অস্ট্রেলিয়া ও ‘Cricket’ স্মৃতি – প্রথম পর্ব

আবার ভারত গেছে অস্ট্রেলিয়া সফরে। আবার আমার বন্ধুবান্ধবদের কিছু লেখা এসে গেছে। ভারত জিতে গেছে প্রথম টেস্ট। নব ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। 

আমারও মন উতলা। ইচ্ছে করলো ভাগ করে নিতে কটি বিশেষ দিনের স্মৃতি। 

আসলে খুব ছোটবেলাতেই আমাদের বাড়িতে দেখেছিলাম ডাকযোগে কিছু পত্রিকা আসতো, অস্ট্রেলিয়া থেকেই। তার ওপরেই ছবি থাকতো, সিডনির সেই বিখ্যাত অপেরা হাউসের। 

সিডনীর সেই বিখ্যাত অপেরা হাউসের ছবি 

আমার বাবা পাঁচের দশকে যাদবপুর থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে কলম্বো প্ল্যানে প্রায় বছরখানেক ট্রেনিং নিয়েছিলেন, অধিকাংশ সময় নিউজীল্যাণ্ডে এবং কিছুকাল অস্ট্রেলিয়াতে। বিষয় ছিল – মাইনিং ইলেক্ট্রিফিকেশন। সেইসময় কোন বিভাগের থেকে নিয়মিত এই পত্রিকা আসতো।

আমার জীবনে প্রথম টেস্ট খেলার স্মৃতি হল ১৯৬৯ সালে গ্রাহাম ডাউলিং এর দলের ভারতে আগমন। সেই প্রথম ধারাবিবরণী শোনা – মানে বড়রা ইংরেজিতে শুনে বলে দিতেন। কাগজে অবশ্য খেলার খবর পড়তাম। তবে সেবার কোন খেলা ইডেনে হয়নি, বাংলাতে আর কমেন্টারি শোনা হয়নি। খেলা দেখা তো দূরের কথা।

সেটা সম্ভব হল আর কিছুদিন পরেই।

দৃশ্য – ১

১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৬৯। জীবনে প্রথম মাঠে গিয়ে টেস্ট খেলা দেখলাম। ভারতকে গোহারান হারতে দেখলাম। সেবার আবার ভারতীয় দলে দু-দুজন বাঙালী, সুব্রত গুহ আর অম্বর রায়। চতুর্থ দিনেই খেলা শেষ। ইডেনের কাঠের গ্যালারিতে আগুন জ্বলতে দেখলাম। অস্ট্রেলিয়া মাদ্রাজ টেস্ট শুরু করলো ২-১ এ এগিয়ে।

সেই শেষ টেস্টে প্রথম ইনিংসে যথারীতি ধেড়িয়ে ছিলেন ভারতীয়রা। ৯৫ রানে এগিয়ে অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করে ঘোর বিপদে পড়েগিয়েছিল – ২৪ রানে চলে গিয়েছিল ৬ উইকেট। একমাত্র আয়ান রেডপাথ ছাড়া সক্কলেই প্যাভিলিয়নে। এখনো মনে পড়ে ক্রিসমাসের আশে পাশের সেই দিনটা। আমরা পাড়াতে ক্রিকেট খেলছি আর স্কোর শুনছি।

পাড়ায় ছোট্ট ক্রিকেট মাঠ, তার পাশেই বাড়ীতে একটু জোরে রেডিও চলছে। ধীরে ধীরে যখন ২৪ / ৬, আশায় দুলছি। রেডপাথ আর কত টানবেন? হবে কি সম্ভব ২ -২? কিন্তু না! টানলেন। ম্যাকেঞ্জি, কনোলি, ম্যালেটকে নিয়ে – ১৫৩ অবধি। যদ্দূর মনেপড়ে, একটা চান্সও দিয়েছিলেন, সম্ভবত তখন রান ৩৫ এর মধ্যেই। ৩৫ / ৭ হলে কি মুখ থুবড়ে পড়তো না অস্ট্রেলিয়া? নাঃ, উলটে ভারতই পড়ে গেল। ২৪৮ রানের লক্ষে ১১৪ / ২থেকে একেবারে ১৭৭। ব্যস, ৭৭ রানে হার।

এই আয়ান রেডপাথ আবার ততদিনে এক অকারণ প্রখ্যাতি পেয়েছিলেন,ওঃ ইন্ডিজ এর অস্ট্রেলিয়া সফরে। ১৯৬৯ এ বছর শুরুর দিকে এডিলেড টেস্টে ক্রিজ ছেড়েবেরিয়ে যাওয়াতে তাঁকে ‘মানকাদীয়’ প্রথায় আউট করেছিলেন চার্লি গ্রিফিথ। স্বাভাবিক কারণেই খুব সমালোচনা হয়েছিল গ্রিফিথের।

ক্যাপটেন বিল লরি ও আয়ান রেডপাথ 

ভারতকে হারিয়ে নাচতে নাচতে দঃ আফ্রিকাতে গিয়ে দুরমুশ হয়েছিলঅস্ট্রেলিয়া, খুব আনন্দ হয়েছিল আমাদের। মানে সেই এখনকার ‘দেখ কেমন লাগে’ টাইপের। ওদের ক্যাপ্টেন বিল লরি ছিল এক্কেবারে – “দুষ্টু লোক”! আমাদের সাংবাদিক, ফটোগ্রাফারদের সঙ্গে খুব দুর্ব্যবহার করেছিল। তার হেনস্থাতে আমরা সেই শিশুকালে খুব খুশী হলাম। পোলক ভাইরা, ব্যারি রিচার্ডস, এডি বার্লো, মাইক প্রোক্টর- তখন আমাদের চোখের মনি।

দৃশ্য -২

পরের বার – ১৯৭৭ এর ডিসেম্বর মাস! এর মধ্যে ভারত অস্ট্রেলিয়ার কোন খেলা হয়নি। আর এসে গেছেন কেরি প্যাকার। ‘ ক্ষীরমিবাম্বুমধ্যাৎ’ এর মত সব ভালো প্লেয়ার চলে গেছেন,  ভাঙা- ছেঁড়া দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ববি সিম্পসন। শুধু জেফ টম্পসন রয়ে গেছেন। আমরা খুব আশাবাদী, সিরিজ জয় হবে।প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে দুদ্দাড় করে ভেঙেও পড়লো অস্ট্রেলিয়া। নায়ক আমাদের স্পিনাররা, বেদী ও চন্দ্রশেখর। 

 আমরা আনন্দে উচ্ছ্বসিত। কিন্তু টমসন আর নবাগত ওয়েন ক্লার্কের বোলিং এ তাসের ঘরের মত ভারতীয় ইনিংসও ভেঙে পড়লো। দ্বিতীয় ইনিংসে আবার খারাপ শুরু করেও বুড়ো কাপ্তান সিম্পসনের ঘাড়ে ভর করে অস্ট্রেলিয়া ৩২৭ করে ফেললো। ভারতের সামনে জয়ের লক্ষ ৩৪০। এই খেলার শেষ সময়ে বেশ এক উজ্জ্বল স্মৃতি আছে। আমি তখন সদ্য যোগ দিয়েছি পাঠভবনে। আমাদের এক শিক্ষক ছিলেন পিনাকীদা।

বেশ আশ্চর্য মানুষ ছিলেন ‘পিনাকীদা’! অঙ্কের শিক্ষক, কিন্তু তাঁর পড়াশুনো ছিল রীতিমতো তাজ্জব করে দেওয়ার মতো।

প্রথম টেস্টের শেষ দিন, সুনীল গাভাসকারের সেঞ্চুরির ওপর ভর করে ভারত চতুর্থ ইনিংসে ভালই রান তাড়া করছিল। আমাদের আর ক্লাসে মনই নেই। কেউ একটা ছোট্ট ট্রানসিস্টর রেডিও নিয়ে ক্লাসে এসে খেলা শোনার চেষ্টা করছে। কোনভাবে তা পিনাকীদার চোখে পড়ে। পিনাকীদারও খুব ইন্টারেস্ট ছিল ক্রিকেট, ফুটবল দুটোতেই। তিনিও অনুমতি দিলেন, কমেন্টারি শোনার- আমাদের সঙ্গে বসেও গেলেন শুনতে! এখনো মনে পড়ে, সবাই উৎকন্ঠিত হয়ে বসে আছে, নড়া চড়া করলেই যদি উইকেট পড়ে যায়! এদিকে সক্কলের আঙুলের নখের অবস্থা তো সহজেই বোঝা যায়। হা হতোস্মি, ভারতীয় ব্যাটসম্যানেরাএকেবারে কূলের কাছে এসেও তরী ভেড়াতে পারলো না! মাত্র ষোল রানে হার স্বীকার।

দৃশ্য -৩

১৯৮১ সাল নাগাদ ভারতীয় টীম গেল অস্ট্রেলিয়া। এবারে কিন্তু অস্ট্রেলিয়া দুর্ধর্ষ টীম। তাও আবার নিজেদের মাটিতে। গ্রেগ চ্যাপেল ক্যাপটেন, আমাদের ক্যাপটেন সুনীল গাভাসকার। অস্ট্রেলিয়ার বোলিং এ লিলি, প্যাসকো, হগ। ব্যাটে গ্রেগের সঙ্গে এলান বর্ডার, ডগ ওয়াল্টার্স, কিম হিউজেস, গ্রিম উড। উইকেট কীপার রডনি মার্শ। তিন টেস্টের সিরিজ। তখন আমি যাদবপুরে, বন্ধুরা সবাই খেলা নিয়ে সদাই উত্তেজিত।

প্রথম টেস্টেই ইনিংসে হার। আমাদের হতাশা থাকলেও মেনে নিলাম এ হেন মহারথীদের কাছে এরকম পরাজয় খুব লজ্জাজনক নয়। দেখা যাক, আগে কি হয়।

দ্বিতীয় টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে কোনক্রমে হার এড়ানো গেল। এখনো মনে পড়ে শিবলাল যাদব আর কারসন ঘাউড়ি শেষের দিকে ঘর সামলাচ্ছেন আর আমরা কমেন্টারি শুনতে শুনতে আশা নিরাশায় দুলছি। শেষ মেশ অবশ্য বেঁচেই যাওয়া গেল। যাক পরের আর শেষ টেস্ট মেলবোর্নে।

এই টেস্টে এক সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছিল। পরে আসছি। প্রথম ইনিংসে শিল্পী গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ এক অসাধারণ শতরান করলেন। চাপের মুখে সেই খেলা –এখনকার মিডিয়া থাকলে খুবই নাচানাচি হত, ‘ভগবান’ টাইপ। কিন্তু সেই সময় এতটা মনোযোগ পেতেন না। তবে আমরা, বিশ্বনাথের ভক্তরা খুব আশান্বিত ছিলাম। তখনো অবধি প্রায় প্রবাদ ছিল, আগের ফলাফলের ভিত্তিতে, যে বিশ্বনাথ সেঞ্চুরি করলে ভারত ম্যাচ হারবে না।

খেলার স্কোর – তুমি আছ ‘বিশ্বনাথ’!

এই সিরিজে গাভাসকার একদমই খেলতে পারছিলেন না। তৃতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে তিনি একটু ভাল ফর্মে এসে গেছেন, চৌহানও যোগ্য সঙ্গত করছেন। প্রথম জুটিতে ১৬৫ রান হয়ে গেছে, এই সময় হঠাৎ লিলির বলে গাভাসকারকে LBW আউট দেন কুখ্যাত অস্ট্রেলিয়ান আম্পায়ার রেক্স হোয়াইটহেড। সুনীল ব্যাট দেখিয়ে সম্ভবত বোঝাতে চেষ্টা করছেলেন, যে বল তাঁর ব্যাটে লেগে তারপর প্যাডে লেগেছে। কিন্তু আম্পায়ার অটল। গাভাসকার চলে যাচ্ছিলেন, কিন্তু লিলি তাঁর সঙ্গে কি এক তর্ক বাঁধালেন। ব্যস, রেগে মেগে খপ করে চৌহানকে নিয়ে প্যাভিলিয়নের দিকে হাঁটা দিলেন। মাঠে তুমুল শোরগোল। কমেন্টেটরদের ও চক্ষু চড়কগাছ। কি হবে বোঝা যাচ্ছেনা। এই সময় তৎকালীন ম্যানেজার উইং কম্যান্ডার দুরাণী খুবই বিচক্ষণতার পরিচয় দিলেন। গাভাসকার চৌহানকে নিয়ে ফিরছেন, তিনি প্রায় লাফিয়ে এসে গেটে পথ আটকালেন, গাভাসকারকে বুঝিয়ে চৌহানকে আবার ফিরত পাঠালেন মাঠে।

লিলি ও গাভাসকারের ঝগড়া – যার পরে গাভাসকার  সচৌহান মাঠ ছাড়তে যাচ্ছিলেন

পরবর্তীকালে গাভাসকারের এই আচরণ তীব্র সমালোচিত হয়। সুনীল নিজেও পরে অনেকবার স্বীকার করেছেন তাঁর এই অদূরদর্শী আচরণের কথা। কিন্তু সেই সময় তিনি প্রায় ভারতের যুবসমাজের চোখের মণি হয়ে উঠেছিলেন।

আসলে অস্ট্রেলিয়াতে আম্পায়ার বিতর্ক বেশ জোরদার ছিল। আর আমাদের তখন ঐ সদ্য টীন অতিক্রান্ত সময় – কাজেই সানির এই কাজ খুব আনন্দ দিয়েছিল –একেবারে সেই বিখ্যাত গানের মতই-

আমার প্রতিবাদের ভাষা আমার প্রতিরোধের আগুন দ্বিগুণ জ্বলে যেন দ্বিগুন দারুণ প্রতিশোধে   
করে চূর্ণ ছিন্ন -ভিন্ন শত ষড়যন্ত্রের জাল যেন আনে মুক্তি আলো আনে আনে লক্ষ শত প্রাণে।”!!

শুধু লক্ষ শত প্রাণ নয়, ভারতীয় টীমও যেন সাংঘাতিক রকম অনুপ্রাণিত হয়ে উঠে পড়লো। দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া যখন মাত্র ১৪৩ রানের লক্ষে ব্যাট করতে নেমে ১৮ রানে তিন উইকেট খুইয়ে বসলো – ব্যস! আমাদের আর পায় কে? বড়রা অবশ্য সতর্কবাণী দিচ্ছিলেন, এখনই অত নাচানাচি করার নেই, কপিলও অসুস্থ! হ্যাঁ, এটা আমাদের এক চিন্তার কারণ ছিল। আমাদের নায়ক কি শেষদিনে মাঠে নামবেন? চোট পেয়ে আগের দিন মাঠ ছেড়েছিলেন।

পরের দিন ভোর সাড়ে পাঁচটাতে রেডিও খুলে জানা গেল তিনি খেলছেন। আহা, আর কি খেলাই খেললেন! কমেন্ট্রিতে শুনছি, আর মন ভরে যাচ্ছে। মাত্র ২৮ রানে পাঁচ উইকেট। শেষ পর্যন্ত ৮৩  রানে ভেঙে পড়লো অস্ট্রেলিয়া। আহা, প্রতিশোধ,প্রতিশোধ। কি আনন্দ! পাড়ার একটি ছেলে নাচতে নাচতে  বলে গেল ,“দেখ ওদেরও মন পাল্টে গেছে, একদম শেষ আউটটা LBW দিয়েছে”! এতেই বোঝা যাবে সেই জয়ের আনন্দ। আর একটা কথা, সিরিজ ড্র এর ফলে রাবার কিন্তু আমাদের কাছেই রয়ে গেল – নিজের মাটিতে রাবার পুনরুদ্ধার করতে না পারাটা অস্ট্রেলিয়ার বিরাট পরাজয় বলেই ধরে নিতে হবে।

                          দৃশ্য -৪

১৯৮৬-৮৭ সাল। অস্ট্রেলিয়া এল ভারতে। অস্ট্রেলিয়ার ক্যাপ্টেন বর্ডার আর আমাদের কপিল।

তখন আবার আমি কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে। এইসময় আমাদের যে বন্ধুগোষ্ঠী ছিল তাদের প্রায় শখ ছিল প্রতি নিয়ত তর্ক  করা। আসলে তখনো ‘ইন্টারনেট’ নামক বস্তুটির প্রচলন নেই। স্যাটেলাইট টিভিও হয়নি। টিভিতে সবেধন নীলমনি একটিই চ্যানেল। কদিন আগে কে যেন লিখেছিলেন, শোক ছিল বটে  আমাদের। কোন মন্ত্রী মারা গেলে ব্যস – দু তিন দিন ধরে চলল রাষ্ট্রীয় শোক। টিভি খুললেই – সেই ‘এমন দিনে তুমি মোর কাছে নাই’ বলে ‘করুণ হরিনী তার তান তুলেছে’! রেডিও ও তথৈবচ। সুতরাং আমাদের নিজেদের খেলা, সিনেমা থিয়েটার, বই, গান – সব নিয়ে আলোচনা আর তর্ক। মোটামুটি এই ছিল আমাদের জীবনের সার। স্বাভাবিক তর্ক তো ছিল, এমনকি  তখন অনেক কষ্ট করে কেউ স্কুটার কিনেছে কেউ বাইক – তর্কের বিষয় হল – বাইক ভাল না স্কুটার ভাল? বোঝ!

প্রথম টেস্টে বেশ জমাটি খেলা হল। অস্ট্রেলিয়া প্রচুর রান করলেও ভারত কিন্তু খারাপ জবাব দিল না, সেঞ্চুরি করলেন ক্যাপটেন কপিল। দ্বিতীয় ইনিংসে এলান বর্ডার শেষ দিনের শুরুতেই ইনিংস ঘোষনা করে ভারতের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন – সারা দিন খেলে ৩৪৮রান করে জিতে নাও!

সবাই ভেবেছিল ভারত ড্রয়ের রাস্তায় হাঁটবে। কিন্তু ১৯৮৩র পর ভারতীয় দলের মনোভাব অনেকটাই পালটে গেছিল। গাভাসকারের ৯০ এ ভর করে শুরুটা ভালই করেছিল, মাঝে হঠাৎ করে উইকেট খুইয়ে বিপদে পড়ে যায়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল কপিলদেবের উইকেট হারিয়ে। তাঁর মত হার্ড হিটার থাকলে জয় অনেক সহজ হত। রবি শাস্ত্রীই টানছিলেন।  সঙ্গে খুব ভাল পাল্লা দিচ্ছিলেন অফ স্পিনার শিবলাল যাদব। হঠাৎ করে শিবলাল আউট হতেই সর্বনাশের আঁচ পাওয়া গেল। 

অফ স্পিনার ক্রেগ ম্যাথুজের  শেষ ওভার  – দরকার চার রান। দ্বিতীয় বলের শেষে বাকি ছিল দু রান। ক্রেগ ম্যাথুজের তৃতীয় বলে শাস্ত্রী একটি সিঙ্গল নেন, দুদলের রান সমান সমান। চতুর্থ বল খেলবেন মনিন্দর সিং। কোনরকমে সামলে দিলেন মনিন্দর। আবার ম্যাথুজ বল করলেন, মনিন্দরের পায়ে লাগলো, সিঙ্গলস নেবে কি নেবে না, দেখা গেল অস্ট্রেলিয়ার আবেদনে সাড়া দিয়ে আঙুল তুলেছেন আম্পায়ার।

মনিন্দর বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, তিনি ব্যাটে খেলেছেন। কিন্তু ততক্ষণে মাঠে চূড়ান্ত বিভ্রান্তি। অস্ট্রেলিয়ার ম্যানেজার বব সিম্পসন ছিলেন আগের টাই টেস্টের খেলোয়াড়। তিনি আবার ইতিহাসের সাক্ষী হলেন।

কিন্তু তখনই আবার শুরু হল চুলচেরা বিতর্ক। রবি শাস্ত্রীর সিঙ্গলস নেওয়া উচিত হয়েছে কি হয়নি? 

স্পিনার ক্রেগ ম্যাথুজের কীর্তি কাগজে হেডলাইন হয়েছিল


খেলা শেষ – মনিন্দর  আম্পায়ারকে বলছেন বল ব্যাটে লেগে তারপর ম্যাডে লেগেছে

নেওয়ার পক্ষে

নিশ্চয়, নিদেন পক্ষে হার তো বাঁচানো গেল। পরের বলে যদি রবি আউট হতেন সকলে বলতো কেন সিঙ্গলস নিলেন না? মনিন্দর পরের বল কোনক্রমে খেলে দিলেই তো দৌড়ে আর একরান নিয়ে জেতা যাবে।

নেওয়ার বিপক্ষে

এটা কোন যুক্তিই নয়। রবি এতক্ষণ ধরে খেলছেন। আরো তিন তিনটে বল ছিল।  রবি থাকলে ম্যাথুজের ওপরেও বেশি চাপ থাকতো। একটু ঝুঁকি নিয়ে তুলে মেরে চার অথবা দু রান নেওয়াই যেত।

এই বিতর্ক কিন্তু আমাদের মধ্যেই নয়, ছড়িয়েছিল  পরের দিনের কাগজেও। আবার ঐ LBW টাও যে ঠিক ছিল না, তা নিয়েও প্রচুর লেখালেখি হয়েছিল। যে আম্পায়ার ঐ সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন, তিনি বরাবরের জন্য নির্বাসিত হন। 

তবে  এই  বিতর্কের জের দেখি এখনো আছে। রবি শাস্ত্রী  মানেই  বেশ বিতর্ক। তাঁর নাকি সর্বদাই খেলার চাইতে অন্যদিকে বেশী  মন পড়ে  থাকতো। এইবার সেই খেলার ইতিহাস হাতড়াতে গিয়েও দেখি  সেই ক্রিকেট সাংবাদিক নিজেই বলেছেন, শাস্ত্রীর সাংঘাতিক ভুল হয়েছিল মনিন্দরের মত একেবারে নড়বড়ে ব্যাটসম্যানকে ফেস করতে দেওয়া। 

বেশ মজা লাগলো কিন্তু বিগত পাঁচ দশক ধরে ভারত অস্ট্রেলিয়ার এই মধুর স্মৃতিচারণ। খেলা পালটেছে, খেলোয়াড় বদলে গেছে, আর বদলে গেছে খেলার দর্শক। এখন কি আর সেরকম পাড়ার তর্ক চলে? শীতের রোদে পাড়ার ক্রিকেট দেখতে দেখতে আর কমেন্টারি শুনতে শুনতে সেই বিশেষজ্ঞ মতামত, 

“বুঝলি, এই রেডপাথ টাও দেখি অনেকটা আমাদের সোলকারের মতই!” 

9 thoughts on “অস্ট্রেলিয়া ও ‘Cricket’ স্মৃতি – প্রথম পর্ব

    1. ১৯৬৯ এর দিল্লী জিত মনে ছিল। কিন্তু মাদ্রাজে হারের কথা বেশী মনে আছে।

      Like

    1. নাঃ! এটা সাত আর আটের দশকের শুধু। নয়ের দশকে বিয়ে হয়ে গিয়ে বয়স হয়ে গেল তো!!

      Like

  1. সকালে পড়েই এক আধটা তথ্যগত ভুল নজরে পড়ে। বলেওছি সেটা। তথ্যগত বিশুদ্ধতাটাই একটা লেখার সবকিছু এমনটা ভাবিনা। মূলকথা লেখাটার নান্দনিক স্পর্শ! কোথাও কোনভাবে মনকে ছুঁয়ে যাচ্ছে কিনা। সেদিক থেকে লেখাটা খুবই ভালো লাগলো। মনে হচ্ছিলো আমারই সমবয়স্ক এক বন্ধুর সঙ্গে আমিও বড় হয়ে উঠছি ইডেন, কোটলা, মেলবোর্ন, এডিলেড ঘিরে একরাশ স্বপ্ন ছুঁয়ে ছুঁয়ে। মাঠের কুশীলবরাতো বটেই, কখন যেন সুশীল দোশী, অনন্ত শীতলবাদ, ডঃ পুরী, রবি চতুর্বেদিরাও আত্মজন হয়ে উঠেছিলেন আমাদের বিবর্তনের পথে। কৈশোরের সেই দিনগুলোয় ওঁদের চিত্রল শব্দের আলপনায় মাঠের আনাচকানাচ ছবি হয়ে উঠে আসতো মনে! আজো আমার ক্রিকেট ঘিরে জীবনের সেরা শ্রুতিনন্দন ১৯৭৭-৭৮ সিরিজ! আহা! গাব্বায় ১৬ রানে হার! ওয়াকায় ২ উইকেটে! মেলবোর্ণে ২২২ রানে জয়! সিডনিতে ইনিংস ও দু রানে। অবশেষে এডিলেডে আবার হার! মাত্র ৪৫ রানে। প্যাকারের ঝলমলে সার্কাসের প্রতিস্পর্ধী এক সমান্তরাল নন্দন! জাতীয়তাবাদ ছুঁয়ে অারো গৌরবোজ্জ্বল বরং! আর অন্য সিরিজের উজ্জ্বল মুহূর্তগুলোতো বলেইছেন! ৮১ মেলবোর্নে দিলিপ দোশির অবদানও কিন্তু ভুললে চলবে না! আরো কত সব_ _ _! স্মৃতিমেদুরতা! আর স্মৃতিমেদুরতা! নিরপেক্ষ যৌক্তিক বিচারে হয়তো একটু বেশিই ভাবোচ্ছ্বাস অামাদের ঐ প্রজন্মের মনে! তবুতো মনের মণিকোঠার গহন সঞ্চয়! আপনার লেখা শুধু আপনার প্রতিনিধিত্ব করেনি! ভারত-অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দ্বৈরথ ছুঁয়ে একটা প্রজন্মের বড় হয়ে ওঠার গল্প যেন! Bhaskar Bose

    Liked by 1 person

  2. বেশ লাগলো পড়ে… যদিও ক্রিকেট আমার প্রাণের খেলা নয়। তোমার লেখার বর্ণনার নান্দনিক রূপটিকে খুবই প্রশংসণীয়।।

    Liked by 1 person

  3. খুব ভাল স্মৃতিচারণা.. লেখার বাঁধুনিটা বেশ ! আমার স্মৃতিতে 1969 এর এই অস্ট্রেলিয়া তো বটেই, 1967র ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইন্ডিয়া সফরও টাটকা.. সেই সফরে ইডেন উদ্যানে আগুন এক অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা. আর অস্ট্রেলিয়ার সাথে কলকাতায় খেলাতে daily টিকিটের লাইনে 6 জনের মৃত্যুও অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ঘটনা.. তারপর থেকে সেটা সম্ভবত 1977 সালে. তাইতো ভাস্করবাবু? তারপর থেকে daily টিকিট বিক্রি হওয়া বন্ধ হয়ে গেছিল.. আমি থাকতাম তখন জোড়াসাঁকো অঞ্চলে চিৎপুর ঠাকুরবাড়ির বিপরীত গলিতে, গনেশ টকিজ অঞ্চল. সেখানেই আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা. 1984 অব্দি ওখানেই থাকা তারপর বাগুইআটি. যাই হোক আপনার লেখাটা বেশ সরসর করে এগিয়ে চলল..

    তবে একটা কথা আমি এই মোটামুটি 2000 সালের পর থেকে ক্রিকেট নিয়ে মাতামাতি করার থেকে অনেকটাই সরে এসেছি.. দেশের 99.999..% মানুষ যদি একটা খেলা নিয়ে মত্ত থাকে তবে আমার মত .001% মানুষের অনুপস্থিতিতে ক্রিকেট নামক মহান খেলার ইন্ডিয়া তে জনপ্রিয়তায় কোন ভাঁটা পড়বে না বলেই আমার বিশ্বাস.. সবশেষে দুটো কথা আবারো বলি আপনার লেখাটা খুব উপভোগ করলাম.. আর ক্রিকেট নিয়ে বা অন্য যে কোনো বিষয়ে লেখা আপনি অবশ্যই আমার কাছে পাঠাবেন..

    অনেক ধন্যবাদ ভাস্করবাবু..

    Liked by 1 person

    1. অনেক ধন্যবাদ অপূর্ববাবু! আপনি আমার এই ব্লগেই আমার লেখাগুলি ফেখতে পাবে, Categorize ও করা আছে। গান, সিনেমা, খেলা, স্মৃতিচারণ – ইত্যাদি ভাবে। পড়ে দেখতে পারেন। মন্তব্য করলে খুবই খুশি হবো।

      Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s