বড়মামা

সুরধুনীর তীরে নদিয়া নগরে নেচে নেচে কে বা যায় রে’ – সম্ভবতঃ বড়মামার কন্ঠে শোনা আমার প্রথম গান। সে সময় আমার বয়স চার পাঁচ। মামাবাড়ীর কীর্তনের তিনি ছিলেন একেবারে মধ্যমণি – আজকের ভাষায় – লীড ভোকালিস্ট। ভোকাল কর্ডের ওপর ভালমতই অত্যাচার করেছেন বড়মামা, জীবনের শেষদিকে শারীরিক কারণে সেরকম অত্যাচার করতে না পেরে বেশ মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে পড়েছিলেন। আর কেউ যদি আহ্বান জানাতেন, কীর্তনের আসরে, তাঁর মন একেবারে রঙের পাখনা মেলে উড়ে যেত।

সব অর্থেই সুকুমার ঘোষ তাঁর ভাইবোনদের ‘দাদা’ ছিলেন – আমার মা এবং অন্যান্য ভাইবোনেরা একেবারে অজ্ঞান ছিলেন। ‘ভোম্বলবাবু’ মোটামুটি ছোট বড় সকলেরই বেশ কাছের মানুষ ছিলেন।

বাঁ হাতে হারমোনিয়ামের বেলো টানতে টানতে – ‘বিন্দা বিপিনে মঙ্গল আরতি’ – পরে ‘মঙ্গল আরতি’ তে ঘাড় বেশ নড়ে যেত, পরের ‘মঙ্গল আরতি’ তে আরো অন্যভাবে, ভঙ্গিটি বেশ মনোগ্রাহী।

তা অনুকরণ করে দেখালে চটে তো যেতেনই না, বরং পকেট থেকে খয়েরী রঙের ‘নস্যি রুমাল’ বার করে ছোট NC নস্যর থেকে দু-টিপ নস্যি নিয়ে আরাম করে নাক মুছে বলতেন – ‘বাঃ বেশ হচ্ছে তো’! হেমেন রায়ের গোয়েন্দা জয়ন্তর নস্যি নেওয়ার শখ ছিল, ভঙ্গি বুঝতে আমাদের সেজন্য অসুবিধে হতনা। মাঝে আবার কদিন দেখি চুরুটের শখও হয়েছিল!

মামাবাড়িতে মঙ্গলবার করে কীর্তন গান হত। সেখানে বড়মামা উচ্চকণ্ঠ। কিন্তু বৃহস্পতিবার যখন রামনাম হত সেখানে তাঁর হাত পা বাঁধা – রামনামে বেশী কাজ দেখাবার সুযোগ নেই। শুধু স্থিতাবস্থা বজায় রেখে পাঠ –

বৈকুণ্ঠালযসংস্থিত রাম /  নিত্যানন্দপদস্থিত রাম / রাম রাম জয রাজা রাম / রাম রাম জয সীতা রাম ||

কিন্তু তারপরে শেষে ছিল –  স্তব!

কনকাম্বর কমলাসনজনকাখিল- ধাম |

সনকাদিকমুনিমানসসদনানঘ ভূম ||

শরণাগতসুরনাযকচিরকামিত কাম |

ধরণীতলতরণ দশরথনন্দন রাম ||

এখানে বড়মামার বেশ গলার কাজ দেখানোর অবকাশ ছিল এবং সেটা তিনি ভালমতোই সুযোগ নিতেন। আমাদের কানে এটাই বসে গেছে। মনে পড়ে ‘রামনাম’ এর সময়েও আটার জন্য অপেক্ষা করতাম।  কিছুদিন আগে অন্য এক জায়গাতে রামনামের পর এই স্তব শুনলাম, বড় সাদামাটা – মন ভরলো বা। ‘কালোয়াতী’ টাই কানে লেগে আছে।

শুধু কীর্তনের আসর নয়,  মামাবাড়ির যে কোন অনুষ্ঠানে তিনি একেবারে আসর জমিয়ে রাখতেন। বড়মামার মধ্যে বেশ একটা সজীব মন ছিল, ফলে বয়োজ্যেষ্ঠরা তো ‘ভোম্বল’ বলতে অজ্ঞান ছিলেনই, কনিষ্ঠরাও তাঁর সঙ্গে ইয়ার্কি, ফাজলামি করতে পারতো! বড়মামা রাগ করাতো দূরের কথা, বেশ প্রাণ খুলে তাদের সঙ্গে যোগ দিতেন।

বড়মামার কাছে পুরনো গল্প শোনাও খুব আকর্ষক ছিল – দিদুর গল্প –

‘একদিন বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকছি, মা বললেন – ভোম্বল দাঁড়াও। কাজের লোককে ডেকে বললেন – ভোম্বলের পায়ে নোংরা, পা টা ভাল করে পেড়ে দাও। সে একটা ন্যাতা নিয়ে এল, আমি এক পায়ে দাঁড়িয়ে রইলাম এক্কা দোক্কা খেলার মত, সে ভাল করে ন্যাতা দিয়ে পা পেড়ে নিল, তবে ঘরে ঢোকার অনুমতি পেলাম। বোঝ কাণ্ড!’

আর একদিন-

‘আমাদের উড়ে ঠাকুর বসে আছে, মা ডাকলো, ‘ঠাকুর কি করছো?’ –‘কিছু করছি না, বসে আছি’। ‘আচ্ছা, ভাল করে হাত ধুয়ে এস।’ ঠাকুর হাত ধুয়ে এল, হুকুম হল, ‘উনুনে কয়লা দাও’! ঠাকুর হতবাক, এদ্দিন জানতো কয়লা দিয়েই তারপরে লোকে হাত ধোয়।’

আমার মায়ের কাছে বড়মামা ভালমতোই মুস্কিল আসান ছিলেন। বেশ উল্টোপাল্টা সময়েও কাজের দায়িত্ব পালনে বিমুখ হতেন না। আমার দিদির বিয়ের পর তত্ত্ব ও জিনিষপত্র নিয়ে আমি ও ছোটমামা গেছি ব্যারাকপুরে। সন্ধে হয়ে রাতের দিকে যাচ্ছে,  প্রায় ফিরে আসার সময়। হঠাৎ বড়মামা ঢুকছে, হাতে একটা বড় প্যাকেট! কি হল? না, মশারীটাই নাকি ফেলে আসা হয়েছে! তা, বোন বলেছে – যদি খুব কষ্ট না হয় —!!

আর একবার, তখন যাদবপুরে পড়ি। বাবার এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে তাদের পোষা কুকুরে আমাকে হাতে কামড়ে দিয়েছিল। বেশী কিছু হয়নি, একটা ছোটখাটো ইনজেকশন নিতে হয়েছিল। রাত প্রায় সাড়ে নটার সময় দেখি, ঠং করে গেট খোলার আওয়াজ। বড়মামা ঢুকছে – ‘কিরে কি হল? শুনে বেশ চিন্তায় আছি” ঘন্টা খানেক থেকে আবার বাড়ি ফেরা। সেই আটের দশকের রাজপুর কিন্তু আজকের রাজপুরের মত এত সহজগম্য ছিল না, এতেই বোঝা যাবে তাঁর কিরকম টান ছিল ।

আমার বিয়ের পর মা বড়মামাকে দায়িত্ব দিলেন তাঁর ছেলে আর বৌকে ট্যাক্সি করে আত্মীয়দের বাড়ি বাড়ি ঘুরে দেখাতে হবে। বড়মামাও খুশি। চলো, মনোহরপুকুর দিয়ে শুরু করে লেকের বাড়ী ঘুরে তারপরে দিদির বাড়িতে আমাদের গচ্ছিত করে বড়মামার ছুটি। আমি ও আমার স্ত্রী আপশোষ করছিলাম, ‘ইস! এবারেই শেষ! পরের বার থেকে নিজেদেরই ঘোরাঘুরি করতে হবে।

২০০৬ শোনা গেল, আমার দাদু শ্রী সুবোধ চন্দ্র ঘোষের শতবার্ষিকী হবে। বড়মামা মূল উদ্যোক্তা। একটি অনুষ্ঠান আমাদের বাড়িতে হবে। আমার মাতৃদেবীর আজ্ঞা হল, যে সময় আমরা ব্যাঙ্গালোর থেকে কলকাতায় আসবো সেই সময়ই হবে। তা আমরা এলুম, অনুষথানের বেশ তোড়জোড় ও হচ্ছে। বড়মামা আবদার ধরে বসলেন, ‘হ্যাঁরে, এখানে তে বেশ বড় জায়গা – একটু বেশ বড় জায়গা, একটু মাইকের ব্যবস্থা হলে ভাল হত তো!” তা সে হল। পরে অবশ্য সেই মাইকে কীর্তন শুনে আমাদের পাড়ার লোকজন এসে জিজ্ঞেস করেছিল – “বাঃ, তোদের বাড়িতে বেশ ভালো নামগান হল তো!”

২০০৮ সালে বড়মামা, মা ও বড়মামীকে নিয়ে আমার ব্যাঙ্গালোরের বাড়িতে বেশ কদিন ছিল। বেশ আনন্দে কেটেছিল কদিন। বেশ হাল্কা কীর্তনও হত রোজ সকালে আমাদের বাড়িতে। বাড়িতে বেশ ভক্তি, ভক্তি ভাব এসে গিয়েছিল।

২০১১ সালে বড়মামার বিবাহের সুবর্ণ জয়ন্তী হল। আমি অবশ্য যেতে পারিনি, সবার কাছে শুনলাম খুবই হৈ চৈ হয়েছে।


গতবারে জানুয়ারি মাসেও চারদিনের জন্যে কলকাতা গিয়ে দেখা করেছিলাম। বাপ্পু আমাকে নিয়ে গেল, বেশ কিছুক্ষণ বসে আড্ডা হল, খাওয়া দাওয়া করে ফেরত গেলাম।

মাঝে মাঝেই ফোনে কথা হত। এইবার  কদিন আগে অসুস্থ জেনে ফোন করলাম। একটা ব্যাপারে একটু আলোচনাও করেছিলাম।

বড়মামা ছিল একেবারে আপাদমস্তক উত্তমভক্ত। বেশ তরুণ বয়সে সিনেমা দেখতে দেখতে ‘গুরু, গুরু’ বলে আওয়াজও বার হয়ে যেত, মায়ের কাছে এমন কথা শুনেছি।  আমার একটা ব্যাপারে বেশ কৌতূহল ছিল – ১৯৫৫ সালে যখন ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পায়, একই বছরে প্রায় একই সময়ে মুক্তি পায় ‘শাপমোচন’! একজন উত্তমভক্তের কাছে যার বয়স তখন  ২৫-২৬, তার বা তাদের কাছে এই দুটি বিপরীত মেরুর ছবির কিরকম আকর্ষণ ছিল। শুরুও হয়েছিল ইন্টারভিউ, খানিকক্ষণ পরেই বড়মামা একটু ক্লান্ত হয়ে পড়লো। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই কবে আসছিস আবার? এলে কথা হবে।” আমার তখন যাওয়া ঠিকও হয়ে গেছে, জানালাম। বললো – “ওহ, তাহলে তো ভালই। বিস্তারিত কথা হবে!”

কি আর করা যাবে?  বাকি রয়ে গেল। সেই গানের মত – ‘কথায় কথায় যে রাত হয়ে যায়, কি কথা রাখলে বাকি’!   

ভাল থেক বড়মামা! যেখানেই আছ, যাদের সঙ্গে, –  ছোট বড় সব্বাইকে নিয়ে! ঠিক যেমন এখানে ছিলে।

ছবিগুলি শ্রী অরবিন্দ ঘোষ, পার্থসারথি ঘোষ, দেবদত্ত মিত্র দের
সৌজন্যে প্রাপ্ত

2 thoughts on “বড়মামা

Leave a comment