কিছু কিছু লেখা আমাদের কৈশোরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আছে প্রচুর গল্প উপন্যাস, আর আছে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিনেমা সমালোচনা। ১৯৭৬ সাল থেকে ‘দেশ’ পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত এই সমালোচনাগুলি ছিল আমাদের তখন অবশ্যপাঠ্য। সেই নিয়ে বেশ তর্কাতর্কিও হত। তাঁর সমর্থক ও সমালোচক, দুয়েরই ঘাটতি ছিল না।
এই লেখাগুলিকে একত্র করে দীপ প্রকাশন প্রকাশ করেছেন – ‘সেই সব লেখা’, যা পড়তে গিয়ে বারে বারে আমার মনে পড়ে যায় ‘সেই সব দিন’। বন্ধু, সাহিত্যিক সৌরভ মুখোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন বইটির কথা। এবারে সংগ্রহ করে ফেলা গেল।

কি আশ্চর্য! লেখাগুলো পড়তে গিয়ে দেখছি অনেক লেখাই বেশ মনে আছে। প্রায় চল্লিশ বছর আগের লেখা ফিল্ম রিভিউ, এক আধটা নয়, বেশ অনেকগুলি, তাও যদি পাঠকের মনে থেকে যায় তাহলে ধরতেই হবে লেখাগুলি বেশ গভীরভাবে দাগ কেটেছে।
তা সত্যিই। মুগ্ধ করেছিল তাঁর প্রাঞ্জল লেখনশৈলী। সব লেখাতে তাঁর মতামত নিজের সঙ্গে মেলেনি। কিন্তু লেখাগুলি বেশ মনের কাছাকাছি ছিল। ওঁর বাংলা থেকে বেশ কিছু শেখারও ছিল। ‘জীবন যে রকম’ ছবির সমালোচনা (এই বইতে নেই) করতে গিয়ে ‘কেয়া চক্রবর্তীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে’ দেখে ব্যথিত হয়ে তিনি উদ্দেশে আর উদ্দেশ্যের তফাৎ নিয়ে লিখেছিলেন। সেটা আমাকে শিখতে সাহায্য করেছিল।
আবার ‘শেষরক্ষা’ ছবির আলোচনাতে উনি এক শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছিলেন, ‘আশ্চর্য, অফুরান রবীন্দ্রনাথ’! (১৩৫ পৃঃ)
শব্দবন্ধটি আমার এতই ভাল লাগে যে, পরবর্তী কালে একটি ছোট্ট লেখাতে জুড়ে দিই –
‘কমলহীরের আলোয় দ্যুতিময় এই বাক্যটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেই আশ্চর্য ও অফুরান রবীন্দ্রনাথকে।’
‘শেষরক্ষা’ ছবিটির সমালোচনাকালীন তিনি ট্রানস্লেশন ও সিনেম্যাটিক ট্রান্সক্রিয়েশন কথাগুলো এনে আমাদের নতুন ভাবনার খোরাক দিয়েছিলেন। যেমন আবার ‘বাবুমশাই’ ছায়াছবির আলোচনাকালে (১১৯ পৃঃ) চূড়ান্ত এনাক্রনিজমের (anachronism) লক্ষণ দেখিয়েছেন তা সিনেমা দেখার সময় আমাদের চোখে পড়েনি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে এই ছবির একমাত্র আকর্ষণ তা অবশ্য আমরাও মানি। এইভাবে আমাদের কিশোর মনে তিনি একটি সিনেমা মনস্কতা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।
অন্য উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যেতে পারে পীযূষ বসুর ‘সিস্টার’। ছবিটি মন্দ লাগেনি, বিশেষতঃ সলিল চৌধুরীর সঙ্গীত পরিচালনাতে গানগুলি। কিন্তু পরে তাঁর সমালোচনা (১৩৬ পৃঃ) পড়ে আবার মাথা চুলকোতে শুরু করলাম। যাঃ বাবা! এইসব দুর্বলতাগুলো তো সিনেমা দেখার সময়েই চোখে পড়ার কথা।
তবে আবার অনেক সময় একমত হতাম না। উদাহরণস্বরূপ – ‘চারমূর্তি’ ছবির সমালোচনা (২০৫ পৃঃ)। পড়ার আগেই ছবিটি দেখেছি, মোটামুটি লেগেছে। টেনিদা আমাদের অত্যন্ত প্রিয়, সেজন্য প্রত্যাশা ছিল খুব বেশী। চিন্ময় রায়কে ঠিক মেনে নিতে পারিনি। প্যালা ও হাবুল, তথৈবচ, ক্যাবলা একটু পদের। তবে রবি ঘোষ, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সন্তোষ দত্ত খুবই ভাল। সমালোচনা পড়ে অবাক! উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন রঞ্জন। এই ছবি দেখে নাকি টেনিদা খুশি হয়ে বলতো –‘ডি লা গ্রান্ডি’! আদৌ না। খুবই সংক্ষিপ্ত সমালোচনা, পরতে পরতে উচ্ছ্বাস। অবিশ্বাস্য!
তাঁর কিছু ভবিষ্যৎবাণীও একেবারে অমোঘ। ‘প্রতিশ্রুতি’ (১৪৭ পৃঃ) ছবিটির সমালোচনা কালে দায়িত্বশীল, স্নেহপ্রবণ, বড় ভাই এর চরিত্রে রূপদানকারী অভিনেতা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য –
‘রঞ্জিত মল্লিক অনেকদিন বাদে তাঁর ক্ষেত্র খুঁজে পেলেন।’
পরের তিন দশক ধরে তাঁর এই ক্ষেত্রে বিচরণ দেখে ভবিষ্যতদ্রষ্টার দূরদৃষ্টির প্রশংসা না করে পারা যায় না।
রঞ্জন সম্পর্কে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল, – তিনি সত্যজিতের পুরো অন্ধ ভক্ত। কখনোই কিছু ত্রুটি দেখতে পান না। আমি নিজে মনে করি এই অভিযোগের অনেকটাই সত্যি। তাঁর সত্যজিতের সাক্ষাৎকারগুলি কেমন যেন একটু একপেশে। শুধু তাই নয়, যে কোন সিনেমার টেকনিক্যাল আলোচনাতে সর্বত্র উনি সত্যজিতের প্রসঙ্গ আনতেন। আমার মত ঘোর সত্যজিৎ ভক্তের কাছেও এটা বেশ দৃষ্টিকটু লাগতো, ঋত্বিক বা মৃণাল অনুরাগীরা অত্যন্ত খাপ্পা ছিল।
এই দুর্বলতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ – ‘গণশত্রু’র সমালোচনা (২৭৪ পৃঃ) । এই ছবিটি সম্পর্কে অনেক সত্যজিৎ অনুরাগীও বেশ নিঃস্পৃহ। কিন্তু রঞ্জন উচ্ছ্বসিত – ‘একেবারে নতুন সত্যজিৎ’! ১৯৯০ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশকালেই পড়েছিলাম সমালোচনাটি, সিনেমা দেখে ভীষণ হতাশ হয়েছিলাম। সমালোচনার একেবারে অন্তিমপর্বে এসে তাঁর যেন কিছুটা বোধোদয় হয়,
”ইবসেন এর নাটকে কেন্দ্রীয় চরিত্রের অন্তিম নিঃসঙ্গতার যে ট্র্যাজিক মাহাত্ম্য, তার চেয়ে সত্যজিৎ ডাঃ গুপ্তের স্লোগানধর্মী বিজয়কে বড় মনে করলেন কেন?” এটাই তো সবচেয়ে বড় বিচ্যুতি। কিন্তু রঞ্জন যেন এড়িয়ে গেলেন।
তবে এই বইটি বাংলা সিনেমার সঙ্গে জড়িত সকলেরই অবশ্য পাঠ্য। বেশ কিছু আলোচনাতে অনেক দিক নির্দেশ আছে। তরুণ মজুমদার, সত্যজিতের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বেশ নতুন কিছু কথা উঠে এসেছে। পূর্ণেন্দু পত্রী, অপর্ণা বা মাধবীর উপর লেখাগুলিতেও আলোর ঝলক।
‘দত্তা’ ছবির আলোচনা ও সেই সময়কার চিঠিপত্রের আদানপ্রদান বাংলা ছবির এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
দীপ প্রকাশনকে অনেক ধন্যবাদ, এমন একটি বই প্রকাশ করার জন্য। মুদ্রণ ও বাঁধাই চমৎকার, প্রচ্ছদও সুন্দর।
তবে ফিল্মোৎসবের লেখাগুলি পড়তে গিয়ে সেই সময়কার ছবিগুলোর কথা বারে বারে মনে পড়ছিল। কোনরকমে অনুমতি নিয়ে যদি এই তিনটি লেখাকে আলাদা করে ছবিগুলি লাগিয়ে পরবর্তী সংস্করণে প্রকাশ করা যায়, তা খুবই আকর্ষণীয় হবে।
Bhalo laglo lekha
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ সোনু।
LikeLike
তোমার আলোচনাটি ভালো লাগলো যেমন তোমার সব লেখাই ভালো লাগে, এখানেই হোক বা “অবসর”-এ। অবশ্য পক্ষপাতিত্বের দোষ কেউ কেউ দিতে পারে কারণ আমিও যাদব যদিও তোমার তুলনায় প্রাগৈতিহাসিক যুগের (1957)😊। কিন্তু যেহেতু আমি রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় লোকটিকে মানুষ বা লেখক কোন হিসেবেই পছন্দ করতে পারলাম না, ওর কোন বইএর কথা শুনলেই আমার একটা allergic প্রতিক্রিয়া হয়। কিন্ত তুমি চালিয়ে যাও, অশীতিপর বৃদ্ধের কথায় কান দিও না। তোমার আরও লেখা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
LikeLiked by 1 person
দীপকবাবু,
মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। আসলে ওঁকে ব্যাক্তি হিসেবে হয়তো আমিও পছন্দ করি না, কিন্তু এককালে ওঁর কিছু লেখা আমাকে সাহাজ্য করেছে, ভাবিয়েছে। সেটারই স্বীকৃতি দিতে চেয়েছি।
LikeLike
রঞ্জনবাবুর লেখা কিছু চিত্র সমালোচনা পড়েছি। একটা বয়সে চেনা ভাষায় ছাপা যে কোনো অক্ষরই পড়তাম , তা সে তাকে চড়ানো খবরের কাগজ হলেও।
কিছু লেখাকে তাৎক্ষণিক ভাবে অপরিণত বা জল ঢালা মনে হত।
সবার সিনেমা দেখা এক হবে, এমন কোনও আইন নেই ঠিকই , কিন্তু তা হলেও এই ক্ষেত্রে একটা ন্যূনতম কিছু থাকার কথা । সে অভাববোধটা থেকেই যেত।
LikeLike
প্রসূন,
ঠিক কথা। শুধু অভাববোধ নয়, নিরপেক্ষতারও সমস্যা ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটা সময় ফিল্ম সম্পর্কে আমাকে বেশ আগ্রহী করে তুলেছিল এই লেখাগুলি। সেটার কথা মনে রেখেই এই স্বীকৃতি।
LikeLike