রাজা কহিলেন, “দেবমন্দির হইতে যদি সে দূর হয় তো ক্রমে মানবের হৃদয় হইতেও দূর হইতে পারিবে।” পশ্চাৎ হইতে একটি পরিচিত স্বর কহিল, “না, মহারাজ, মানবহৃদয়ই প্রকৃত মন্দির, সেইখানেই খড়্গ শাণিত হয় এবং সেইখানেই শত সহস্র নরবলি হয়। দেব-মন্দিরে তাহার সামান্য অভিনয় হয় মাত্র।” – রাজর্ষি – রবীন্দ্রনাথ
উপরোক্ত পংক্তিটির দুটি ব্যাখ্যা হতে পারে। একটি নঙর্থক – এই উদাহরণ আমরা ভুরি ভুরি দেখছি। বস্তুতঃ রাজর্ষিতে রবীন্দ্রনাথ ও এই অর্থেই ব্যবহার করেছেন। যুগ যুগ ধরে ধর্মের নামে যে হিংসা চলেছে আসলে তা মানব হৃদয়ের শাণিত খড়্গের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
আজকের ভারতবর্ষের দিকে তাকালে যে হিংসার পরিবেশ দেখতে পাচ্ছি, তা ও আমাদের অন্তরের নিজস্ব হিংসার ‘অভিনয় মাত্র’! বস্তুতঃ জীবনের শেষ দিকে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রতি খুবই বেশিমাত্রায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। ‘মানবপুত্র’ কবিতায় লিখছেন –
সেদিন তাঁকে মেরেছিল যারা
ধর্মমন্দিরের ছায়ায় দাঁড়িয়ে,
তারাই আজ নূতন জন্ম নিল দলে দলে,
তারাই আজ ধর্মমন্দিরের বেদীর সামনে থেকে
পূজামন্ত্রের সুরে ডাকছে ঘাতক সৈন্যকে —
বলছে ‘মারো মারো’।
মানবপুত্র যন্ত্রণায় বলে উঠলেন ঊর্ধ্বে চেয়ে,
‘হে ঈশ্বর, হে মানুষের ঈশ্বর,
কেন আমাকে ত্যাগ করলে।’
কবিতাটি অবলম্বনে একটি গান রচনা করেন তিনি। যেটি গীত হয় ২৫শে ডিসেম্বর ১৯৩৯ সালে, তাঁর জীবনের একেবারে শেষের দিকের বড়দিনে।
গানটিতে তিনি কিন্তু আরো উচ্চকণ্ঠে বললেন,
গর্জনে মিশে পূজামন্ত্রের স্বর–
মানবপুত্র তীব্র ব্যথায় কহেন, হে ঈশ্বর!
এ পানপাত্র নিদারুণ বিষে ভরা
দূরে ফেলে দাও, দূরে ফেলে দাও ত্বরা।।
খুব ছোটবেলাতে প্রথম অশোকতরু বন্দ্যোপাধায়ের গলাতে শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল গানটির, এক অনুষ্ঠানে। তারপর থেকে সেটিই কানে লেগে আছে। ওঃ! কি গর্জন ছিল প্রতিবাদের।
কিন্তু এর একটি সদর্থক দিকও হতে পারে – মানব হৃদয় যদি এতই শক্তিশালী তাহলে তা যদি অন্য ভালো কাজে ব্যবহৃত হয় তাতে অসাধারণ সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা। একেই আর এক যুগনায়ক ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে –
If you think you can do a thing or think you can’t do a thing, you’re right. –
Henry Ford
অর্থাৎ তোমার কর্মের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করছে তোমার নিজস্ব ‘অন্তরতম’ প্রত্যয়ের ওপর। বাইরের জগতের অনুপ্রেরণা থাকতেও পারে, কিন্তু নিজেকে মানসিক বলে বলীয়ান করে রাখতে হবে।
মনে পড়ে সেই ও হেনরির ‘শেষপাতা’ (The last Leaf) গল্পটি? বা তার থেকে কিছুটা হলেও অনুপ্রাণিত পরশুরাম প্রণীত ‘বটেশ্বরের অবদান’ গল্পটি? যখনই নায়িকাকে তাদের মত করে বোঝানো হল, তাদের বাঁচার ইচ্ছে ফিরে এল এবং তারা সুস্থ হয়ে গেল। তাদের চিকিৎসকরাও স্বীকার করলেন রোগী বাঁচার ইচ্ছেই তাকে সুস্থ করে তুলেছে।
সুতরাং মনকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে। তাহলে সেখানেও ‘প্রকৃত সাফল্য রচিত হবে’ আর ‘বহির্জগতে ইহার অভিনয় হইবে মাত্র’!
সাধনার উদ্দেশ্য অন্তরকে শুদ্ধ করা, বলশালী করা! সেই সাধনাতে সারাজীবনই তিনি ব্রতী। অনুপ্রাণিতও করেছেন অনেককে।
পড়ুয়াদের শরীরচর্চার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে রবীন্দ্রনাথ জাপান থেকে যুযুৎসু শিক্ষককে আমন্ত্রণ জানিয়ে আশ্রমে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর নাম তাকাগাকি। কিন্তু সমস্যা হল তখনকার শান্তিনিকেতনের ছাত্রীরা বড়ই লাজুক, তারা অংশগ্রহণে অনিচ্ছুক।
এগিয়ে এলেন তিনি। ‘গান দিয়ে দ্বার’ খোলানোতে তাঁর চিরকালীন পারদর্শিতা।
রাণীচন্দ লিখছেন, তাঁর ‘গুরুদেব’ বইটিতে –

শান্তিদেব ঘোষ লিখছেন – ‘জীবনের ধ্রুবতারা’ বইটিতে –

তথ্যসূত্র – http://www.gitabitan.net/top.asp?songid=774
গানের সুর আর কথাগুলি কি অপূর্বভাবে আমাদের আজও অনুপ্রাণিত করতে পারে ভেবে অবাক লাগে।
“আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়”
প্রসঙ্গত এই গানটি তিনি চিত্রাঙ্গদা গীতিনাট্যেও ব্যবহার করেন।
“মুক্ত করো ভয়,
দুরূহ কাজে নিজেরি দিয়ো কঠিন পরিচয়”!
এও কি আজকের কথা নয়?

প্রাক পঁচিশে বৈশাখে অনুপ্রাণিত হওয়ার প্রচেষ্টা –
অপূর্ব তথ্যভিত্তিক লেখা। রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তরে জড়িয়ে রয়েছে। ওনার লেখা বিশেষ করে প্রবন্ধগুলি ভাবিয়ে তোলে। গান জীবনের চলার পথে পাথেয়। যখন এগুলির সঠিক মুল্যায়ন চোখে পড়ে যেমন এই লেখাটির মাধ্যমে পেলাম এক নতুন অনুপ্রেরনা পাই। অশেষ ধন্যবাদ ভাস্কর বসু মহাশয় কে।
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ
LikeLike