শারদীয়া সাহিত্য ১৪২৬ – পাঠ প্রতিক্রিয়া – ১
কোন শিল্প বা সাহিত্য সমাজে একটি নির্দিষ্ট যুগকে স্বর্ণ যুগ বলে সম্ভবত ঠিক চিহ্নিত করা মুশকিল। সেটা মেনে নিয়েও একথা আমরা বাঙালীরা স্বীকার করি যে পাঁচের বা ছয়ের বা কিছুটা সাতের দশকেও বাঙালী মনন খুব উচ্চমার্গে যাতায়াত করতো। সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান, খেলা, সিনেমা, চিত্রকলা – সবেতেই বাঙালীরা যে সারা ভারতের তুলনাতে এই সময় যে বেশ কিছুটা এগিয়ে ছিলেন, তা অনেকেই স্বীকার করেন। এই উপন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতই উক্ত সময়কালই।

সৌরভের নিজের কথায় –
তখন কলেজ-জীবন। মাঠের আড্ডায় উত্তাল হয়ে ওঠে তর্ক, আলোচনা, মত-বিনিময়, তথ্য লেনদেন। রুপোলি পর্দার প্রিয় মুখদের নিয়ে, সোনালি গানের ঈশ্বর-ঈশ্বরীদের নিয়ে। ঝোঁকের মাথায় হঠাৎ হঠাৎ মনে হত, আহ্, কী সব জীবন… এদের নিয়ে আস্ত মস্ত উপন্যাস লেখা যায় কী দুর্দান্ত!
উপন্যাসের কেন্দ্রে আছেন – মণিময় মিত্র যিনি শিল্পী, গায়ক। যাঁর সুরের কন্ঠজালে বাঙালী দর্শক মাতোয়ারা। গায়ক মণিময় মিত্রের জীবনে দু – দুটি মণি-কাঞ্চন যোগ আসে, একটি সঙ্গীতস্রষ্টা অরুণেশ এর সঙ্গে, অন্যটি ম্যাটিনি আইডল সিনেমার নায়ক নীহার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। দুটি যোগের ফলে প্রসূত হয় অসংখ্য ‘সোনার ধান’। উজ্জীবিত হয়ে ওঠে তিন প্রতিভাই। কিন্তু কালের লিখন মিলে যায়, এড়ানো যায় না ব্যক্তিত্বের সংঘাত। মণিময়ের জীবন থেকে সরে যান অরুণেশ, সরে যান নীহারও। সেই টানাপোড়েন, সংঘাত, মিলিত ফসল, শিখরে আরোহণ, না পাওয়ার দুঃখ, তীব্র মনোমালিন্য, দুঃখময় আত্মহনন, শিখরচ্যুতি – এই সবই এই উপন্যাসের উপজীব্য। রূপোলী পর্দার উপরে যে নাটক হয় তার চেয়ে অনেক বেশি নাটক অন্তরালে।
সাধুবাদ দিতে হয় সৌরভকে এমন একটি বিষয়কে ঠিক মাপে ধরার জন্য। এরকম উপন্যাসে পরিমিতিবোধ ও শৈলী খুব গুরুত্বপূর্ণ। বলতে দ্বিধা নেই সৌরভ সে পরীক্ষাতে সসম্মানে উত্তীর্ণ। কেন্দ্রীয় চরিত্রের সঙ্গে পার্শ্ব চরিত্রের সম্পর্কের যে ঠাস বুনোট তৈরী হয়েছে তা উপন্যাসের গতিকে কখনো শ্লথ হতে দেয়নি।
তিনটি চরিত্রই নিজেদের প্রস্তুত করেছে, তাদের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশের জন্য। মণিময় গানে, অরুণেশ সঙ্গীত রচনাতে এবং নীহার অভিনয়ে। তাদের প্রস্তুতি পর্বের এই কাহিনীতে যথেষ্ট পরিমাণ ডিটেলের আয়োজন রেখেছেন লেখক। এর থেকে বোঝা যায় এই উপন্যাসের যোগ্য প্রস্তুতি তিনি নিয়েছেন, একেবারে কল্পনার ফানুস উড়িয়ে লঘু মনোরঞ্জন করতে তিনি আসেননি। সবচেয়ে সংশয় ছিল অরুণেশ ও মণিময়ের গান সংক্রান্ত প্রস্তুতি নিয়ে, কথা ও সুর উভয়তই। বলতে দ্বিধা নেই, এই পর্বেও মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন সৌরভ –সলিলের ‘সোজা পথের ধাঁধায় আমি অনেক ধেঁধেছি’ কে ভেবে চিন্তে করেছেন “নিয়মের নিগড় পরে বারণের গর্তে শোওয়া —–। ‘গাঁয়ের বধূ’ হয়েছে ‘পথের মা’। ‘আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা’ – হয়েছে – ‘তুফানকে তুমি জিজ্ঞেস কর আমায় সে চেনে কিনা’! মুকুল দত্তের (উপন্যাসে – প্রসূন বিশ্বাস) ‘ফেরানো যাবে না আর চোখ তার নীল চোখ থেকে’ হয়েছে ‘সাগরের তট ধরে হেঁটে গেছি বহুদূর / ঢেউ শুধু ঢেউ আর বালি”। ছোটর মধ্যে ভাল লেগেছে ‘নবেন্দু সেনগুপ্ত’র চরিত্রটি। মণিময়ের প্রতি তাঁর অবিচার যে অনেকটাই গোপনে লালিত ঈর্ষাসঞ্জাত তা দেখানো গেছে মণিময়ের স্ত্রী অতসীর সঙ্গে তাঁর কথোপকথনে। কৃষ্ণা সরকার চরিত্রটিও ছোটর মধ্যে যথাযথ, দুই প্রতিভার মধ্যে তাঁর অনিশ্চয় অবস্থান এবং বেদনাদায়ক পরিণতি মর্মস্পর্শী।
নীহার চ্যাটার্জীর মধ্যে সমকালীন বাঙালীরা তাঁদের প্রিয় ‘নায়ক’ কে নিশ্চয় খুঁজে পাবেন। বিপর্যস্ত নীহার তাঁর ব্যর্থতার কারণ খুঁজে পান – নীহার – মণিময় – বল্লরীর রসায়নে সকলের যে চূড়ান্ত সাফল্য, তা প্রমাণ করে যে ত্রয়ীর অনিবার্যতা। পরবর্তী কালে নায়িকা বল্লরীর সঙ্গে প্রেম এবং বিচ্ছেদের মর্মস্পর্শী কাহিনিও গভীর ভাবে দাগ কাটে। মণিময়ের দুর্ভাগ্য, সেই বিচ্ছেদের পেছনেও দায় থাকে তাঁর, নিজের অজান্তেই।
তবে মণিময়ের চরিত্রে কোন রকম ‘পাঁক’ লাগতে দেননি লেখক। এটা যেন একটু আদর্শ চরিত্র, একটু আধটু খাদ মেশালে ক্ষতি ছিল কি? এমনকি স্বামী হিসেবেও স্ত্রীর কাছে? নাঃ, এটা একটু বাড়াবাড়ি। অতসী, বল্লরী, কৃষ্ণা, নীহার, অরুণেশ, নবেন্দু, রেখা – সবাই যেন কোন না কোন ভাবে তাঁর প্রতি মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থেকেছে। কোনরকম বিচ্যুতিই নেই তাঁর মধ্যে, না শিল্পীজীবনে না ব্যক্তিজীবনে।
আর একটা ব্যাপার। সময়ের কোন ছাপ তিনি যেন সতর্ক ভাবে এড়িয়ে গেলেন। অর্থাৎ ঘটনার পাত্র পাত্রীরা ঠিক কোন সময়ে তাদের পূর্ণতা অর্জন করলেন আর কবে গ্রহণে গেলেন তা আমাদের অনেকটাই অনুমান করে নিতে হয়। আমার মনে হয় এই সময়ের কিছু বাস্তব ঘটনাবলীর ছাপ থাকলে চরিত্রগুলির হাঁটাচলা বুঝতে আমাদের সুবিধে হত। হয়তো আমরা বুঝতে পারছি চরিত্রে কাদের ছাপ, কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের যাঁরা পড়বেন তাঁদের পক্ষে একটু মুশকিল হতে পারে। ঐতিহাসিক ঘটনা তো নেহাৎ কম ছিল না, পাঁচের দশকে পথের পাঁচালী, জীবনানন্দের মৃত্যু, স্বাধীনতার দশম বর্ষ পূর্তি – ছয়ের দশকে ভারত চীন বা পাক ভারত যুদ্ধ, নকশাল আন্দোলন ইত্যাদি। অথবা রূপোলী জগতের মানুষেরা অনেকেই ফুটবলের অনুরাগী ছিলেন, সে সময়কার লীগ বা শিল্ড ম্যাচের উত্তেজনা স্টুডিয়োতে চলে আসতো, সেটা নিয়ে খুব মজার মন কষাকষি ও হত। সেসময়কার কোন খেলোয়াড়ের কথা রাখলেও সময়ের ছাপ থেকে যেত।

সূক্ষ্মভাবে একবার দুবার অবতারণা করেছেন – মণিময় বাংলা লিরিকের ব্যাপারে বলছেন-“পোস্ট ইন্ডিপেন্ডেন্স বাংলা গানের বিষয়বস্তু আর ভাষা” বা “ সবে কবছর হল আমাদের সবচেয়ে বড় গীতস্রষ্টা চোখ বুঝেছেন”– তখন বুঝতে সুবিধে হয় না, নিঃসন্দেহে পাঁচের দশকের কথাই আলোচনা হচ্ছে। নীহার ও বলেছেন, দেশ স্বাধীন হবার পর এক দশক কাটতে চলল। কিন্তু তা এতই সঙ্গোপনে যে বিরাট ছাপ ফেলা মুশকিল। তবে লেখক হয়তো এটাকে কিছুটা চিরকালীন ঘটনা বলেই রাখতে চেয়েছেন। আবার হয়তো শারদীয় পত্রিকার পরিসরও অন্তরায় হতে পারে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিভিন্ন উপন্যাসে এই সময়ের দাগ রেখে যাওয়ার শৈলীটি আমার বেশ প্রিয়। সম্ভবতঃ এই ধরনের উপন্যাসের সর্বাপেক্ষা যোগ্য পরিবেশনের মাধ্যম ধারাবাহিক ভাবে, যখন ক্রমশঃ চরিত্রগুলি আমাদের মনে জায়গা করে নেয়।
শব্দ প্রয়োগে, টেলিভিসন সাংবাদিকের ‘‘বাইট বা ‘টি আর পি’– এই শব্দবন্ধগুলির প্রয়োগ ঠিক সময়ানুগ মনে হলনা। ভারতীয় দূরদর্শনে এই শব্দবন্ধগুলি মূলতঃ একবিংশ শতাব্দীর। আর পাঁচের দশকের বিখ্যাত গায়ক বা সুরকার বা নায়ক, এতদিন সক্ষম থাকবেন, এটা একটু বিভ্রান্তিকর।
পরিশেষে দুটো অপ্রাসঙ্গিক কথা না বলে পারছি না।
‘অঞ্জনা দাশ’ লিখিত আগের উপন্যাসগুলির সঙ্গে এই উপন্যাসের কোন তুলনাই হয় না, কারণ সেগুলি খুবই হালকা, জনমনোরঞ্জক উপন্যাস ছিল যার কাজ কিছু তাৎক্ষণিক কিছু পাঠক বাড়ানো। এই উপন্যাসটি অনেক বেশি মননশীল, সুখপাঠ্য। আমার আশা অনেকদিন এই লেখা পাঠকের মন জুড়ে থাকবে।
দ্বিতীয়তঃ ‘শারদীয়া আনন্দলোক’ পত্রিকা সম্পর্কে পাঠকের এত বীতশ্রদ্ধার কারণ বুঝলাম না। ১৯৮০ সালে বুদ্ধদেব গুহের অতি প্রিয় উপন্যাস ‘বাংরিপোসির দু রাত্তির’ এবং রতন ভট্টাচার্যর ‘স্বপ্নের পুরুষ ও জীপগাড়ি’ এখানেই পড়েছি। ১৯৮৭ সালে আমি বাণী বসুকে আবিষ্কার করি এইখানেই। ১৯৮৯ সালে হর্ষ দত্তকে। ১৯৯২ এ সত্যজিতের মৃত্যুর পর সত্যজিতের সাহিত্য নিয়ে অসামান্য প্রবন্ধ পড়েছি রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের। আমার মনে হয় পাঠকদের একটু চোখ কান খোলা রাখা উচিত আর কোন পত্রিকা সম্পর্কে উন্নাসিক মনোভাব ত্যাগ করা উচিত। নাহলে ভালো লেখাও তাঁদের দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে। ফেসবুক না থাকলে যেমন এই উপন্যাসটিই যেত। ভুললে চলবে না, ‘শারদীয় জলসা’ পত্রিকায় সত্যজিৎ খুঁজে পেয়েছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’। সবশেষে লেখককে আবার তারিফ জানাই, সেইসময়কে আমাদের সামনে জীবন্ত করার জন্য। আমরা যারা একটু পুরনো মানুষ, তারাই সম্ভবত উদ্দিষ্ট পাঠকগোষ্ঠী। তাদের কাছে এই উপন্যাসের আবেদন চিরকালীন। কারণ আড়ালের চরিত্রের চলাফেরা আমরা সহজেই আঁচ করে ফেলতে পারি, আবার যখন দেখি গতিপথ জানা পথে না গিয়ে পালটে যাচ্ছে, তখন আবার মুগ্ধ হই। একেবারে শেষে অরুণেশের ‘গানভঙ্গ’ কবিতার অনিবার্যতা মেনে নিয়েও আমাদের সেই বেদনা ছুঁয়ে যায়।
সেরৌভ মুখোপাধ্যয়রে ব্ইগুলো সত্যি অসাধারণ, লেখক ও প্রকাশক সভািইকে ধন্যবাদ
LikeLiked by 1 person