প্রস্তাবনা–
‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’ – কথাটা খুবই প্রাণিত করে। বাস্তবজীবনে কিন্তু এই একলা চলা সব সময় সম্ভব হয় না। আর সৌভাগ্য থাকলে, ‘জানি বন্ধু জানি তোমার আছে তো হাতখানি’ এই গানটিই বেশী উপভোগ্য হতে পারে। শিল্পজগতে এইরকম মিলিত কাজকর্ম আমরা অনেক দেখেছি, দেখেছি বিভিন্ন জুটিকে বা তিন বা আরো বেশী শিল্পীর সম্মিলিত অবদানকে কালজয়ী হতে। হিন্দী ছবির সেই জনপ্রিয় গানটির মতই এই জুটিরা আক্ষরিক অর্থেই বলতে পারেন – ‘হম ও হ্যয় যো দো অর দো, পাঁচ বনা দে’!!
পথের পাঁচালির কথাই যদি ধরি – সত্যজিতের সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছিলেন আলোকচিত্রী সুব্রত মিত্র ও শিল্পস্রষ্টা বংশী চন্দ্রগুপ্ত। সলিল চৌধুরীর কালজয়ী গানগুলির পেছনে আছে ভগবানকন্ঠী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অবদান। শম্ভু মিত্রর সঙ্গে ছিলেন আলোকসজ্জাতে তাপস সেন, উৎপল দত্তর সঙ্গে ছিলেন খালেদ চৌধুরী। হিন্দিতে দেখেছি, এরকমই জুড়ি গীতিকার গুলজার আর সুরকার রাহুলদেব বর্মণের। ঠিকই, এঁরা সকলেই নিজস্ব প্রতিভাতেই উজ্জ্বল, তাহলেও বলবো এক সার্থক জুড়ির অনির্বচনীয় মেলবন্ধন জন্ম দিতে পারে অবিস্মরণীয় সব সৃষ্টির। এমন সব সৃষ্টির যা পরের প্রজন্মদেরও অনুপ্রাণিত করতে পারে এরকম ‘যুগলবন্দী’ সৃষ্টি করার।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে অলঙ্করণের একটা ভূমিকা থাকে। সার্থক অলংকরণ পাঠকের কাছে তাকে জনপ্রিয় করতে সাহায্য করে। কমিকসের জনপ্রিয়তা সর্বজনবিদিত। বিদেশী সাহিত্যেও দেখা যাবে জনপ্রিয় লেখকদের লেখা প্রকাশনার সঙ্গে থাকত যুতসই ছবি। শার্লক হোমসের সেই বিখ্যাত পাইপওলা ছবি দেখে আমরা মুহূর্তের মধ্যেই তাঁকে মনে নিতে পারি। এরকুল পোয়ারোর গোঁফজোড়া একই রকম জনপ্রিয় – অলঙ্করণের গুণেই।

বাংলা সাহিত্যে এই অলঙ্করণের ধারা খুব উঁচুমানের। সহজপাঠের লেখায় রবিঠাকুর, রেখায় নন্দলাল বসু। কিন্তু তাঁদেরও ভুল ধরে দিয়েছিল একটি অল্পবয়সী ছেলে, নাম – অভীককুমার চৌধুরী। মজার সে ঘটনাটির কথা তুলে ধরার লোভ সামলানো যাচ্ছেনা।
১৯৭৫ সালের শারদীয়া আনন্দমেলাতে প্রকাশিত তথ্য থেকে এই কথা জানা যায়। সহজপাঠের বিখ্যাত কবিতাতে রান্নাঘরের চালে তিনটে শালিক ঝগড়া করার কথা আছে। কিন্তু ছবি দেখে কি বোঝা যাচ্ছে? পরিষ্কার দুটি শালিক। চিঠি লিখে শ্রীমান অভীক সে কথা জানালেন শিল্পাচার্য নন্দলালকে। উদার শিল্পাচার্য নির্দ্বিধায় মেনে নিলেন ত্রুটির কথা। উত্তরে জানালেন শিল্পে এরকম হিসেবের গরমিল হয়েই থাকে, ঘুষ হিসাবে পাঠালেন নিজের আঁকা একটি ছবি। আর অবশ্যই আসতে আহ্বান করলেন শান্তিনিকেতনে – যা নাকি সত্যিই এক ‘উলটো রাজার দেশ’।

বাংলা সাহিত্যে এরকম কিছু জুটির কথা আমরা আলোচনা করছি। এই জুটিদের একটাই তফাৎ,- উপরে উল্লিখিত ঐ বিখ্যাত জুটিগুলির মত তাঁরা এতটা প্রচারিত নন। তাঁদের কথা অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে, ‘কালো রাত্রির খামে’! আমাদের এই প্রতিবেদন তাঁদের সেই অলৌকিক মেলবন্ধনকে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ।
প্রথম জুড়ি
প্রথমেই আসছি পরশুরাম ও যতীন সেন মশাইয়ের কথায়। প্রথম আবির্ভাব ১৯২২ সালে। “ভারতবর্ষ” পত্রিকায় ‘শ্রীপরশুরাম’ বিরচিত ও ‘শ্রীনারদ’ বিচিত্রিত “শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড” গল্পটি প্রকাশিত হয়।
লক্ষ করলে দেখা যাবে দুই রচয়িতাকেই সমান সম্মান দেওয়া হল। দুজনেই হাজির ছদ্মনামে। পরবর্তী কালে অবশ্য যতীন্দ্রকুমার সেন স্বনামেই আবির্ভূত হন। এই জুটিকে আমরা পথিকৃতের সম্মান দিতে চাই, কারণ তাঁরাই বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক জুড়িদার। অবশ্য তাঁদের জন্য আছে স্বয়ং রবিঠাকুরের শংসাপত্র।
১৩৩২ সালে ‘প্রবাসী’তে এই “গড্ডলিকা” পাঠ করে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমালোচনা প্রসঙ্গে লিখেছিলেন –
“লেখার দিক থেকে বইখানি আমার কাছে বিস্ময়কর, ইহাতে আরো বিস্ময়ের বিষয় আছে সে যতীন্দ্রকুমার সেনের চিত্র। লেখনীর সাথে তুলিকার কী চমৎকার জোড় মিলিয়াছে, লেখার ধারা রেখার ধারা সমান তালে চলে, কেহ কারোর চেয়ে খাটো নহে। চরিত্রগুলো ডাহিনে বামে এমন করিয়া ধরা পড়িয়াছে যে, তাহাদের আর পলাইবার ফাঁক নাহি”
এখানেই থামলেন না – আবার আবদারও রেখে গেলেন,
“ভূষন্ডীর মাঠে একদা যখন আমার গতি হইবে তখন প্রেতদের সাথে আমার কিভাবে বোঝাপড়া ঘটিবে পরশুরামের উপর তাহার রিপোর্টের ভার রহিল কিন্তু যতীন্দ্রকুমারের কাছে দরবার এই যে আমার প্রেতশরীরের প্রতিরূপটির প্রতি মসীলেপন সম্বন্ধে করুণ ব্যবহার করবেন।” – ১
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র আনুষ্ঠানিকভাবে বেঙ্গল কেমিক্যালসের প্রতিষ্ঠা করেন (পুরোনাম – ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস’) ১২ই এপ্রিল, ১৯০১ সালে। যতীন সেন ছিলেন এই কারখানারই কর্মী। এই কারখানার বিজ্ঞাপনের ছবি আঁকা হত তাঁরই হাতে। ১৯০৩ সালে রাজশেখরও সেখানে যোগ দিলেন, তখনই এই ‘চমৎকার জোড়’ এর গোড়াপত্তন। ১৪ নম্বর পার্শিবাগান লেনের সেই বিখ্যাত আড্ডার এক স্তম্ভ ছিলেন যতীন্দ্রকুমার। তাঁর স্বহস্তে রচিত চা ছিল এই আড্ডার এক বিশেষ আকর্ষণ। তখন বিজ্ঞাপনের ভাষ্য লিখতেন তিনি, আঁকতেন যতীন্দ্রকুমার। বোঝাই যাচ্ছে বিজ্ঞাপনের জগতের সঙ্গে বাংলা শিল্প সাহিত্যের সম্পর্ক বেশ নিবিড়।
পরশুরামের নিজেরও আঁকার হাত মন্দ ছিল না, প্রথম গল্পে দেখি তিনি যতীন্দ্রকুমারকে নির্দেশ দিচ্ছেন,

প্রথম গল্প থেকেই ছবি নিয়ে দেখা যাক।

এই ছবিতে আছেন দাঁড়িয়ে গন্ডারিরাম, বসে শ্যামবাবু ও অটলবাবু। অটলের মাথাভর্তি চুল, মুখের কাট, চশমা – একেবারে যেরকম নির্দেশিত। শ্যামের গলাতে রুদ্রাক্ষ, যেটাকে একাবারে দাগিয়ে দিয়েছেন পরশুরাম। গন্ডেরির ক্ষেত্রে গায়ে কালো কোট চড়িয়ে দিয়েছেন, মুখে হাসি আর হাতজোড় করে এমন ভাব ফুটিয়েছেন যা মোক্ষম।
আর সেই বিখ্যাত গল্প ‘চিকিৎসা সঙ্কট’ – সেই প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়ে যাওয়া বাক্যটি – ‘হয়, হয়, z।নতি পারনা।’

সেই যে বর্ণনাতে আছে – ‘কবিরাজ মহাশয়ের বয়স ষাট, ক্ষীণ শরীর, দাড়ি গোঁফ কামানো। তেল মাখিয়া একটি আটহাতি ধুতি পরিয়া একটি চেয়ারের ওপর উবু হইয়া বসিয়া তামাক খাইতেছেন।” ২
ওপরের ছবির সঙ্গে একেবারে হুবহু মিল। নাড়ি টেপার ভঙ্গীটিও চমৎকার। মুখে আবার দার্শনিক ঔদাসীন্য! আর রোগীও কিরকম সমর্পিত ভঙ্গিমাতে বসে আছেন।
এরপরে আসি কিছু ব্যক্তিগত পছন্দের ছবিতে। ‘মহেশের মহাযাত্রা’ – মহেশ মিত্তির অঙ্কের প্রফেসর এবং ঘোরতর নাস্তিক। তাঁর পরমবন্ধু হরিনাথ কুণ্ডুও অধ্যাপক, ফিলসফির। মহেশ কিচ্ছু মানেন না, ঈশ্বর, আত্মা, ভূত কিচ্ছু না। হরিনাথ আর কিছু না মানুন, ভূত মানতেন এবং ভয় পেতেন। গল্পের শেষে এক অদ্ভুত ঘটনা, অবিশ্বাসী মহেশের শেষযাত্রায় রইল চার অশরীরী, আর মহেশ জীবনে প্রথমবার হার স্বীকার করলেন, জানিয়ে গেলেন –‘আছে, আছে, সব আছে’। অলৌকিক সেই দৃশ্যের ছবিটিতেও এক অলৌকিক ভাব, – আলোছায়ার মাধ্যমে সেটুকু বোঝানো হয়েছে। অদ্ভুত এক ত্রিমাত্রিক ভাবের সৃষ্টিও হয়েছে শুধু সাদা কালোর আঁচড়ে।

আর সেই ‘স্বয়ংবরা’ মেমসাহেব, যাঁকে কাছ থেকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন কেদার চাটুয্যে, -‘চোস্ত ঘাড় ছাঁটা, কেবল শনের মত দু গাছি চুল কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে পরনে দেড়হাতী গামছা’– অপূর্ব বর্ণনাটি। কিন্তু সঙ্গে ছবিটি থাকাতে একেবারে যেন মনে খোদাই হয়ে যায়।

পরশুরাম আর সুকুমার – দুজনেরই অসামান্য রসবোধ। আবার পরিচালক সত্যজিৎ রায় যে পরশুরাম অনুরাগী ছিলেন তাও সকলের জানা। তাই শেষে আসছি – মহাপুরুষ বিরিঞ্চিবাবার কথায়।


কি অদ্ভুত সুন্দর ছবিটি না! বুঁচকির দাঁড়ানোর ভঙ্গির আর হাতটি বাঁকিয়ে সামনে আনার মধ্যেই এক লজ্জা-লজ্জা ভাব আছে না? সেই গোলমেলে উত্তরের মতই –‘যাঃ’!! সত্যজিতের সিনেমাতে সত্যব্রতর চরিত্র করেছিলেন সতীন্দ্র ভট্টাচার্য। তাঁর চেহারার সঙ্গে কিন্তু বেশ সাদৃশ্য আছে ছবিটির।
সবাই স্বীকার করেন, গড্ডলিকা ও কজ্জলীর ঐশ্বর্য ছবিগুলি। পরের দিকের বইগুলিতে এই ঐশ্বর্যের অভাব খুবই বোধ করেছি আমরা। ধরা যাক বিখ্যাত গল্প গগনচটী, সরলাক্ষ হোম, পরশপাথর, চিঠিবাজী ইত্যাদি। সরলাক্ষ যে শার্লকের বঙ্গীয় সংস্করণ তাতে সন্দেহ নে, কেমন হত তাঁর ছবি? পরেশবাবুর বপু খানিও কতখানি তা অদেখা রয়ে গেল। ‘ধুস্তুরীমায়া’র উদ্ধব পাল আর জগবন্ধু গাঙ্গুলী – কেমন ছিলেন তাঁরা লেখকের কল্পনাতে? সাধারণ পাঠকরা তো বটেই, এমনকি গবেষকরাও মনে করেন পরবর্তী কাহিনি গুলিতে ছবি না থাকাতে অঙ্গহানি হয়েছে। তবে যতীন সেন আঁকবেন না, সেজন্য অন্য কারুকেও ভার দিতে চাননি পরশুরাম। হয়তো দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন অন্য কেউ সেই পর্যায়ে পৌঁছতে পারবেন কিনা, যে স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন যতীন্দ্রকুমার। প্রমথনাথ বিশী লিখেছেন, –
“গড্ডলিকা আর কজ্জলীর আর একটি ঐশ্বর্য ছবিগুলি। — ওগুলো আছে বলে পাঠক একটু অতিরিক্ত সচেতন হয়ে ওঠে, ওগুলো না থাকলে অনবহিত পাঠক হয়তো সেগুলো অতিক্রম করে যেতো। শেষ ছয়খানি গ্রন্থে আপেক্ষিক ম্লানতার কারণ নীচে দাগ দেওয়ার বা উত্তরীয়প্রান্তে টান দেওয়ার অভাব।” ৩
আরেক প্রাবন্ধিক সুমিত রায়ও বিস্তারিত আলোচনাতে স্বীকার করেছেন, আক্ষেপ করেছেন,
“এ পর্যন্ত সবই আগের মতো, যতীন্দ্রকুমারও আছেন পূর্ণগৌরবে। এই গল্পগুলির পরে ১৯৩২ সালে লেখা একটা গল্প যোগ হয়েছে (“প্রেমচক্র”), নিছক মজার গল্প, আধুনিক-পৌরাণিক মেশানো, যথারীতি পরশুরামের যাদুর ছোঁয়াচ আছে। তফাত্ হোলো এই প্রথম পরশুরাম পুরোপুরি চলিত ভাষা ব্যবহার করলেন এবং যতীন্দ্রকুমারের ছবি আর নেই, তার বদলে আছে পরশুরামের নিজের আঁকা কিছু কার্টুন গোছের ছবি। যতীন্দ্রকুমারের ছবির কোনো বিকল্প নেই দেখে এর পর থেকে পরশুরাম ছবি দেওয়াই ছেড়ে দিলেন,” ৪
অর্থাৎ আমরা সাধারণ পাঠকেরা তো বটেই, ঋদ্ধ সমালোচকেরাও হতাশা প্রকাশ করেছেন। মহানায়কের ভুবনমোহিনী হাসির সঙ্গে একটু ঘুরিয়ে বলাই যায় – ‘শুধু তুমি নয় অবলাকান্ত, পড়ার সময় অনেকেরই আপশোস হয়’! মেলবন্ধনের সফলতার এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কি হতে পারে?
দ্বিতীয় জুড়ি –
শিবরাম ও শৈল চক্রবর্তী

শিবরাম চক্রবর্তী হলেন আমাদের প্রাণের মানুষ, আবার ‘Pun’ এরও। তাঁর লেখা সৃষ্ট চরিত্রের মধ্যে যেগুলি আমাদের বরাবর মনোহরণ করে চলেছে সেগুলি নিঃসন্দেহে লেখক, বিনি, হর্ষবর্ধন ও গোবর্ধন।
তাঁর চরিত্র চিত্রিত হয়েছে বিভিন্ন হাতে।
কিন্তু সবচেয়ে বেশী যাঁর হাতে তা প্রাণ পেয়েছে তা নিঃসন্দেহে শৈল চক্রবর্তীর। শৈল
চক্রবর্তী এমন এক গৌরব লাভ করেছেন যা যে কোন শিল্পীর কাছেই ঈর্ষনীয়।
রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় তিনি রবীন্দ্রকাহিনীর অলঙ্করণ করেন।
গত শতাব্দীর চারের দশকে আনন্দবাজার পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের সেই গল্পদুটি হল ‘ল্যাবরেটরি’ ও ‘প্রগতিসংহার’। এটা অবশ্য জানা নেই এর জন্য যতীনবাবুর মত তাঁরও কোন দুর্লভ স্বীকৃতি মিলেছিল কিনা।

তিনি প্রায় ৩৫ বছর যুক্ত ছিলেন অমৃতবাজার পত্রিকায়। কলকাতা পুরসভার লোগো ও তাঁরই কীর্তি। কার্টুন আঁকার শেষে সই করতেন ‘Alias’ যে ইংরেজি কথার মানেই হল ‘ওরফে’, আবার এই ছদ্মনামের মধ্যে লুকিয়ে থাকত শৈল। ইংরেজি শব্দটি উল্টে নিলেই হল। -৬
কবে থেকে ‘মিলন হল দোঁহে’ তা না জানা গেলেও ‘কি ছিল বিধাতার মনে’ তা বেশ পরিষ্কার – বিধাতা অলক্ষ্যে হেসে গড়িয়ে পড়েছিলেন নিঃসন্দেহে। শুরুতেই এমন এক মজার ঘটনার কথা উল্লেখ করেই আলোচনার সূত্রপাত করা যেতে পারে। একদিন শিবরাম লেখা নিয়ে হাজির হলেন শৈলবাবুর কাছে। ছবি না নিয়ে তিনি নড়বেন না।

কোন আপত্তি শুনবেন না। বেগতিক দেখে শৈল করেই ফেললেন ছবিগুলি।
ছবিগুলো হাতে দিয়ে শৈল জিজ্ঞাসা করলেন,
‘আচ্ছা শিবরামবাবু, আপনি নিজেই গল্পগুলো নিয়ে এলেন কেন? এগুলোতো প্রকাশকের কাজ।’’
‘‘আহা বোঝেননা কেন, আমার গল্প হল ছিপ আর আপনার ছবি হল চার। এবার তো প্রকাশক টপ করে গিলবে। আর ফেরাতে পারবেনা। একেবারে নগদ বিদায় নিয়ে ছাড়ব।’’ শুনে শৈল হেসে অস্থির। আর শিবরাম রওনা দিলেন প্রকাশকের দফতরে।- ৭
আগের জুড়ির ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি তাঁদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও অপরের কাজের প্রতি ধারণাটিই ছিল সাফল্যের মূলে। শৈল চক্রবর্তী নিজেই ছিলেন হাসির গল্পের লেখক। রচনা করেছেন ‘বেজায় হাসি’, ‘চিন্তাশীল বাঘ’, ‘ঘটোৎকচ বিজয়’, ‘স্বর্গের সন্ধানে মানুষ’, ‘কার্টুন’, ‘কৌতুক’, ‘যাদের বিয়ে হল’, ‘যাদের বিয়ে হবে’, ‘আজব বিজ্ঞান’, ‘চিত্রে বুদ্ধজীবন কথা’, ‘বেলুন রাজার দেশে’, ‘কৃপণের পরিণাম’, ‘টুলটুলির দেশে’, ‘কালো পাখি’-সহ প্রায় ২৫টি রচিত গ্রন্থ। আর সেই লেখাগুলিতে অলংকরণ ছিল তাঁর নিজেরই। কাজেই যখন তিনি শিবরামের কোন চরিত্রের কথা ভেবে তুলি হাতে ধরতেন, সেই চরিত্রের অবয়ব সম্বন্ধে একটি নির্ভুল ধারণা রাখা তাঁর পক্ষে খুব সহজ হত। এছাড়া শৈল চক্রবর্তী আরো নানারকম কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। এদের মধ্যে একটি হল – পাপেট শো বা পুতুল নাচ। এর ফলে দেহ সৌষ্ঠব সম্পর্কে একটি সুন্দর ধারণা ছিল, যা রেখায় সহজেই ফুটে উঠতো।
শৈল চক্রবর্তী চিত্রিত লেখকের ছবি দেখে অনেকেই ভাবতেন শিবরামকে আসলে এরকমই দেখতে। আসল শিবরামকে স্বচক্ষে দেখে তাঁদের ভুল ভাঙে। ছবিতে উজ্জ্বল ছিল ঘাড়ে বাবরি, গালে লম্বা, উড়ন্ত ঝুলপি। পরনে ধুতি, ঢোলা হাতা সিল্কের পাঞ্জাবী, মুখে এক অবর্ণনীয় হাসি। বিনির চেহারা কিন্তু বেশ সপ্রতিভ, রীতিমতো সুন্দরী। সাধে কি আর খুশী হয়ে লেখক বলেছিলেন শিল্পীকে, ‘আপনি মেয়েদের বড়ো সুন্দর করে আঁকেন’। নিজের ফটো দেননি – ‘না, আমার কোনো ফটো নেই | কী হবে ফটো নিয়ে? আপনার ছবিতেই আমি থাকব’—| তারপর গলা খাটো করে বললেন, ‘তাহলে কোনদিন বুড়ো হব না |’ -৮
আর বিখ্যাত দুই চরিত্র – হর্ষবর্ধন আর গোবর্ধন। দুই ভাই – হর্ষবর্ধন রীতিমতো ধনী লোক, কাঠের ব্যবসায়ী। তাঁর ছোট ভাই গোবর্ধন ওরফে গোবরা একটু ক্যাবলাকান্ত টাইপ, দাদার কাছে খুব বকুনি খায়। শৈল চক্রবর্তীর তুলির আঁচড়ে তারা সব বইয়ের পাতা থেকে ছিটকে এসে আমাদের মনের কোনে জায়গা করে নেয়।


হর্ষবর্ধনের বপুখানি বেশ প্রমাণ মাপের হলেও গোবরা বেশ রোগাসোগা, চোখে সরল চাহনি। তাদের ছবির সংগে তাদের চরিত্রের এতই মিল যে এই মানিকজোড় এক্কেবারে আমাদের চোখের সামনেই থাকে।
শখ করে আবার ডিটেকটিভ কাহিনীও লিখেছিলেন শিবরাম – আগেকার কালের বিখ্যাত ডিটেকটিভ হুকাকাশির (মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য বিরচিত) ভাই বা ভায়রাভাই ‘কল্কেকাশী’। তার জন্য দরাজ, দক্ষ হাতে ছবি আঁকলেন শৈল – পাশের ছবিটি ‘রহস্যময় হর্ষবর্ধন’ গল্পে বর্ধন-ভ্রাতাদের সঙ্গে অতিথি-চরিত্র কল্কেকাশি-র সাক্ষাৎ। ‘হাসির চোটে দম ফাটে’ (১৯৭৬) গ্রন্থ থেকে।

গত শতাব্দীর পাঁচ থেকে সাতের দশক এই জুড়ি মাতিয়ে রেখেছিলেন বাংলার হাস্যরসের জগৎকে। নামের মিলের জন্য কেউ কেউ তাঁদের সহোদর বলে ভুলও করে ফেলতো। বাস্তবে তা না হলেও রেখায় – লেখায় তাঁদের জুড়িকে সৌভ্রাতৃত্ত্বের অপূর্ব বন্ধন বললে অত্যুক্তি হবে না।
তৃতীয় জুড়ি –
প্রেমেন্দ্র মিত্র ও অজিত গুপ্ত –
কল্লোল যুগের কৃতী সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র। তিনি কিশোর সাহিত্যেও সৃষ্টি করেছিলেন এক অবিস্মরণীয় চরিত্র – ঘনাদা। এই সিরিজের প্রথম গল্প ‘মশা’ (১৯৪৫) সালে প্রকাশিত হয়, দেব সাহিত্য কুটীরের শারদীয়া ‘আলপনা’ পত্রিকায়। অলংকরণ করেন শ্রীপ্রতুলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর অঙ্কিত ঘনশ্যাম দাস অপেক্ষাকৃত বয়স্ক, ঠিক দাদাসুলভ নন।


সেই বছরেই প্রকাশিত ‘সাগর থেকে ফেরা’- প্রেমেন্দ্র মিত্র রচিত সম্ভবত জনপ্রিয়তম কাব্যগ্রন্থ। বইখানি উৎসর্গিত হয় সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশে।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের অনেক পরিচয় – তিনি বাংলা শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পকারদের অন্যতম। তিনি বাংলা চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত।
তাঁর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি – স্বচ্ছতা, স্পষ্টতা ও গভীর আবেগ – এই কাব্যের কবিতাগুলিতে স্পষ্ট। ১৯৫৭ সালে ভারতের জাতীয় সারস্বত প্রতিষ্ঠান সাহিত্য অকাদেমী এই কাব্যের জন্য প্রেমেন্দ্র মিত্রকে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কারে সম্মানিত করে। পরে এই গ্রন্থ রবীন্দ্র পুরস্কারেও সম্মানিত হয়।
এই ‘সাগর থেকে ফেরা’ বইয়ের প্রচ্ছদ শিল্পী ছিলেন অজিত গুপ্ত। ১৯২৮-এ শ্রীরামপুরে জন্ম। গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের কৃতী ছাত্র, পরে কমার্শিয়াল আর্টেই মন দেন। তিনিই এই বইয়ের সব ছবি আঁকেন। এই বইয়ে মোট আটটি কাহিনী লিপিবদ্ধ হয়, সবকটি গল্পের নামকরণ দুই অক্ষরের– মশা, পোকা, নুড়ি, কাঁচ, মাছ, টুপি, ছড়ি, লাট্টু। এই গ্রন্থে আগেকার সব ধাঁচ সম্পূর্ণ বদলে দেন অজিত গুপ্ত। তাঁর প্রতিকৃতিকেই প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং অধিকাংশ পাঠক যথার্থ ঘনাদা বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
প্রথম সংস্করণের প্রকাশের পরেই ঘনাদার ছবি পাঠকদের মনে একেবারে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। নিজের কিশোর অভিজ্ঞতায়ও দেখেছি কাছাকাছি ঐরকম চেহারার কোন মানুষকে দেখলেই তৎক্ষণাৎ তিনি ‘ঘনাদা’ নামে পরিচিত হতেন।

এর পরে ধীরে ধীরে ঘনাদা কাহিনীগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হতে থাকে – অদ্বিতীয় ঘনাদা (১৯৫৯), আবার ঘনাদা (১৯৬৩), ঘনাদাকে ভোট দিন (১৯৬৪), ঘনাদা নিত্য নতুন (১৯৬৬) – সবকটি বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ করেন শিল্পী অজিত গুপ্ত। দুশোরও বেশি প্রচ্ছদ এঁকেছেন বাংলা বইয়ের। দেশ, বসুমতী, বসুধারা-র বিশেষ সংখ্যার প্রচ্ছদ করেছেন। প্রেমেন্দ্র মিত্রের সাগর থেকে ফেরা, বনফুলের হাটে বাজারে, গজেন্দ্রকুমার মিত্রের কলকাতার কাছেই, শংকরের চৌরঙ্গী-র মতো স্মরণীয় প্রচ্ছদ তাঁরই আঁকা। ডাকটিকিট দিয়ে করা চৌরঙ্গী-র অভিনব প্রচ্ছদটি আজও মুদ্রিত হচ্ছে। তাঁর সময়ের কথা নিয়ে লিখেছেন দুটি বই, ‘ভালবাসার আড্ডা’ আর ‘লেখক নিজেই গল্প’।

কিন্তু তা সত্ত্বেও বলতে হবে বাংলার পাঠকের কাছে তাঁর সর্বাধিক সমাদর ‘ঘনাদা’র রূপকার হিসেবেই। পরবর্তী কালে তাঁর পথই অনুসরণ করেছেন তাঁর অনুজরা – দেবাশিস দেবও যখন ঘনাদার অলঙ্করণ করেন তাঁর ও মাথাতে থাকে সেই ঘনাদার পূর্ববর্তী চেহারা। – ৯

উপরোক্ত তিনজন আলংকারিকের মধ্যে একটি খুব মিল আছে, – তাঁরা তিনজনেই লেখক। কেউ বলেছিলেন, লেখার চেষ্টা করলেই যে কেউ লেখক হবেন তা নয়, তবে এটা ঠিক তাঁদের সাহিত্যবোধ অনেক ভাল হবে, পাঠক হিসেবে তাঁরা অনেক পরিণত হবেন। আমার মনে হয় এই সার্থকতার কারণ আলঙ্কারিকরা খুবই উঁচুমানের পাঠক। কাজেই তাঁরা যখন কাহিনীটি পড়ছেন, নিজেদের অজান্তেই তাঁরা বকলমে লেখক হয়ে ভাবতে শুরু করেছেন তাঁরা নিজেরা রচয়িতা হলে এই চরিত্রগুলিকে কিভাবে সৃষ্টি করতেন। এছাড়াও ছিল পারস্পরিক পরিচিতি ও শ্রদ্ধাবোধ, জুটি তৈরীতে যা একান্ত অপরিহার্য।
চতুর্থ জুড়ি–
যা দিয়ে শুরু করেছিলাম, ‘একলা চলো রে’, ফিরে এলাম সেই কথাতেই। বাংলার ‘রায়চৌধুরী’ পরিবারের মত প্রতিভাসম্পন্ন পরিবার একাই একশো বললে একটু কম নিদেনপক্ষে একাই দুশো বললে কিছুটা মেলে। এই পরিবারের প্রথম যিনি বাংলা সাহিত্যে সাড়া ফেলে দেন তিনি নিঃসন্দেহে উপেন্দ্রকিশোর। তাঁর রচিত বইগুলোর মধ্যে ছিল টুনটুনির বই, সেকালের কথা, ছেলেদের রামায়ণ, ছেলেদের মহাভারত ইত্যাদি। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের অবলম্বনেই তাঁর পৌত্র সত্যজিৎ চলচ্চিত্রে সৃষ্টি করেন গুপী বাঘার মত চরিত্র যা আজো সব বয়সের বাঙালীদের মনোহরণ করে। উপেন্দ্রকিশোরকে বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যের অন্যতম অগ্রপথিক বলা চলে। একেবারে বিংশ শতাব্দীর গোড়াতে এক পরাধীন দেশে একটি আঞ্চলিক ভাষাতে উঁচু মানের সাহিত্য রচনা করে তিনি এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটালেন।

এরপর ১৯১৩ সালে, উপেন্দ্রকিশোর ‘সন্দেশ’ পত্রিকার মাধ্যমে বাঙালী কিশোরদের এক নতুন স্বাদ দিলেন। মাসিক এই পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালের মার্চে। ২০১৩ সালে পত্রিকাটির শতবর্ষপূর্তিও হয়ে গেছে।

দুর্ভাগ্যবশত, মাত্র দু বছর পরেই (১৯১৫) সালে তাঁর মৃত্যু হয়। ‘সন্দেশ’ পত্রিকার দায়িত্ব নেন তাঁর সুযোগ্য পুত্র সুকুমার। বিলেতফেরত, বিজ্ঞান শিক্ষাতে শিক্ষিত, অসামান্য রসবোধ ও সাহিত্য প্রতিভা নিয়ে তিনি ‘সন্দেশ’ কে অনেক বেশী সুস্বাদু করে তুললেন। মাত্র সাত বছরে তিনি বাংলা সাহিত্যকে যা দিয়ে গেলেন তা তুলনারহিত।
তাঁর হাতে সৃষ্টি হল ‘পাগলা দাশু’র মত চরিত্র। যার বর্ণনা নিম্নরূপ-
‘-তার মুখের চেহারায়, কথাবার্তায়, চলনে চালনে বোঝা যাইত যে তাহার মাথায় একটু ‘ছিট’ আছে। তাহার চোখদুটি গোল-গোল, কানদুটা অনাবশ্যক রকমের বড়, মাথায় এক বস্তা ঝাঁকড়া চুল। চেহারাটা দেখিলেই মনে হয়—
ক্ষীণদেহ খর্বকায় মুণ্ড তাহে ভারী যশোরের কই যেন নরমূর্তিধারী।’
ছবিতেও যেন সেটি বিম্বিত –

বিভিন্ন গল্প আর তার সঙ্গে আঁকা যথোপযুক্ত ছবির মাধ্যমে অচিরেই এই বইটি বাংলার সকল কিশোর কিশোরীর মনে চিরকালীন আসন দখল করল। আমি জানি, অনেক বাঙালীই দুঃখের দিনে এই বইটি খুলে বসেন, ফিরে যান সেই গৌরবময় কৈশোরের দিনগুলিতে। একটি গল্প থেকে ছোট্ট উদাহরণ দিই –
“দাশু আমার শ্লেটখানা লইয়া পণ্ডিতমহাশয়কে দেখাইয়া বলিল, “এই দেখুন, আপনি যখন ঘুমোচ্ছিলেন, তখন ওরা শ্লেট নিয়ে খেলা কচ্ছিল- এই দেখুন, কাটকুটের ঘর কাটা।”
শ্লেটের উপর আমার নাম লেখা- পণ্ডিতমহাশয় আমার উপর প্রচণ্ড এক চড় তুলিয়াই হঠাৎ কেমন থতমত খাইয়া গেলেন। তাহার পর দাশুর দিকে কট্মট্ করিয়া তাকাইয়া বলিলেন, “চোপ্রও, কে বলেছে আমি ঘুমোচ্ছিলাম?”
দাশু খানিকক্ষণ হাঁ করিয়া বলিল, “তবে যে আপনার নাক ডাকছিল?”
পণ্ডিতমহাশয় তাড়াতাড়ি কথাটা ঘুরাইয়া বলিলেন, “বটে? ওরা সব খেলা কচ্ছিল? আর তুমি কি কচ্ছিলে?”
দাশু অম্লানবদনে বলিল, “আমি পটকায় আগুন দিচ্ছিলাম।” – চীনে পটকা
ওপরের ছবিটি দেখলেই পণ্ডিতমশায়ের ঘুম পণ্ড হওয়ার আতঙ্ক আমাদের মনে ছড়িয়ে পড়ে। আবার ধরি খুড়োর কল, বিজ্ঞানের ছাত্র সুকুমার এখানে আবার তাঁর মেকানিক্সের জ্ঞানের সঙ্গে রসিকতার চরম মিলন ঘটিয়েছেন। পেটুক বাঙালীর কাছে সুখাদ্য হল লোভনীয়, তার জন্য সে করতে পারে না এমন কাজ নেই। পদ্যে আছে,

এরসঙ্গে এক্কেবারে মানানসই ছবি, আমরা বিজ্ঞানের বইতে যে কপিকল দেখেছি, তাই এসেছে পিঠে। আর লোভী, পেটুক, মানুষের মুখের ভাবটিও চমৎকার! আজকের স্বাস্থ্যসন্ধানীরা চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

‘কুমড়োপটাশ’ বা ‘ভয় পেওনা’ র অদ্ভুত জীবের ছবি, বা গোমরাথেরিয়াম’, ‘বেচারাতেরিয়াম’, ‘চিল্লানোসরাস’, ‘ল্যাগব্যাগর্নিশ’, ‘ল্যাংড়াথেরিয়াম’ – এইসব বিচিত্র জীবের ছবি। নাঃ, অসম্ভব, এই আজগুবি ভাবনা আর কোন চিত্রকরের মাথাতেই ঢোকানো যেতনা। এখানে, ‘চল একেলা, চল একেলা’!!
আমার মতে তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি হল প্রবাদ বাক্যের ছবি ও কবিতা।

যে কোন বাংলা শিক্ষকের পক্ষে এই ছবির মাধ্যমে সরস ভাবে প্রবাদবাক্য বা বাগধারার প্রতি ছাত্রদের কৌতূহলী করে তোলার পথ প্রশস্ত করেছেন সুকুমার।
এঁদের তৃতীয় প্রজন্ম সত্যজিৎ তো শিক্ষাই পেয়েছিলেন আঁকার। শান্তিনিকেতনে বিনোদবিহারী বা নন্দলালের মত শিল্পীরা ছিলেন তাঁর শিক্ষক। তারপর প্রচ্ছদ শিল্পী রূপে তিনি তো সিগনেট প্রেসে বিপ্লবই ঘটিয়েছিলেন বলা চলে। আম আঁটির ভেঁপু বা বুড়ো আংলা কে আমরা কি ভুলতে পারি?

কাজেই ষাটের দশকে যখন তিনি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে সন্দেশ পত্রিকা আবার শুরু
করলেন, নিজের গল্পের অলংকরণ স্বাভাবিক ভাবেই নিজেই করলেন। তাঁর অলঙ্করণ নিয়ে আলাদা
বইও আছে, কাজেই এই লেখাতে আমরা শুধুমাত্র ফেলুদা নিয়েই আলোচনা করবো।
সন্দেশে তাঁর প্রথম ফেলুদার গল্প ছিল ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ – প্রকাশ ১৯৬৫ সাল। সন্দীপ রায় জানাচ্ছেন যে তখনো সত্যজিৎ ভাবেননি যে ফেলুদার এরকম জনপ্রিয়তা হবে। তিনি মনের খেয়ালেই লিখে ফেলেছিলেন। অবশ্য, আমাদের সেই সদ্য কিশোর বয়সে, আমরা ছিলাম সবাই তোপসে, আর আমাদের দাদা – ‘ফেলুদা’!

জটায়ুকে নিয়ে প্রথম গল্প ‘সোনার কেল্লা’। ১৯৭১ সালে শারদীয়া দেশ পত্রিকাতে প্রকাশিত। কিন্তু ১৯৭৪ এ ‘সোনার কেল্লা’ ছবিতে সন্তোষ দত্তর অভিনয় দেখে এতই মুগ্ধ হলেন সত্যজিৎ যে পরবর্তী কালে তাঁর জটায়ুতে অবিকল সন্তোষ দত্তের ছাপ এসে গেল। নীচের ছবি দেখলেই তা পরিষ্কার এই যে নিজের ভাবনাকে নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার স্বাধীনতা তিনি নিয়েছিলেন, তার কারণ হল ঐ – ‘একাই একশো’ !!

শেষকথা –
আমাদের ওপরের আলোচনা থেকে এটাই দেখা যেতে পারে, আলঙ্কারিকের অসামান্য সাহিত্যবোধ না থাকলে উঁচুমানের সৃষ্টি অসম্ভব। যে কোন সার্থক জুটির মত এখানেও পারস্পরিক বোঝাপড়া, আদানপ্রদান, একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পত্রিকাতে প্রকাশিত লেখার ক্ষেত্রে আরো দরকার হয় সম্পাদকের দায়িত্ববোধ ও তাঁর নিজস্ব শিল্পভাবনার। বর্তমানে এর কিছু কিছু অভাব দেখা দিচ্ছে। জনপ্রিয় পত্রিকাতে লেখার সঙ্গে রেখা অনেক সময়ই মানানসই হয়না, মনে হয় এর থেকে নিরাভরণ লেখাই বাঞ্ছনীয়।
এক্ষেত্রে সম্পাদকদের অগ্রণী ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন। তাঁরা যদি আলঙ্কারিকদের ঠিকমতো নির্দেশ দিতে পারেন, বাংলা সাহিত্যের এই ঐতিহ্যময় দিকটির সঙ্গে তাঁদের পরিচয় করাতে পারেন, অবশ্যই আমরা আবার নতুন দিগন্তের সন্ধান পাব।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার
এই লেখাটি আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেওয়ার বিশেষ কৃতিত্ব ‘বহুস্বর’ পত্রিকার সম্পাদক শ্রী বিভাস ভট্টাচার্যর। এই ব্যাপারে বিস্তারিত লিখেছি আগে –
https://bhaskarbose.com/2018/10/12/editors-2/
ছবিগুলি সবই ইন্টারনেট থেকে গৃহীত।
১ – পরশুরাম গল্প সমগ্র, প্রথম অখণ্ড সংস্করণ, এম সি সরকার, নভেম্বর, ১৯৯২ – পৃ = ৮২০
২ – পরশুরাম গল্প সমগ্র, প্রথম অখণ্ড সংস্করণ, এম সি সরকার, নভেম্বর, ১৯৯২ – পৃ = ৬৩
৩ – পরশুরাম গল্প সমগ্র, প্রথম অখণ্ড সংস্করণ, এম সি সরকার, নভেম্বর, ১৯৯২ – পৃ = ২৪
৪ – http://www.abasar.net/UNIbibidh_lit_RajShekhar8.htm
৬ – http://archives.anandabazar.com/e_kolkata/2012/february/atiter_tara.html
৮– https://banglalive.com/how-did-shibram-chakraborty-got-younger-with-age/
৯ – http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/%E0%A6%98%E0%A6%A8-%E0%A6%A6-1.101446
Agree 200%
LikeLiked by 1 person
ধন্যবাদ
LikeLike
দাদা, নতুন ভাবনার লেখা। এমন লেখা আমি আগে পড়িনি । গোগ্রাসে রসাস্বাদন করলাম। আর পড়তে পড়তে হারিয়ে গেলাম কৈশোরের দিনগুলোতে। অনেক ধন্যবাদ দাদা।
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ সৌম্য।
LikeLiked by 1 person
পড়ে ফেললাম ঝপাং করে | আপিসে বসেই | আপনার এই লেখা আবার করে গল্প এবং তারসাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রেখাচিত্রের গুরুত্ব মনে করালো | আমিই তো শৈলবাবুর সৃষ্টিতেই শিব্রাম চক্রবর্তী মশাইকে মনে রাখি | ওইরকম সামনে একগোছা চুলের কেয়ারি – ধুতি পাঞ্জাবীতে নিখাদ ভদ্রলোক! এছাড়া ঘনাদাও তাই | ওইরকম নাক – রোগা লিকলিকে চেহারা আর তাইতেই বিশ্বজুড়ে কতই না রহস্যের পরদা উন্মোচন! রায় পরিবার নিয়ে আমি কিছু বলছিনা! পান্ডব গোয়েন্দার গল্পের অলংকরণ ও মনে পাকাপোক্ত ভাবে খোদাই করা | সাম্প্রতিক কালে যেমন কাকাবাবু বায়োস্কোপে দেখতে গিয়ে খুব হতাশ হয়েছিলাম | গল্পের ছবির সেই জ্বলজ্বলে বুদ্ধিদীপ্ত চোখে চশমা পরা কাকাবাবুর সাথে প্রসেনজিৎ কে মেলাতে পারিনি | বহুকাল আগে সবুজ দ্বীপের রাজাতে অবশ্য মন্দ লাগেনি |
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ বর্ণালী।
LikeLike
অপূর্ব সুন্দর তথ্যসমৃদ্ধ
On Tue, 12 Mar 2019, 8:56 am ভাবনা আমার পথ খুঁজে চলে, wrote:
> bhaskarbose1960 posted: ” প্রস্তাবনা– ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে
> একলা চলো রে’ – কথাটা খুবই প্রাণিত করে। বাস্তবজীবনে কিন্তু এই একলা চলা সব
> সময় সম্ভব হয় না। আর সৌভাগ্য থাকলে, ‘জানি বন্ধু জানি তোমার আছে তো হাতখানি’
> এই গানটিই বেশী উপভোগ্য হতে পারে। শিল্পজগতে এইরকম মিলিত ক”
>
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ!!
LikeLike
ধন্যবাদ
LikeLike
ভালো। নারায়ণ বাবু বাদ চলে গেলেন, ওঁকে নিয়ে আলাদা করে লিখবে কি?
LikeLiked by 1 person
আসলে উদ্দীষ্ট পাঠকমন্ডলী হল মূলতঃ নবপ্রজন্ম। তাঁরা নারায়ণ দেবনাথকে অনেকটাই মনে রেখেছেন। তুলনাতে এঁরা অনেকটাই বিস্মৃতির আড়ালে। সেইজন্যই কিছুটা। এছাড়া এটি ‘বহুস্বর’ পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যার জন্য লেখা। তাতে নারায়ণবাবুর জন্য আলাদা লেখাও ছিল।
LikeLike
খুব ভালো লাগলো পড়ে । সুখপাঠ্য । তথ্য তো থাকবেই, আছেও কিন্তু তা ভারাক্রান্ত করে নি । এইসব যুগলবন্দি সত্যিই তো শিল্প সাহিত্যকে ক্রমান্বয়ে ঋদ্ধ করেছে । যত্ন নিয়ে লেখা, পরিশ্রমের ছাপ রয়েছে । খুব ভালো লাগল ভাস্করবাবু । বন্ধুতা নেবেন ।
LikeLike
সমীরবাবু, অনেক অনেক ধন্যবাদ!!
LikeLike
Apurbo lekha. Jano ak jhank chhotobyala khunje pelam hotath. 🙂
LikeLiked by 1 person
অজস্র ধন্যবাদ!!
LikeLike
এত সুন্দর তথ্য ও অলঙ্করন বহুল লেখা খুব কমই পড়েছি। খুব ভালো লাগলো।
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ
LikeLike
Khoob Bhalo Laglo . Very entertaining .
LikeLike
অনেক ধন্যবাদ।
LikeLike