এমনই এক শরতে তিরিশ বছর আগে তিনি বিদায় নিয়েছিলেন। সম্ভবত কোন কাগজে হেডলাইনও ছিল –
“শরতে হেমন্তের বিদায়”
সে কাগজ আমার পড়া হয়নি। আমি তখন প্রবাসে। তখন যোগাযোগ ও এত সুলভ ছিল না। শুনতে পারিনি প্রণবেশ সেন সংবাদ পরিক্রমাতে তাঁকে নিয়ে কি লিখেছেনও। তখন স্যাটেলাইট টিভিরও প্রচলন ছিল না, কাজেই এখনকার মত হৈ চৈ ও চোখে পড়েনি।
আমি যে কলেজের ছাত্র, সেই যাদবপুরেই তিনি ভর্তি হয়েছিলেন কারিগরী শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে। ইচ্ছা হয়তো ছিল না, কিন্তু অভিভাবকের নির্দেশ অমান্য করতে পারেননি। স্বাভাবিক ভাবেই পারেননি শেষ করতে। আমাদের সৌভাগ্য, তিনি নিজের রাস্তা বুঝতে পেরেছিলেন।
তবে তিনি প্রথমে চেয়েছিলেন সাহিত্যিক হতে। ‘দেশ’ পত্রিকায় তাঁর গল্পও প্রকাশিত হয়। অচিরেই অবশ্য বন্ধু-বান্ধব দের সংস্পর্শে এসে একেবারে গানের জগতে পুরোপুরি সামিল হলেন। তবে তাঁর সাহিত্যবোধ সম্ভবত সারাজীবন তাঁর সঙ্গী ছিল। সলিল চৌধুরীকে বলতেন – “‘আমার মনের ভাব যেন তোমার গীতিকাব্য হয়ে বেরিয়ে আসে।” আর সলিল – “ভগবান গান করলে তাঁর গলাটা অনেকটা হেমন্তদার মতই শোনাত”।
পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন ইচ্ছে করলেই তিনি গীতিকারও হতে পারতেন। অনেক গীতিকারকে গানের আইডিয়া দিতেন রবীন্দ্র অনুপ্রেরণাতে। এইভাবেই সৃষ্টি হল -”আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে’ বা “ওগো বন্ধু আমার আঁধার রাতে যদি এলে” র মত গান।
মূল দুখানি রবীন্দ্রসঙ্গীত যথাক্রমে – ‘আমার এ পথ তোমার পথের থেকে অনেক দূরে” আর “আজি বিজনঘরে, নিশীথরাতে, আসবে যদি”।
তিনি আবিষ্কার ও করেছিলেন এক গীতিকারকে। শুধু আবিষ্কার নয়, লালন পালনও করেছিলেন। প্রবাসী এই গীতিকার হলেন – শ্রী মুকুল দত্ত।
স্বাভাবিক ভাবে তিনি হয়তো মুকুলকেও প্রভাবিত করে থাকবেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের কলি দিয়ে। বিখ্যাত বিদায়ের গানে রবিঠাকুর লিখেছেন –
যে পথে যেতে হবে সে পথে তুমি একা–. নয়নে আঁধার রবে, ধেয়ানে আলোকরেখা।
মুকুলের হাতে কি সুন্দর আটপৌরে ভাষায় হয়ে গেল এই দার্শনিক ব্যাখ্যা –
চোখের আলো নিভলো যখন মনের আলো জ্বেলে / একলা এসেছি আমি একলা যাব চলে।
রবিঠাকুরে যা ছিল অনুরোধ,, এ গানে তা যেন আশীর্বাদ হিসেবে মাথায় তুলে নেওয়া হল। তীব্র অভিমানে গানে বলা হল-
মন আমার বাঁধলো বাসা ব্যাথার আকাশে
পাতা ঝরা দিনের মাঝে মেঘলা বাতাসে।
আমিও ছায়ার মত মিলিয়ে যাব
আসবোনা ফিরে আর আসবোনা ফিরে কোনদিন
বললেই হল? তিনি তো ফিরে আসবেন আমাদের কাছে বারংবার। শিল্পীর আসল জীবন শুরুই তো তাঁর মৃত্যুর পর। এখনো তাই বার বার শুনি আমরা –
আমিও পথের মত হারিয়ে যাব
আমিও নদীর মত আসবোনা ফিরে আর
আসবোনা ফিরে কোনদিন।