চিরায়ত শিল্প বা ক্লাসিক তাকেই বলা চলে যা কালের ব্যবধানকে অতিক্রম করতে সক্ষম। আমরা আরো মনে করি পুনরাবিষ্কারের ফলে সেই সৃষ্টির মাহাত্ম্য সম্বন্ধে নতুনভাবে অবহিত হওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল। নতুন নতুন উচ্ছ্বাসের জোয়ারে আমরা প্লাবিত হই। এই রকম একটি গীতিকবিতা আজ আমাদের আলোচ্য – সেটি সলিল চৌধুরীর – “শোন কোনো একদিন।”
বর্ষার বিরহকাতরতা আর তার অনুসৃত সৃজনশীলতা আমাদের কাব্যে ভীষণভাবে উপস্থিত। মেঘদূতের বিরহী যক্ষের স্মৃতি আজও অমলিন – তাই ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে’ মেঘের সমাগমের সঙ্গে সঙ্গে বিরহী কবিদের সৃষ্টিশীল কলম খাতার পাতায় ময়ূরের মত নেচে ওঠে –
বিদ্যাপতি লেখেন – "এ ভরা বাদর, মাহ বাদর, শূন্য মন্দির মোর।"
অতুলপ্রসাদে পাই – "নিদ নাহি আঁখিপাতে, আমিও একাকী তুমিও একাকী, আজি এ বাদলরাতে।"
আর রবীন্দ্রনাথ, “ব্যাকুল বাদলসাঁঝে, গহন মেঘের নিবিড় ধারার মাঝে” বসে লেখেন – “বুকে দোলে তার বিরহব্যথার মালা গোপন-মিলন-অমৃতগন্ধ-ঢালা।”
গীত কবিতার এই ট্র্যাডিসনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এইরকম এক রিমঝিম অবিরাম বরষায় আর এক বিরহীর অন্যরকম ছবি পাই সলিল চৌধুরীর গানে –
শোনো কোনো একদিন আকাশ বাতাস জুড়ে রিমঝিম বরষায়, দেখি, তোমার চুলের মত মেঘ সব ছড়ানো চাঁদের মুখের পাশে জড়ানো।
চাঁদের সঙ্গে সুন্দরী নারীর মুখের তুলনাটি বহু প্রাচীন, তা সে ‘মুখচন্দ্রিমা’ ই হোক আর ‘চাঁদপানা মুখ’ ই হোক! কিন্তু নতুনত্ব হিসেবে সেই সৌন্দর্যকে দিলেন ‘চলমানতা’। ভাসমান মেঘ বিভিন্ন সময়ে চাঁদের সৌন্দর্যকে পাল্টে দিচ্ছে আর প্রেমিকের মনে দোলা দিয়ে যাচ্ছে তার প্রেমিকার সুন্দর মুখের স্মৃতি যা হয়তো এমনি ভাবেই ঘন কুন্তলদামের আড়াল থেকে ক্ষণে ক্ষণে বদলে যেত! সেই সৌন্দর্যের কল্পনায় তার মন কোথায় ভেসে যায় – তাই,
মন হারাল হারাল মন হারাল, / মন হারাল হারাল মন হারাল / সেইদিন।
এরপর আমরা কিছুটা অপ্রত্যাশিত ভাবে পরিচিত হই স্রষ্টার জীবনের কোন এক নিরাশা থেকে উত্তরণের ঘটনায় – কোনো একদিন যখন তাঁর জীবনে গভীর রাত্রির মত নিরাশা আর একাকীত্ব ছিল.
আরো একদিন, তমসী তমস্বিনী রাত্রি, ঘুম ঘুম নিঃঝুম জীবনপথের সব যাত্রী, আমি একেলা, চলেছি নিরুদ্দেশ যাত্রী, রাতজাগা এক পাখী শুনি জীবনজয়ের গীত গাত্রী। মনে হলো মোর দুখরাতে এমন করে কে ভোলাতে মন হারাল হারাল মন হারাল, মন হারাল হারাল মন হারাল - সেইদিন।
এই স্তবকটি আমাদের বিশেষভাবে কৌতূহলী করে তোলে – হঠাৎ এই ভাবে একাকী নিরুদ্দেশ পথচলার প্রসঙ্গের অবতারণা কেন – এই পথচলা কি আক্ষরিক না আলঙ্কারিক! আমরা দ্রুত চলে যায় তৃতীয় স্তবকটিতে উত্তর খুঁজতে –
আরো একদিন, আমার খাঁচার পাখি চন্দনা গীতহীনা, আনমনা, ভাবে বসে তা কি জানিনা সন্ধ্যাবেলা, হঠাৎ ঘরেতে ফিরে দেখি, উড়ে গেছে, চলে গেছে, আমার খাঁচার পাখি চন্দনা, মনে হল মোরে পিছে ফেলে, যেদিন তুমি চলে গেলে, মন হারাল হারাল মন হারাল, মন হারাল হারাল মন হারাল, সেইদিন।
এইবার আমরা পুরোপুরি স্বাদগ্রহণে সক্ষম হই- আমরা প্রত্যেকটি ঘটনার তাৎপর্য খুঁজে পাই। বিরহী প্রেমিক বরষায় প্রেমিকাকে স্মরণ করছেন। প্রেমিকা যখন তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তখন তার জীবনকে এক তমসী, তমস্বিনী রাত্রির মত মনে হয়ে ছিল, তিনি জীবনের লক্ষ হারিয়েছিলেন (চলেছি নিরুদ্দেশ যাত্রী) কিন্তু প্রকৃতি এক রাতজাগা পাখির গানে তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছে জীবনের প্রতি বিশ্বাসবোধ।
তাই তাঁর খাঁচার পাখি চন্দনার উড়ে যাওয়াতে উপলব্ধি করেছেন তিনি – গীতহীনা, আনমনা পাখির মুক্তিই ভালো। জীবনের এই পর্যায়ে এসে তিনি বুঝেছেন – তাঁর প্রেমিকার ও তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণ ও হয়তো তাই, প্রেমহীন জীবনের চেয়ে মুক্তিই ভালো। গভীর ভালবাসায় তিনি তাই বলেন মনে হল মোরে পিছে ফেলে, যেদিন তুমি চলে গেলে – প্রেমিকার দোষ ছিলনা, হয়তো তিনিই পিছিয়ে পড়েছিলেন। বিরহী প্রেমিকের তাই আজ আর কোন দুঃখ নেই, তিনি হয়তো আত্মসমর্পণ করেছেন রবীন্দ্রনাথে –
তুমি সুখ যদি নাহি পাও যাও সুখের সন্ধানে যাও আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে আর কিছু নাহি চাই গো।
একটি প্রবন্ধে প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক অম্লান দত্ত লিখেছেন –
‘বিদ্বেষ অসুন্দর, বিদ্বেষে ঘটে প্রেমের মৃত্যু। বিরহবেদনায় আছে প্রেমের শুদ্ধ স্বীকৃতি, ততে অসুন্দর কিছু নেই। আপাতদৃষ্টিতে বিপরীত তবু প্রেমেরই দুটি প্রকাশ মান্যতা পেয়েছে যুগে যুগে। একটি বিরহে বিধৃত, অন্যটি মিলনে উদ্ভাসিত। দুটি ভাবই অবিস্মরণীয় ভাবে স্থাপিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য সঙ্গীতে।’
প্রবল রবীন্দ্র অনুরাগী সলিল ও সেই পথের ই পথিক। তাই প্রেমিকার স্মৃতি নিয়ে তাঁর তিক্ততা নেই, বরং সজল মেঘের ঘন ছায়াতে সেই স্মৃতি তাঁকে উদ্বেল করে। জীবনের প্রতি অসামান্য ভালবাসা তাঁকে দিয়েছে বিভিন্ন স্তবকে তাঁর একটি বর্তমানের ছবি ও দুটি স্মৃতির ছবি উল্লিখিত এবং তার সঙ্গে তিনটি বিচিত্র অনুভূতি ব্যক্ত হয়েছে। সমগ্র গানটিতে সলিল এই অনুভূতিকে আগুপিছু করে সাজিয়েছেন তাঁর অসামান্য শিল্পশৈলীর সহায়তায়।
‘জীবনস্মৃতি’র ভূমিকা লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন –
‘স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানিনা, কিন্তু যে আঁকে সে ছবিই আঁকে। সে আগের জিনিষকে পাছে বা পাছের জিনিষকে আগে সাজাইতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনা। বস্তুতঃ তাহার কাজই ছবি আঁকা, ইতিহাস লেখা নহে!’
সলিলের এই গানটিতে মেঘমেদুর বরষায় আঁকা এক বিরহী প্রেমিকের ছবির আবেদন যুগোত্তীর্ণ ও চিরকালীন শিল্পের এক উজ্জ্বল প্রতীক। তাই এই সৃষ্টির অসামান্যতায় মুগ্ধ হয়ে আমরা না বলে পারিনা –
মন হারাল হারাল মন হারাল / মন হারাল হারাল মন হারাল/চিরদিন।
আর কেই বা গাইতে পারতেন এই গান? তঁর ভগবানকণ্ঠী, তাঁর সুরের ও কথার সেই ‘রানার’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছাড়া?
Oshadharon 🙏🏻🙏🏻🙏🏻
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ।
LikeLike
দারুন লাগল।
LikeLike
অজস্র ধন্যবাদ।
LikeLike
Khub Shundor 🙏
LikeLiked by 1 person
অজস্র ধন্যবাদ।
LikeLike
কী অদ্ভুত সুন্দর লিখেছ! সলিলের দু:খ-বিরহের গানে রাবীন্দ্রিক প্রভাব আছে, তবে অন্যভাবে- সেই অন্যভাবে এর চেয়ে ভাল বিশ্লেষণ বোধহয় হয় না।
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ পল্লব।
LikeLike
Khub bhalo laglo.Salil Choudhury r gaan manei Biroher udjapon..Megh ashe,dukkho ashe..amader Uttoroner disha amra nijeder moddhyei khunje pai.
LikeLiked by 1 person
বাহ ! খুব সুন্দর লেখা ! ‘ভালবেসে যদি সুখ নাহি’–এই অপূর্ব গানটিতে রবীন্দ্রনাথ ভালবাসার যে ভিন্নতর তাৎপর্যের প্রতি আমাদের আগ্রহী করে তুলতে চেয়েছিলেন, তেমনই সলিল চৌধুরীও তাঁর এই গানে । গান শুধু শোনা নয়, তা নিয়ে ভাবাও দরকার । আপনাকে সেই ভূমিকায় দেখে আমার খুব ভাল লাগে । ‘মুক্তি’ শব্দটির প্রয়োগ যথার্থ ।
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ!
LikeLike