মাঠের বাইরে ‘সুনীল’ আকাশ – দ্বিতীয় পর্ব

গাভাসকার যে একবার সিনেমাতে মুখ দেখিয়েছিলেন তা অনেকেই ভুলে গিয়েছিলেন। মোটামুটি ১৯৮৭ তে অবসর নেওয়ার আগে থেকেই তিনি সম্ভবত ঠিক করে রেখেছিলেন অবসর পরবর্তী জীবনের লক্ষগুলি।

সিনেমার নাম ছিল – মালামাল, নায়ক নাসিরুদ্দিন। যে যাই বলুক নাসিরের সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করতে তাবড় তাবড় অভিনেতাদের ভয় লাগে। কিন্তু গাভাসকার দিব্যি মানিয়ে নিয়েছিলেন। নীচের ছবি দেখলে বা ইউটিউবে সিনেমা দেখলে (https://www.youtube.com/watch?v=SeD0rrjrOpI) সেটা পরিষ্কার হবে।

অভিব্যক্তিতে কিন্তু কোন অংশেই নাসিরুদ্দিনের চেয়ে পিছিয়ে নেই

এর একটা কারণ থাকতে পারে। গাভাসকার কিন্তু কোন ব্যাপারেই হেলাফেলা করার পাত্র নন। আমি বেশ কিছু গাভাসকার ভক্তকে দেখেছি যাঁরা এই ব্যাপারে বাজি ফেলবেন যে সানি স্টুডিওতে আসার আগেও রীতিমতো প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিলেন। সাংবাদিকতাতে যেমন অবতীর্ণ হওয়ার আগেই তিনি লেখালেখি শুরু করেছিলেন, ঠিক তেমনই। আর ওঁর লেখার কিন্তু কোন অনুলেখক ছিল না। অর্থাৎ যাই করুন না কেন, তার জন্য একটা পূর্ণ প্রস্তুতি থাকত। এটা কিন্তু ভীষণ শ্রদ্ধা করার মত ব্যাপার।

আমার মনে হয় ধারাবিবরণীতেও তাঁর একটা অন্যরকম প্রস্তুতি ছিল। মানছি তিনি অসম্ভব প্রত্যুৎপন্নমস্তিষ্ক, ক্রিকেটের জ্ঞানও অসাধারণ, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর অনবদ্য শব্দচয়ন পুরো অভিভূত করে দিত। যেমন দিয়েছিল সেই ১৯৯৩ সালে হিরো কাপ সেমি ফাইনালের শেষ ওভারে। সেই শচীনের শেষ ওভারের খেলা!

এই খেলাটি ছিল সম্ভবতঃ বেসরকারি টেলিভিশনের প্রথম খেলা। ব্যাঙ্গালোরে আমার বাড়িতে তখনও কেবল নেওয়া হয়নি, আরেক দাদার বাড়িতে বসে খেলা দেখছি। শেষ ওভার। গাভাসকার বলছেন, “Only very few runs to defend. Now Azhar has to decide whether he will depend on experienced Kapil or younger Srinath!” বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটছে। হঠাৎ সানির চমকে ওঠা গলা, “So surprising! It’s Sachin who is going to bowl the last over!” এই ধরনের কিছু বলেছিলেন। তবে পরেই যেটা বলেছিলেন সেটা ভীষণভাবে মনে গেঁথে গেছিল। বললেন, “If this decision succeeds, Azhar will be hailed as an wizard, but if it backfires, he will be mercilessly criticized.”
“Mercilessly”! একথা তিনিই বলতে পারেন যাঁর শুধু অভিজ্ঞতাই নেই, আছে দুরন্ত সাহস এবং অকপটে সোজা সাপটা কথা বলার অভ্যাস। তিনি জানেন, ভারতীয় দর্শক এবং ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে। তারা কিন্তু এই সাহসী সিদ্ধান্তকে কুর্নিশ জানানোর মত উদার নন। লাগলে ভাল, না লাগলে – ক্ষমাহীন সমালোচনার আগুনে ঝলসানো হবে অধিনায়ককে।

জিতে শচীনকে ঘিরে উচ্ছ্বসিত সতীর্থরা

আবার ধরা যাক ১৯৯৭ সালের সেই বিখ্যাত (বা কুখ্যাত) ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট। মাত্র ১২০ রান করার লক্ষ্য ছিল, ৮১ রানেই গুটিয়ে গিয়েছিল শচীনের দল। আমরা একটু ক্ষুব্ধ হলেও গাভাসকার কিন্তু বলেছিলেন এই পিচে খুবই কঠিন ছিল খেলা। বোলারদের খুবই সাহায্য করছিল পিচ এবং তারা শুধুমাত্র ঠিক জায়গায় বলটা রাখলেই কাজ হচ্ছিল। এটাও বলেছিলেন এমন পিচে রান না করতে পারার জন্য ভারতীয় দলের ভেঙে পড়ার বা লজ্জার কিছু নেই। আমার কাছে এই কথা খুবই স্বস্তিদায়ক লেগেছিল, কারণ একটাই। গাভাসকার কিন্তু এই ব্যাপারে বেশ অকপট ছিলেন এবং সাধারণতঃ তাঁর কথা খুবই বিশ্বাসযোগ্য হত। ফলতঃ হারলেও আমাদের একটা সান্ত্বনা রয়েই গিয়েছিল।

মনে পড়ে আরো কুখ্যাত সেই ১৯৯৯ – ২০০০ সালের অস্ট্রেলিয়া সফর? কী দুঃস্বপ্নের দিন ছিল সব! গুজব শোনা গেল ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সেক্রেটারি জয়ন্ত লেলে নাকি আগেই বলে দিয়েছেন এই ভারতীয় দল একেবারে ০-৩ গোহারা হারবে অস্ট্রেলিয়ার কাছে। সেই দলে ছিলেন না আজহার, জাদেজা ও নয়ন মোঙিয়া। সব মিলিয়ে ভারতীয় সমর্থকদেরও নন একেবারে ভেঙে গিয়েছিল। তাও তারা খেলা দেখত এবং সেই গোহারা হারই দেখতে পেয়েছিল। একদম শেষ টেস্টে সানিও স্বীকার করেছিলেন যে নিশ্চয়ই ভারত খারাপ খেলেছে, কিন্তু একথা কখনোই অস্বীকার করা যাবে না যে খুব গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ভারত খুবই দুর্ভাগ্যজনক আম্পায়ারিং সিদ্ধান্তের স্বীকার হয়েছে। সেটা না হলে ভারত কিছুটা হলেও প্রতিরোধ করতে পারত।

আমরা যারা সেই সিরিজ দেখেছি, তারা জানি ঘটনাটা খুব সত্যি। কিন্তু সাহসী সানি সজোরে সেই কথা মিডিয়ার সামনে ঘোষণা করে আমাদের মন জয় করে নিয়েছিলেন।

আর তাঁর সেই স্ট্রেট ড্রাইভের প্রতি পক্ষপাতিত্ব তো সুবিদিত। “The straight drive is the biggest insult of a fast bowler.” কোন ব্যাটার মনজুড়োনো এই শট মারলেই গাভাসকারের এই উক্তি শোনা যেত। এর কারণ সম্ভবত, অন্যান্য শটগুলিতে যাকে বলে ‘চালনা করা’, কিছুটা হলেও ফাঁকি মেরে রান। কিন্তু ফাস্ট বোলারকে তার পাশ দিয়ে স্ট্রেট ড্রাইভ মারা যেন মুখের ওপর যোগ্য জবাব! ব্যাপারটা যেন, ‘আমিও কম যাই না হে’ গোছের আর কী! যত দিন যাচ্ছে, এই উক্তির অনিবার্যতা যেন আমার কাছে আরও পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। সাধে কি আর নিজের লেখা একটি বইয়ের নাম দিলেন “Straight Drive”!

একেবারে হালের কথাই ধরা যাক! ২০১৮তে ইংল্যান্ডে স্বপ্নের ফর্মে খেলছেন বিরাট কোহলি। কোন ফাস্ট বোলারের একটি দুরন্ত গতির বল অফ স্টাম্প থেকে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিল। বিরাট ব্যাটটিকে প্রায় মাটির সঙ্গে প্রায় সমান্তরাল করে রাখলেন। বল ব্যাটের কানা নিয়ে সুতীব্র গতিতে চলে গেল বাউন্ডারির বাইরে। আর তাঁর সহ ধারাভাষ্যকারের উদ্দেশে ভেসে এল গাভাসকারের মন্তব্যঃ
“That angle the bat is placed at is a definite measurement of the form and confidence of the batsman!”

কী অসাধারণ তীক্ষ্ণ মন্তব্য না! একটু ভাবা যাক! যখন ব্যাটার খেলার শুরুর দিকে একটু কম প্রত্যয়ী থাকবেন তখন তিনি কিন্তু ঝুঁকি নিতে চাইবেন না, তাঁর ব্যাট যথাসম্ভব উইকেটের সঙ্গে সমান্তরাল থাকবে কারণ তিনি উইকেট বাঁচাতে চান। এমনকি যদি তিনি ফর্মে না থাকেন তাহলে বেশ কিছুক্ষণ খেলা চলাকালীনও তিনি উইকেটের সমান্তরাল ব্যাট রেখেই খেলবেন। অর্থাৎ স্কোয়ার কাটের মত ঝুঁকিপূর্ণ শট তিনি মারবেন না। ১৯৮১ সালে বিশ্বনাথ এবং ২০০৩ সালে শচীন, দুজনেই তাই করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা যখন ভালো ফর্মে ছিলেন এবং আত্মপ্রত্যয় বেশি ছিল, তাঁরা কিন্তু নির্দ্বিধায় সেই শটগুলি নিতেন যেগুলি অনেক সুদর্শন, বিপজ্জনক এবং তাঁদের ফর্ম এবং আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে মানানসই। সেই শটগুলি, গাভাসকারের ভাষায়, ‘placed at an angle that is definite measurement of their form and confidence’.

সত্যি! ছোট্ট একটা মন্তব্য, কিন্তু কীভাবেই না আমাদের ভাবাতে পারে! এমন একটি বাক্য বলার জন্য এক ধারাভাষ্যকারের শুধু প্রতিভা থাকলেই হয় না, চাই নিরন্তর অনুশীলন আর নিজেকেই ছাপিয়ে যাওয়ার উদগ্র বাসনা।

সানির এই বাসনাই তাঁকে জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে এগিয়ে রেখেছে।

তাঁর জীবনের দুই সতীর্থ ক্রিকেটার সম্পর্কে তিনি বারংবার উচ্ছ্বসিত। তাঁরা বিশ্বনাথ এবং কপিলদেব।

কপিল সম্পর্কে বলেছেন, “Kapil Dev Was India’s Greatest Match-Winner.” বলেছেন এমন আর কেউ নেই যে বল হাতে এবং ব্যাট হাতে ভারতীয় ক্রিকেটকে এমনভাবে জিতিয়েছেন আর কেউ নেই। (https://www.youtube.com/watch?v=mwE9hMdlQ_4)

এমনকি ১৯৮৪ সালের ঐ বাদ পড়ার ঘটনাতেও বলেছিলেন, ‘আচ্ছা, আমি কি পাগল যে আমার সেরা ম্যাচ উইনারকে বাদ দিয়ে মাঠে নামব?”

বিশ্বনাথ সম্পর্কে তো সব্বাই জানেন।

“”I have seen situations when we all struggled against the opposition,” Gavaskar began. “But then Vishy would score off the good deliveries. The rest if us, we thought we could keep out the good balls and score off the bad ones. But Vishy, he had four-five strokes to the good balls that were bowled to him.”

(https://www.espncricinfo.com/story/viswanath-the-greatest-batsman-gavaskar-284776)

বিভিন্ন সময়ে বলেছেন যে ও সম্ভবত নিজেই জানত না, ও কত বড় ক্রিকেটার! মাঝে মাঝেই দেখেছি বলতেন, ‘এক একটা পুরনো ইনিংস দেখি আর ভাবি, কতবার ও একার হাতেই আমাদের বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করেছে।’

সত্যিই! সব ভিশি এবং কপিল ভক্তরা তাঁর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞ থাকবেন। তাঁর এমন দরাজ সংশাপত্র পাওয়া মানে নিঃসন্দেহে এক বিরাট প্রাপ্তি।

তাঁর এই প্রশস্তি যে অকপট এবং নিরপেক্ষ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আগের পর্বের লিংক – https://bhaskarbose.com/2023/07/10/sunny_outside_ground-1/

4 thoughts on “মাঠের বাইরে ‘সুনীল’ আকাশ – দ্বিতীয় পর্ব

  1. দুর্দান্ত লাগলো ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বকালের ‘লিট্‌ল মাস্টার গাভাস্কারকে নিয়ে নিবন্ধটি। অনবদ্য স্মৃতিচারণার বিবরনীর সাথে বিবিধ বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানতে পারলাম অনেক অজানা কথা। অজস্র ধন্যবাদ জানাই নিবন্ধকারকে।।
    -অরিন্দম বোস

    Liked by 1 person

  2. সুনীল শুধু আমার প্রিয় ক্রিকেটারই নন, প্রখরতর তাঁর ক্রিকেট-বোধ আর স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তা। আর কী বাক্‌চাতুর্য, রীতিমতো শৈল্পিক, যদিও তাঁর Sunny Days-এ বলা একটা কথা ওয়েস্ট ইন্ডিজ দর্শক-পাঠক-ভক্তদের বেশ ক্ষুন্ন করেছিল।
    একটা কথা জানাই, সুনীল গাভাস্কার মাতুলালয়-সূত্রে ক্রিকেট পেয়েছিলেন, মামা মাধবরাও মন্ত্রী ছিলেন ভারতের একসময়ের নামকরা ক্রিকেটার। মা শ্রীমতী মীনাল গাভাস্কার ছিলেন তাঁর শৈশবের ক্রিকেট খেলার সঙ্গী। তাঁর সন্তানের ছেলেবেলার ঘটনাসমূহ নিয়ে তিনি “পুত্র হ্বাবা আসা” (ছেলে হয় তো এমন) নামে একটি বই প্রকাশ করেন যা মারাঠি বাদে খুব কম লোকই হয়ত জানে।

    Liked by 1 person

Leave a comment