আমার কৈশোরে আমার এক নায়ক ছিলেন। তিনি একজন লেখক, কিন্তু তাঁকে পড়া যেত না, শোনা যেত রেডিওতে। প্রতিদিন রাত দশটায়।
পরে জেনেছি আমার মত তাঁর আরো অনেক ভক্ত ছিল। একজন দেবব্রত বিশ্বাস।
তরুণ চক্রবর্তী র সঙ্গে আলাপচারিত তে অনুরোধ করেছিলেন, “আমি মারা গেলে আমাকে নিয়ে যে সংবাদ পরিক্রমা লিখবেন প্রণবেশ সেন, সেটি আপনিই পড়বেন।”

সংবাদ পরিক্রমা নামে তাঁর বেতার ভাষ্যের জন্য শ্রোতাদের ছিল উৎকর্ণ প্রতীক্ষা। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিতে তাঁর বেতার ভাষ্যের জনপ্রিয়তা ছাড়িয়ে যায় বেতারের অন্য সব অনুষ্ঠানকে।বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ সম্মানে ভূষিত হন। এই স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তিতেও তাঁকে মরণোত্তর সম্মান জানান বাংলাদেশ সরকার।
আমার লেখাটি আর একটু পরের। সাতের দশকের মাঝামাঝি কোন এক সময়ের। ঘটনাটি মিনিবাসের মধ্যে প্রেম ও রবিঠাকুর।
এইরকম এক ২৪শে বৈশাখ একটি কথিকা লিখেছিলেন উনি। স্মৃতি থেকেই ভাগ করে নিচ্ছি বন্ধুদের সাথে। তখন কলকাতায় সদ্য মিনি বাস চালু হয়েছে। গরমে ক্লান্ত প্রণবেশ এক মিনিবাসে উঠে একটু ক্লান্ত হয়ে নিদ্রালু হয়ে পড়েন।
হঠাৎ কানে এল খুব হাল্কা ভাবে রবীন্দ্র সঙ্গীত। লক্ষ করলাম আমার পিছনের সীটে একজোড়া কপোত কপোতী। সম্ভবতঃ সদ্য বিবাহিত। তারা নিভৃতে আলাপ করছে। মেয়েটি ছেলেটিকে অনুরোধ করে যাচ্ছে আর ছেলেটি সুরেলা কন্ঠে একটু নীচু স্বরে একের পর সেই অনুরোধ রাখছে। নিজের অজান্তেই আমি সেই অনুরোধের আসরের একমাত্র শ্রোতা। মেয়েটির অনুরোধ এ ছেলেটি শুনিয়েছে, ‘আমার পরান যাহা চায়, সখী, ভাবনা কাহারে বলে, আমি তোমায় যত বা মনে হল যেন পেরিয়ে এলেম, — অনেকগুলি গান।
সেই গ্রীষ্মকাল, গরমের দাবদাহ থেকে মুক্তি পেতেও রবীন্দ্রনাথ!!
হঠাৎ মেয়েটির খেয়াল হল যে তারা পেরিয়ে গেছে গন্তব্য! ছেলেটি কে ডেকে কন্ডাকটরকে ডেকে বাস দাঁড় করিয়ে নেমে গেল। কন্ডাকটর যথারীতি বিরক্ত। খুব জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো – ‘উফফ, এতক্ষণ ধরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে, শুনতে পাননি নাকি?”
হায়, বেচারা কন্ডাকটর! তারই বা কি দোষ? সে তো জানে না এই মুহূর্ত গুলি তে কি এক স্বর্গ রচনা হয়েছিল।”


উনি কিন্তু কন্ডাকটরকেও সহানুভূতির চক্ষে দেখেছিলেন। এমনই ঐ গান, প্রলেপ লাগিয়ে দেয়।
সব মিলিয়ে এসেই গেল পঁচিশে বৈশাখ।
জয়তু রবিঠাকুর।
সেই গানগুলির থেকে একটি গান নিয়ে- প্রিয় গায়কের কণ্ঠে –
রবিঠাকুরকে উদ্দেশ করে তো বলা যেতেই পারে –
দূরে হতে আমি দেখেছি তোমার ওই বাতায়ন-তলে
নিভৃতে প্রদীপ জ্বলে–
আমার এ আঁখি উৎসুক পাখি ঝড়ের অন্ধকারে॥