প্রথম পর্বের পর বেশ কিছুদিন কেটে গেল। ইতিমধ্যে সিরিজ ১ -১ । আমার কিছু নবীন বন্ধু বলেছেন – তাঁদের সময়কার স্মৃতি নিয়েও কিছু লেখা হোক। বিগত পর্ব শেষ হয়েছিল আটের দশকে তাই – এই পর্ব শুরু হবে নয়ের দশকে। তবে সেই সিরিজ বা ম্যাচগুলির কথাই থাকবে যা আমার স্মৃতির পটে সমুজ্জ্বল। কারণ – ইহা ইতিহাস নহে, শুধুমাত্র স্মৃতির পটে খেলার ছবি মাত্র! এবং তা শেষ হবে ২০০৩ – ৪ এর সিরিজ দিয়েই। তার পরের সিরিজগুলি ভীষণভাবে পরিচিত ও নথীবদ্ধ।
নয়ের দশকে প্রথম যে বার ভারত অস্ট্রেলিয়া যায়, তার নেতৃত্বে ছিলেন আজহারউদ্দিন। সেই সময় ভারতের ক্রিকেট কিন্তু বেশ ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। গাভাসকার অবসরপ্রাপ্ত, স্পিনার চতুষ্টয় ও তাই। কপিলদেবকে আর সেরকমভাবে নির্ভরশীল বলা চলে না, তাঁর জায়গা নেওয়ার মত অবশ্য কেউ আসেনি।
এসেছেন একজনই। শচীন তেন্ডুলকর খুব সাড়া জাগিয়েছেন আবির্ভাবেই। আছেন আজহার বা ভেঙ্গসরকার সঙ্গে সঞ্জয় মঞ্জরেকর। বোলিং কিন্তু বেশ দুর্বল, কপিল ছাড়া মনোজ প্রভাকর আছেন। স্পিনে আছেন অনিল কুম্বলে, রাজু, ইত্যাদিরা। আজহারউদ্দিনের অধিনায়কত্বও বেশ সমালোচিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে সেই সিরিজে আশা ব্যঞ্জক কিছু ঘটেনি। ভারত খুব বাজে ভাবে হেরে এসেছিল।
এরপরে ১৯৯৬ সালে অস্ট্রেলিয়া একটি মাত্র টেস্ট খেলতে ভারতে এল। সেই টেস্ট হবে দিল্লীতে। ভারতীয় দলে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হল অধিনায়ক হয়েছেন তেন্ডুলকর আর সেবছরই ইংল্যান্ডে টেস্ট অভিষেক হয়েছে দুই তরুণ ব্যাটসম্যানের – সৌরভ গাঙ্গুলি ও রাহুল দ্রাবিড়। ইতিমধ্যেই অনেক পরিণত অনিল কুম্বলে সঙ্গে আছেন শ্রীনাথ বা প্রসাদের মত পেসাররা।
এর মধ্যেই অস্ট্রেলিয়া দলে এসে গেছেন শেন ওয়ার্নে। ১৯৯২ সালে দলে এসেই তিনি চমক দেখাতে শুরু করেছেন। কিছুদিন আগেই তিনি ভারতেই বিশ্বকাপে ওঃ ইন্ডিজকে স্পিনের জাদুতে কাবু করেছেন। কাজেই দিল্লির পিচে তিনি দলে থাকলে ঘুর্নি দেখাতে পারেন। কাজেই সম্ভবত স্পিনের পিচ কতটা মারাত্মক হতে পারে সেই নিয়েও চিন্তা ছিল।
কিন্তু এইসময় জানা গেল ওয়ার্নে অস্ট্রেলিয়া দলের সঙ্গে আসছেন না। সম্ভবতঃ সেই আনন্দেই আর স্পিন সহায়ক পিচ করতে বাধা রইল না।
তবে এই ম্যাচে সবচেয়ে উজ্জ্বল স্মৃতি নিঃসন্দেহে নয়ন মোঙ্গিয়াকে নিয়ে। খুব ঝুঁকি নিয়ে তাঁকে দিয়ে ভারতীয় টিম ওপেন করায়। এই ফাটকা জব্বর কাজে লেগে গেল। তিনি প্রায় রানের পাহাড় গড়লেন, ভারতের ৩৬১ রানে তাঁর অবদান ১৫২। অভাবনীয়! তার আগে প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি, কুম্বলে ও তার সাথীরা ১৮২ রানের মধ্যেই সাবড়ে দিয়েছেন।
অস্ট্রেলিয়ার টীমে কোন ভাল স্পিনার নেই। আমরা তখন ভাবছি – ওঃ, দেখেছ, ওয়ার্নে আসবে না শুনেই খুঁড়ে ফেলেছে।
ফলতঃ দ্বিতীয় ইনিংসেও কুম্বলে ও সাথীরা আবার কুপোকাত করলেন। প্রায় ইনিংস ডিফিট হতে যাচ্ছিল, সামলে দিলেন স্টীভ ওয়া। লড়াকু ইনিংস খেলে পঞ্চাশের মত লীড রাখলেন। ভারত অনায়াসেই জিতে গেল।
তবে ১৯৯৮ সালে কিন্তু অস্ট্রেলিয়া সশের্ন ই এল। এবারেও অস্ট্রেল্যার ক্যাপ্টেন মার্ক টেলর, কিন্তু পাকেচক্রে ভারতের নেতৃত্ব আবার চলে গেছে আজহারের হাতে। তবে সেবার আমাদের দেখার উত্তেজনা ছিল তেন্ডুলকর ও ওয়ার্নে দ্বৈরথ। প্রথম টেস্ট শুরু হবে চেন্নাইতে – চীপকের পিচ বরাবরই স্পিন সহায়ক।
প্রথম রাউন্ডে কিন্তু জিতলেন ওয়ার্নেই। তাঁর বলে শুধু তেন্ডুলকরই আউট হলেন না, তিনি রীতিমতো ত্রাস সৃষ্টি করে ভারতের ওপেনিং জুটির শতাধিক রানের ভাল কাজকে পণ্ড করে দিলেন। নেহাত পরিণত রাহুল দ্রাবিড় একটু রুখেছিলেন, তাই ভারতের রান ২৫০ অতিক্রম করতে পারলো। অস্ট্রেলিয়াও প্রথম ইনিংসে ভাল খেলে বেশ লীড নিল। কিন্তু আসল খেলা শুরু হল চতুর্থ দিনে।
ওয়ার্নের ওপর সব থেকে ভরসা ছিল অস্ট্রেলিয়ার, কিন্তু বিশেষ সুবিধে করতে পারছিলেন না তিনি। সিধু, দ্রাবিড় তাঁকে ভালই খেলে দিয়েছিলেন, তবে তাঁর চরম হেনস্থা করলেন শচীন তেন্ডুলকর। ১৯১ বলে তাঁর দুরন্ত ১৫৫ রান সেই চতুর্থ দিনে ভারতকে যেন হঠাৎই চালকের আসনে বসিয়ে দিল। এর পরে উৎসবে যোগ দিলেন আজহারউদ্দিনও। যথেচ্ছভাবে অস্ট্রেলিয়াকে দুরমুশ করে অস্ট্রেলিয়াকে চতুর্থ ইনিংসে ৩৪৮ রানের লক্ষ দিয়ে ব্যাট করতে ডাকলেন। শুরুতেই ছন্দপতন, ইনিংসের শুরুতেই শ্রীনাথ স্লেটারকে তুলে নিলেন, প্রায় পরপর আউট হলেন ব্লুয়েট এবং তৎকালীন অধিনায়ক মার্ক টেলর। চতুর্থ দিনের শেষে অস্ট্রেলিয়া তিন উইকেট হারিয়ে ধুঁকছিল। পঞ্চম দিনে কুম্বলে ও তাঁর নিজস্ব বাহিনী লাঞ্চের কিছু পরেই কর্তব্যকর্ম শেষ করে ফেললেন।
এই জয় ভারতীয় ফ্যানদের প্রভূত আনন্দ দিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়া তখন ওয়ার্নেকে নিয়ে উত্তাল। উল্টোদিকে কুম্বলেকে সেরকম কেউ গুরুত্ব দিচ্ছেন না। কার্যত হল ঠিক উলটো, স্পিন সহায়ক পিচেও ওয়ার্নে কিছু করতে পারলেন না, তেন্ডুলকরের হাতে তাঁর হেনস্থা হল। আর কুম্বলে (ম্যাচে মোট আট উইকেট) অস্ট্রেলিয়াকে পুরো শেষ করলেন। অস্ট্রেলীয় মিডিয়া সেরকমভাবে আর অজুহাত খুঁজে বার করতে পারলেন না। টীম দ্বিতীয় টেস্টের জন্য কলকাতা চলে গেল।
শেন ওয়ার্নের এই পরাজয়ে উল্লসিত হওয়ার আরো একটু ঘটনা ছিল। সেটা অল্প আলোচনা করা যেতে পারে। এর কিছুদিন আগেই শুরু হয়েছিল মুথাইয়া মুরলীধরনের সেই তুমুল বল ছোঁড়া বিতর্ক। সেটা এমন পর্যায়ে যায় যে ক্রিকেট নিয়ে খুব সাংঘাতিক যে সব ঘটনা ঘটেছে এটি তার মধ্যে অন্যতম। এটির নাম হয়ে গিয়েছিল – ‘Hair Rising Controversy’! অস্ট্রেলিয়ান আম্পায়ার ডেরিল হেয়ার মুরলীধরনের বলকে নো বল ডেকে ছিলেন বল ছোঁড়ার অভিযোগে। সেই সময়ে অনেকেই ভেবেছিল এটি অস্ট্রেলিয়ার এক চক্রান্ত, যেহেতু বিশ্বে এক নম্বর স্পিনার নিয়ে ওয়ার্নের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী মুরলীধরন, তাই তাকে শেষ করতে অস্ট্রেলিয়া বদ্ধ পরিকর। অস্ট্রেলিয়া যেমন শ্রীলংকাকে চোর বলেছিল, শ্রীলংকাও ছাড়েনি, অধিনায়ক রনতুঙ্গা বলেছিলেন, ‘ওদের ইতিহাস সবাই জানে’। আসলে এক সময়ে আসামীদের দ্বীপান্তরে অস্ট্রেলিয়াতে পাঠানো হত, অর্থাৎ রনতুঙ্গা বলতে চেয়েছিলেন আমরা চোর হলে ওরা ডাকাত।

‘Hair Rising Controversy’!
অস্ট্রেলিয়াকে কেউ বিশেষ পছন্দ করতো না, মুরলীধরনের প্রতি ভারতেও অনেকে বেশ সহানুভূতিশীল ছিলেন। তামিলনাড়ুর রাজধানীতে ওয়ার্নের এই চরম হেনস্থা তাই অনেকেই খুব উপভোগ করেছিলেন।
দ্বিতীয় টেস্টে অস্ট্রেলিয়া টসে জিতে ব্যাট করতে নেমে প্রথম ওভারেই বিপাকে। জাভাগল শ্রীনাথ প্রথম ওভারেই তুলে নেন স্লেটার এবং ব্লুয়েটকে। পরেপরেই মার্ক ওয়াকেও – ১৫ / ৩। অধিনায়ক মার্ক টেলরকে যখন প্রথম ইডেনে খেলতে নামা সৌরভ তুলে নিলেন (২৯ / ৪) তখন একেবারে ইডেন জুড়ে নাচ শুরু হয়ে গেছে। পন্টিংও প্রায় যেতে বসেছিলেন – কিন্তু বেঁচে গিয়ে অসাধারণ ইনিংস খেললেন। আর খেললেন তিনি – স্টীভ ওয়াহ। ওঁর সময়ে কতবার যে উনি অস্ট্রেলিয়াকে অসম্মানের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন গুনে শেষ করা যাবে না। স্টীভ ওয়াহ ছিলেন আমাদের ভীতির কারণ, তিনি অনেকটা আমাদের আগের কালের গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথের মতই। একেবারে শেষ দিকের ব্যাটসম্যানদের নিয়েও লড়ে যেতেন। এবারেও তাই করলেন। ২৩৩ রান অবধি গেল অস্ট্রেলিয়া। ভারত কিন্তু রানের পাহাড় গড়লো। লক্ষণ, সিধু, তেন্ডুলকর, গাঙ্গুলি, দ্রাবিড় সব্বাই রান করলেন, ইডেনকে বলা হত আজহারের নিজস্ব মাঠ – তিনি করে ফেললেন ১৬৩ নট আউট! সব মিলিয়ে ৬৩৩ / ৫ এ ৪০০ রানের লীড নিয়ে ভারত দান ছাড়লো। ওয়ার্নে আবার যথারীতি ব্যর্থ, কোন উইকেট নেই, ভালই পিটুনি খেলেন।
অস্ট্রেলিয়ার শুরুতেই আবার আঘাত হানলেন শ্রীনাথ – স্লেটারকে তুলে নিয়ে! আর একটু স্থিতু হতে গিয়েই আবার ব্লুয়েটকেও তুলে নিলেন। এরপরে কুম্বলে হাল ধরলেন। পরপর উইকেট পড়তে লাগলো – স্টীভ ওয়াহ লড়ে গেলেন, কিন্তু বিশেষ সুবিধা করতে পারলেন না। বিশাল বিপর্যয় – অস্ট্রেলিয়া হারলো এক ইনিংস আর ২১৯ রানে। ইডেন পুরো মাতোয়ারা! আর একটি বিশেষ কারণও ছিল – বাঙালীর নয়নের মণি গাঙ্গুলি মশাই এই জয়ে বেশ চৌখস ভূমিকা রাখলেন – প্রথম ইনিংসে শ্রীনাথের সঙ্গে শুরু করে তিন উইকেট এবং ৬৫ রান!
নামী দামী প্লেয়ার সমন্বিত অস্ট্রেলিয়াকে ভারত এরকম নির্দয়ভাবে পর্যুদস্ত আগে কখনো করেনি। আমরা ভাবছি এবার ৩ – ০ হলে আমাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। কিন্তু কি জানি, ‘কি ছিল বিধাতার মনে’! পরের টেস্টে ব্যাঙ্গালোরে আহত শ্রীনাথকে বিশ্রাম দিয়ে হরবিন্দার সিংকে আবার সুযোগ দেওয়ার কথা উঠলো।
টসে জিতে ভারত ভাল খেলে ৪০০র ওপর রান করলো। কিন্তু এবার অস্ট্রেলিয়াও বেশ ভাল শুরু করলো। মাইকেল স্লেটারকে বারে বারে সমস্যায় ফেলছিলেন শ্রীনাথ, এবারে তাঁর অনুপস্থিতিতে আর হরবিন্দারের মহিমায় তিনি নিজমূর্তি ধারণ করলেন। অন্যরাও ভাল ব্যাট করলেন, অস্ট্রেলিয়া ভারতের থেকে অল্প পিছিয়ে ইনিংস শেষ করল। ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসে একেবারে বিরাট বিপর্যয় দেখা দিল হঠাৎই। পেসার কাস্প্রোউইচ বেশ ভয়ংকর হয়ে উঠে পাঁচখানা উইকেট নিয়ে ভারতকে বিপদে ফেলে দিলেন। চতুর্থ ইনিংসে অস্ট্রেলিয়াকে করতে হবে ১৯৫ – সেটাও বেশ চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু ঐ যে! শ্রীনাথের অভাব এবারেও বেশ অনুভূত হচ্ছিল – মার্ক টেলরের পরিণত সেঞ্চুরী কোন সমস্যাই হতে দিল না – আরাম করে অস্ট্রেলিয়া আট উইকেটে জিতে শেষ হাসি হাসলো।
এই সিরিজে ওপেন করেছিলেন বিখ্যাত VVS (Very Very Special) Laksman! যিনি পরে অস্ট্রেলিয়ার ত্রাসের কারণ হবেন তিনি কিন্তু এই সিরিজে বিশেষ সুবিধে করে উঠতে পারেননি। আর শেষ টেস্টে দলে এলেন নবাগত একটি পাগড়ি পরিহিত নব্যযুবা শিখ – হরভজন সিং।
কিন্তু এর পরেই বেশ বিতর্ক শুরু হল। ম্যাচ ফিক্সিং কাণ্ড নিয়ে সারা ভারত উত্তাল। আজহার, নয়ন মোঙ্গিয়া – দুজনের ই নাম জড়াল। ফলে ১৯৯৯ সালে অস্ট্রেলিয়াতে অধিনায়ক শচীন তেণ্ডুলকর যে টীম নিয়ে গেলেন, তাদের সামর্থ্যও সীমিত! মনোবলও বেশ ভঙ্গুর। আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত শোনা গেল তদানীন্তন সেক্রেটারি জয়ন্ত লেলে মত প্রকাশ করেছেন – ‘ এই দল ৩-০ হেরে আসবে’! এরপর আর বিশেষ কিছু আশা করাই মুশকিল। অপরদিকে মার্ক টেলর অবসর নেবার পর স্টীভ ওয়াহর নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলিয়া দল – কিছুদিন আগেই যারা বিশ্বকাপ জিতেছে। নিজের মাটিতে তাঁদের আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে।
১৯৯৯ এর সেই সকাল গুলোর কথা মনে পড়লে এখনো বেশ কষ্ট হয় – ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে শুধুই হতাশা। প্রথম দুই টেস্টে ভারত ভাল লড়েছিল, মনে হচ্ছিল আজহার ও মোঙ্গিয়া থাকলে বেশ ভাল জমে যেত। শেষ টেস্টে একেবারে ইনিংসে হার! সিরিজ শেষ হওয়ার পর সুনীল গাভাসকার কমেন্টেটর হিসেবে একটা কথাই বলেছিলেন – ‘মানছি যে ভারত খুবই দুর্বল প্রদর্শন করেছে, তবে অনেক বিতর্কিত সিদ্ধান্তই ভারতের বিপক্ষে গিয়েছে’। একটা ঘটনা খুব মনে পড়ে। শেষ টেস্টের প্রথম ইনিংসে চার উইকেট পড়ে যাবার পর দাপটে ব্যাট করছিলেন শচীন তেণ্ডুলকর – ম্যাকগ্রাথকেও রেয়াৎ করছিলেন না। এক ওভারে পরপর তিনটি চার মারলেন, তারপর হঠাৎই ম্যাকগ্রাথের একটি লেগের দিকে বেরিয়ে যাওয়া বলে তাঁকে LBW দেওয়া হল। খুবই আশাভঙ্গের কারণ ছিল। সব মিলিয়ে এই সিরিজটি প্রায় ভুলে যাওয়ার মতই। তবে তৃতীয় টেস্টের শেষ ইনিংসে বেশ আশাপ্রদ কিছু ঘটলো। ভারতের শেষ ইনিংসের ২৬১ রানের মধ্যে ১৬৭ রানই এল তাঁর ব্যাট থেকে যাঁকে পরে বলা হবে অস্ট্রেলিয়ার ত্রাস – VVS (Very Very Special) Laksman। প্রথমে একদিনের দলে তাঁকে নেওয়া হয়নি, এই ইনিংস দেখে তাঁকে চটপট নিয়ে নেওয়া হল। সম্ভবতঃ ঐ সিরিজের এটাই একমাত্র পাওনা।
পরেরবার ভারতে অস্ট্রেলিয়া যখন এল তখন বলা হয়েছিল – They are here to win the final frontier. তার আগে প্রায় দুর্দমনীয় গতিতে এগিয়ে চলেছিল অস্ট্রেলিয়া। পরেরপর ১৫টি টেস্টে জিতে এসেছে। এর আগেই নিজের ব্যাটিং এ বেশী মনোযোগ দেবার জন্য অধিনায়কত্ব ছেড়েছেন তেন্ডুলকর, ভারতের অধিনায়ক বঙ্গতনয় সৌরভ গাঙ্গুলি।
প্রথম টেস্ট মুম্বাইতে। কিন্তু ভারতীয় দলে বেশ হতাশা – অনিল কুম্বলে, যাঁর উপর সবচেয়ে বেশী ভরসা করা যেত, তিনিই আহত – ফলে দলে থাকতে পারবেন না।
প্রথম টেস্ট মুম্বাইতে শুরু হল – এবং প্রথম ইনিংসেই ভারতের আত্মসমর্পন দেখে মনে হল যে কি হতে চলেছে। তিনদিনে খেলা শেষ, কোনক্রমে ইনিংস পরাজয় এড়ালেও দশ উইকেটে হার হল। সৌরভের অবস্থা ছিল খুবই করুণ, একদিকে স্টীভ ওয়াহর মত অধিনায়ক যাঁর সবকিছুই ঠিকঠাক হচ্ছে। অন্যদিকে সৌরভের কিছুই ঠিকমতো চলছে না, না ক্যাপ্টেনসি না ব্যাটিং। শুরু হয়ে গেছে চীৎকার চেঁচামেচি, মুম্বাইতে অনেক হৈ চৈ হয়েছে। কুম্বলে থাকলে তবুও কিছুটা ভরসা পেতেন, তিনিও নেই। চূড়ান্ত হতাশ টীম কলকাতায় এল।
এখনো মনে পড়ে কলকাতা টেস্ট ম্যাচ শুরু হওয়ার আগের দিনের খবর। এরকম হতাশাজনক অবস্থায় কলকাতা টেস্টে কিন্তু বেশ ভালই প্রত্যাশা রয়েছে। আগের দিন টিভিতে দেখানো হল কিছু দর্শক হৈ চৈ করে মাঠে যাচ্ছে, সাংবাদিক তাঁদের জিজ্ঞেস করছেন –‘কি ব্যাপার, কি বুঝছেন কিছু হবে?’ তাঁদের মুখ উজ্জ্বল –‘হবে হবে, এ হল ইডেন গার্ডেন্স’! সম্ভবত আগের বার অস্ট্রেলিয়ার ইডেনের সেই সাংঘাতিক হারের কথা মনে হচ্ছিল। আমরা কিন্তু খুব বেশী আশাবাদী ছিলাম না।
অস্ট্রেলিয়া ইডেন টেস্টের প্রথম দিনে বেশ অস্বস্তিতে ছিল, কারণ সৌজন্যে হরভজন সিং এর বিতর্কিত হ্যাটট্রিক। দিনের শেষে আট উইকেটে ২৯১। শুধু রয়েছেন স্টিভ ওয়াহ। কিন্তু পরের দিন তিনি আবার সেই অধিনায়কোচিত ইনিংস খেললেন – শেষ দুই উইকেটে অস্ট্রেলিয়া তুলে ফেলল প্রায় ২০০র কাছাকাছি রান। শেষ করলো ৪৪৫ এ। এরপরেই শুরু হল – ‘শুধু যাওয়া আসা’! উফফ! কি কষ্টকর যে সেই দৃশ্য! একমাত্র লক্ষণই কিছুটা ঠেকালেন। ১৭১ এ ইনিংস শেষ। ব্যস, অতি বড়ো সমর্থকও আশা ছেড়ে দিয়েছিল। একে মার্চ মাস, অফিসের সব্বাইয়েরই হঠাৎ বড়ো কাজের চাপ বেড়ে গেল। আর কি হবে! বরং নিজের কাজে মন দিলে কিছু লাভ হতে পারে এমনই ভাবখানা। স্টীভ ফলোওন করতে ডাকলেন, ভারত মোটামুটি খেলতে শুরু করলো। তিন নম্বরে খেলতে নামলেন লক্ষণ, তাঁর আগের ইনিংসের সর্বোচ্চ ৫৯ বেশ ভরসা দিয়েছিল। কিন্তু তারপরে আবার বিপর্যয়, তেন্ডুলকর খুব তাড়াতাড়ি আর সৌরভ লক্ষণকে কিছুক্ষণ সঙ্গ দিয়ে ফিরে গেলেন। ৬ নম্বরে ব্যাট করতে নামলেন রাহুল দ্রাবিড়। দিনের শেষে ৪ উইকেটে ২৫৪। ভাবছি যাক হারটা হলেও নিতান্ত অসম্মানের হার হবে না। কিন্তু এর পরের দিন ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসের এক স্বর্ণোজ্জ্বল দিন। সেদিন যাঁরা খেলা দেখতে গিয়েছিলেন, তাঁরা এক অতুলনীয় অভজ্ঞতার সাক্ষী থাকেন। যাঁরা ‘মার্চ’ প্রেসারে অফিসে ছিলেন তাঁরা? কাজের মাঝে মাঝেই খবর নিচ্ছিলেন আর অবাক হচ্ছিলেন? এখনো খেলছে? তাহলে ড্র হলেও হতে পারে? আবার বেশি আশা করতেও ভয়! যাই হোক কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়ি ফিরে শুনলেন – তাঁরা দুজন অপরাজিতই। ভারত প্রায় ৬০০র কাছাকাছি। প্রায় ৩০০র ওপর লিড, মনে হচ্ছে প্রাণে বেঁচে গেল। পরের দিন একটু নিশ্চিন্ত, ড্র তো হবেই। অস্ট্রেলিয়া ভালই ব্যাট করছে। লাঞ্চ এবং চা ও নিস্তরঙ্গ ভাবে কেটে গেল! চায়ের পর খবর আসতে লাগলো, একে একে নিভিছে দেউটি। তাও কি বিশ্বাস হয়! এ যে প্রায় অলৌকিক ব্যাপার! ফলোঅন করে জেতা? কিন্তু সম্ভব হল। সম্ভব করলেন হরভজন! অবশ্য তেন্ডুলকর ব্যাটে কিছু না করতে পারলেও বলে যোগ্য সঙ্গত করলেন হরভজনের। এই টেস্ট জিতে ভারতীয় ক্রিকেটের চেহারাই পাল্টে গেল। পরের টেস্ট চেন্নাইতে।

তখনো মার্চ মাস চলছে, কিন্তু ভারতীয় ফ্যানেরা মনে করছেন আশা আছে, তাই ইয়ার এন্ডের চাপকে একটু খাটো করে দেখতে শুরু করেছেন।
নাঃ! সে গুড়ে বালি ঢেলে দিতে চল্লেন ম্যাথু হেডেন! টসে জিতে ব্যাট করে প্রথম দিনের শেষে অস্ট্রেলিয়া ৩ উইকেটে ৩২৬। হেডেন প্রায় দেড়শো, আর ভারতের সেই চিরকালের কাঁটা স্টিভ ওয়াহও রয়েছেন, সুতরাং কর্মী মানুষেরা আবার ভাবলেন, নাঃ – অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে যাওয়াই বোধহয় ভাল।
পরের দিন কিন্তু আবার ধ্বস নামালেন হরভজন, স্টিভ ওয়াহর কাঁটা সরতেই ব্যস। সব্বাই একে একে প্যাভিলিয়নে ফিরলেন, লাঞ্চের আগেই ৩৯৩ এ খেলা শেষ। সব্বাই নড়েচড়ে বসল। এর ওপর ভারতের ওপেনিং জুটিও বেশ আশাপ্রদ শুরু করলো, তিন নম্বরে এসে লক্ষণ আবার চমৎকার খেললেন, চার নম্বরে তেন্ডুলকরের সেঞ্চুরি – সব মিলিয়ে ভারত পাঁচশো ছাড়ালো। ভয়ের কারণ কিন্তু আছে, শেষ দিনে চীপকের পিচে ভারতকে খেলতে হবে। তবে আবার হরভজন আক্ষরিক অর্থেই ‘খেলা’ দেখালেন, পঞ্চম দিনে যখন অস্ট্রেলিয়া শেষ করলো, ভারতের লক্ষ ১৫৫ রান। ওপেনাররা কিন্তু এবারে ব্যর্থ, তিন নম্বরে আবার লক্ষণ এসে সামলে নিলেন, কিন্তু তারপরে আবার একে একে বিদায় নিলেন শচীন, রাহুল, সৌরভ – এরপরে লক্ষের খুব কাছে এসে চলে গেলেন লক্ষণ। একে মার্চের প্রেসার তার ওপর একেবারে তীরে এসে তরী ডোবার ভাবনা – মন একেবারে ককিয়ে উঠছে। এরমধ্যে কারুর বাড়ি থেকে ফোনে খবর আসছে, আমার তরুণ সহকর্মীরা কেউ হতাশ, কেউ উন্মত্ত! কাজের ব্যস্ততায় কেউ একজনের দেওয়া খবরের সত্যতা চেক করতে পারছে না। এই সময়ে আমার এক খুব ঘনিষ্ঠ সহকর্মী খুব করুণ মুখ করে এসে বলল, নাঃ আর হল না! ব্যস, আরো অন্য দুজন – ‘জানতাম, ধুর – সব ধেড়ানো পাবলিক’ বলতে বলতে কাজে চলে গেল। আমিও করুণ মুখ করে বসে আছি, এই সময় দেখি সেই ছেলেটি আমার কঁধে হাত দিয়ে বলল, ‘চিন্তার কিছু নেই, প্রায় জিতে গেছি, আর দু তিন রান বাকি।’ ‘সেকি? এক্ষুনি বললে যে-’! ‘আরে না, ঐ দুটোকে একটু জব্দ করছিলাম, কালকে আমাকে খুব টেনশন দিয়েছিল, তাই প্রতিশোধ’! যাক! অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে দেখলাম, বেশ উৎসব উৎসব ভাব! সত্যিই, কুম্বলে ছাড়া পুরোশক্তির বিশ্বজয়ী অস্ট্রেলিয়াকে এভাবে সাবাড়ানো = ‘ফাইন্যাল ফ্রন্টিয়ার’ অধরাই রয়ে গেল!এই সিরিজকে বলা হয় ‘টেস্ট ক্রিকেটের সর্বোত্তম বিজ্ঞাপন’! এই সময় কিছুটা হলেও ওয়ান ডের দাপটে টেস্টের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হচ্ছিল, এরকম টানাপোড়েনের সিরিজের পর সব্বাই মেনে নিল – ‘নাঃ, এই ধ্রুপদী খেলার আনন্দ অন্যমাত্রার’!
দুবছর পরের মরশুমে ২০০৩ এর শেষে ভারত গেল অস্ট্রেলিয়াতে। তার আগেই ২০০৩ এর মার্চে অস্ট্রেলিয়ার কাছে বিশ্বকাপ ফাইন্যালে হেরেছে ভারত। অস্ট্রেলিয়ার সেই টীমের ক্যাপ্টেন ছিলেন রিকি পন্টিং, স্টীভ ওয়াহ বাদ পড়েছেন। কিন্তু টেস্ট সিরিজের নেতৃত্ব দেবেন তিনিই, আবার সৌরভ-স্টীভ দ্বৈরথ। কানা ঘুষো শোনা যাচ্ছে, এই সিরিজের পরেই অবসর নেবেন স্টীভ।
একটা কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। আগের অস্ট্রেলিয়া সিরিজে কুম্বলের অনুপস্থিতিতে হরভজন ছিলেন জয়ের মুখ্য স্থপতি, বিশ্বকাপ ফাইন্যালেও কুম্বলের স্থান হয়নি। সৌরভকে অনেক করে বুঝিয়েছিলেন কুম্বলে, তাও তাঁর মন গলেনি। দলে একজনই স্পিনার খেলবেন, তিনি হরভজন। টেস্ট সিরিজে কিন্তু সৌরভ কুম্বলেকে নিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। ফলও মিলেছিল হাতেনাতে – কিন্তু সে কথা পরে। লক্ষণ, দ্রাবিড়, ইতিমধ্যে ভারতীয় দলে ওপেনার হিসেবে এসে গেছে সেওয়াগ, তাঁর খেলার ধাঁচ অনেকটাই আক্রমণাত্মক – ওয়েস্ট ইন্ডিজের রয় ফ্রেডেরিকসের মত। তিনি রানও করেন দ্রুতগতিতে। আর একজন ওপেনার আকাশ চোপড়া – তাঁর ওপর ভরসা করা যেতে পারে। আসলে এই রকম সিরিজে ওপেনিং খুব, খুব গুরুত্বপূর্ণ। গাভাসকার চলে যাবার পর আর সেরকম উঁচু মানের ওপেনার পাওয়া যায়নি, সেওয়াগ এসে অনেকটা সেই স্থান পূর্ণ করেছেন। তবে একটি অপূর্ণতা রয়ে গেল। জাভাগল শ্রীনাথ তার আগে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর ঘোষণা করেছিলেন। অস্ট্রেলিয়াতে তাঁর মত একজন পেসারের খুব দরকার ছিল, সৌরভ অনেক বুঝিয়েও তাঁকে রাজি করাতে পারলেন না। ব্যাক্তিগত ভাবে আমিও খুব পছন্দ করতাম, একটু মন খুঁতখুঁত করতে লাগলো।
ব্রিসবেনে প্রথম টেস্টের একটা ঘটনা আমাদের মনস্কামনা পূর্ণ করলো। সৌরভ গাঙ্গুলীর অধিনায়কোচিত ইনিংস। অস্ট্রেলিয়ার ৩০০র ওপর রানের পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে ভারত যখন বেশ টলোমলো, তখন তাঁর ১৪৪ ভারতকে বেশ স্থিতু করে, অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে প্রথম ইনিংসে এগিয়ে থাকতে সাহায্য করে। এইরকম হাড্ডাহাড্ডি সিরিজে প্রথম টেস্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ, দুই দলই মানসিক ভাবে অন্য দলের চেয়ে এগিয়ে থাকতে চায়। এছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে ফাস্ট বোলিংর বিরুদ্ধ, লাফিয়ে ওঠা বল খেলার দুর্বলতারও জবাব দেওয়া দরকার ছিল। এছাড়া গত সিরিজে গাঙ্গুলির আক্রমণাত্মক ক্যাপ্টেন্সিও অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়াকে মারমুখী করে তুলেছিল। শুধু অস্ট্রেলিয়াই নয়, ভারতীয়দেরও যে মেজাজী হবার অধিকার আছে তা হাবেভাবে বুঝিয়েছিলেন গাঙ্গুলি। স্বাভাবিকভাবেই অস্ট্রেলিয় মিডিয়া তাল খুঁজছিল, সৌরভের এই ইনিংস বেশ ভাল জবাব দিয়েছিল। বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচ ড্র হয়ে যায়, ভারত কিন্তু একটু যেন এগিয়েই রইল।

দ্বিতীয় টেস্ট ছিল যুগান্তকারী। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘lightning never strikes the same place twice’! আজ অবশ্য অনেকে মনে করেন এটি গপ্পো, কারণ এডিলেডেও এই প্রবাদ মিথ্যে হয়েছিল। আগের সিরিজের ইডেনের ভূত যেন তাড়া করেছিল অস্ট্রেলিয়দের। টসে জিতে ব্যাট করে অস্ট্রেলিয়া করে ফেলেছিল প্রায় ৫৫০র ওপর রান, মূল স্থপতি রিকি পন্টিং। পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে ৮৫ /৪ এ বিপদে ভারত, তখনই আবার – সেই বজ্রপাত! আবার সেই দ্রাবিড়ও লক্ষণ, এবারে একটু উল্টো। দ্রাবিড় তিনে নেমেছেন, লক্ষণ ছয়ে – কাজেই দ্রাবিড়ের ডবল আর লক্ষণের সেঞ্চুরী। প্রায় ছুঁয়ে ফেলল অস্ট্রেলিয়ার রান। কিন্তু এবার কি হবে? ইডেনের পিচও নেই, নেই হরভজন। কিন্তু যোগ্য জবাব দিলেন অজিত আগরকর। অস্ট্রেলিয়ার পিচের বাউন্সকে কাজে লাগিয়ে দারুণ বল করলেন, নিজের অস্ত্রে নিজে ঘাত হল অস্ট্রেলিয়া। ২০০ রানও করতে পারলো না। ভারতের সামনে চতুর্থ ইনিংসে জয়ের জন্য লক্ষ্য – ২৩০ রান। চতুর্থ ইনিংসে খুব কম নয় কিন্তু। আশা নিরাশায় দুলছি সকলে।

এই টেস্টে দ্রাবিড়ের ওপর কিছু ভর করে থাকবে, সম্ভবত সেই প্রমথ চৌধুরীর ‘মন্ত্রশক্তি’। ওপেনাররা মোটামুটি শুরু করলেও মাঝে মাঝে উইকেট পড়ে বেশ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু একদিকে তিনি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর অপরাজিত ৭২ রান এনে দিল সেই বহু প্রত্যাশিত জয়। অবিশ্বাস্য, অভাবনীয় – অস্ট্রেলিয়া, বিশ্বজয়ী অস্ট্রেলিয়ার নিজের মাটিতে তাদের বিরুদ্ধে আমরা এগিয়ে। স্বাভাবিক ভাবেই ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হলেন – রাহুল দ্রাবিড়!!

পরের টেস্ট ম্যাচ – মেলবোর্ন – বক্সিং ডে। এই সময় আমি কলকাতায় ছুটিতে। বেশ খেলা দেখছি, কি আপদ! সেইসময় হঠাৎই দুদিনের কাজে ভাইজ্যাগ যেতে হল। ভাইজ্যাগে মিটিং এ গিয়ে শুনলাম সেওয়াগ ১৯৫ করে ছয় মারতে গিয়ে আউট হয়েছে! ইস! কি আপশোষ, দেখতে পেলাম না। তবে সেওয়াগ এত ভাল খেলেছে, জয় নিশ্চিত। যাঃ বাবা! একদিনে কাজ শেষ করে পরের দিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে শুনি – বিপর্যয়!! কোথায় ৪৫০র ওপর রান করবে – না, ৩৫০ র একটু ওপরেই ইনিংস শেষ। এখানেইঅস্ট্রেলিয়া ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়ে গেল। ক্রিকেটে এটা অনেকবার হয়েছে, ইডেনের কথা সকলেরই মনে আছে। পন্টিং আর হেডেনের সাহায্যে অস্ট্রেলিয়া রানের পাহাড় গড়ে ফেলল। আবার দ্বিতীয় ইনিংসে ভাল শুরু করেও ব্যর্থতা- হুড়মুড় করে শেষ দিকে ভেঙে পড়ে অস্ট্রেলিয়াকে জয়ের লক্ষ রাখ হল ১০০র কম। সহজেই তা হয়ে গেল। এই পরাজয় সেওয়াগপ্রেমীদের খুব দুঃখ দিয়েছিল। প্রথম দিন যে উজ্জ্বল স্বপ্ন দেখেছিলাম তা ধূলিসাৎ হতে দেখলে কার না খারাপ লাগে?
চতুর্থ টেস্টের আগে অবধি খুব, খুব খারাপ ফর্মে ছিলেন তেন্ডুলকর। শুধু এই সিরিজ নয়, বেশ কিছুদিন ধরেই তাঁর ব্যাটে রান নেই। দ্রাবিড়, লক্ষণ, সৌরভ, সেওয়াগ – সবাই রান পাচ্ছেন। গত টেস্টে তাঁর একটা সেঞ্চুরী হয়তো হার বাঁচাতে পারতো!
শেষ টেস্টে তিনি বেশ ভালোভাবেই ফর্মে ফিরলেন, টসে জিতে প্রথম ইনিংসে ভারত ব্যাট করল পুরো দুদিন ধরে – ৬৫০র ওপর রান, তেন্ডুলকর তখনো অপরাজিত! ভারত কিন্তু তখনো ডিক্লেয়ার করার সাহস করেনি! এই নিয়ে বেশ সমালোচনা হল। মনে করা হল ভারত সিরিজ ড্র করে রাবার নিজেদের কাছেই রাখতে চাইছে। তৃতীয় দিনে ও কিছুক্ষণ খেলে ৭০০র ওপর রান তুলে দান ছাড়ল ভারত।
একটা কথা এখানে ভাবতে হবে। দ্বিতীয় টেস্টে ৫৫০র ওপর রান করে অস্ট্রেলিয়া হেরেছিল। সে হিসেবে দেখলে সৌরভকে একটু সাবধান থাকতেই হত। আর দুদ্দাড় করে দ্বিতীয় ইনিংসে গুটিয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়। সে হিসেবে ভারতের এই পদক্ষেপ সাবধানী বলা চলে, কিন্তু খুব রক্ষণাত্মক নয়। আগের টেস্টে অস্ট্রেলিয়া মানসিক ভাবে এগিয়ে গেছে, তাই একটু সতর্কতার প্রয়োজন ছিলই। আজকেই যেমন রিকি পন্টিং পূজারার ইনিংসকে ‘অতি রক্ষণাত্মক’ বলেছেন, আবার এও বলেছেন ভারত জিতে গেলে এটা খুব দামী হয়ে যাবে অন্যথায় নয়। বোঝো!
অস্ট্রেলিয়া ভাল জবাব দিলেও প্রায় ২০০ রানের ব্যবধান রইল। কুম্বলে নিলেন ৮ উইকেট, তাঁকে যোগ্য সঙ্গত করার কেউ থাকলে হয়তো অস্ট্রেলিয়া আরো তাড়াতাড়ি শেষ হত, রানের ব্যবধান ৩০০ থাকতো। দ্বিতীয় ইনিংসে ভারত মোটামুটি তাড়াতাড়ি রান করে চতুর্থ দিনের শেষে প্রায় ৪৫০ রানের লক্ষ দিল অস্ট্রেলিয়াকে। অস্ট্রেলিয়া বিপদে পড়তে চলেছিল, কিন্তু আগের ইনিংসের নায়ক সাইমন কাটিচের সঙ্গে যোগ্য সহযোগিতা করলেন স্টীভ ওয়াহ। নিজের শেষ টেস্টকে স্মরণীয় করে রাখলেন তিনি! ম্যাচ বাঁচিয়ে ফেলল অস্ট্রেলিয়া, রাবার অবশ্য ভারতের কাছেই রইল।

এই ম্যাচ আর সিরিজ না জেতার জন্য আমাদের আপশোষ রয়ে গেল! সৌরভ খুবই হতাশ হয়ে বললেন দুই ইনিংসেই কুম্বলে যা অসাধারণ বল করলেন তাঁর সঙ্গে যদি কেউ যোগ্য সহায়তা করত, এই ম্যাচ আমাদের হাতে থাকত। একদম ঠিক কথা –দুই ইনিংস মিলিয়ে ১৬টি উইকেটের মধ্যে ১২ উইকেট ছিল কুম্বলের দখলে। সৌরভ যে তাঁকে জোর করে দলে ঢুকিয়েছিলেন, তার পূর্ণ মর্যাদা রেখেছিলেন তিনি। আগরকর, ইরফান পাঠান, মুরলী কার্তিকরা যদি আর একটু কিছু করতে পারতেন, – বিরাট এক স্বপ্ন সম্ভব হত।
হয়নি, পরেও আর হয়নি! তাই এবার সেই আশা নিয়েই তাকিয়ে রইলাম! দেখা যাক, কাল কি হয়!!