খুব ছোটবেলায় পড়েছি, একে গুনগুন / দুয়ে পাঠ। সাহিত্যিকের গল্পও শোনা যাক।
আজ চক্কোত্তি মশাইয়ের জন্মদিন।
আমার জন্মাবধি তিনি আমার মনোরঞ্জন করে আসছেন। শেখাচ্ছেন ও।
দাড়ি গজানোর মন্তর হিসেবে তিনি শিখিয়েছিলেন, দাড়িকে হিন্দি ও ইংরেজি, দুই ভাষাতেই আমন্ত্রণ জানানোর কথা। “কাম” (Come) আর “আও” দুয়ে মিলিয়ে উদ্ভাবন সেই মন্ত্র, “কামাও”!
তবে এ হেন শিবরাম পড়েছিলেন এক মুশকিলে, মুশকিলআসানও হয়েছিল নিজের বুদ্ধিতেই। মুশকিল এর কারণ বুদ্ধদেব বসু।
তিনি বাংলা সাহিত্যের একটি ওপর গ্রন্থ লেখেন। ইংরেজিতে লিখিত বইটির নাম “এন একার অব গ্রীন গ্রাস (An acre of Green Grass).
বই এসে পড়লো শিব্রামের কাছে। নিয়ে চক্কোত্তি দৌড় দিলেন আর এক বন্ধুর বাড়ি।
আরে তুমি, আমি একটু ব্যস্ত। “কল্লোল যুগ” বইটার জন্য একটু —
কিছু শুনছি না, আমাকে একটি “অচিন্তনীয়” কাজ করে দেখাতে হবে।
সে কি? হাতে আবার কি বই?
এর জন্যই আসা। আমাকে পড়াতে হবে বোস সাহেবের এই বইটি।
ধুর! এত সাহিত্যের বই। এ নিজে পড়তে হয়।
চেষ্টা করেও পারলাম না। আসলে “এন একার অব গ্রীন গ্রাস” – ‘আকর গ্রন্থ’ কিন্তু আমার “একার” পক্ষে “গ্রাস” করা ভারী শক্ত।

কদিন আগে সুজনদা বুদ্ধদেব ও তাঁর কন্যা মীনাক্ষি ওরফে মিমিদির কথা লিখেছেন সুন্দর করে।
লিখছেন –
কী কারণে ঠিক মনে পড়ছে না, শিবরাম চক্রবর্তীর কথা উঠল … আমার ছেলেবেলার ফেভারিট লেখক। আড্ডায় ছিল মিমিদি আর জ্যোতিদা। শিব্রাম সম্পর্কে আমার জ্ঞান শুধু ওঁর লেখা থেকে, ব্যাস। মিমিদি ওঁকে চিনত বাবার বন্ধু হিসেবে। মিমিদি (মীনাক্ষী) হল বুদ্ধদেব বসু আর প্রতিভা বসুর বড় মেয়ে… শিবরামকে চেনে সেই ছোট্টবেলা … ফ্রক-পরা অবস্থা থেকে।
শিবরাম তখন কাকা। তবে মিমিদি যখন শাড়ি ধরল, শিবরাম ভালো করে তাকিয়ে বললেন, নাঃ, এখন থেকে আর কাকা নয়, আমাকে শিব্রামদা ডাকবি।
মিমিদি বরাবরই সুন্দরী। বিয়ের আগে ওঁর পাণিপ্রার্থীর সংখ্যা কম ছিল না। অশোক মিত্র, নরেশ গুহ থেকে শুরু করে সেকালের অনেক খ্যাতনামা বিবাহ-যোগ্য যুবক বুদ্ধদেব বসুর বাড়িতে ঘন ঘন আসতেন ক্ষণিক দর্শন পাবার আশায়। তাঁদের সবাইকে উপেক্ষা করে মিমিদি বাছল চাকরি-বাকরি কিচ্ছু নেই সদ্য বিএ পাশ করা ছোকরা জ্যোতির্ময় দত্তকে। এসব প্রতিভা বসুর লেখাতেই আছে, নতুন কোনও কাহিনি নয়। বলতে কী, এক্কেবারে মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ! মিমিদির মা গায়িকা প্রতিভা সোমেরও অনেক গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন … গায়ক দিলীপকুমার রায়, কবি কাজি নজরুল, বিজ্ঞানী সত্যেন বসু… (‘বিবাহ-যোগ্য’ শব্দটা ব্যবহার করছি না) কিন্তু পছন্দ করে বিয়ে করলেন সবে ইউনিভার্সিটির গণ্ডি পেরনো বুদ্ধদেব বসুকে। প্রেমের গতি সত্যিই বড় বিচিত্র। পরে অবশ্য বুদ্ধদেব খ্যাতনামা হলেন, জ্যোতিদাও সাংবাদিক ও লেখক হিসেবে স্বনামধন্য হয়েছে।
শিবরাম মিমিদির বিয়েতে নিমন্ত্রিত। পেটুক মানুষ, খাবার ডাক পড়তেই টুক করে গিয়ে বসেছেন বরের বাবার সঙ্গে। ইতিমধ্যেই খবর পেয়ে গেছেন মেনুতে ছানার পায়েস আছে, রাবড়ির মত ওঁর আরেকটা প্রিয় বস্তু। অনেক সময় বিয়েতে ভালো ভালো জিনিস ফুরিয়ে যায়… ভি-আই-পি টেবিলে বসলে সে ভয় নেই।
হায়, সবই এল শুধু সেটিই এল না। শিবরাম মাঝে মাঝেই হাঁক দিচ্ছেন, ‘ছানার পায়েস কিন্তু এদিকে আসেনি।’
কয়েকবার সেটা শোনার পর জ্যোতিদার বাবা আর পারলেন না। হাত জোর করে বললেন, ‘শিবরামবাবু, এবার প্লিজ থামুন। আমি বরের বাবা, এটা ভালো দেখায় না।’
বিয়ের কয়েকদিন বাদে শিবরাম বুদ্ধদেবের বাড়িতে এসেছেন… মিমিদির সঙ্গে দেখা। শিবরামের খেয়াল হল মিমিদির বর কী করে সেটাই জানা হয়নি।
‘হ্যাঁরে তোর বর কী করে?’ জ্যোতিদা ইতিমধ্যে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ থেকে অফিস-ক্লার্কের একটা চাকরি পেয়েছে।
‘ক্লার্কের চাকরি।’
‘ক্লার্ক! কতটাকা মাইনে পায়?’
‘১৬০ টাকা।’
আর কোনও কথা নয়, শিবরাম বেরিয়ে গেলেন। খানিক বাদে ফিরলেন… হাতে দুটো প্যাকেট। ডান হাতের প্যাকেটটা টেবিলে রেখে বললেন,
‘এখানে ছ’মাসের ভিটামিন আছে।’
এবার অন্য প্যাকেটটা রেখে বললেন,
‘এটাতে ছ’মাসের টনিক। বরকে এগুলো খেয়ে দৌড়োদৌড়ি করে ছ’মাসের মধ্যে ভালো একটা চাকরি জোগাড় করতে বলবি।’
‘সুজন’ আমার আমার পরম গুরুজন , কাজেই তাঁর স্মৃতিচারণ শুনে আমারো মনে পড়ে শিব্রাম – মীনাক্ষি সম্পর্কে কিছু কথা।
মীনাক্ষির একটি চমৎকার স্মৃতিগ্রন্থ আছে, “বুদ্ধদেব বসু ও তাঁর সারস্বত গোষ্ঠী”। সুখপাঠ্য।
এতে তিনি লিখেছেন আমার প্রিয় শিব্রামের কথাও। লিখছেন,
“শিবরাম চক্রবর্তী ২০২ এর বাচ্চাদের প্রিয় ছিলেন। — pun এর ব্যবহার প্রতিবাক্যে কিভাবে যে মাথায় আসত। একবার বেশ কিছুদিন বাদে এসেছেন, আমি সেদিন শাড়ি পরেছি। বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে শাড়ি পরিহিতা আমাকে দেখে বললেন,” বা বা বা কিসুন্দর । শোন ভাই কাকা টাকা আর নয়, এবার থেকে শিবরামদা বলবে আমাকে”!!
বাবা হাসতে হাসতে বললেন, ‘শিবরাম ভাঁড়ামি ছাড়ো”!! সুরসিক মানুষ!!
সে যা হোক, শিবরাম সম্ভবত একটু আঘাত পেয়েছিলেন। নিজের আত্মজীবনী ‘ঈশ্বর, পৃথিবী, ভালোবাসা’ তে প্রতিশোধ নিয়ে নিলেন! অসাধারণ প্রতিশোধ। সেটা দিয়েই শুরু করেছি এই লেখা।
মিমি খুব প্রভাবিত ছিলেন তাঁর দ্বারা। নইলে আর তাঁর লেখা বইয়ের উৎসর্গে ঋণ স্বীকার করেন।
বইটি মীনাক্ষি উৎসর্গ করেছেন – “বন্ধু-বর জ্যোতির্ময় দত্ত”কে!!

আমাদের বড় করে দিয়েছিলেন তিনি, চুমুর কথা লিখে। বলি তা সবিস্তারে।
আমাদের কৈশোরকালে বাংলা সিনেমাতে চুম্বনের সেরকম প্রচলন ছিলনা – লুকিয়ে পড়া যে দুটি বইতে আমরা পরিচিত হয়েছিলাম – সে দুটি হল “ন হন্যতে” আর নীললোহিতের “সুদূর ঝর্ণার জলে”!! “ন হন্যতে” র বিখ্যাত সংলাপ – “Mirca, Mirca, I told them you only kissed on my forehead” তখন সকলের মুখে মুখে। আর ফরাসী সুন্দরী মার্গারেট কে চুম্বন করে নীললোহিত আসমুদ্রহিমাচল বাঙ্গালীর পরম ঈর্ষাভাজন।
চুম্বন নিয়ে তাঁর “Pun”আসক্তি ছিল চরম। তাঁর সেই যে – “ঈশ্বরের এমন এক প্রসাদ যা খেতে খেতেই খাওয়ানো যায়” – সম্ভবতঃ চুম্বনের শ্রেষ্ঠ সংজ্ঞা হয়ে থেকে যাবে। তাঁর খুবই প্রিয় বস্তু ছিল -‘রাবড়ি’- বলতেন – “ধূমপান এর নেশা অতি বদ – দমকে দমকে খেতে হয়। ভাল হল রাবড়ির নেশা – কেমন চুমুকে চুমুকে খাওয়া যায়। আর নেশার সেরা নেশা – সে ও ঐ “চুমু” কেই।
আর কৈশোরে আমরা যখন এসব পড়ে হা হুতাশ করতাম, আমাদের রবীন্দ্রপ্রেমী বন্ধু বাতলাত – ‘আরে আমরা হচ্ছি হতভাগ্য – কিন্তু বুঝলি, প্রাণ খুলে হাস, আমাদের রবিঠাকুর আছেন’! সে আবার কি – আমরা হতবাক – রবিঠাকুর তো ‘কম্পিত কিশলয়ে মলয়ের চুম্বন’ টুম্বন কি সব লিখে ‘ন হন্যতে’ র নায়িকার মাথা খেয়েছিলেন। তিনি আবার – বন্ধু গম্ভীর ভাবে ঘাড় নেড়ে বলত – হুঁ, হুঁ, বাবা, পড়িস নি তো – “হতভাগ্যের গান” – আমাদের উত্তরের আশা না করে নিজেই ঘাড় দুলিয়ে বলতে শুরু করে দিল-
Kiss এর তরে অশ্রু ঝরে, Kiss এর লাগি দীর্ঘশ্বাস ,
হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস।

প্রণাম চক্কোত্তি মশাই! দুঃখের পৃথিবীতে ও আপনার কথা মনে এলে কত মানুষ প্রাণখুলে হাসতে পারে।
আপনি এরকমই থাকুন।
খুব ভালো লাগল।
LikeLike
Good Piece !!
LikeLiked by 1 person
ভাস্কর দা, শিব্রাম চক্রবর্তী আমার একজন প্রিয় লেখক। রোজকার থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়ের কচকচি পেরিয়ে মন যখন নির্ভেজাল আনন্দরসের জন্য ছটফট করে – ঠিক সেইসময় এনার রচনাসমগ্র আমার এনার্জি বুস্টার। আমরা ভাগ্যবান যে উনি এবং নারায়ণবাবু “আমাদেরই লোক”। আমরা ভাগ্যবান যে এঁদের লেখার চোখের সামনে খোলা না থাকলেও শুধু ভেবে নিয়েই ভয়ানক রকম উজ্জীবিত বোধ করা যায়। আমার শ্রদ্ধা
জানাই।
LikeLike
খুব ভাল লাগল লেখাটা। প্রথম অংশটা অবশ্য আমিও সুজনদার পোস্টে পড়েছি (মিমিঘটিত)। রসসম্রাটের জন্মদিনে চমৎকার শ্রদ্ধার্ঘ্য।
LikeLiked by 1 person