ক’দিন আগেই খবর পেলাম যে আমাদের বাংলা শিক্ষক নিমাইবাবু প্রয়াত হয়েছেন। আমাদের সময় বাংলার তিনজন খুবই সুদক্ষ শিক্ষক ছিলেন, সতীপ্রসাদ মিশ্র, দেবপ্রসাদ চক্রবর্তী এবং নিমাই ভট্টাচার্য। সতীবাবু অনেকদিন আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন অকালে, কিছুদিন আগে প্রয়াত হলেন দেববাবু। এবার পালা ছিল নিমাইবাবুর।
নিমাইবাবু আমাদের ক্লাস নিয়েছেন নবম ও দশম শ্রেণীতেই। সতীবাবু এবং দেববাবু অবশ্য তার আগেই আমাদের ক্লাস নিয়েছেন। সুতরাং নিমাইবাবুর সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে একটু দেরিতেই। আমাদের সতীর্থ প্রদীপ গুহঠাকুরতা অবশ্য নিমাইবাবুর বাড়ির কাছে থাকার জন্য ওঁকে ভালো করেই চিনত। সম্ভবতঃ ওঁর কাছে পড়তেও যেত।
এর আগে হরিনাভি স্কুলের ওপর বইটিতে আমি সতীবাবু এবং দেববাবুকে নিয়ে বিস্তারিত লিখলেও নিমাইবাবুকে নিয়ে বিশেষ কিছু লিখিনি। এমনিতেই অনেক বিস্তারিত হয়ে গেছিল। খবরটা পাওয়ার পর থেকেই মনে পড়ে যাচ্ছিল একটি অসাধারণ দিনের কথা যার সঙ্গে নিমাইবাবু খুবই জড়িত।
হরিনাভি স্কুলের সেই বইতে একদিনের কথা লেখাছিল এইভাবে –

“রবীন্দ্র-নজরুল জন্মদিন পালন হলেও প্রথম সুকান্ত ভট্টাচার্যর জন্ম জয়ন্তী পালন শুরু করিয়েছিলেন দিলীপবাবু। শিক্ষকরা তো বলেছিলেন, আমাদের উঁচু ক্লাসের ছাত্রদেরও বলার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তখন সুকান্ত সমগ্র যোগাড় করে একটি বক্তৃতা তৈরী করেছিলাম। তখনই কিন্তু সুকান্তর সঙ্গে প্রথম পরিচয়। আচ্ছা, তখন কি অদ্ভুত ব্যাপার ছিল। কবি সুকান্তর সঙ্গে পরিচয় করালেন একজন অঙ্ক শিক্ষক!!”
সেই সভাতে অনেকে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তবে সবচেয়ে খেটেখুটে বক্তৃতা দিয়েছিলেন নিমাইবাবু। তিনি আলোচনার জন্য নিয়েছিলেন সুকান্তর ‘রানার’ কবিতাটি। ‘রানার’ একজন সমাজের নিচুতলার কর্মী। এরা প্রয়োজনীয় কিন্তু অবহেলিত বা ঘৃণিতও। এমন একজন যাদের কথা রবীন্দ্রনাথ তাঁর “ওরা কাজ করে” কবিতায় বলেছিলেন,
ওরা চিরকাল টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল, ওরা মাঠে মাঠে বীজ বোনে, পাকা ধান কাটে। ওরা কাজ করে নগরে প্রান্তরে।
সত্যেন্দ্রনাথ লিখছেন –
কে বলে তোমারে বন্ধু, অস্পৃশ্য অশুচি শুচিতা ফিরিছে সাদা তোমারি পিছনে। তুমি আছ, গৃহবাসে তাই আছে রুচি, নইলে মানুষ বুঝি ফিরে যেত বনে। শিশুজ্ঞানে সেবা তুমি করিতেছ সবে, ঘুচাইছ রাত্রিদিন সর্ব ক্লেদ গ্লানি। ঘৃণার নাহিক কিছু স্নেহের মানবে, হে বন্ধু, তুমিই একা জেনেছ সে বাণী।
কাজি সাহেব লিখছেন –
দেখিনু সেদিন রেলে, কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে! চোখ ফেটে এল জল, এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল? যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে, বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে। বেতন দিয়াছ?-চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল! কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল্?
সুকান্ত লিখছেন –
রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে রানার রানার চলেছে, রানার! রাত্রির পথে পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার-রানার কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার রানার! রানার!
নিমাইবাবু সুন্দর করে বুঝিয়েছিলেন এই কাব্যসুষমার কথা নিচের পংক্তিতে –
এর দুঃখের কথা জানবে না কেউ শহরে ও গ্রামে, এর কথা ঢাকা পড়ে থাকবেই কালো রাত্রির খামে। দরদে তারার চোখ কাঁপে মিটিমিটি, – এ-কে যে ভোরের আকাশ পাঠাবে সহানুভূতির চিঠি
এই “কালোরাত্রির খাম”, “সহানুভূতির চিঠি”, দরদী তারা – এই ধরনের শব্দবন্ধের ব্যবহার খুবই অভিনব। এবং এদের এই অত্যাশ্চর্য প্রয়োগই সুকান্তর সৃষ্টিকে অন্য দুটি কবিতার থেকে আলাদা করে দেয়। এমনকি একেবারে শেষে এসে ‘নতুন খবর আনার’ বার্তাটি এবং ‘লাল পূর্বকোণ’ – এ দুটি প্রয়োগও বেশ চমকপ্রদ। এই কথা নিয়ে অবশ্য একটু বিতর্কও হয়েছিল। কেউ কেউ বলেছিলেন এভাবে নজরুলের সঙ্গে সুকান্তর কাব্যভাষার ঠিক তুলনা হয় না। কিন্তু আমার মনে হয় উনি সেটা করতে চানওনি। ওঁর বক্তব্য ছিল যে একটি সাধারণ কর্মী মানুষের জীবনকাব্য লিখতে যে এমন ভাষার প্রয়োগ হতে পারে তা এক নবীন কবির কাছে সেইসময় বেশ অপ্রতাশিত এবং অভিনব ছিল। এইখানেই সুকান্ত অনন্য। এখনও মনে পড়ে নিমাইবাবু বক্তৃতার আগে অবধি নোট তৈরি করছিলেন, তাঁর বলার সময় এসে গেছে শুনে হন্তদন্ত হয়ে টিচার্স রুম থেকে আমাদের রবীন্দ্রমঞ্চে এসে বক্তৃতা শুরু করেছিলেন। ছাত্রদের অল্প সময়ে এই এভাবে শিক্ষিত করে তোলার এই তাগিদও সেই সময়কার শিক্ষকদের কাছে খুব সহজাত ছিল।
এই তুলনামূলক কাব্যভাষার ব্যাপারটি আমার কাছে বেশ শিক্ষণীয় ছিল। অনেক পরেও নিজে যখন কিছু গীতিকবিদের নিয়ে কিছু লেখালেখি করেছি তখনও এটি কাজে লেগেছে।
এছাড়া আরও একদিনের কথা মনে পড়ে। নিমাইবাবু সম্ভবত বাংলা ব্যাকরণ পড়াচ্ছিলেন। সেখানে বিভিন্ন ভাষার থেকে বাংলা ভাষাতে এসে মিশে যাওয়া শব্দগুলির কথা বলতে গিয়ে তিনি জানিয়েছিলেন ‘যবনিকা’ শব্দটির কথা। বাংলা বা ভারতে তখন যে নাটক হত সেখানে মঞ্চে পর্দার ব্যাপার ছিল না। পরে বিদেশি যাদের যবন বলা হত তাদের অভিনীত নাটকে এই পর্দার ব্যাপার ছিল। সেজন্য আমাদের ভাষায় ‘যবনিকা’ শব্দের প্রবেশ ঘটল। তার মানে হল পর্দা পড়ে যাওয়া অর্থাৎ সমাপ্তি। এটি আর শুধু নাটকেই আটকে রইল না, আমাদের বাস্তব জীবনেও এই শব্দের ব্যবহার হতে শুরু করল। পরে যখন আমার শব্দ নিয়ে, বিশেষ করে শব্দের উৎপত্তি নিয়ে আগ্রহ হতে শুরু করল, এই ঘটনাটি মনে পড়ে গিয়েছিল।
শান্ত স্বভাবের নিমাইবাবুর সঙ্গে স্কুল ছাড়ার পর আর দেখা হয়নি। কদিন আগে তাঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে মনে পড়ছিল কথাগুলো।

শ্রাবণ মাসে আকাশে ঘন মেঘ। লিখতে লিখতে মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই সময়কার স্কুলজীবন আর সেই শিক্ষকদের কথা। বর্ষা তখনও ছিল – ছিল সেই বর্ষার দিনে স্কুল আর আমাদের সেই মফস্বলি শ্যামল, সুন্দর জীবন।
Bhalo laglo pore.
LikeLike