বিনয় মুখোপাধ্যায় যাযাবর ছদ্মনাম নিয়ে লিখেছিলেন একটি অনু উপন্যাস, ‘দৃষ্টিপাত’। তার একটি অনুচ্ছেদ প্রায় প্রবাদ হয়ে গেছে,
“আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ। তাতে আছে গতির আনন্দ, নেই যতির আয়েশ!”
এই যতির আয়েশ বলতে ট্রেনযাত্রার কথাই বলা হয়েছে, বেগবান যান টি অবশ্যই বিমান। আমাদের ভারতীয় প্রযুক্তিতে রেল অবশ্যই বড় ভূমিকা নিয়েছে। এমনকি ভারতীয় চলচ্চিত্রেও রেলযাত্রার বড় ভূমিকা দেখে থাকি আমরা। যে চলচ্চিত্র কে আমরা আধুনিক চলচ্চিত্রের জনক বলে থাকি, সেই ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রে কিন্তু এক অপূর্ব ভূমিকা ছিল ট্রেনের।
অপু ও দুর্গা – দুজনে মিলে দৌড়তে দৌড়তে ট্রেন দেখতে যাচ্ছে। উপন্যাসেও ছিল সে ঘটনা। আর এত অপূর্ব সেই চলচ্চিত্রায়ন, যা আজো আমাদের মনকে দোলা দিয়ে চলেছে।
নীল আকাশ, তার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে আসছে ট্রেন। ষ্টীম ইঞ্জিনের ধোঁয়া পাক খেতে মিলিয়ে যাচ্ছে আকাশে। দুটি গ্রাম্য বালক বালিকা পূর্ণ বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। তারা যেন পৃথিবীর সব ছেলে মেয়েদের প্রতিনিধি। আরো আশ্চর্য, তাদের এই অকপট বিস্ময়ের অনবদ্য চিত্রটি খোদ স্রষ্টারও মাথায় ঢুকে গেল।

আসলে সত্যজিতের নিজের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক চিরন্তন শিশু। তাঁর অদম্য কৌতূহল, অফুরন্ত প্রাণশক্তি। লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো বলেই ছিলেন, তাঁর মতে সত্যজিৎ সম্পর্কে যথোপযুক্ত বিশেষণ হল – ‘শহুরে অপু’। কোন শিশু অভিনেতাকে যখন নির্দেশ দিতেন, তাঁর সেই চারিত্রিক গুণটি সহজেই প্রতিভাত হত। আর ট্রেন তো সব শিশুরই প্রিয়।

পরশুরামের ‘বিরিঞ্চিবাবা’ গল্পে কিন্তু ট্রেনের সেরকম কোন ভূমিকা ছিলনা। কিন্তু সত্যজিৎ ‘মহাপুরুষ’ চলচ্চিত্রে বাবার আগমন ঘোষণা করলেন ট্রেনেই। সেই ট্রেনেই দেখা গেল, সকালবেলা বিরিঞ্চিবাবা সূর্যকে জাগিয়ে দিচ্ছেন, “ওঠ, ওঠ” বলে!! সেই দেখেই ভক্তরা বুঝে গেলেন, ‘মহাপুরুষ’!

পরবর্তী কালে সত্যজিতের সৃষ্টিতে ট্রেনের এক বড় ভূমিকা দেখা যায়। চলচ্চিত্র এবং সাহিত্য, দুটিতেই। তিনি এবং তাঁর চরিত্ররা খুবই উপভোগ করতেন এই ট্রেন যাত্রা। এমনকি বাংলার ম্যাটিনি আইডল খোদ উত্তমকুমারকে অবধি ট্রেনে চড়িয়ে এক অনন্য চিত্রকাব্য উপহার দিয়েছিলেন -“নায়ক”!!

“নায়ক” পুরস্কার নিতে দিল্লী যাচ্ছেন। প্লেনে নয়, ট্রেনে। এখানে তিনি দেখালেন “যতির আয়েশে” লব্ধ এক নতুন আখ্যান। এই ট্রেনযাত্রার সঙ্গে কেমনভাবে মিলে গেল নায়ক অরিন্দমের জীবনের যাত্রাপথও। সদ্যপরিচিতা অদিতির কাছে তিনি ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হলেন, যতির আয়েশেই। বিমানে দিল্লী যেতে লাগে মাত্র ঘন্টা দেড়েক, তাতে সম্ভব ছিলনা। এছাড়া ট্রেনে সহযাত্রীরাও বিভিন্ন অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর। তাদের জীবনে সাফল্যের মাপকাঠি একেবারেই আলাদা। তাদের সম্পর্কে এসে যেন নায়কের জীবনের যাত্রাপথের ঘটনা অরিন্দমের মনে দোলা দেয়। আমার মনে হয়েছে, এখানে ‘নায়ক’ জীবনের দৌড়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে যেন ট্রেনে একটু শান্তি পাচ্ছে, এমন ভাবনাও থাকতে পারে।
ট্রেনের নাতিদীর্ঘ সময়টিতে নায়ক অরিন্দম এবং তাঁর সহযাত্রীদের মধ্যে এক অদ্ভুত সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। এটি কিন্তু বিমানযাত্রাতে আদৌ সম্ভব নয়। এক সাংবাদিকের কাছে তিনি যেভাবে উন্মুক্ত হতে পারলেন, তার পিছনে ঐ যাত্রার দৈর্ঘ্য এবং পরিবেশ খুব সহায় ছিল।
তাঁর জীবনের শুরুর দিন থেকে নিজের স্বপ্নের কথা, অপমানের কথা, দ্বিধা-দ্বন্দের কথা, দোষের কথা অকপটে তিনি স্বীকার করতে পারলেন এক সদ্য পরিচিতার কাছে। নিজের মনে তিনি হয়তো চেয়েছিলেন এই যতির আয়েশ, নিজের বেগবান জীবনে কি তিনি নিজেই ক্লান্ত হয়ে যাননি? নাহলে বন্ধুর কাছে কেন বলবেন, ‘২৪টি ঘন্টা এসব ঝামেলার থেকে স্রেফ রেহাই চাই। প্লেনের বুকিং পাওয়া যায়নি, এক হিসেবে ভালই হয়েছে।”
যাত্রার একেবারে শেষের দিকের সেই দৃশ্যটি ও খুব উল্লেখযোগ্য। যেখানে কিছুটা স্খলিত অরিন্দম অদিতিকে তাঁর শেষ সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। ১৪২৪ সালে প্রকাশিত শর্মিলা ঠাকুরের একটি লেখা থেকে জানা যায় এই দৃশ্যে তাঁকে অভিনয় করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ। তাঁরা দুজন কথা বলছেন, ট্রেনের দুলুনিতেও অরিন্দমের কথা কেটে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে আলো এসে পড়ছে, ট্রেনের গতি বাড়ছে, কমছে, ট্রেন কখনো এক লাইন থেকে পালটে চলে যাচ্ছে অন্য লাইনে – এ যেন অরিন্দমের জীবনেরই এক দোদুল্যমান অবস্থা। ‘জীবনদোলায় দুলে দুলে আপনারে, ছিলেম ভুলে’ – এই অন্ধকার জীবনে তিনি যেন অদিতির চোখেই একটু সহানুভূতির আলো দেখতে পান।
https://www.youtube.com/watch?v=CaWw-9TomXo
তাঁর কিশোর সাহিত্যে তো ট্রেনের বিরাট ভূমিকা। বাক্স রহস্য গল্পে এ ট্রেনেই বাক্স বদল হয়ে গল্পের শুরু। একই রকম দেখতে দুটি বাক্স, অদল বদল হয়ে কি গণ্ডগোল হল। তাঁর প্রিয় লেখক বিভূতিভূষণ মহাশয়ের একটি গল্পের নাম বাক্সবদল। সেখানেও এক ট্রেনেই নায়ক নায়িকা আসেন, তাঁদের দুজনের একই রকমের স্যুটকেস। বাক্সবদল হয় অবশ্য স্টেশনে। এই কাহিনী অবলম্বনে একটি কাহিনীচিত্র হয়, তার চিত্রনাট্য এবং সঙ্গীত সত্যজিৎ করলেও পরিচালক তাঁর সহকারী নিত্যানন্দ দত্ত। সম্ভবত “বাক্সরহস্য” র অনুপ্রেরণা এটিই।

“বাদশাহি আংটি” গল্পেও দেখেছি লখনৌ স্টেশন বারবার এসেছে। ডুন এক্সপ্রেসে চেপে সবাই মিলে হরিদ্বার যাচ্ছে। সেখানেও ট্রেনে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। অস্টিওপ্যাথ শ্রীবাস্তব আর বনবিহারীবাবুর সঙ্গে আলোচনাতে রহস্য আরো ঘনীভূত হচ্ছে। ‘সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। কামরার বাতিগুলো এইমাত্র জ্বলেছে। ট্রেন ছুটে চলেছে বেরিলীর দিকে। কামরায় সবশুদ্ধ সাতজন লোক।” এত সহজে ট্রেনের একটা সজীব ছবি! তারপর ট্রেনের দোলানিতেও তোপসের ঘুম আসছে কিন্তু চিন্তা এত ঝাঁকুনির মধ্যে ঘুম আসে কিকরে? তোপসেকে ট্রেনপ্রেমী ফেলুদা বোঝাচ্ছে,
“এরকম শব্দ যদি অনেকক্ষণ ধরে হয় মানুষের কান অভ্যস্ত হয়ে যায়; তখন আর শব্দটা ডিস্টার্ব করেনা। আর ঝাঁকুনিটা তো ঘুমকে হেল্পই করে। খোকাদের দোল দিয়ে ঘুম পাড়ায় দেখিসনি।”!!
মনে করা যাক, “দুই ম্যাজিশিয়ান” গল্পটি। সেখানেও ট্রীটমেন্ট পুরো ‘নায়ক’ ধর্মী। নামী ম্যাজিশিয়ান তাঁর প্রাক্তন গুরুর কাছ থেকে একটি দৈব ম্যাজিক লাভ করেন। ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর কামরাতে তিনি একলাই ঘুমিয়ে পড়েন, স্বপ্ন দেখেন। “ভূতের রাজা দিল বর”!! একখানি ম্যাজিক, কিন্তু মোক্ষম লাভ।

‘বারীন ভৌমিকের ব্যারাম’ গল্পটিতেও বারীন ভৌমিক তাঁরি মতন আরেক ক্লেপ্টোম্যানিয়াকের সন্ধান পান ট্রেনের কামরাতে। ‘অনাথবাবুর ভয়’ গল্পে অনাথবাবুর সঙ্গে লেখকের আলাপ ট্রেনের কামরায়। সেখানেও ট্রেনের অনেক যাত্রীর মধ্যে তাঁর বেঞ্চে পাশে বসে থাকা মানুষটির সঙ্গে আলাপ হয়। ‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’ গল্পেও রেল ব্রিজের এক মুখ্য ভূমিকা।

১৯৭১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকাতে প্রথম ফেলুদা কাহিনী প্রকাশিত হয় – ‘সোনার কেল্লা’। সেই গল্পে ট্রেনের ভূমিকা ছিল। কিন্তু ১৯৭৪ সালে সেই কাহিনীর ভিত্তিতে যে চলচ্চিত্র তৈরী করেন সত্যজিৎ তাতে ট্রেন প্রায় একটি চরিত্রই হয়ে ওঠে।

আমাদের সকলের মনে আছে এই সিনেমাতে ট্রেনের কি অসাধারণ ভূমিকা। প্রথম থেকেই ভাবা যাক। যে ট্রেনে করে ডঃ হাজরা মুকুলকে নিয়ে রওয়ানা দেন রাজস্থানে, ঘটনাচক্রে সেই একই ট্রেনে যাত্রা করেন মিঃ বর্মন ওরফে ভবানন্দ ও তাঁর চ্যালা মন্দার বোস। ট্রেনের কামরাতেই আলাপ করে ম্যাজিক দেখিয়ে মুকুলকে তাক লাগান মন্দার বোস। ক্রমশ সেই আলাপ ঘনীভূত হয়।
ফেলুদা ও তোপসেও আবার তুফান মেলে রওয়ানা দেয়। তাদের ট্রেনে ‘যতির আয়েশ’ একটু বেশী মাত্রায়, কারণ কানপুর স্টেশনে ফেলুদা তোপসেকে সন্দেশ খাওয়ার পরামর্শ দেয়, ‘ট্রেন লেট চলছে, দিল্লী পৌঁছতে দেরী আছে”। লালমোহনবাবুর আবির্ভাব ট্রেনেই, কুলির সঙ্গে তর্ক করতে করতে। তারপর সেই উটের পিঠে চড়ে ট্রেন ধরার অসামান্য প্রয়াস। রামদেওরা থেকে জয়সলমীর যাওয়ার পথে ট্রেনের মধ্যে ফেলুদা, জটায়ু, মন্দার বোস আর ডক্টর হাজরার সাংঘাতিক সব কীর্তিকলাপ।
এই ট্রেনদৃশ্য তুলতে গিয়ে অনেক ঝঞ্ঝাট পোয়াতে হয়েছে সত্যজিৎ কে। “মরুপ্রান্তরের বিশাল ঝলমলে আকাশ ট্রেনের মিশকালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যাচ্ছে – এ না হলে জমবে কি করে?” তিনি নিজেই লিখেছেন ‘একেই বলে স্যুটিং’ বইটিতে। স্যুটিং হচ্ছিল “সোনার কেল্লা” ছবির। মাঝে প্রায় বানচাল হতে যাচ্ছিল, তিনি স্মৃতিকথাতে প্রায় আর্তনাদের সুরেই লিখে ফেলেছেন,
“ফেলুর দল উটের পিঠে করে ছুটে গিয়ে ট্রেন থামানোর চেষ্টা করছে, আমার এই সাধের দৃশ্য কি ছবিতে স্থান পাবে না? না এ হতেই পারে না।”
https://www.youtube.com/watch?v=LUCpXPmUrqY
রাত্রে আবার রামদেওরা থেকে ট্রেন ধরার দৃশ্য, যেখানে ফেলুদা মন্দার বোসকে চিনতে পারবে তার আংটি দেখে। তারপর রাতে ট্রেনের কামরাতে মারামারি। প্রাণে বেঁচে মন্দার বোস যে কামরাতে যান, সেখানেই ছিলেন আসল ডঃ হাজরা। পরদিন সকালে আবার ট্রেনের কামরা থেকেই তোপসেকে দেখায় ফেলুদা – “তোপসে দেখ, সোনার কেল্লা।”

“আমার এই সাধের দৃশ্য” – ব্যস। এখানেই ‘আকাশের পাখি’ ধরা দিয়েছেন তাঁর ভক্তকুলের কাছে। ‘সোনার কেল্লা’র সন্ধানে জয়সলমীর ছুটে চলেছে লক্ষ লক্ষ পর্যটক। ‘জাতিস্মর আছে কি নেই, তা জানা নেই’ ‘ভবানন্দ মিথ্যেই পরিশ্রম করলেন’ সবই হয়তো সত্যি। কিন্তু মিটার গেজের ট্রেনে করে আজো পর্যটকরা চলেছে জয়সলমীরে ‘সোনার কেল্লা’র সন্ধানে, ট্রেনের জানলা থেকে তারা অপলকে তাকিয়ে আছে বিশাল মরুপ্রান্তরের দিকে – এর চেয়ে বড় সত্য আর কি হতে পারে? তাঁর মনোভূমিতে রচিত সত্যজিতের সত্যই আসল – কারণ শিল্পমাধ্যমে
“সেই সত্য যা রচিবে তুমি,
ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি
রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।”
তথ্যঋণ –
- একেই বলে শুটিং – সত্যজিৎ রায় – আনন্দ
- https://www.dailyo.in/arts/satyajit-ray-sonar-kella-myths-cinema-train-journeys/story/1/17290.html
- ফেলুদা সমগ্র ১ -২ – সত্যজিৎ রায় – আনন্দ
পরবর্তীকালে এর ওপর ভিত্তি করে একটি ছোট ভিডিও নির্মিত হয়েছিল। আগ্রহীরা নিচের লিংকে ক্লিক করে ভিডিওটি দেখতে পারেন –
অসাধারণ লেখা। খুব ভালো লাগলো পড়ে।
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ!!
LikeLike
Sorry Bhaskar, no more metre gauge train from Jodhpur to Jaisalmer now. All are now BG. That nostalgia is missing now.
LikeLiked by 1 person
ছবিতেই অমরত্ব লাভ করলো। বলে দেখি শতবর্ষে যদি কিছু করা যায়।
LikeLike
দারুণ লেখা
LikeLike
অনেক ধন্যবাদ।
LikeLike