‘
বৃহস্পতিবার ২৪শে জুলাই তিনি চলে গেলেন। শুক্রবার ২৫শে জুলাই তাঁর অন্তিম ক্রিয়া সম্পন্ন হল। এই যাত্রাতে বিবরণী দিয়েছিলেন শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। জগন্নাথ বসু স্মৃতিচারণাতে লিখেছেন –
“উত্তমকুমারের শরীরে যখন আগুন ছোঁয়ানো হল, ক্ষণিকের জন্য থেমে গেলেন তিনি। চোখটা চিকচিক করে উঠল। তারপর তাঁর সেই চিরাচরিত বাচনে বলে যেতে লাগলেন,
“যে সুন্দর কমনীয় শরীর মুখমণ্ডল এতকাল তাঁর অজস্র ভক্তকে আনন্দ দিয়েছে, সেই শরীরে আগুন স্পর্শ করল। ছোঁয়ালেন তাঁর প্রিয়তম পুত্র গৌতম। মহানায়কের নশ্বরদেহ ঘিরে এখন আগুনের লেলিহান শিখা। একটু একটু করে গ্রাস করে নিচ্ছে তাঁর শরীরকে। আমি দেখতে পাচ্ছি, কাতারে কাতারে মানুষ এসে একবার পাদপদ্ম স্পর্শ করতে চাইছে” – ১
আমি পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম উত্তমকুমারকে ঘিরে সাধারণ মানুষের আবেগকে কী অনায়াসে তিনি গলায় তুলে নিচ্ছিলেন। এর আগে ও তিনি আর একবার বাঙালীর শ্রেষ্ঠ মানুষটির শেষযাত্রার বিবরণ দিয়েছিলেন।”
সেটি ছিল রবীন্দ্রনাথের শেষযাত্রার বিবরণ। বাঙালী জীবনে উত্তমকুমারের স্থান বোঝাতে আর অন্য কোন উপমার দরকার সম্ভবত হবে না।
তারপরেই সপ্তাহান্তে দূরদর্শনে দেখানো হল ‘নায়ক’। সবার সঙ্গে বসে দেখলেন স্বয়ং সত্যজিৎ ও। দেখলাম আমরাও। আর সত্যিই মাথা ঘুরে গেল।
‘নায়ক’ দেখতে দেখতে কখনো মনে হয়নি যেন সিনেমা দেখছি। ঘটনাগুলো যেন আমাদের চারিপাশে ঘটছে, আমরাও ট্রেনে উঠে যাচ্ছি, আবার নেমে অরিন্দমের সঙ্গে বীরেশের ফ্যাক্টরির গেটে চলে যাচ্ছি। প্রত্যেক সংলাপ যেন গেঁথে যাচ্ছে মনে –
‘মনে রেখ একমাত্র অভিনেতাই ইনডিস্পেন্সেবল, তার কোন এসিস্ট্যান্ট নেই যে কাজ চালিয়ে দেবে”
“পরপর তিনটে ছবি মার খেলে কি অবস্থা হয়”
“বাস্তবতার একটু অভাব – যেমন বিএ পাস করা নায়িকার কখনো বিরহে গান করা উচিত নয়”
“আই মাস্ট গো টু দ্য টপ, দ্য টপ, দ্য টপ”
সেই ট্রেনযাত্রা যেন নায়কের নিজস্ব যাত্রা। কত মানুষের সঙ্গে আলাপ, তাদের ভালো মন্দ, আশা নিরাশার শরিক হওয়া, একজনের কাছে মনের কথা বলতে পারা, আপাত সফল মানুষের মধ্যেও কত ব্যর্থতার পাহাড় পেরোনোর গল্প, এক অসাধারণ কোলাজ।

‘নায়ক’ ছবিটি নিয়ে গল্পেরও শেষ নেই। সত্যজিৎ উত্তমের নিষ্ঠা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। যেদিন শ্যুটিং থাকতো না, সেদিনও উত্তম চলে আসতেন কাজ দেখার জন্য। এই কদিন আগেও শর্মিলা ঠাকুর লিখছিলেন কিভাবে উত্তমকে নির্দেশ দিয়েছেন সত্যজিৎ আর উত্তমও পরে সেটা কাজে লাগিয়েছিলেন।
‘’নায়ক’ এ অভিনয়ের পর অবশ্য উত্তমবাবুর অভিনয়ের ধরনে একটা বদল এসেছিল। কেটে কেটে সংলাপ বলাটা তখন থেকেই শুরু, টাইমিংটাও বদলে গিয়েছিল। ‘নায়ক’ এর শেষের দিকে সেই দৃশ্যটা, যেখানে ট্রেনের দরজাটা খোলা, ছুটন্ত ট্র্যাক দেখা যাচ্ছে, অরিন্দম বেশ খানিকটা মদ্যপান করেছেন ——-সেটা মানিকদা ভেঙে ভেঙে সংলাপ বলে পুরো দৃশ্যটা অভিনয় করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। — অভিনয়ের এই ধরনটা নিশ্চয় উত্তমবাবুকে ভাবিয়েছিল। ওটা তুলে ফেলেছিলেন খুব তাড়াতাড়ি। কারণ, তারপর অনেক সময়েই ওঁকে ওই ভেঙে ভেঙে সংলাপ বলতে শুনেছি।” – ২
সেই বিখ্যাত দৃশ্যটি –
আমারও নিজস্ব ধারণা এরপরে উত্তমের অভিনয়েও অন্য একটা মাত্রা আসে। অনেকে বলেন এটা টিপিক্যাল সত্যজিৎ ভক্তের কথা। কিন্তু পরবর্তী কালে ছবিগুলোতে তাঁর অভিনয়ে বেশ পাল্টেছে, সত্যজিতের প্রভাব থাকুক বা না থাকুক।
এরপরেই কিন্তু কলকাতাতে তাঁর পুরনো ছবিগুলি একে একে আবার আসতে শুরু করলো। টিভিতেও দিতে লাগলো। প্রথম ছবিটি দেখতে গেলাম ‘উজ্জ্বলা’ সিনেমাতে – ‘চৌরঙ্গী’। উপন্যাসটি পড়া ছিল। বেশ জটিল উপন্যাস, বহু চরিত্র। স্যাটা বোসের চরিত্রে উত্তম প্রথম পর্দায় এলেন, শংকররূপী শুভেন্দুর উদ্দেশে তাঁর প্রথম সংলাপ –

প্রবল হাততালিতে হল প্রায় ফেটে যাচ্ছে। সিটি, চীৎকার – কিছুই বাকি নেই। তারপরে ঠাণ্ডা হয়ে আবার সিনেমা শুরু হল। এটাতে দারুণ লেগেছিল উত্তমকে। পুরো সিনেমা জুড়ে অনেকে থাকলেও স্যাটা বোস একাই একশো। ‘বড় একা লাগে’ গানটি হয়তো স্যাটা বোসকে মানায় না কিন্তু স্যাটা রূপী উত্তমকে চমৎকার মানায়। আর বিহ্বল লেগেছিল শেষ দৃশ্যে সমুদ্রতীরে বিধ্বস্ত ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা।

এরপরে দূরদর্শনে আর বিভিন্ন সিনেমা হলে আসতে লাগলে একের পর এক ছবি। আর চলতে থাকলো আবিষ্কারের পর্ব।
এল তাঁর প্রায় পরিচালিত ছবি – ‘দুই পৃথিবী’। পীযূষ বসুর মৃত্যুর পর তিনি নাকি নিজেই দায়িত্ব নিয়ে সিনেমাটি শেষ করেন।
তখন ‘যাত্রিক’ ব্যানারটিকে একাই নিয়ে এগোচ্ছিলেন শ্রী দিলীপ মুখোপাধ্যায়। পরপর দুটি ছবি দেখানো হয়েছিল দূরদর্শনে- ‘এখানে পিঞ্জর’ আর ‘নগর দর্পণে’। দুটোই দুর্দান্ত লেগেছিল, সিনেমা এবং উত্তমের অভিনয়। স্বয়ং দিলীপও ছিলেন দুটি ছবিতেই, তাঁকেও আমার ভাল লাগতো। এখানে উত্তম কিন্তু সেরকম সফল নায়ক নন, তাঁর মধ্যে অনেক বিভ্রান্তি, ওঠা নামা রয়ে গেছে। সেই কারণে চরিত্রটি বেশ জটিল ছিল। আসলে দিলীপের সঙ্গে ওঁর সম্ভবতঃ এক চমৎকার বোঝাপড়া ছিল, যার ফলে এই জুটির প্রত্যেকটি ছবিই বেশ সুন্দর।

তখন সিনেমা হলে আসতে শুরু করেছে তাঁর পুরনো ছবিগুলিও। দেখলাম পরপর দুটি ছবি – ‘কলঙ্কিত নায়ক’ এবং ‘অপরিচিত’। ‘অপরিচিত’ তে আমি প্রথম দেখলাম সৌমিত্র – উত্তম যুগলবন্দী। এই সিনেমাটিতে দুজনকেই অনবদ্য লেগেছিল – উত্তমের সেই বড়লোকের বয়ে যাওয়া ছেলের দুরন্ত অভিনয়। সৌমিত্র একদম সহজ, সরল গ্রামের মানুষ। আসলে সে একটু অপ্রকৃতিস্থ।

এরপরেই মুক্তি পেল, ‘ওগো বধূ সুন্দরী’! এটি তাঁর অভিনীত শেষ ছবি। এই ছবিতে শট দিতে গিয়েই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন, আর সুস্থ হননি। দাড়ি কামাতে কামাতে, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়েই তাঁর হার্ট এটাক হয়।
সিনেমাটি সকলেই জানেন, বার্নাড শ এর বিখ্যাত নাটক পিগম্যালিয়ন ভিত্তিক। প্রফেসর হিগিন্স উত্তম। তাঁর বন্ধুর চরিত্রে ছিলেন সন্তোষ দত্তের মত খ্যাতনামা অভিনেতা। নাম ছিল অবলাকান্ত। ‘শুধু তুমি নয় অবলাকান্ত, বলার সময়, অনেকেরই খেয়াল থাকেনা’! দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সিনেমা ও কিশোরের গানগুলো।
এরপরেই এসে গেল ১৯৮৩ সাল আমার পশ্চিমবঙ্গের বাস উঠলো। ব্যাঙ্গালোরে এসে তখন আর সেইভাবে বাংলা সিনেমা দেখার সুযোগ ছিল না। তবে বেশ কিছু বছরের মধ্যেই কিন্তু দুঃখ ঘুচে গেল, কারণ ছিল স্যাটেলাইট টিভি।
আসলে এই সময়েই আমার বিভিন্ন ছবি নিয়মিত দেখার সুযোগ হল। যেমন ধরা যাক – ‘দেয়ানেয়া’ আর ‘ছদ্মবেশী’। মানে তখন ঐ অনুপম মুখশ্রী, মুখের অভিব্যক্তি আর গানে লিপ – বোঝাই যায় কেন তিনি বাংলার মহিলাদের নয়নের মণি ছিলেন। সেই যে শ্যামলের প্লেব্যাকে গান –
“কন্ঠ ভরা এ গান শুনে / ছুটে তুমি এলে দ্বারে
চোখে দেখেও এতো করেও / চেননি তো কভু তারে।
অবহেলায় সরেও তবু / আমায় তুমি নাওগো ডেকে / সে তো কবেনা
জীবন খাতার প্রতি পাতায় / যতই লেখো হিসাব নিকাশ / কিছুই রবেনা”
আর সেই তনুজার মুগ্ধ হয়ে শোনা। তনুজা যেন সমগ্র বাঙালী তরুণীদের প্রতিনিধি।

বা সেই ছদ্মবেশী ছবিতে – ‘আমি কোন পথে যে চলি’ গানটিতে লেংচে চলার সাথে অপূর্ব মুখভঙ্গি।
এই তালিকা শেষ হবার নয়।
আবার তাঁর অন্যধরনের অভিনয় দেখেছি ‘দুই পুরুষ’ বা ‘বাঘবন্দী খেলা’ ছবিতে।
আজ প্রযুক্তি আমাদের অনেক সুবিধে দিয়েছে, হাতের মুঠোয় পৃথিবী। তাই চাইলেই ফিরে ফিরে দেখতে পারি সেই মহানায়ককে। আজ থেকে উনচল্লিশ বছর আগে, ২৫শে জুলাই, ১৯৮০ –
“যে সুন্দর কমনীয় শরীর মুখমণ্ডল এতকাল তাঁর অজস্র ভক্তকে আনন্দ দিয়েছে, সেই শরীরে আগুন স্পর্শ করল।”
তাঁর মৃত্যুর এত বছর পর তিনি এখনো বাঙালী জীবনে উজ্জ্বল। শেষ করার আগে একটা ছোট প্রসঙ্গ উত্থাপন না করে পারছি না। উত্তম জীবনেও খুব সহানুভূতিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। ওঁর কাছে কোন সাহায্যপ্রার্থী ফিরে যেত না। তাই কেউ বলতেন উনি নাকি ‘না’ বলতে পারতেন না। কিন্তু কাজের ব্যাপারে পারতেন। এমনই এক ঘটনা শুনিয়েছেন উত্তমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু D: বিশ্বনাথ রায়।
অভিনেতৃ সংঘের ব্যানারে একবার সিনেমা করার জন্য উত্তম পছন্দসই কাহিনী খুঁজছিলেন। বিশ্বনাথ রায় নিজেও কাহিনীকার ছিলেন, তাঁর গল্প অবলম্বনে সিনেমাও হয়েছে ‘কলঙ্কিত নায়ক’ – মূল ভূমিকাতে উত্তম। তিনি উত্তমকে অনুরোধ করলেন তাঁর গল্প নির্বাচন করার জন্য। উত্তম পরিষ্কার বললেন – ‘না ভাই। তুমি এখনো এত বড় লেখক হওনি যে অভিনেতৃ সংঘের ব্যানারে তোমার কাহিনী চিত্রায়িত হবে।’ বিশ্বনাথ ভুল বুঝতে পারেন। পরে আলোচনা করতে করতে রমাপদ চৌধুরীর ‘বনপলাশীর পদাবলী’ কাহিনি নির্বাচিত হয়। বিশ্বনাথবাবু এই কাহিনি শুনিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ঠিক জায়গাতে তিনি না বলতে জানতেন। সেজন্যই তিনি উত্তমকুমার।’
সেই যে আমাদের উদ্যানবিদ্যার শিক্ষক বলেছিলেন, তিনি উত্তমকুমার আর আমরা অধমকুমার!
বাঙালীর জীবনে অন্যরা অধম না হলেও মধ্যম তো বটেই।
নিশ্চিত ভাবে উত্তম একজনই, ‘অত্যুত্তম’।
১ – http://www.abasar.net/radioissuejagannath.html
২- শর্মিলা সৈকতে – ধ্রুবজ্যোতি নন্দী – শারদীয়া আজকাল – ১৪২৪ – পৃঃ – ৩১৭
উত্তমের কন্ঠ কার ? হেমন্তের, না মান্নার ? এই নিয়ে একটা লেখার অপেক্ষায় রইলাম ।
LikeLike
নিঃসন্দেহে মূলত হেমন্তের।
LikeLike