মাঠের বাইরে ‘সুনীল’ আকাশ– প্রথম পর্ব

যে সময় আমরা খেলা দেখা শুরু করেছি, অর্থাৎ একেবারে ষাটের দশকের শেষের দিকে তখন এত টেলিভিশন ছিল না। প্রায় এক দশক পরে টিভিতে ভালোভাবে খেলা দেখা শুরু। কাজেই ক্রিকেট সম্পর্কে আমাদের বোধ একটি হয়তো স্থূল প্রকৃতির। আমরা ঐ বিভিন্ন কৌণিক ভঙ্গীতে বল বা ব্যাট করার তাৎপর্য সম্পর্কে একটু উদাসীনই। এমনকি বলের গতিবেগ মাপার তেমন সুবিধে ছিলনা আমাদের কৈশোর অথবা প্রথম যৌবনেও। তাই ১৩০, ১৪০ বা ১৫০ গতিবেগের তফাতে ফাস্ট বা মিডিয়াম পেসারের তফাৎ অত বুঝতে পারতাম না। তবে বোলারদের নয়নাভিরাম বোলিং একশন বা ব্যাটারদের বিভিন্ন রকম শট দেখে প্রভূত আনন্দ পেতাম।
সে কারণেই আমার মনে হয়, যদিও আমরা সুনীল গাভাসকারের আবির্ভাব দেখেছি, মাঠে এবং টিভিতে তাঁর বেশ কিছু অসাধারণ ইনিংস দেখারও সৌভাগ্য হয়েছে, তাহলেও তাঁর খেলার টেকনিকাল এমনকি নান্দনিক দিক নিয়ে বেশি না লেখাই ভাল। তাঁর জন্য এখন অনেক বিশেষজ্ঞ রয়েছেন সোসাল মিডিয়া জুড়ে। সত্যি বলতে কি এখনকার ফেসবুকার বা ব্লগারদের মত অসামান্য কাটা ছেঁড়া করতে আমাদের সে যুগের সাংবাদিক বা ধারাভাষ্যকারদেরও দেখিনি। সম্ভবত আমাদের মত তাঁদের ও দেখার পরিধি সীমাবদ্ধ ছিল।

তাই তাঁর এবারের জন্মদিনে লেখার বিষয় করলাম – তাঁর মাঠের বাইরের কীর্তিকলাপ। অর্থাৎ তাঁর সাংবাদিক জীবন, ধারাভাষ্যকার জীবন এবং আরো অন্যান্য দু-একটি বিষয়।
এই অন্য দু-একটি বিষয়ের মধ্যে একটির কথা খুব মনে পড়ে। সানন্দার সম্পাদক হিসেবে সুনীলের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন অপর্ণা নিজে। এটাই ছিল সুনীলের আবদার। পত্রিকার তরফ থেকে অনুরুদ্ধ হয়ে তিনি কারুকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছিলেন যে তিনি সাক্ষাৎকারে রাজি, শর্ত একটাই! সাক্ষাৎকার নেবেন খোদ সম্পাদক অপর্ণা।
অনেকেই জানেন সেই আশির দশকের প্রথম দিকে সানন্দা পত্রিকার বড় আকর্ষণ ছিল অপর্ণার সম্পাদকীয়। পরে শুনেছি, ঋতুপর্ণ ঘোষও সেই লেখার বড় অনুরাগী ছিলেন। সম্পাদকীয় তে অপর্ণাই জানিয়েছিলেন এই শর্তের কথা।

ভারি মনোগ্রাহী ছিল সাক্ষাৎকারটি। অনেক কথার মধ্যে বিশেষ করে মনে থেকে গেছে একটি ভারি সুন্দর কথা। সে কথা বলার আগে তার পরিপ্রেক্ষিত একটু বোঝানো দরকার।

সত্তরের দশকে আবির্ভাবের পর থেকেই সুনীল মেয়েদের মনোহরণ করতেন। ছেলেদের অনেকের বেশি প্রিয় ছিলেন তাঁর বছর দুয়েকের বড় বিশ্বনাথ। কিন্তু ঐ যৌবনে তাঁর সুন্দর চেহারার জন্য মেয়েরা তাঁর বিশেষ অনুরাগী ছিল। সত্যিই! ১৯৭১ সালে সেই রাজকীয় আবির্ভাব, আর অমন সুন্দর চেহারা! বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর সেই সাদা কালো ছবি দেখেই মেয়েরা মুগ্ধ হত, এ আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা। নীচের ছবিগুলো থাকে কিছুটা বোঝা যেতে পারে।

তা সেই সাক্ষাৎকারে অপর্ণা তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন এই মুগ্ধতার ব্যাপারে। সানির উত্তরটা ছিল চমকপ্রদ – ‘আসলে আমার উচ্চতাই মনে হয় এর কারণ। আমি ওঁদের দিকে চোখ তুলে চাই, ওঁরা চোখ নীচু করে আমার দিকে তাকান। সচরাচর তো তা হয়না। উচ্চতা বেশি হওয়ার কারণে নারীরাই পুরুষের দিকে চোখ তুলে তাকাতে বাধ্য হন।’ বোঝ কাণ্ড! মোটেই তা যে নয় তা আমাদের চেয়ে ভালো কে জানে! কিন্তু ঐ যে অসম্ভব ক্ষুরধার এবং প্রত্যুৎপন্ন মস্তিষ্ক!

সানি খেলা ছাড়লেন ১৯৮৭ সালে বিশ্বকাপের পর। একই সঙ্গে অধিনায়কত্ব হারালেন কপিলদেব। সফরে এল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, তাদের নেতা ভিভিয়ান রিচার্ডস! প্রথম টেস্টেই রিচার্ডসের অসাধারণ ব্যাটিং এর জোরে টেস্ট জিতল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সানি আগেই বরাত পেয়েছিলেন কাগজে লেখার, তার মধ্যে সম্ভবত কোন বাংলা কাগজও ছিল। সানির মন্তব্য ছিল, ‘এই টেস্টে হারের জন্য সম্ভবতঃ আমাকে আর কেউ দায়ী করতে পারবে না।’

আসলে এরও এক ইতিহাস আছে। শেষের দিকে অনেকেই সানিকে দায়ী করতেন ভারতের ব্যর্থতার জন্য। এমনকি সেই বছরেই, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলা তাঁর জীবনের শেষ টেস্টে প্রায় জিতিয়ে এনেও পারেননি সানি। যদিও অসাধারণ ইনিংস খেলেছিলেন তিনি ব্যাঙ্গালোরের ঐ পিচে, কিন্তু তাঁর প্রতি বিরূপ সাংবাদিকরা মন্তব্য করতে ছাড়েননি। এই সাংবাদিকদের মধ্যে এক বাঙালি সাংবাদিকও ছিলেন যিনি ছিলেন বিশ্বনাথের প্রায় অন্ধ ভক্ত। তিনি প্রায়শই তুলনা করতেন এবং সানিকে তাঁর ভগ্নীপতির তুলনায় ম্রিয়মাণ প্রতিপন্ন করতেন।

আর একজন সর্বভারতীয় সাংবাদিক ছিলেন আরো এককাঠি ওপরে। জীবনের শেষদিকে এসে সুনীল ওপেনিং ছেড়ে নীচে খেলে ব্যাটিং উপভোগ করতে চান শুনে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমারও সাংবাদিকতার বেশ অনেকদিন হল। সম্পাদককে বলি একটু জায়গা দিন, কাগজ কলম ছেড়ে টেবিলে উঠে একটু নেচেকুঁদে জীবন উপভোগ করি’।

সানি কিন্তু আবার খবরও রাখতেন সব। তাই সানি নিজেই এবার একটু ‘কথা শোনালেন’ আর কী!

পরের বছরেই (১৯৮৮) অবশ্য সানি আমাদের জন্য এক অনবদ্য উপহার নিয়ে এলেন যেটি একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল। দূরদর্শন ছিল তখনকার একমাত্র টিভি চ্যানেল। সেখানে সাড়ম্বরে এসে গেল –

“Sunil Gavaskar Presents”!

দারুণ ছিল সেই অনুষ্ঠান। অবশ্য সেই সময়কার তরুণদের চাহিদাও ছিল খুব সামান্য কারণ তাদের দেখার জগৎ ছিল খুব সীমিত। তাই তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত রবিবারের সকালের জন্য। রামায়ণের প্রায় পরে পরেই তার আগমন ঘটত। পরিচালক ছিলেন তখনকার বিখ্যাত পরিচালক আজিজ মির্জা, ধারাবাহিক নুক্কড় বা মনোরঞ্জন বা সার্কাসের কল্যাণে যিনি আমাদের খুব কাছের মানুষ। সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন পণ্ডিত যশরাজের পুত্র সারংদেব।

উফফ! এখন লিখে বোঝানো যাবে না সেই সিরিজ দেখার অনির্বচনীয় আনন্দ। বিভিন্ন ম্যাচ দেখাতেন আর তার সঙ্গে থাকত সাক্ষাৎকার। যেমন একবার শ্রীকান্ত এলেন। তাঁর একটা ম্যাচ দেখানো হল যেখানে সানি অধিনায়ক আর শ্রীকান্ত ক্যাচ ফেললেন। অবশ্য তার পরে আবার ক্যাচ ধরলেনও! শ্রীকান্ত বললেন যে ক্যাচ মিস করার পর তিনি ঐ জায়গা থেকে সরে নিরাপদ জায়গায় দাঁড়াতে চাইছিলেন, সানি অনুমতি দেননি। পরে আবার ক্যাচ এল, প্রায় দুর্গানাম জপতে জপতে তিনি সেই ক্যাচ ধরে ফেললেন। সেই সময় সানি আর শ্রীকান্তের মজার কথোপকথন এখনও মনে পড়ে। শ্রীকান্ত জানালেন, তিনি বুঝেই গিয়েছিলেন সানির মত অত রান তিনি কোনদিন করতে পারবেন না, তাই চাইতেন কিছুটা আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলে দর্শকদের অনুরাগের অন্ততঃ কিছু অংশের দাবিদার হতে। তাঁর ধারণা তিনি দর্শকদের যতটুকু ভালোবাসা পেয়েছেন তা যতটা না রানের পরিমাণের জন্য, তার অনেক বেশি তাঁর রান করার পদ্ধতির জন্য।

এইভাবেই বিভিন্ন খেলোয়াড়ের সঙ্গে বসে তিনি তাঁর বিরাট স্মৃতির ভাণ্ডার খুলে বসতেন। চাগিয়ে দিতেন তাঁদের স্মৃতিকেও। আর আমরা উপভোগ করতাম সেই অনির্বচনীয় কথোপকথন। শোনা যায় তাঁর এই অনবদ্য স্মৃতির ভাণ্ডারকে পরিচালক আজিজ মির্জা বলেছিলেন – “Elephantine Memory”!

আমাদের আরও ভালো লাগত যখন তিনি বলতেন, তিনি নন, তাঁর প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথ! ব্যস! আমরা, ভিশি ভক্তরাও কাত!

তবে সবচেয়ে মজার ঘটনা যেটা মনে আছে সেটা লিখেই এই পর্বে ইতি টানছি। সেটা তাঁর নিজেকে নিয়েই বলা! আর সেটা তাঁর মুখের ইংরেজিতে না লিখলে মজাটা থাকবে না।

একটা এপিসোডের শুরুতেই, তিনি শুরু করলেন-

‘The match started. India batted first. I continued my off-form and got out cheaply!’
তারপরেই দর্শদের দিকে তাকিয়ে একটু দুষ্টু হাসি দিয়ে,-

‘But if you keep on chasing deliveries outside the off stamp, you get into nothing but off-form!”

কী দারুণ না! কত অকপট স্বীকারোক্তি! এখনো যখন কোন ব্যাটসম্যানের ‘off-form’ শুনি, এই কথা মনে আসে। মিলিয়ে দেখেছি, অনেক ক্ষেত্রেই বেশ সত্যি।

যাঁরা সেই অলৌকিক সিরিজের কণাটুকু পেতে চান তাঁরা এই নীচের লিংকে ক্লিক করে দেখতে পারেন।

https://theprint.in/feature/sunil-gavaskar-presents-a-little-masterclass-from-the-1980s-that-shaped-a-generation/505271/

5 thoughts on “মাঠের বাইরে ‘সুনীল’ আকাশ– প্রথম পর্ব

  1. Fatafati. Sei sob golden age r kotha mone pore galo . Gavaskar ei man ta amader kache onnya unmadona. Ja present generation ke bojhano e jabe na. Chai o na. Sunny sudhu amader e. Hats off to you for Sunil Akash. Vishon sunder language.
    Egarly waiting for next episodes.

    Liked by 1 person

Leave a comment