বর্ণময় শিক্ষক – পিনাকী দা

১৯৭৭ সালের মাঝামাঝি রাজনৈতিক পালাবদলের মাধ্যমে বাঙালির জীবনে খুব বড় রকমের পরিবর্তন এলো। আমার জীবনেও। হরিণাভি স্কুলের পালা চুকিয়ে ভর্তি হলাম কলকাতার এক বিখ্যাত স্কুলে। পাঠভবনের তখন খুবই নাম। সত্যজিতের স্কুল! অনেক বড় বড় মানুষের ছেলেরাও পড়তো সেখানে। সন্দীপ রায়, অমিতকুমার এরাও ছিলেন পাঠভবনের ছাত্র। সত্যজিতের ছবির তোপসে আর মুকুলও পাঠভবনের ছাত্র। ইন্টার্ভিউতে গিয়ে জানলাম আমাদের হরিণাভিও কম নয়, যখন পাঠভবনের যিনি প্রাণ, সেই উমা স্নেহানবিশ আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, -“বিভূতিভূষণ, শিবনাথ শাস্ত্রীর স্মৃতি বিজড়িত স্কুল ছেড়ে এখানে আসবে?”

সেখানে আমিই একমাত্র ছাত্র ছিলাম যে অনেক দূর থেকে পড়তে যেত। সহপাঠীরা বেশ অবাক হত। কিন্তু সেই সময় ট্রেনে ডেলি প্যাসেঞ্জারি জীবনে অনেক অভিজ্ঞতার জন্ম দিল। মনে আছে, স্কুলের কোনও কোনও ফাংশনে যোগ দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে যেত দূরত্বের কারণে আর ভয়ঙ্কর ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়তাম। ছুটি পড়ার আগে ছাত্র-শিক্ষক মিলে একটা ছোট ধরনের সাহিত্য আলোচনা হত— কবিতা পাঠ, গান, নানান আলোচনা। মফস্বলের স্কুল থেকে আসা আমার কাছে তা ছিল সত্যিই মুগ্ধ করার মত। একে কলকাতার আধুনিক স্কুল, তাও আবার Co-educational। বেশ শঙ্কিতই থাকতাম।

তবে এখানে এসে সবচেয়ে অন্য অভিজ্ঞতা হল, শিক্ষক- শিক্ষিকাদের দাদা-দিদি বলে ডাকার প্রথা। ‘পিনাকীদা’, ‘স্বপনদা’, ‘সমীরদা’, ‘মৈত্রেয়ীদি’ – ইত্যাদি। আমার রীতিমত তাজ্জব লাগতো!! শিক্ষকদের মধ্যে বেশ বৈচিত্র্যও ছিল – এঁদের একজনের কথা বলার চেষ্টা করছি।

বেশ আশ্চর্য মানুষ ছিলেন ‘পিনাকীদা’! অঙ্কের শিক্ষক, কিন্তু তাঁর পড়াশুনো ছিল রীতিমতো তাজ্জব করে দেওয়ার মতো। প্রথম দিন ক্লাসে এসেই তিনি যখন আইনস্টাইন, বার্ট্রান্ড রাসেল, বার্নাড শ, ইত্যাদির বইয়ের নাম করে আমাদের পড়তে বললেন, আমি রীতিমতো প্রমাদ গুনছিলাম – ভালই তো ছিলাম, এ কোথায় এলাম!! ক্লাস শেষ হবার পর অবশ্য পাঠভবনের পুরনো ছাত্ররা আশ্বস্ত করলো – এটা বেশী সিরিয়াসলি নেওয়ার দরকার নেই বলে। ছোট্টখাট্টো চেহারার পিনাকীদা যখন বড় বড় বিষয় নিয়ে খুব গম্ভীরভাবে আলোচনা করতেন, তখন আমাদের কয়েকজনের ওনাকে ভীষণ রকমভাবে প্রফেসর ক্যালকুলাসের মত লাগত।

সমস্যা হয়েছিল প্রথমেই। আমরা নতুন নিয়মে ১১-১২র দ্বিতীয় ব্যাচ। তখন সিলেবাস বেশ পাল্টে গিয়েছিল, বেশ বিভ্রান্তিও ছিল। তার ওপর প্রঃ ক্যালকুলাস শুরু করলেন ক্যালকুলাস দিয়ে। হা হতোস্মি! পুরোপুরি জলে পড়ে গেলাম।

অনেকেই জানেন, ক্যালকুলাসে লিমিট, ফাংশন, ইত্যাদি বেশ বোঝা শক্ত। পিনাকীদার অবশ্য চেষ্টার ত্রুটি ছিল না, কিন্তু অস্বীকার করবো না একটু রাগই হয়েছিল। তাও পিনাকীদা হাল ছাড়তেন না- একবার নেসেসারি আর সাফিসিয়েন্ট কন্ডিশন বোঝানোর চেষ্টা করে চলেছেন। শেষে উদাহরণ দিলেন –

ধর বৃষ্টি হলে মাটি ভিজবেই, কিন্তু মাটি ভেজা মানেই কি বৃষ্টি হতে হবে? মাটি তো কেউ এক বালতি জল ফেলেও ভেজাতে পারে, তাই না? সুতরাং বৃষ্টি হল মাটি ভেজার সাফিসিয়েন্ট কন্ডিশন কিন্তু নেসেসারি নয়।”

উপমাটি আমার বেশ লাগসই লেগেছিল, বুঝতে অসুবিধে হয়নি, পরে অনেককে এই উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছিও।

তবে পিনাকীদার প্রতি আকর্ষণ বাড়ার অন্য একটি কারণ ছিল। পিনাকীদা মাঝে মাঝেই অঙ্ক থেকে অনেক অন্য শাখাতে চলে যেতেন। একদিন হঠাৎ করে আলোচনা করছিলেন ঐতিহাসিক উপন্যাস নিয়ে আর বললেন,

বাংলা সাহিত্যে শরদিন্দুর ঐতিহাসিক উপন্যাসের কোন জুড়ি নেই।”

ব্যস, আমার কাছে ওঁর শত দোষ মাপ। যিনি শরদিন্দুর ঐতিহাসিক উপন্যাসের ভক্ত, তিনি আমার পছন্দের লোক।

তবে পিনাকীদা কিন্তু একবার আমাদের মন জয় করে নিয়েছিলেন এক বিশেষ অনুমতি দিয়ে।

অনেকেরই মনে আছে, বহুদিন বাদে, বিষণ বেদীর নেতৃত্বে একটি ক্রিকেট দল গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া সফরে – ৭৭-৭৮এ। অস্ট্রেলিয়ার তখন অবস্থা সুবিধের নয়, সব ক্রিকেটাররাই কেরি প্যাকাটের দলে যোগ দেওয়াতে ববি সিম্পসন কে এসে দলের হাল ধরতে হয়েছিল। কিন্তু আমরা খুব উৎসাহে প্রতীক্ষা করছিলাম এইবার ভারত অস্ট্রেলিয়াকে হারাবে। প্রথম টেস্টের শেষ দিন, সুনীল গাভাসকারের সেঞ্চুরির ওপর ভর করে ভারত চতুর্থ ইনিংসে ভালই রান তাড়া করছিল। আমাদের আর ক্লাসে মন ই নেই। কেউ একটা ছোট্ট ট্রানসিস্টর রেডিও নিয়ে ক্লাসে এসে খেলা শোনার চেষ্টা করছে। কোনভাবে তা পিনাকীদার চোখে পড়ে। পিনাকীদার ও খুব ইন্টারেস্ট ছিল ক্রিকেট, ফুটবল দুটোতেই। তিনিও অনুমতি দিলেন, কমেন্টারি শোনার- আমাদের সঙ্গে বসেও গেলেন শুনতে! কিন্তু শেষ রক্ষা হল না,  ভারতীয় ব্যাটসম্যানেরা একেবারে কূলের কাছে এসেও তরী ভেড়াতে পারলো না! মাত্র ষোল রানে হার স্বীকার।

চূড়ান্ত মোহনবাগান সমর্থক পিনাকীদা মাঝে মাঝেই লিমিট আর ক্যালকুলাসের মাঝেও খেলার প্রসঙ্গে চলে যেতেন। ১৯৭৮ সাল। লীগে মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলকে ইতিমধ্যেই হারিয়েছে শ্যাম থাপার দুর্দান্ত গোলে। শেষ খেলা বাকি। তখনো কোন পয়েন্ট নষ্ট করেনি।

তার আগের বছর ১৯৭৭ সালে অপেক্ষাকৃত দুর্বল টীম নিয়েও ইস্টবেঙ্গল লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, একটি পয়েন্টও না হারিয়ে। এবারে যদি শেষ খেলায় মোহনবাগান জিততে পারে, তাহলে তারাও কোন পয়েন্ট না হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হবে। প্রতিশোধ নেওয়া হবে।

শেষ খেলা সম্ভবতঃ টালিগঞ্জ অগ্রগামীর সঙ্গে। আর হবি তো হ,  ১-০ গোলে এগিয়ে থাকা মোহনবাগান গোল খেয়ে ১-১ ড্র করে বসলো। পিনাকীদা আবার সেদিন মাঠে খেলা দেখতে গিয়েছিলেন।

পরের দিন, ক্লাসে এসে তাঁর –‘ঐদিকে যে মন পড়ে রয়’! বেশ উত্তেজিত হয়ে নিজের নৈরাশ্যের কথা বলে ফেলছিলেন। ‘বড়ো আশা করে’ মাঠে গিয়েছিলেন – কেন? চ্যাম্পিয়ন তো মোহনবাগান হতই, প্লেয়ারদের কি জানা ছিল না সমর্থকদের আশার কথা।

পিনাকীদা মাঝে মাঝে বেশ অদ্ভুত বিষয় নিয়েও আলোচনা করতেন – নক্সাল আন্দোলন নিয়েও বেশ বক্তব্য রাখতেন। আমার রাজনৈতিক চেতনা বরাবরই কম, কাজেই সেই আলোচনা বেশ মাথার ওপর দিয়ে যেত। ছাত্ররা আন্দোলনে যোগ দেবে কিনা বা বাইরে থেকে সমর্থন করবে কিনা এই নিয়ে দু একবার তাঁকে কথা বলতে শুনেছি। অঙ্ক তাঁর প্রিয় বিষয়য়। এতটাই যে মাঝে মাঝে বেশ অবাক হতেন,

‘ভাবো একটা লোক ডিফান্সিয়াল ক্যালকুলাস জানেনা- দিব্যি খাচ্ছে, দাচ্ছে! কোন সমস্যা নেই।’

আমাদের আরো অবাক লাগতো এই ভাবনা ওঁর মাথায় কি করে এল!

আমাদের এক বন্ধু পার্থ মুখার্জী ওঁর কাছে পড়তে যেত। পিনাকীদা অবশ্য প্রাইভেটে খুব পড়াতেন না, পার্থ মোহনবাগান সমর্থক বলে ম্যানেজ করেছিল। এসে আমাদের গল্প শোনাতো।

পিনাকীদার বাড়িতে প্রচুর বই ছিল, বিভিন্ন বিষয়ের। প্রিয় ছাত্র ছাত্রীরা সেই বই নিয়ে যেত, কিন্তু আবার ফেরৎ দিতে ভুলে যেত। পার্থ এসে বললো পিনাকীদা এবার একটা খাতা করেছেন, বই নিলেই নাম লিখে রাখছেন। পার্থ ও একটা বই নিয়েছে, তাকে লুকিয়ে উনি টুক করে নামটা লিখে রেখেছেন। আহা, জানতে পারলে খারাপ লাগবে না?

এই ছিলেন পিনাকীদা। অসম্ভব ছাত্রদরদী। ছাত্ররা যাতে গোটা মানুষ হয়ে ওঠে সেদিকে সব সময় নজর রাখতেন।

জানিনা এরকম বর্ণময় শিক্ষক আজ আর আছেন কিনা। তাঁর মৃত্যুতে ছাত্রসমাজ নিঃসন্দেহে ক্ষতিগ্রস্ত হল।

12 thoughts on “বর্ণময় শিক্ষক – পিনাকী দা

  1. লেখাটি পড়ে মন চলে গেল সেই দিনগুলিতে, যা সময়ের ব্যবধান সত্ত্বেও পিনাকীদার সব ছাত্রদের একসাথে বেঁধে দিয়েছে। আজ আমরা নানা জায়গায় নানাভাবে ওঁর কথা ভাবছি, এ ধরনের লেখা ভাগাভাগি করে নিচ্ছি, এ পিনাকীদার প্রতি আমাদের সম্মিলিত স্মৃতিতর্পণ।

    Liked by 1 person

  2. এধরণের শিক্ষকরা একে একে চলে যাচ্ছেন, আর তাঁদের শূন্যস্থান পূরণ হচ্ছে না। হয়ত এ যুগে তা হবারও নয়।

    Liked by 1 person

  3. পিনাকীদা কে এখনও আমি জীবনের এক ধ্রুবতারা হিসেবে দেখি। সেই “স্টপার” উপন্যাসে কমলের দৃষ্টিতে পল্টুদা যেমন ছিলেন। ফুটবল খেলা শেখাতে গিয়ে পল্টুদার দেওয়া সেই অমোঘ শিক্ষা “কমল, ব্যালান্স কখনো হারাস নি” যেমন কমলের ব্যবহারিক জীবনে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বারবার কাজে লেগেছে, আমার জীবনে পিনাকীদার শিক্ষাও অনেকটা সেই রকম। ক্যালকুলাস শেখাতে গিয়ে বিভিন্ন প্রসঙ্গে পিনাকীদার বিভিন্ন কথা ব্যবহারিক জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিকে বুঝতে বা নিজের কর্তব্য স্থির করতে কাজে এসেছে। এমন অজস্র উদাহরণ বলতে পারি। একটিমাত্র বলছি- ” যখনই কোনো function নিয়ে কাজ করবে, তার domain of definition সম্বন্ধে আগে sure হয়ে নেবে”। যখনই কোনো পরিচিত বা বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে সাহিত্য আলোচনা করি, পিনাকীদার এই উপদেশ স্মরণ করি… মনে না রেখে অনেক বার ঠকেছি…!

    Liked by 1 person

  4. Bhaskar lekha pore ( Path bhavan , Pinakida ) khub bhalo laglo. Choto belai pouchhe gelam. Jodio ami PB student noi. Tabuo thakhonkar diner shikhhok der sneho aar poriye anonddo pabar triptti onnorakam chilo. Ami JU Mechanical , 1976. Like jao , Amrra pore jai. Bhalo theko. Ami Gaan kori professional level desh bideshe. Calcutta JUte Geete Sansad under legend Abhijt Banerjee aar Late Arabinda Biswas kichuta talim chilo. Yuva vanite korttam 72-75. Bombay te service life , Ekhon Dubai

    Liked by 1 person

Leave a comment