পরিবেশের পুণ্যভূমি – লেহ – লাদাখ

    পুণ্যভূমি বলতে আমাদের মনে ভেসে আসে তীর্থস্থানের কথা। কিন্তু তীর্থযাত্রীদের চাপে তীর্থস্থানের পরিবেশ হয়ে উঠেছে দুঃসহ। তাই পুণ্যভূমি বলতে যদি বোঝায় এক ‘স্বর্গীয়’ পরিবেশ, ভারতে সেই জায়গা হল লেহ – লাদাখ। আমার এই কাহিনী সেই অনাবিল ভ্রমণের।

      লে-লাদাখ – ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করে নিতে চাই প্রথমেই। জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অন্তর্গত লাদাখ জেলা, তারই রাজধানী শহর লেহ। ভ্রমণার্থীরা বিমানযোগে লে গিয়ে সেখান থেকেই শুরু করেন লাদাখ ভ্রমণ। সড়কপথেও অবশ্য আসা যায় কাশ্মীরের দিক থেকে, কার্গিল হয়ে। আমরা অবশ্য বিমানযোগেই লেহ তে গিয়েছিলাম। কার্গিল নামটা শুনতেই কেমন বুক কেঁপে গিয়েছিল।

১৯৯৯ সালে সেই বিখ্যাত যুদ্ধের সময় আমি কাজে গিয়েছিলাম জম্মু শ্রীনগর রুতের একটি জায়গা – কিষেনপুর। তখনই বাড়ির লোকজন কেঁদে কেটে একসারা হয়েছিল। ঘরপোড়া গরুরা আবার কার্গিল মাড়াবে? কাজেই দিল্লী থেকে উড়ে চল।

লেহ শহর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১১,৫০০ ফিট – সুতরাং এখানে বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা বেশ কম। আমরা যাচ্ছিলাম দিল্লী থেকে, কাজেই মাত্র দুঘন্টার মধ্যেই আবহাওয়ার এতটা পরিবর্তন শরীরের ওপর চাপ ফেলে। তাই আমাদের বলা হয়েছিল প্রথম দিনটা আলসেমি করে একেবারে শুয়ে বসে কাটাতে, এমনকি স্নান করাও নিষেধ। এরফলে আমাদের শরীর অনেকটাই কম অক্সিজেনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে। আগে কিছু যাত্রীদের সমস্যার কথা শুনেছিলাম, তাঁরা কথা না শোনার জন্য শ্বাসকষ্টে ভুগেছিলেন। তাই আমরা একেবারে বেদবাক্যের মত মেনেছিলাম।

দ্বিতীয় দিন থেকে একেবারে পূর্ণমাত্রার ভ্রমণ শুরু। তবে আমি নিজে একটু অসুস্থ হয়ে পড়ায় প্রথম দিনের প্রথমার্ধ থেকে বাদ পড়েছিলাম। তাতে অবশ্য কিছু ক্ষতি হয়নি। শরীর ফিট হয়ে যাওয়াতে পরের দিকে ভ্রমণ পূর্ণমাত্রাতে উপভোগ করেছিলাম।

প্রথমেই যা মুগ্ধ করল তা হল একেবারে স্বচ্ছ নীল আকাশ – অনেক, অনেক দিন আগে আমাদের মফস্বলেও এরকম পরিষ্কার আকাশ দেখা যেত। এখানে বায়ুদূষণ একেবারে অনুপস্থিত। সেই সঙ্গে বিস্তৃত পটভূমি।

  বিস্তৃত পটভূমি, পরিষ্কার আকাশ, সূর্যের বর্ণচ্ছটা

লেহ শহরে শুধু নয়, সমগ্র লাদাখ জেলাতে অধিকাংশ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। শহরে বৌদ্ধ প্যাগোডার ধাঁচে গঠিত অনেক সৌধ দেখা যায়। বিভিন্ন থামের আকৃতি অনেকটা জপযন্ত্রের মত।

আচ্ছা, সেই ফেলুদার ‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে’ মনে পড়ে? জটায়ু ‘জপযন্ত্র’ দিয়ে কাত করেছিলেন আততায়ীকে? সেখানে জপযন্ত্রের মাধ্যমে ও অনেক গোপন কাজকর্ম হত। জপযন্ত্র হল বৌদ্ধধর্মের প্রতীক। ‘ওঁম মণিপদ্মে হুম’ খোদিত জপযন্ত্র ঘুরিয়ে শুরু করতে হয় বিভিন্ন গুম্ফা দর্শন। লাদাখে তাই পাওয়া বিভিন্ন রঙের, বিভিন্ন আকারের জপযন্ত্র। এই জপযন্ত্রকে হাতে নিয়ে ঘোরালে মানসিক স্থৈর্য্য অনেক বেড়ে যায়। আমিও একটা নিয়ে এসেছিলাম, হারিয়ে ফেলে তা আর বাড়ানো গেল না। জটায়ুজীর বেড়েছিল কিনা, তাও জানার উপায় নেই। নাই বা বাড়ুক, জপযন্ত্রের এক অত্যাশর্য প্রয়োগ তিনি করে আমাদের মুগ্ধ করেছিলেন।

বিভিন্ন আকৃতির, রঙীণ জপযন্ত্র

বেশ বড়সড় আমাদের দলটি – সর্বমোট ১৮ জন। আমরা মধ্যবয়সী নারী পুরুষরা আছি, আবার সঙ্গে আছে একটি তরুণ ও তিনটি তরুণী, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের। আমাদের সকলের বিচিত্র শখ, খাওয়া, বেড়ানো, ইতিহাস বা ভূগোল নিয়ে কৌতূহল, ধার্মিক বা রাজনৈতিক গুরুত্ব জানা, সেখানকার বিশিষ্ট কিছু জিনিষপত্র কেনাকাটা করা! এছাড়া ছবি তোলা আর তোলানো – সেটা না হলে তো বেড়ানোর মানেই হয়না। বিশেষত এইরকম স্বর্গীয় জায়গাতে। ১৮ জন আমরা চারটি গাড়িতে ভাগ হয়ে গেলাম।

আমাদের ভ্রমণকাল ছিল জুলাই মাস। এটা একটু সুবিধেজনক, বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশী থাকাতে শ্বাসকষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। উল্টো বিপত্তিও হতে পারে, হুড়মুড় করে বৃষ্টি হয়ে বেড়ানো একেবারে বানচালও হতে পারে। আমাদের সৌভাগ্য, তা হয়নি। কিন্তু এখানে বেড়ানোর সময় প্রচুর উঁচু, নীচু, বিভিন্ন বাঁক। কাজেই বমন সম্ভাবনা খুব প্রবল, বিশেষ করে আমাদের মত মধ্যবয়সীদের। কাজেই আমরা ওষুধ খেয়ে নিলাম! ‘যৌবনেরই পরশমনি’র স্পর্শে যারা ‘অকারণে চঞ্চল’, তাদের কথা অবশ্যি আলাদা।

লেহ শহরে আমরা দেখলাম শঙ্কর গুম্ফা মনাস্টারি আর রাজপ্রাসাদ। ষোড়শ শতাব্দীতে, ১৫৫৩ সালে তিব্বতের লাসার পোটালা প্রাসাদের অনুকরণে লাদাখের শাসনকর্তা রাজা সেওয়াং নামগ্যাল পাহাড়ের চূড়ায় এই রাজপ্রাসাদ নির্মাণ শুরু করেন। শেষ করেন তাঁর ভাইপো, সেঙ্গে নামগ্যাল  ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ। প্রাসাদটির গঠনে তিব্বতী ধরণ খুবই সুস্পষ্ট। এই রাজপ্রাসাদটির বর্তমান অবস্থা বেশ খারাপ, কিন্তু তা সত্ত্বেও দর্শনীয়।

লেহ রাজপ্রাসাদ

পরের দিন আমাদের যাত্রা ছিল নুব্রা উপত্যাকায়। স্থানীয় চালক আমাদের জানিয়েছিল, এর আসল নাম লুমড়া, ব্রিটিশ উচ্চারণে তার নাম হল ‘নুব্রা’, আমাদের চুঁচুড়া যেমন হয়েছিল – ‘চিনসুরা’!

এই উপত্যকা পৌঁছতে হলে পার হতে হবে ‘Highest Motorable Road of the world’। এটি হল খারদুংলা পাস, উচ্চতা – ১৮৩৮০ ফুট

এইখানে বায়ুর চাপ সবচেয়ে কম, ফলে একটু বয়স্ক যাঁরা, তাদের শ্বাসকষ্ট হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। আমরা যাওয়ার আগেই এরকম ঘটনার কথা শুনেছিলাম। তাই সাবধান ছিলাম, বেশী দৌড়োদৌড়ি বা লাফালাফি না করলে, সেরকম সমস্যা হবে না। অল্পবয়সীদের কথা আলাদা, তারা হরিণের মত দৌড়ে, লাফিয়ে ছবি তুলতে পারে। তবে একটা টোটকাতে আমরা সকলেই বেশ উপকার পেয়েছিলাম, তা হল রুমালে বেঁধে রাখা কর্পূর। শ্বাস কষ্ট শুরু হলেই একটু শুঁকে নিলেই বেশ স্বস্তি বোধ হচ্ছিল।

আজ হম উপর

কিন্তু ‘যৌবনের পরশমণি’র স্পর্শে যাদের ‘চিত্ত হল রঞ্জিত’, তাদের কিন্তু ভয় ডর নেই। ঠাণ্ডাও কাবু করতে পারছে না। দিব্যি ওপরে গিয়ে হেসে হেসে ছবি তুলছে।

এই উপত্যকাতে আছে এক অদ্ভুত দু-কুঁজ ওয়ালা উট। উটে চড়ার কথা তো হবেই, তার আগে একটু বলে নিই লাদাখের নৈসর্গের কথা। কাশ্মীর বা হিমাচলের মত লাদাখের পাহাড়ে কিন্তু সেরকম সবুজের আভাস দেখা যায় না। এখানে সেরকম বৃষ্টিপাত না হওয়ার ফলে গাছপালার সংখ্যা আশ্চর্যজনক ভাবে কম। এখানকার আবহাওয়ার সঙ্গে মরুভূমির কিছুটা মিল আছে। আর মরুভূমি থাকবে, আর সেই মরুভূমির জাহাজ থাকবে না? এর নামই অবশ্য – Cold Desert.

‘আমার জীবনের সব কটা স্বপ্নই যে এভাবে ফলে যাবে তা কিন্তু আমি ভাবিনি মশাই’ – জটায়ুর সেই বিখ্যাত সংলাপ বলতে বলতে উটের পিঠে চড়া হল। এটা তো সত্যিই, ‘সোনার কেল্লা’ দেখার পর থেকে সকলের স্বপ্ন ছিল উটে চড়া। সেই স্বপ্ন দ্বিগুণ ভাবে পূর্ণ হচ্ছে, সব্বাই উল্লসিত – ছেলে, মেয়ে, তরুণ, মধ্যবয়সী।

দু-কুঁজ ওয়ালা উটের পিঠে চড়ে সফর

আরো ভালো করে উটের দুই কুঁজ দেখা যাবে নীচের ছবি দুটিতে

দুই কুঁজের মাঝখানে আরাম করে বসা

দুই কুঁজের মাঝেই নিজেকে খুব স্বচ্ছন্দ করে নিতে হয়। সেখানে গিয়ে যাত্রীদের একটু মন কষাকষি ও হয় বৈকি। ‘আমার দুটো কুঁঁজই বড় ছিল” “মোটেই না, আমার পেছনের কুঁজটা অনেক বড়”, “বললেই হল, আমার দুটো কুঁজই পুরো এক সাইজের”! কেউ বা আবার একটু হতাশ – “টাকা তো সবাই একই নিল, কিন্তু আমাকে খুবই ছোট খুঁজ দিল, সামনের টা তাও ঠিক আছে, পেছনেরটা তো দেখাই যায় না”! বোঝো কাণ্ড! এ যেন নিউ মার্কেটের বাজার!! যাঁরা আমার লেখা পড়ে সদলবলে নুব্রাতে উতে চড়ার কথা ভাবছেন, তাদের জন্য একটাই সতর্কবাণী,- ‘কুঁজ বুঝে উটের দাম দর করুন’!

এই উপত্যকাতে উটের দল যখন ধীরে ধীরে দূরের দিকে মিলিয়ে যায়, সে এক ভারী চিত্তাকর্ষক ব্যাপার। সেই ছবি গুলি দেখলে এখনো ভালো লাগে – দিনান্তের এই এক কোনাতে, সন্ধ্যা মেঘের শেষ সোনাতে’ – সেই মিলিয়ে যাওয়ার ছবি। নীচে মিলিয়ে দেখা যেতেই পারে, আমি বাড়িয়ে বলছি কিনা –

দূরে কোথায়, দূরে দূরে

নুব্রাতে আমরা দেখেছি ‘দিক্সিত গুম্ফা’! এখানে মৈত্রেয় বুদ্ধর যে মূর্তিটি আছে তা লাদাখে সর্ববৃহৎ।

মৈত্রেয় বুদ্ধের মূর্তি ও পদতলে ভক্তগণ

এইবার একটু বিস্তারিত ভাবে বলা যাক নুব্রা উপত্যকার কথা। এখানে থাকা সত্যিই এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। এখানে থাকার জন্য কোন ইঁট-কাঠের তৈরি হোটেল নেই। আছে অসংখ্য তাঁবু, সারে সারে। কিন্তু তাদের মধ্যে কি অপূর্ব সাজ সরঞ্জাম! প্রয়োজনীয় সব কিছুর ব্যবস্থা করা আছে। আলোর ব্যবস্থা তো আছেই, আছে সুন্দর খাট বিছানা, ড্রেসিং টেবিল, লাগোয়া বাথরুম, সামনে একফালি বারান্দা এবং শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও – একটি ছোট্ট জানালা।

নুব্রার সেই তাঁবুগুলি – ভিতর ও বাহিরে, সদলবলে

আর সুন্দর গ্রাম্য পরিবেশ। সকালে উঠে সেই একফালি বারান্দাতে বসে চা খেতে খেতে প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলা চলে। আমি মফস্বলের ছেলে, ছোটবেলাতে এরকমই দেখেছি। বাড়ির বারান্দাতে কাগজ এলে, সবাই মিলে ভাগাভাগি করে পড়া হত। উত্তেজনাপূর্ণ খবর নিয়ে আলোচনা হত পাশের বারান্দার কাকুদের বা ভাইদের সঙ্গে। এখানে সকালের চা জলখাবার খেয়ে আবার শুরু হল পাড়া বেড়ানো। নয় নয় করে আমাদেরই তো নিজস্ব ন খানা তাঁবু। তাই খুব হৈ চৈ আনন্দ করে থাকা গেল। যদি কোন ভ্রমণকারীর দল বেশ ভারী হয়, তাঁরা একাধিক দিন এখানে থাকতে পারেন। বেশ একটা অন্যরকম অনুভূতি, নিজেদের কৈশোর বা শৈশবকে ফিরে পেতে পারেন।

ঘুরে বেড়িয়ে সন্ধ্যাবেলা ফিরে এস চা আর পকোড়া খেতে খেতে গান গল্প ছিল চমৎকার। পরিষ্কার আকাশ, একেবারে ‘তারায় তারায় খচিত’। দূষণমুক্ত এরকম পরিবেশ, খোলা জায়গায় নির্মল আড্ডা, গান, তর্ক – বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল আমাদের শৈশবের দিনগুলির কথা। আবার ফিরে আসতে হল লেহ তে,  ফেরার পথেও আবার পড়ল খারদুংলা।

‘খারদুংলা’র অর্থ হল ‘Pass of Lower castle’। এর ঐতিহাসিক গুরুত্বও আছে, মধ্য এশিয়ার কাসগর থেকে লেহ আসার জন্য এই পথটি ব্যবহৃত হত। প্রত্যেক বছর হাজার হাজার উট ও ঘোড়া এই পথ দিয়ে ব্যবসার জিনিষপত্র নিয়ে যেত। আবার রাজনৈতিক গুরুত্বও কম নয়, এই পথ ধরেই সিয়াচেন গ্লেসিয়ারে সব সরবরাহ হয়। এই পথটির নির্মাণকার্য শুরু হয় ১৯৭৬ সালে, ১৯৮৮ সালে তা সাধারনের জন্য খুলে দেওয়া হয়। তারপর থেকেই শুরু হয়ে গেছে বিভিন্ন যাত্রীদের আনাগোনা।

নুব্রা আর খারদুংলার কনকনে ঠাণ্ডা থেকে ফিরে লেহ শহরে দেখি রীতিমতো গরম। উফফ! সকলেই যারপরনাই বিরক্ত। ঘরে ফ্যান নেই, শীতের দেশে কি আর ফ্যান থাকবে? গোদের ওপর বিষফোঁড়া আর কাকে বলে – হোটেলের ঘরে ঢুকে দেখি বড় বড় লেপ মাথা উঁচু করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কি কাণ্ড!! শীতের দেখা নাই অথচ শীতবস্ত্রের সম্ভার! আগেকার দিন হলে চোখের জ্যোতিতে লেপকে ভস্ম করে দেওয়া যেত।

পরদিন যাত্রা লেহর আশে পাশে – এলচি গ্রাম, সিন্ধু উপত্যকা ও প্রাচীন নদী।

সকালে উঠেই প্রতিদিনের মতই গাড়ীতে ভাগ হয়ে আমরা বেরোলাম। প্রথমেই আমরা দেখতে গেলাম লাদাখ শহরের মধ্যেই ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর বিখ্যাত মিউজিয়াম – “Hall of Fame”!

লেহ শহরের বিশাল চত্ত্বর জুড়ে ছড়িয়ে আছে আমাদের সেনা বাহিনীর অতন্দ্র প্রহরা। এই জায়গাটি সীমান্তের খুব কাছে। এর কিছুদূরে গেলেই পাওয়া যাবে কার্গিল যার নাম শুনলেই আমাদের মনে পড়ে ১৯৯৯ সালের মে -জুন-জুলাই মাসের সেই দিনগুলির কথা। আমরা যখন লেহ গিয়েছিলাম, সেই বিজয়ের ১৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে কার্গিলে অনুষ্ঠান হচ্ছিল। লেহ তে যে বিজয় সৌধটি আছে তা দেখার জন্য সকল ভ্রমণকারীকে অনুরোধ করব একটি দিন ধার্য করে রাখার জন্য। ফটো তোলা সম্ভব নয়, তাই ভেতরে গেলে আর না দেখলে বোঝা যাবেনা আমাদের সেনাবাহিনীর লোকজন কি অসহ্য কষ্ট স্বীকার করে আমাদের ভারতভূমির অখন্ডতা বজায় রাখছেন। সৌভাগ্যক্রমে এক বাঙালী ভদ্রলোকের কাছে বেশ কিছু রোমহর্ষক গল্প শোনা গেল। দেখা গেল যুদ্ধের বিভিন্ন ছবি। আর সেই যোদ্ধাদের যাদের কাছে ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ তাই ‘চিত্ত ভাবনাহীন’ ভাবে তাঁরা দেশমাতৃকার সেবায় ব্যাপৃত সিয়াচেন ছোট্ট বাংকারে দিনাতিপাত করে কিভাবে যে তাঁরা দেশরক্ষা করছেন তাঁরাই জানেন।

এখানে একটি তথ্য চিত্র দেখানো হয়। ‘অপারেশন ভিজয়’! কার্গিল যুদ্ধের বহু মূল্যবান ফুটেজ দেখতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন সৈনিকের বলিদান দেখতে দেখতে চোখে জল আসে – তথ্য চিত্রটি সমাপ্ত হয় সেই বহুল প্রচলিত – ‘মেরে বতন কি লোগ’ দিয়ে। কিন্তু এই শহীদদের আত্মত্যগ দেখতে দেখতে আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল আর একটি বাংলা গানের কথা যা ঐ গানটির মতই দেশ স্বাধীন হওয়ার সময়ই রচিত – গানটির স্রষ্টা শ্রী মোহিনী চৌধুরী –

“কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা / বন্দীশালার ঐ শিকল ভাঙা
তারা কি ফিরিবে এই সুপ্রভাতে / যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে
মু ক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হলো বলিদান
লেখা আছে অশ্রুজলে।”


       বিখ্যাত ‘হল অফ ফেম’

চোখের জল মুছে আমরা এবার রওয়ানা দিলাম আরো প্রাচীন ইতিহাসের দিকে।

‘লাদাখ’ – এই তিব্বতী শব্দের অর্থ –‘গিরিবর্ত্মের দেশ’। ‘লা’ শব্দের অর্থ যে গিরিবর্ত্ম (pass) তা তো আমরা জানি – বিভিন্ন নাম শুনেই আসছি, – চাংলা, ফোতুলা, জোজিলা ইত্যাদি। লাদাখ যেহেতু এমনিতেই অনেক উঁচু, স্বাভাবিকভাবেই এখানে গিরিবর্ত্মের ছড়াছড়ি। প্রাচীনকালে রেশম ব্যবসার রমরমা ছিল, ছিল রেশম পথ (Silk Route)। লাদাখের মধ্যদিয়ে ভারতে যেত এই পথ।

এখানে ‘আলচি’ নামের একটি গ্রাম আমরা দেখতে গিয়েছিলাম। গ্রামটি পরিত্যক্ত হলেও এখানে একটি দর্শনীয় মনাস্টারি আছে। মনাস্টারির গায়ে সুন্দর কাজ। অদ্ভুত ব্যাপার হল, মনাস্টারি হলেও এখানে আবার রয়েছে পাঁচ পাঁচটি মন্দির।

এটি যেতে আমাদের পার হতে হল সিন্ধু উপত্যকা। এখানে এক অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্যের সাক্ষী হলাম আমরা। দুটি নদীর সঙ্গম স্থলে উপস্থিত হলাম আমরা। ’জানস্কর’ (Zanskar) নদীটি গিয়ে পড়ছে সিন্ধু নদীতে। দুটি নদীর জলের রঙ আলাদা, আবার তাদের গতিবিধিও আলাদা। হবেই তো, জানস্কর হল খরস্রোতা পার্বত্য নদী সিন্ধু হল উপত্যকার। সিন্ধুর রঙ ঝলমলে নীল, জানস্করের রঙ কালচে সবুজ।  

  আলচি গ্রামে   সিন্ধু ও জানস্কার মিলনস্থল

এবারে আমরা মুখোমুখি হলাম প্রকৃতির এক অদ্ভুত খেয়ালের সঙ্গে। Magnetic Hill বা চৌম্বক পাহাড় লাদাখের এক দর্শনীয় স্থান। এখানকার ভৌগোলিক প্রকৃতি একটি চৌম্বকীয় আকর্ষণ এমনভাবে তৈরী করে যে পার্বত্য রাস্তায় যে গাড়ীর নীচে যাওয়ার কথা, চুম্বক ক্ষেত্রের প্রভাব মাধ্যাকর্ষণকে অতিক্রম করে তাকে উপরে টেনে নেয়। এই নিয়ে অবশ্য অনেক মতভেদ ও আছে, কারুর মতে এটি হল দেখার ভুল – Optical Illusion. আমার তরুণ পাঠকরা যখন যাবেন বেড়াতে, তারাই পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ধারণ করে নেবেন। এর কাছেই পাথর সাহিব, সেটি গুরু নানকের স্মৃতি বিজড়িত একটি সুন্দর গুরুদ্বোয়ারা। গুরু নানক তিব্বত ভ্রমণ করে ফেরাকালীন এই গুরুদ্বোয়ারাতেই বিশ্রাম নিয়েছিলেন। আমরাও সেই প্রাতস্মরণীয় মহাজ্ঞানী, মহাজনের পন্থানুসরণ করে সেই গুরুদ্বোয়ারাতে আমরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম, প্রসাদও পেলাম।

ম্যাগ্নেটিক হিল, পাহাড় ও পাথর সাহিব গুরুদ্বোয়ারা

‘বহতী হাওয়াসা থা ওহ / উড়তী পতঙ্গ সা থা ওহ / কঁহা গয়া উসে ঢুঁড়ো’

আমাদের গাড়ী যাচ্ছিল লেকের দিকে আর আমার কানে ভেসে আসছিল সেই  ‘থ্রী ইডিয়টস’ সিনেমার নায়ক ‘র‍্যাঞ্চো’র জীবনসঙ্গীত। সকলেই জানেন যে প্যাংগং লেকে সিনেমার সেই বিখ্যাত স্কুটার দৃশ্যের স্যুটিং হয়েছিল আর তারপর থেকেই এই জায়গাটি এত জনপ্রিয় হয়।  সেখানকার বাসিন্দারা সকৃতজ্ঞ চিত্তে স্বীকার করেন, একটি বোর্ডে তাঁরা সেই স্বীকারপত্র দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু উল্টো বিপত্তিও ঘটেছে। অধিকাংশ ভ্রমণার্থীরা পরিবেশ সচেতন নন বলে সেই সুন্দর পরিবেশে আবর্জনার পাহাড় জমা হচ্ছে।

যাক সে কথা। আমরা কিন্তু প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ, জল যে এত পরিষ্কার হতে পারে জানা ছিল না। এই লেকটির এক – তৃতীয়াংশ ভারতের আর বাকী অংশ চীনের। অর্থাৎ ভারত চীন সীমানা প্যাংগং লেকের ওপর দিয়েও গেছে।

নীল আকাশ, সাদা মেঘ, স্বচ্ছ জলরাশি

এখানে পৌঁছেই দেখি সকলের স্মৃতি উদ্বেল হয়ে ওঠে, আর ভীষণভাবে ছবি তোলার প্রবণতা প্রবল হয়ে ওঠে। তাতে আমি দোষের কিছু দেখিনা। এরকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পরিপ্রেক্ষিতে কেই বা না চাইবে নিজেকে ধরে রাখতে? এমনকি ব্যসস্ত, অন্যমনস্ক ক্যামেরাম্যান ও ধরা পড়ে যেতে পারে অন্য ক্যামেরার বিষয় হয়ে!

সেই রাত্রে আমাদের তরুণ বাহিনী বেশ কিছুক্ষণের জন্য গায়েব হয়ে আমাদের একটু বিপত্তিই ঘটিয়েছিল। তাদের ইচ্ছে ছিল একটু চারপাশ ঘুরে দেখার, কোন কারণে আমরা জানতে পারিনি। ব্যস, কয়েক ঘন্টার মধ্যে বেশ আতঙ্কিত পরিবেশ! তারপর তারা ফিরে এসে আমাদের আতঙ্কিত দেখে একটু আশাহত – তারো তো বড় হয়েছে, কোথায় আর তারা হারাবে? কিন্তু বড়দের মন কি আর মানে? তবে যাইহোক, পরদিন সূর্যোদয় দেখে আমরা সকলেই অভিভূত হলাম। সে কথা একটু সবিস্তারে জানানো দরকার।

সূর্য ওঠার বিভিন্ন রকম ভাব থাকে, সাগরে সূর্যোদয় দেখা যায় যেন এক রঙীন থালা জলের মধ্যে থেকে উঠে এল। আবার পাহাড়ে সূর্য যেন লাফিয়ে চড়ে বসে। বেশ আচমকাই। এখানে সূর্যোদয় বেশ আলাদা। প্রথমে দেখা গেল প্যাংগং লেকের চারধারের পাহাড়ে রঙীন আভা, খুব আস্তে আস্তে পাহাড়ের গা রক্তবর্ণ ধারণ করছে। তারপরে যেন আগে থেকে জানান দিয়ে, আমাদের মানসিক ভাবে প্রস্তুত করে তিনি আস্তে আস্তে অবতীর্ণ হলেন। অপূর্ব! সৌভাগ্যবশতঃ আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটাও ছিলনা, পুরোটাই দৃশ্যমান হল। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। ভাষায় বর্ণনা করার আমার ক্ষমতা নেই , নীচের ছবিগুলি দেখলে কিছুটা হয়তো আঁচ পাওয়া যেতে পারে।

সূর্য তাকাও, আলো ছড়াও

মেঘের ফাঁকে, দিওনা লুকি

এরপরে আমাদের যাত্রা করতে হবে লেহর পথে। প্যাংগং ই ছিল আমাদের শেষ দ্রষ্টব্য। পথে যেতে পড়ল হেমিস গুম্ফা।

এটি লাদাখের সর্ববৃহৎ মনাস্টারি। প্রতি বছর জুন / জুলাই মাসে এখানে একটি অনুষ্ঠান হয় – হেমিস ফেস্টিভ্যাল। তিব্বতীদের গুরু পদ্মসম্ভবের জন্মতিথিতেই এই উৎসব হয়। পুরো লাদাখ জুড়ে হলেও প্রাণকেন্দ্র এই মনাস্টারি। এখানকার স্থানীয় মানুষ এবং ভ্রমণার্থী – উভয়ের কাছেই এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।

হেমিস মনাটারির বোর্ড ও ভিতরের দৃশ্য

পরের দিন সকাল বেলা আমরা বেরিয়ে পড়লাম লাদাক থেকে। আমাদের দেশেই এক ভূস্বর্গ ভ্রমণের স্মৃতি থেকে যাবে চিরকালীন হয়ে।

লাদাখ ভ্রমণেচ্ছুদের আমি কিছু বলতে চাই। প্রকৃতির এক অপরূপ অংশ যা সৌভাগ্যক্রমে আমাদের দেশেই রয়ে গেছে। নিঃসন্দেহে অতীব দর্শনীয়। যদি লাদাখের ভূগোল ও ইতিহাস নিয়ে একটু পড়াশোনা করে আসেন, তাহলে ভ্রমণটি নিঃসন্দেহে অনেক বেশী চিত্তাকর্ষক হবে। শারীরিক ব্যাপারে ঝুঁকি না নেওয়াই ভাল, ডাক্তারের পরামর্শ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা উচিত। সব ওষুধ-পত্তর হাতের কাছে থাকাই ভাল, কোনরকম শ্বাসকষ্ট, বমনোদ্রেক, জ্বর, কাশি বা গা, হাত-পা ব্যাথা করার সম্ভাবনা প্রবল। সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিলে কোনই সমস্যা হবে না।

তবে এই পরিবেশকে রক্ষা করার দায়িত্বও কিন্তু আপনার। ‘থ্রী ইডিয়টস’ ছবিটির সূত্রে প্রচুর ভ্রমণার্থীর আসছেন প্যাংগং লেকে। দুর্ভাগ্যবশত তাঁদের অযত্ন, অবহেলাতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এটি খুবই গ্লানির। তাই সুন্দর জায়গাটিকে দেখে আসার সময় লক্ষ রাখবেন আপরার পরবর্তী ভ্রমণকারীদের জন্য তা সযত্নে রক্ষিত থাকে।

              বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার –

লেখাটি কিছুটা সংক্ষিপ্তাকারে গতবারের শারদীয়া ‘হাট্টিমাটিম’ পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল। সম্পাদক শেখর বসু ও প্রকাশক ‘দ্য কাফে টেবল’ এর অনুমতি পূর্বক আমার ব্লগে পুনঃপ্রকাশিত হল।

12 thoughts on “পরিবেশের পুণ্যভূমি – লেহ – লাদাখ

  1. অসাধারণ বর্ণনায় আবার করে যেন ঘুরে এলাম, বড় মধুর লাগলো,অনুভূত হল সেইসব ঘটনা,কিছুক্ষণের জন‍্য হারিয়ে গেছিলাম।।।

    Like

  2. দারুন এক বর্নময় ভ্রমন কাহিনির মধ্যে দিয়ে জানলাম লেহ-লাদাখের অনেক না জানা কথা…….।এমন সুন্দর একটি লেখা উপহার দেওয়ার জন্য লেখককে অশেষ ধন্যবাদ ।।

    Liked by 1 person

  3. ভীষণ ভালো লাগল. মনে হল চলে গেছি লাদাখে. লেখার মধ্যে বেশ বেড়ানোর সংগে আনন্দ যুক্ত হয়েছে. এবার আমেরিকা ভ্রমণ কাহিনী হয়ে যাক

    Liked by 1 person

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s