শুরু হয়েছিল ৩০শে জানুয়ারি, কিন্তু আমি গিয়েছিলাম দুদিন – ১লা ও ২রা ফেব্রুয়ারি।
প্রথম দিনটি ছিল খুব ছোট করে মিটিং আর সমস্ত প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা। তবে এখানে বেশ কিছুদিন বাদে আমার ও আমার স্ত্রী, দুজনেরই খুব প্রিয় বন্ধুর সাথে দেখা হল। বেশ কিছুক্ষণ আড্ডাও হল। আমার বন্ধু সোমনাথ আর স্ত্রীর বন্ধু সুপর্ণা!

২রা ফেব্রুয়ারির জন্য আমরা প্রায় বিগত তিনমাস ধরে পরিকল্পনা করেছিলাম। আমরা মানে ‘অবসর’ পত্রিকার লেখক লেখিকারা ও আমাদের অন্যান্য প্রিয়জনেরা। দেশে বিদেশে থাকি সবাই, বিগত দু – তিন বছর ধরে বেশ মেলাতে বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা হয়। প্রাণ খুলে আলোচনা, যাদের বই পড়ি, মেলা প্রাঙ্গণে তাঁদের স্বাক্ষরিত বই পাওয়া বা তাঁদের সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্যও নিজেদের কথা জানাতে পারা – এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। আবার ‘অবসর’ পত্রিকার বিভিন্ন লেখকরা ছড়িয়ে আছেন ভারতবর্ষ ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। মেল এবং ফোনে বিভিন্ন সময় বিস্তারিত আলোচনা হয়, কিন্তু মুখোমুখি দেখা করার বা কথা বলার আনন্দ আলাদা।
গতবারের এই আসরে আমরা বেশ সমস্যায় পড়েছিলাম। আমাদের আসরের মধ্যমণি শ্রী সুজন দাশগুপ্ত ট্র্যাফিকের জান জটে আটকে পড়ায় দেরী হয়ে গিয়েছিল। এবারে তাই ২রা সকাল থেকেই ফোন করে সুজনদাকে উত্যক্ত করে রেখেছিলাম। হাজার হোক, লোকে বলে আমিই নাকি আয়োজক!
বন্ধুবর অমিতাভ প্রামাণিকের ভাষায় –
“করুণাময়ীর করুণা হতে গাড়ি পার্ক করে ভেতরে ঢুকছি, মনে পড়ছে তিনটেয় কাফে টেবলে যেতে হবে Bhaskar Bose আয়োজিত ধর্মমহাসভায় Sujan DasGupta দা ও বৌদি, Dilip Das দা প্রমুখের সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে। সুজনদার সঙ্গে গত বছর দেখা হয়েছিল, দিলীপদার সঙ্গে এ বারই প্রথম হবে!”
শেখর বসুও লিখেছেন,
“শুনেছি আজ বেলা তিনটের সময় বিশিষ্ট কবি,লেখক,সাহিত্যানুরাগীদের মস্ত এক জমায়েত হবে দ্য কাফে টেবল-এর ২০৫ নম্বর স্টলের সামনে। ইচ্ছে আছে ওখানে একটু উঁকিঝুঁকি মারার পরেই বইমেলায় ঘুরতে যাব”
সুতরাং! তবে এবারে কপাল সুপ্রসন্ন, পৌনে তিনটের সময় কাফে টেবিলের ২০৫ নং স্টলে পৌঁছে দেখি সুজনদা এবং বৌদি দুজনেই এসে গেছেন। সুজনদা গম্ভীর হয়ে চেয়ারে বসে একটার পর একটা বই সই করে যাচ্ছেন বেশ সুবোধ ছাত্রের মত! মনে হচ্ছে আড্ডা দেবার বেশ ইচ্ছে, – কিন্তু সাফল্যের দায়। রইল সেই ছবি, সইরত সুজনদার ও সইসহ বইয়ের।

সুজনদা নিজেই বলেছেন বাংলা না লিখে লিখে হাতের লেখা নাকি খারাপ হয়ে গেছে, দেখে কিন্তু মোটেই তা মনে হচ্ছে না। রহস্য টা কি?
নয়ের দশকে প্রিয় অভিনেতা যশপাল ভাট্টি একটি শো করতেন তাতে বিদায় নেবার আগে বলতেন,
‘আপকা শলা হামে জরুর লিখ ভেজিয়ে গা, হামারা হোসলা বাড় যায়েগা, আপকি হ্যান্ডরাইটিং ইম্প্রুভ হো যায়গী’
সম্ভবত সুজনদার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে! দিতে দিতে সই একেবারে – লাগসই, মানানসই!
এতক্ষণে এসে গেছেন শেখরবাবুও, এবারে সস্ত্রীক। আগে একদিন বাড়িতে গিয়ে আলাপ হয়ে গেছিল বৌদির সঙ্গেও। শুরু হল জমজমাট আড্ডা। আমি আর অভিষেক, অনুরাগী ও প্রকাশক, ঠিক করলাম শেখরবাবুকে নিয়ে আমাদের একটা ছবি তুলতে হবে, ঠিক স্টলের সামনেই দাঁড়িয়ে।

‘দুরন্ত ঘূর্ণির এই লেগেছে পাক / এই দুনিয়া ঘোরে বনবন ছন্দে ছন্দে’
ইতিমধ্যেই মাইশোর পাক নিয়ে প্রায় নাচতে নাচতে হাজির হয়ে গেছেন অমিতাভ প্রামাণিক!

আমি যদি ‘আয়োজক’ হই, তবে মুখ্য প্রচারক নিঃসন্দেহে – অমিতাভ। ‘একেনবাবু’ প্রচারের মন্ত্র –
Buy One (একেনবাবুর বই) –
Get Three free (মাইসোর পাক, লেখকের সাথে সেলফি, প্রচারকের সাথে সেলফি)!
এরপরেই এসে গেল কেয়া, সপুত্র! ২০১৪ থেকে আলাপ। মেল ও ফোনে বহু কথা হলেও দেখা হল এই প্রথমবার। গতবার দেখা হতে হতে মিস! আমার স্ত্রী বেশ হতচকিত, ‘সে কি? এদ্দিনেও দেখা হয়নি?” এটাই বইমেলার বড় পাওনা। এবার এল দিলীপ দাস। দিলীপের কথামতই আমি কারুর সংগে পরিচয় করাইনি, দিলীপ একটু অবাক করাতে চেয়েছিল সব্বাইকে। এসে অমিতাভকে কন্নড় বলে বেশ বিব্রত করার চেষ্টা করছিল, আমি পরিচয় করাতে খুব খুশী। কেয়া, সুজনদা, শমীতা বৌদি, শেখরবাবু, অমিতাভ, – সব্বার সঙ্গেই ওর প্রথম দেখা। মজার ব্যাপার হল দিলীপ যে ব্যাঙ্গালোরে আমার অনেক দিনের পূর্ব পরিচিত সেটা জেনে ওরাও অবাক। এর মধ্যে এসে গেল মণিমেখলা, যিনি মহিষাদলে আমার শাশুড়ির গ্রামের মেয়ে। আমার স্ত্রীর সঙ্গে পরিচিত হয়ে শুরু হল গভীর আলাপচারিতা।

এরপরে এক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটলো। একটু বুঝিয়ে বলছি। সকলেই জানেন, এখন মুদ্রিত বাংলা পত্রিকার সঙ্গে বেড়ে চলেছে বাংলা ওয়েব ম্যাগাজিন। বাংলা ভাষার প্রচারে তাদের ভূমিকা খুব উল্লেখযোগ্য। কিন্তু প্রথম দিকের দুই বাংলা ম্যাগাজিন হল পরবাস ও অবসর। একেবারে নয়ের দশকের শেষের দিকে প্রথমে পরবাস আর পরপরই অবসর – আত্মপ্রকাশ করে। পরবাস পত্রিকার কর্ণধার – শ্রী সমীর ভট্টাচার্য আর অবসর পত্রিকার – শ্রী সুজন দাশগুপ্ত ও শ্রী সুমিত রায়। সুজনদা ও সমীরবাবু, দুজনেই থাকেন মার্কিন মুলুকে। বেশ কাছাকাছিই। কিন্তু তাঁদের দেখা হয়নি কোনদিন। এবারে সেটা হল। কে কি মনে করেন জানিনা, আমরা উৎসাহীরা মনে করছি এটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। আমদের আয়োজনেই হয়েছে বলে কিঞ্চিৎ শ্লাঘা না অনুভব করে পারছিনা। এঁদের একজন, সুজনদা, আমার কলেজের (JU Engg,) অন্যজন স্কুলের (হরিনাভি ডিভি এ এস)। সত্যি বড় মধুর এ পাওয়া।

এরমধ্যে এসে গেছেন আমাদের ‘অবসর’ লেখকমণ্ডলীর আরো কজন লেখক ও অনুরাগীবৃন্দ –
শিবাংশু দা, সোমেন বাবু, প্রসূন ও স্নেহাশীষ (সঞ্জয় সেনগুপ্ত)

সবশেষে এলেন দেবযানীদি ও ঈশানী। ঈশানী অনেককেই প্রায় ৩৫ – ৪০ মিনিট ধরে বলে যাচ্ছে – ‘পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আসছি।’ আমি প্রায় বেরোব বেরোব করে ব্যস্ত হচ্ছি, পরের দিন ভোরেও ব্যাঙ্গালোর রওয়ানা হতে হবে। আমি ও ঈশানী ব্যাঙ্গালোরে থাকলেও দেখা হয়ই না, বইমেলাতেই দেখা আর আড্ডা। আমরা ও দেবযানীদি কিছুক্ষণ গল্প করে বেরোব বেরোব করছি, এসে হাজির। ওর সদ্য প্রকাশিত বই নিয়েও কিছু কথা হল।

অনেকে বলেন আজকাল নাকি বইমেলাতে হুজ্জুত বেশী। হবে হয়তো। তবে এটাকে উৎসাহ – উদ্দীপনা হিসেবেও দেখা যেতে পারে। সারা বছর আমরা কিন্তু এই দিকে তাকিয়ে থাকি। শীতের কলকাতা বরাবরই বড় আকর্ষণের, সেই সঙ্গে বইমেলাও। কত বন্ধুরা আসেন,যাঁদের সঙ্গে সারা বছর ফোনে যোগাযোগ থাকে, মেলেও কিন্তু দেখা মেলে – এই বইমেলাতেই।
পরিশেষে প্রিয় লেখক শেখর বসুর ভাষায় বলি –
“বেঁচে থাক বইমেলা ! পৃথিবীর নানা প্রান্তের গুণী মানুষদের কাছে পাওয়া যায়।”
আসছে বছর আবার হবে!
লেখা, ছবি – দুয়ে মিলে দুর্দান্ত ভাস্করদা!
বেঁচে থাক বইমেলা। দূরকে কাছে আনুক। আসছে বছর আবার সকলের দেখা হোক।
LikeLiked by 2 people
অনেক ধন্যবাদ কেয়া, বিশেষত ছবিগুলোর জন্য।
LikeLike
চমৎকার। এত গুণীজনের মধ্যে আমি যে ঠাঁই পেয়েছি, মনে রেখেছেন সেটাই আমার কাছে বিশাল ব্যাপার। আন্তরিক ধন্যবাদ
LikeLike
জীতা রহো…
LikeLike
অনেক ধন্যবাদ দাদা!!
LikeLike
চমৎকার বর্ণনা। কলকাতার কাছাকাছি থেকেও আসতে পারলাম না, দুঃখ রইল।
LikeLiked by 1 person
খুব, খুব আশা করেছিলাম। পরের বার চেষ্টা কর প্লীজ!
LikeLike
কী সুন্দর লেখা! লেখা না বলে দলিলচিত্র বলা ভালো। এ বছরের ২ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ছবিতে,লেখায় জীবন্ত করে রেখেছে ভাস্কর। সেদিন যাঁদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ; এবং যাঁদের সঙ্গে দ্বিতীয়, তৃতীয়,চতুর্থ সাক্ষাৎ–সবাই মনে রাখার মতো মানুষ।
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ শেখরবাবু।
সত্যিই খুব উপভোগ্য ছিল এবারের সাক্ষাৎকার।
LikeLike
Khub bhalo laglo pore. Anekdin jaoa hoi ni. Lekha ar photos Khub sundor.
LikeLiked by 1 person
আমারও খুব ভাল লাগলো তোমার মন্তব্য
LikeLike
কী আশ্চর্য! কেন জানি মনে হচ্ছে আমি এটা আগে পড়িনি। চমৎকার লিখেছ… একটা স্মরণীয় দিন।
LikeLiked by 1 person
আরে নান, না! এটা পড়েছ তুমি। লিংকটা ফেসবুকে শেয়ার করেছিলাম, পড়ে মন্তব্যও করেছিলে।
LikeLike