপূর্ব লেখা। ধন্যবাদ ।।

    Liked by 1 person

Leave a comment