সুনীলের ইন্দিরা

তারপর উদাসীন ভাবে বললেন, সবাই আমার কাছে এসে নানারকম প্রশ্ন করে। আমি কাউকে কোনো প্রশ্ন করি না। আমার কাজ শুধু উত্তর দেওয়া।

এবং অধিকাংশই অবান্তর প্রশ্ন।

প্রায়।

আমার আর একটাই প্রশ্ন আছে। কী রকম লাগে জীবনটা? এর নাম কি সুখ?

সুখ?

হ্যাঁ।

সুখের কথা চিন্তা করিনি। জীবনে যখনই কোনো সংকট এসেছে, তখনই ভেবেছি আমায় যেন কেউ হারাতে না পারে। কখনো তো হারিনি আমি। অনেক কিছুই অসম্পূর্ণ আছে। কিন্তু হেরে যাইনি।

আপনি বোধ হয় রবীন্দ্রনাথের গান্ধারীর আবেদনপড়েননি। সেখানে তিনি এ কথাই দুর্যোধনের মুখে বসিয়েছেন:

সুখ চাহি নাই মহারাজ

জয়! জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ।

ক্ষুদ্র সুখে ভরে নাকো ক্ষত্রিয়ের ক্ষুধা—’

তুমি আমার সঙ্গে দুর্যোধনের তুলনা করলে?

এবার আপনি প্রশ্ন করছেন।

এটা পাল্টা প্রশ্ন। উত্তরটাকেই পরিষ্কার করে নেওয়ার জন্য।

না, তুলনা করিনি। কাব্যের সঙ্গে জীবনের তুলনা চলে না। তা ছাড়া, মহাভারতে দুর্যোধন আর রবীন্দ্রনাথের দুর্যোধন এক নয়। আমি বলতে চাইছিলাম, যাদের হাতে শাসনভার থাকে, তাদের কাছে জয়টাই প্রধান।

রাজধর্মে, ভ্রাতৃধর্ম, বন্ধুধর্ম নাই, শুধু জয়ধর্ম আছে-

উপরের অংশটি রচিত হয়েছে সত্তরের দশকে। লেখকের নাম শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, গল্পটির নাম ‘নদীতীরে’। এই কল্পিত আখ্যানটিতে এই সংলাপে পাত্রপাত্রী দুজন – একজন লেখক স্বয়ং, অন্যজন – শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে যে সুপ্রযুক্ত উদ্ধৃতিটি ব্যবহৃত হয়েছে তার লেখক রবীন্দ্রনাথ, আখ্যানটির নাম ‘গান্ধারীর আবেদন’- রচনাকাল – ১৮৯৭।

আজ শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর ১০২তম জন্মবার্ষিকী। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্ভবতঃ ইন্দিরার ব্যক্তিত্বের বেশ অনুরাগী ছিলেন। বেশ কটি লেখাতে তার পরিচয় পাওয়া যায়। একটি অবশ্যই উপরের অংশ।

আর একটি কবিতাও খুব বিখ্যাত। বিভিন্ন সময়ে সুনীল বিখ্যাত মানুষদের নিয়ে কবিতা লিখেছেন। চে গেভারা, রবীন্দ্রনাথ তাঁদের অন্যতম। এই সঙ্গে আছেন ইন্দিরা গান্ধীও। লিখছেন – ‘ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি’

                                      গুজরাটের বন্যা দেখতে যেও না

প্রিয় ইন্দিরা, তুমি বিমানের জানলায় বসে, এ বড় ভয়ঙ্কর খেলা।

ক্রুদ্ধ জলের প্রবল তোলপাড়ে উপড়ে গেছে রেললাইন

চৌচির হয়েছে ব্রীজ, মৃত পশুর পেটের কাছে ছন্নছাড়া বালক

তরঙ্গে ভেসে যায় বৃদ্ধের চশমা, বৃক্ষের শিখরে মানুষের

                                      আপৎকালীন বন্ধুত্ব

কবিতার শেষাংশে তিনি জানিয়েছেনও তাঁর কাতর অনুরোধের কারণ–

উঁচু থেকে তুমি দেখতে পাও মাইল মাইল শূন্যতা

প্রকৃতির নিয়ম ও নিয়মহীনতার সর্বনাশা মহিমা

নতুন জলের প্রবাহ, তেজি স্রোত – যেন মেঘলা আকাশ উল্টো

                             হয়ে শুয়ে আছে পৃথিবীতে

মাঝে মাঝে দ্বীপের মতন বাড়ি, কান্ডহীন গাছের পল্লবিত মাথা

ইন্দিরা, তখন সেই বন্যার দৃশ্য দেখেও একদিন তোমার মুখ ফস্কে

                             বেরিয়ে যেতে পারে, বাঃ, কী সুন্দর!

কি অদ্ভুত মুগ্ধতা থাকলে এভাবে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে সতর্ক করা যায়? যেন তিনি তাঁর এক বড় আপনজন!

কে অনুভব করতে পারে।

এই উপন্যাসে ঢুকে পড়েছেন সুনীলের প্রিয় রাজনৈতিক নেতা। আর একাত্তরের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যখন এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য তখন তিনি দূরেই বা থাকেন কিকরে?

সুনীলের এক বিরাট উপন্যাস পূর্ব-পশ্চিম। এই উপন্যাস দুই বাংলারই মানুষের খুব প্রিয়। একেবারে আধুনিক যুবক যুবতীরা এই উপন্যাস পড়ে জানতে পেরে গেছে পশ্চিমবঙ্গের স্বাধীনতার পরের দিনগুলির কথা, উদ্বাস্তু সমস্যা, নক্সাল আন্দোলন,  একাত্তরের দিনগুলির কথা, ভারতীয় যুবক যুবতীদের মার্কিন দেশে বসবাসের কথাও। বলা যেতে পারে বিংশ শতাব্দীর পাঁচের দশক থেকে আটের দশকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন ঘটনাকে এই উপন্যাসে এমনভাবে মেলে ধরা হয়েছে যে উপন্যাস পাঠকালীন পাঠক রুদ্ধশ্বাসে সেই সময়টি

তাঁর প্রথম উল্লেখ পাই আমরা ১৯৭১ এর এপ্রিল মাসে। স্বাধীন বাংলাদেশকে ইন্দিরা সমর্থন করবেন কিনা তাই নিয়ে মামুন এবং অন্যান্য বাংলাদেশীরা চিন্তিত। কিন্তু তখনো তিনি দূরবর্তী। এমনকি এর পরেও বেশ কবার তাঁর প্রসঙ্গ আসে কিন্তু তাঁর মুখে সুনীলের রচিত সংলাপ আমরা পাই না।

তা প্রথম পাই, দ্বিতীয় পর্বের ৫৭ সংখ্যক অধ্যায়ে। ইন্দিরা নিউইয়র্ক এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এলেন, তাঁর পরনে হলুদ ও কমলা রঙের শাড়ী, তার ওপর চাপানো একটা কালো ওভারকোট। ইন্দিরা চাইছিলেন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে সমস্যাটা বোঝাতে। সুযোগ পাচ্ছিলেন না, নিক্সন অন্যান্য বিষয়য় নিয়ে আলোচনা করছেন। একবার জোর করেই ইন্দিরা বলে ফেললেন পাকিস্তান সরকার সে দেশে পূর্বাঞ্চলে যে অত্যাচার চালাচ্ছে, সে বিষয়ে নিক্সন কিছু জানেন কিনা। নিক্সন বললেন তিনি অবশ্যই জানেন কিন্তু এটা ভারত আর পাকিস্তানের ব্যাপার – দুপক্ষই বোঝাপড়া করে নিক।

ইন্দিরা জানালেন যে সমস্যায় ভারত আদৌ নেই। এটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরের সমস্যা, সেখানে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চলছে।

এর পরে কিন্তু প্রায় তিন পাতা ধরে ইন্দিরার ভ্রমণের বর্ণনা। ঐতিহাসিক ঘটনা, কিন্তু তার মধ্যেই দেখি এক একটি বাক্যে লেখকের চরিত্রের প্রতি অনুরাগ বেশ স্পষ্ট। যেমন – চিফ সেক্রেটারি অফ স্টেট মিঃ রজার্সের সঙ্গে কথা বলে –‘ইন্দিরা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন’ বা ‘ইন্দিরার মুখে আবার অপমানের ছাপ পড়লো।’

বা এই পংক্তিটি –

সাতচল্লিশ সালে ভারত দু খণ্ড হয়েছে। এবার তিন খণ্ড হবে, সে দায়িত্ব কি তিনি সহজে নিতে পারেন? এরপর যদি আরো খণ্ড খণ্ড হতে থাকে? তাহলে ইতিহাস কি তাঁকে ক্ষমা করবে?

চুয়ান্নতম জন্মদিনটি তিনি নিরিবিলিতে বাড়ীতে কাটালেন।”

মনে হয়না, এই চরিত্রটির প্রতি লেখক বেশ দুর্বল? তাঁর সহানুভূতি যেন ঝরে ঝরে পড়ছে?

দেশে ফিরে ইন্দিরা এলেন বাংলাতে। রাজভবনে শিল্পী, সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁর ঘরোয়া আলোচনার কথা শুরু হল। এই অনুষ্ঠানে সুনীল নিজে উপস্থিত ছিলেন। সম্ভবত খুব কাছ থেকেই দেখেছিলেন তাঁকে। তাই সম্ভবতঃ বিবরণীটি এত প্রাঞ্জল –

“এই রকম কথা চলছে, হঠাৎ হলঘরের দরজার সামনে এক পুরোদস্তুর নাগরিক পোশাক পরা শিখ এসে দাঁড়ালো। দু-একজন ফিসফিস করল, ইনি তো লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরা, আর্মির ইস্টার্ণ কম্যান্ডের প্রধান। —- অরোরার সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন ইন্দিরা। ততক্ষণে সিদ্ধার্থ রায় এসেছেন সেখানে। সিঁড়ির কাছাকাছি গিয়ে ইন্দিরা দৌড় মারলেন বাচ্চা মেয়ের মতো। বাইরে এসেই প্রায় লাফিয়ে উঠে পড়লেন একটা জিপে। সোজা দমদম। সেখানথেকে এয়ার ফোর্সের প্লেনে দিল্লি।”

সত্য ঘটনার বিবরণের আকাশেও লেখক অপূর্বভাবে ফাঁকে ফাঁকে গুঁজে দিয়েছেন কল্পনার মেঘ। আর সেই বর্ণনার মধ্যেই চেনা চরিত্রের কল্পিত চালচলনেই লক্ষ করা যায় লেখকের চরিত্রের প্রতি স্পষ্ট পক্ষপাত। পক্ষপাতই তো? নাকি দুর্বলতা জনিত অনুরাগ? দেবা ন জানন্তি, কুতো পাঠকাঃ?

7 thoughts on “সুনীলের ইন্দিরা

  1. রাজভবনে শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনা এবং সেই সময় অতর্কিতে পাকিস্তানের আক্রমণের খবর পেয়ে ইন্দিরার দৌড়- ইত্যাদির বিস্তৃত বর্ণনা পূর্ব পশ্চিম উপন্যাস ছাড়াও সরাসরি লেখকের উত্তম পুরুষে বর্ণনায় উঠে এসেছিল লেখকের আত্মজীবনী “অর্ধেক জীবন” এ। তবে এই অংশটুকু সীমায়িত রয়ে গেছে শুধুমাত্র “দেশ” পত্রিকার পাতায়- অর্থাৎ “অর্ধেক জীবন” যখন ধারাবাহিক ভাবে দেশে প্রকাশিত হত। ধারাবাহিকের একেবারে প্রথম সংখ্যায়, রচনা শুরুই হয়েছে এই বর্ণনা দিয়ে। পরবর্তীকালে পুস্তকাকারে প্রকাশ কালে কোনো অজ্ঞাত কারণে লেখক ওই অংশটি বাদ দিয়ে দেন। বইয়ের ভূমিকায় তিনি স্বীকারও করেছেন সে কথা।

    Liked by 1 person

      1. ভাস্করদা, সুনীলের সাক্ষাৎকারটি পড়লাম। “পূর্ব পশ্চিম” এর ব্যাপারে লেখকের বক্তব্য জানা গেলেও, “অর্ধেক জীবন” এর ব্যাপারে কোনো আলোচনা কিন্তু চোখে পড়ল না।

        Liked by 1 person

  2. ভাস্করদা, সুনীলের সাক্ষাৎকারটি পড়লাম। “পূর্ব পশ্চিম” এর ব্যাপারে লেখকের বক্তব্য জানা গেলেও, “অর্ধেক জীবন” এর ব্যাপারে কোনো আলোচনা কিন্তু চোখে পড়ল না।

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s