শতবর্ষে চৌরিচৌরা

৪ঠা ফেব্রুয়ারি, ১৯২২

আজ থেকে ঠিক একশ বছর আগের এ দিন। সেদিন এক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে ভারতের বুকে। যে জায়গাতে ঘটনাটি ঘটেছিল তা উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার একটি নেহাৎই অখ্যাত ছোট গ্রাম – চৌরিচৌরা। তবে তার তাৎপর্য বুঝতে গেলে ভারতের এবং পৃথিবীর সেই সময়কার অবস্থাটা একটু বুঝে নিতে হবে।

১৯১৮ – ১৯২১ সালের পৃথিবী

তার ক’য়েক বছর আগেই শেষ হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৮)। ১৯১৯ এর জুন মাসে সম্পন্ন হয়েছে ভার্সাই চুক্তি। লীগ অফ নেশনস বা জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। রাশিয়াতে বিপ্লবের পর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলশেভিকদের শাসন। ভাবা হচ্ছে, পৃথিবী এখন নতুন ভাবে শান্তির স্বপ্ন দেখবে।

১৯২০ – ১৯২১ সালের ভারতবর্ষ

১৯২০ সালে গান্ধিজি কংগ্রেসের নেতৃত্ব হাতে নিয়েছেন। তার আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি ভারতীয়দের আহ্বান করেছিলেন ইংরেজদের হয়ে লড়বার জন্য, শর্ত ছিল যুদ্ধে জিতলে ইংরেজরা ভারতীয়দের স্বাধীনতা দেবে। সেই ভরসায় গান্ধিজি ১৯২০ সালে দেশকে আশ্বাস দিয়েছেন – একবছরের মধ্যেই ‘স্বরাজ’ এসে যাবে। ১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগে নিরীহ জনতার সমাবেশে গুলি চলেছে। অজস্র হতাহত। খোদ ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের ও টনক নড়েছে। ‘নাইট’ ত্যাগ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাও সহ্য করেছেন গান্ধিজি। অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে খিলাফত আন্দোলনও। ১৯২১ এ স্বরাজের স্বপ্ন দেখছে ভারতবাসী।

১৯২১ সালের জুলাই মাসে লন্ডন থেকে ভারতে ফিরেই চিত্তরঞ্জন দাসের নেতৃত্বে গান্ধিজির অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন সুভাষচন্দ্র। ১৭ই নভেম্বর ইংল্যান্ডের যুবরাজ প্রিন্স অফ ওয়েলস ভারতে এলেন। সারা ভারতবর্ষে হরতাল হল প্রতিবাদে। বাংলাতে নেতৃত্ব দিলেন সুভাষচন্দ্র। তাঁর প্রথম সংগ্রাম – অত্যন্ত সফল। এর পরেই শুরু হল ধর পাকড়। গ্রেপ্তার হলেন সুভাষচন্দ্র, সস্ত্রীক সপুত্র চিত্তরঞ্জন দাশও। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হল এই গ্রেপ্তারে আন্দোলন সঠিক পথে যাচ্ছে ভেবে খুশি হয়েছিলেন চিত্তরঞ্জন। তখন তিনি কী জানতেন তাঁর জেলে থাকাকালীন এক সর্বনাশ ঘটে যাবে?

স্বরাজ আমাদের জন্মগত অধিকার –

১৯২১ এর কংগ্রেস আমেদাবাদে। চিত্তরঞ্জন সভাপতি। কিন্তু তিনি জেলে থাকার জন্য তাঁর ভাষণ পড়ে শোনালেন সরোজিনী নাইডু। কংগ্রেস দাবি করল – ‘স্বরাজ আমাদের জন্মগত অধিকার।’ এই কংগ্রেসেই সমস্ত ভারতবাসীকে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত আইন অমান্য আন্দোলনে আহ্বান করা হল।

আন্দোলন বেশ ধারাল হয়ে উঠছিল। বিগত এক বছরে প্রার্থিত স্বরাজ না এলেও আন্দোলন অনেক জোরদার হয়েছে। কোন সন্দেহ নেই এই আন্দোলনের কাণ্ডারী মহাত্মা গান্ধি।

সবচেয়ে সফল হল বিলাতি বস্ত্র বর্জন। সারা ভারতের কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকরা বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে বিলাতি বস্ত্র সংগ্রহ করে এনে একসঙ্গে পুড়িয়ে দিতেন। সারা ভারতের অসংখ্য সফল আইনজ্ঞ তাঁদের আইনব্যবসা ছেড়ে আইন অমান্য করতে যোগ দিলেন। তালিকার নামগুলি আজও আমাদের মনে শিহরণ জাগায় – চিত্তরঞ্জন দাস, মতিলাল নেহরু, এম আর জয়কর, সৈফুদ্দিন কিচলু, বল্লভভাই প্যাটেল, রাজাগোপালচারি, আসফ আলি প্রমুখ। তাঁর “The Indian Struggle” বইতে সুভাষচন্দ্র লিখছেন,

“It is not possible at this distant date to understand how profoundly the people of India believed in 1921 that Swaraj would be won before the end of that year. Even the most sophisticated people shared this optimism. I remember listening once to the speech of an able Bengalee advocate at a public meeting in 1921, in the course of which he asserted in all seriousness: ‘We are surely going to get Swaraj before the year is out. If you ask me how we are going to win it, I cannot answer. But we are going to win it all the same.'” 1

আন্দোলনের সাফল্যে খুশি গান্ধিজি। ১৯২২ এর ২রা ফেব্রুয়ারিতে তিনি বড়লাটকে চিঠি লিখে হুঁশিয়ারি দিলেন – আন্দোলনে যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের ছেড়ে না দিলে এবং সমস্ত রকম বাধা নিষেধ তুলে না নিলে এবার সারা দেশ জুড়ে একেবারে বড় রকমের আন্দোলনের ডাক দেবেন তিনি। উত্তরের জন্য সাত দিন সময় দিলেন বড়লাটকে।
দেশ জুড়ে শুরু হয়ে গেল প্রতীক্ষা। ফেব্রুয়ারির নয় তারিখের মধ্যে উত্তর না এলে যে আন্দোলন হবে তা ঠেকানোর ক্ষমতা ব্রিটিশ রাজের নেই। কিন্তু ইতিহাসের গতি অন্যরকম ছিল।

৪ঠা ফেব্রুয়ারি, ১৯২২।

অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক শতবর্ষ আগে ঘটে গেল এক অনভিপ্রেত ঘটনা। এর দু’দিন আগেই ভগবান আহির নামে এক অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক গোরখপুর জেলার চৌরিচৌরা তে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে একটি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পুলিশ তাঁকে বেদম প্রহার করে। উত্তেজিত সত্যাগ্রহীরা থানেদারের কাছে এই আচরণের ব্যাখ্যা চায় ও পিকেটিং শুরু করেন। থানেদার গুপ্তেশ্বর সিংহ অতিরিক্ত পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করেন।
৪ঠা ফেব্রুয়ারি থানা অভিমুখে তিন হাজার সত্যাগ্রহীর বিশাল মিছিল আটকাতে ব্যর্থ হন আট জন রাইফেলধারী পুলিশ-সহ স্থানীয় কনস্টেবল ও চৌকিদাররা। এই জয়ে আন্দোলনকারীরা স্বাভাবিকভাবেই বিপুল উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে শুরু করেন। এক জন পুলিশ অফিসার জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে শূন্যে গুলি চালান। তাতে কেউই আহত বা নিহত হয় না। ক্ষুব্ধ জনতা রেলস্টেশনের দিক থেকে পুলিশের উদ্দেশে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। সাধারণ পরিস্থিতি মুহূর্তে হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ। পুলিশ হঠাৎ গুলি চালাতে শুরু করে। তিন জন স্বেচ্ছাসেবক নিহত হন। আহত হন বেশ কিছু লোক। প্রবল আক্রোশে ক্ষিপ্ত জনতা এ বার থানা ঘিরে ফেলে। ভীত পুলিশকর্মীরা প্রাণ বাঁচাতে থানায় ঢুকে পড়েন। জনগণ থানার দরজায় বাইরে থেকে তালা আটকে দিয়ে নিকটবর্তী বাজার থেকে কেরোসিন এনে থানায় আগুন লাগিয়ে দেয়। স্টেশন অফিসার-সহ তেইশ জন পুলিশকে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। 2
গান্ধিজি অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে ১২ ফেব্রুয়ারি দেশ জুড়ে এই আন্দোলন তুলে নেওয়ার ডাক দেন। চৌরিচৌরার ঘটনাটিকে ‘নৃশংস অপরাধ’ বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন। সমস্ত রকম শোভাযাত্রা, জনসভা একেবারে বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। পরিবর্তে সুতো কাটা, মদ্যপান ত্যাগ ও চারিত্রিক শিক্ষা সম্পর্কিত ‘গঠনমূলক কাজ’-কেই একমাত্র অনুসরণের কথা বলা হয়। এ ভাবেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করা হয়।

স্বাভাবিক ভাবেই এই ঘটনায় তীব্রভাবে সমালোচিত হন গান্ধিজি। দেশবন্ধু জেলের ভিতরে নিষ্ফল আক্রোশে মাথা ঠোকেন। সুভাষকে বলেন তিনি বাইরে থাকলে কখনোই গান্ধিজিকে আন্দোলন প্রত্যাহার করতে দিতেন না। তাঁদের লিখিত ইতিহাস বইতে বিপানচন্দ্র প্রমুখ লিখেছেন – ‘রজনী পাম দত্ত এবং আরও কিছু লেখক গান্ধিজিকে অনাবশ্যক তীব্র আঘাত করেছেন। তাঁদের ভাষায়’, “—-

“—- Gandhiji did not withdraw the movement simply because of his belief in the necessity of nonviolence. He withdrew it because the action at Chauri Chaura was a symbol and an indication of the growing militancy of the Indian masses, of their growing radicalization, of their willingness to launch an attack on the status quo of property relations. Frightened by this radical possibility and by the prospect of the movement going out of his hands and into the hands of radical forces, and in order to protect the interests of landlords and capitalists who would inevitably be at the receiving end of this violence, Gandhiji cried halt to the movement.” 3

মতিলাল নেহরুও বলেছিলেন – “চৌরিচৌরাকে এমনকি দরকার হলে গোরক্ষপুরকে বাদ দিয়ে আন্দোলন চালাতে ক্ষতি কী?” তাঁর “The Indian Struggle” বইতে সুভাষচন্দ্র লিখছেন,

“The principal lieutenants of the Mahatma, Deshabandhu Das, Pandit Motilal Nehru and Lala Lajpat Rai, who were all in prison, shared the popular resentment. I was with the Deshabandhu at the time and I could see that he was beside himself with anger and sorrow at the way Mahatma Gandhi was repeatedly bungling. He was just beginning to forget the December blunder when the Bardoli retreat came as a staggering blow. Lala Lajpat Rai was experiencing the same feelings and it is reported that in sheer disgust he addressed a seventy-page letter to the Mahatma from prison.
” 4

ইতিহাসের গতিকে ফেরানো যায় না। সেই আন্দোলনের জন্য শাস্তি পেলেন ১৭২ জন। এদের মধ্যে ১৯ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়, বাকিদের দ্বীপান্তরে চালান করা হয়। এই শহীদদের উদ্দেশে গান্ধি কিন্তু তেমন সহানুভূতি প্রকাশ করেননি।
ভারতের ইতিহাসের এই অধ্যায়টি তেমন সুপঠিত নয়। আজ শতবর্ষে ফিরে দেখে মনে হয়, কী এমন ক্ষতি হত যদি গান্ধি তাঁর অনুগামীদের সাময়িক উত্তেজনা ও বিচ্যুতিকে একটু ‘ক্ষমাসুন্দর চক্ষে’ দেখতেন? আন্দোলনের বিপথগামিতা তাঁকে কি এতটাই ব্যথিত করেছিল? নাকি কেউ কেউ যেমন বলেন তাঁর নিজের ‘অহং’ বাধা দিয়েছিল তাঁকে নতি স্বীকার করতে?


এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া দুষ্কর। তবে আজ শতবর্ষ পরে সেই ২২জন শহীদের (ঘটনাস্থলে মৃত ৩ আর ফাঁসিপ্রাপ্ত ১৯জন) প্রতি আমরা সম্মান জ্ঞাপন করতেই পারি। আজকের এই স্মৃতিস্তম্ভ (পাশের ছবি) অন্তত কিছুটা হলেও স্থানীয় বাসিন্দাদের সেকথা মনে করায়।

References:

  1. Chandra Bose, Subhas . The Indian Struggle ( 1920–1942 ) (p. 72). Kindle Edition.
  2. https://www.anandabazar.com/rabibashoriyo/column-on-non-cooperation-movement-and-incident-of-cauri-chaura/cid/1326293
  3. India’s Struggle For Independence1857-1947 BIPAN CHANDRA et al – Penguin Books – pp -176 – 177
  4. Chandra Bose, Subhas . The Indian Struggle ( 1920–1942 ) (p. 73). Kindle Edition.




চিত্রঋণ – সব ছবিগুলিই অন্তর্জাল থেকে গৃহীত

5 thoughts on “শতবর্ষে চৌরিচৌরা

  1. An excellent compilation of the history of freedom movement 100 years ago. The objective view into the minds of the great leaders of the time is fascinating. How different perspectives and dilemmas of their times shaped history is fascinating. Congratulations on writing this wonderful piece.

    Liked by 1 person

  2. An excellent compilation of the history of freedom movement 100 years ago. The objective view into the minds of the great leaders of the time is fascinating. How different perspectives and dilemmas of their times shaped history is fascinating. Congratulations on writing this wonderful piece.

    Liked by 2 people

  3. ইতিহাস কে ফাঁকি দেওয়া চলেনা। এঁদের কথা স্মরণ করা , আর তার প্রতি শ্রদ্ধায় এ লেখাটি অত্যন্ত সময়োপযোগী ও মূল্যবান হয়েছে। এঁদের কথা আমার জানা ছিলনা।

    Liked by 1 person

  4. অজানা ছিলো উল্ল্যেখিত ঘটনাবলীর বিশদ ও বিস্ময়কর রূপটি। সাধারণ ইতিহাসের বইতে এমন অনেক সত্যকে তেমন ভাবে আমরা পাই না, কারণ যাইহোক না কেন। কিন্ত প্রত্যেক দেশবাসীর জানা উচিত ও অধিকারে পড়ে এমন অজানা ইতিহাসের অধ্যায়গুলি সম্পর্কে অবহিত হওয়া। অনুরোধ রইলো, সম্ভব হলে এমন আরো অজানা ইতিহাসের কথা বিশদে তোমার লেখনীতে তুলে ধরার জন্য। ধন্যবাদ।।

    Liked by 1 person

Leave a comment