‘জীবনস্মৃতি’ তে ‘কবিতা-রচনারম্ভ’ অধ্যায়ে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন –
“পদ্মের উপরে একটা কবিতা লিখিয়াছিলাম, সেটা দেউড়ির সামনে দাঁড়াইয়া উৎসাহিত উচ্চকণ্ঠে নবগোপালবাবুকে শুনাইয়া দিলাম। তিনি একটু হাসিয়া বলিলেন, “বেশ হইয়াছে, কিন্তু ঐ ‘দ্বিরেফ’ শব্দটার মানে কি।” ‘দ্বিরেফ’ এবং ‘ভ্রমর’ দুটোই তিন অক্ষরের কথা। ভ্রমর শব্দটা ব্যবহার করিলে ছন্দের কোনো অনিষ্ট হইত না। ঐ দুরূহ কোথা হইতে সংগ্রহ করিয়াছিলাম, মনে নাই। সমস্ত কবিতাটার মধ্যে ঐ শব্দটার উপরেই আমার আশা- ভরসা সবচেয়ে বেশি ছিল। — যাই হোক, নবগোপালবাবু হাসিলেন বটে কিন্তু ‘দ্বিরেফ’ শব্দটা মধুপানমত্ত ভ্রমরেরই মতো স্বস্থানে অবিচলিত রহিয়া গেল”।
যে শব্দটি তাঁকে এত আনন্দ দিয়েছিল, সেটিকে আমরা একটু নেড়েচেড়ে দেখতে চাই। ‘দ্বিরেফ’ এর অর্থ যে ভ্রমর তা তিনি জানিয়েছেন। ‘ভ্রমর’ পরিচিত কথা, কিন্তু নবগোপাল বাবুর মত আমরাও একটু উৎসুক। জানতে চাই কিভাবে এই শব্দটির উৎপত্তি। আসলে ‘রেফ’ শব্দটি আমাদের পরিচিত – অর্থ – “অক্ষরের মাথায় যুক্ত র (র্র ) চিহ্ন”! কিন্তু এই কথাটি আবার এসেছে সংস্কৃত ‘রিফ’ থেকে যার অর্থ ‘শুঁড়’। ভ্রমরের ঐ দুটি (দ্বি) শুঁড় আছে বলেই তার এই নাম।
আসলে বাংলা ও ইংরাজিতে এমন অনেক শব্দই আছে যাদের বলা চলে ‘অঙ্কোদ্ভূত’ – তাদের উৎপত্তি মাতৃঅঙ্ক নয়, বরং একটি সংখ্যা বা একটি অঙ্কই তাদের স্রষ্টা। কিছু কিছু শব্দের ক্ষেত্রে এই মাতৃপরিচয় খুব সুস্পষ্ট, – উদাহরণ হিসেবে বলা চলে জ্যামিতিক আকৃতি গুলিকে – ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ বা ইংরেজিতে Pentagon, Hexagon ইত্যাদি। কিন্তু ‘চতুর্ভুজ’ শদের আর এক অর্থ হল ‘নারায়ণ’ যাঁর চারটি বাহু (ভুজ)। কিছু শব্দের মধ্যে এদের প্রকাশ বেশ অস্পষ্ট বা সুপ্ত।
“সাষ্টাঙ্গ” প্রণামের সঙ্গে আমরা খুবই পরিচিত। অষ্ট বা আটটি অঙ্গের সমাহারে (স) সুসম্পন্ন হয় এই প্রণাম, তাই এই নাম। এই আটটি অঙ্গ হল – জানু, চরণ, হস্ত, বক্ষ, মস্তক, চক্ষু, দৃষ্টি ও বাক্য। ‘দ্বিজ’ শব্দের অর্থ হল ব্রাহ্মণ, কারণ উপনয়নের পর তাদের দ্বিতীয় জন্ম হয়। সকালের পর দুপুর যা আসলে দ্বিপ্রহর এর অপভ্রংশ। সকালের প্রথম প্রহর অতিক্রম করেই আগমন এই দ্বিতীয় প্রহরের। “হে মাধবী, দ্বিধা কেন, আসিবে কি ফিরিবে কি– আঙিনাতে বাহিরিতে মন কেন গেল ঠেকি” – এই দ্বিধার কারণ হল দুই সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে – আসিবে কি আসিবে না। ‘দ্বাপর’ হল সেই যুগ যার আগমন অন্য দুই যুগের পর, – সত্য ও ত্রেতা। ‘দ্বীপ’ – যদিও তার সবদিকেই জল, কিন্তু উৎপত্তি দুই (দ্বি) দিকে জল (অপ) থেকে। সেই যে
– “কোন্-সে কালের কণ্ঠ হতে এসেছে এই স্বর /‘ এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা’, মধ্যিখানে চর। ‘ ” – কতকটা সেরকমই।
প্রাচীন বিদ্যালয় ‘চতুষ্পাঠী’তে শুধু চার বেদ নয়, অন্যান্য বিদ্যা শিক্ষাও হত। কিন্তু যেহেতু শুরু চতুর্বেদ দিয়ে, নামে সেই পরিচয়। শতদ্রু, বিপাশা, ইরাবতী, চন্দ্রভাগা ও বিতস্তা – এই পঞ্চনদীর তীরে অবস্থিত রাজ্যটি ‘পাঞ্জাব’। আর হাতের পাঁচটি আঙ্গুলকে কাজে লাগিয়ে লড়তে হয় যে খেলা, তাকে বলি ‘পাঞ্জা লড়া’!! পঞ্জিকা অপভ্রংশে পাঁজি, নামটি এসেছে পঞ্চাঙ্গ থেকে। পঞ্চাঙ্গের অর্থ পঞ্জিকার ৫টি অঙ্গ – বার বা বাসর , তিথি, নক্ষত্র, করণ, যোগ।
আমাদের বড় উৎসব দুর্গাপুজো। তার শেষ বিজয়া দশমীতে। হিসেবমতো দশটি কু -প্রবৃত্তি হৃত হওয়ার প্রার্থনা। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য, স্বার্থ, অন্যায়, অমানবিকতা আর আত্মতুষ্টি। এই রিপুগুলি নাশ হলে – বিজয় –অনুভূতি। তাই বিজয়া –দশমী।
এবার তাকানো যাক ইংরেজি ভাষার দিকে। লুকিয়ে থাকা সংখ্যার নমুনা অজস্র – বার্ষিক পরীক্ষা উঠে গিয়ে আজকাল শুরু হয়েছে ‘Semester’ প্রথা। – ‘Six months’ লুকিয়ে আছে এর মধ্যে। দুপুরের আরামদায়ক ঘুমটির ইংরেজি নাম হল – ‘Siesta’! আসলে সকাল শুরু হওয়ার পর ঘণ্টা ছয়েক (’six’) পর এই সুখনিদ্রার আবির্ভাব। ‘Dean’ হলেন আমাদের কলেজের বিভাগীয় প্রধান, এর উৎস হল ‘Decanus’ – প্রাচীন গ্রীসে যিনি ছিলেন দশজনের একটি দলের নেতা – ‘Doyen’ শব্দের ও একই অর্থ। আমরা বলি – ‘দেশের ও দশের’ – সেরকম ই। আবার ‘দশচক্রে’ ভগবান ভূত হন। কাজেই দশের নেতা তো কেউকেটা হবেনই। পরিবর্তনের প্রবল ঝড়ে এবারের নির্বাচনে একটি প্রাচীন দল প্রায় ধূলিসাৎ – ইংরেজিতে বলা হচ্ছে – ‘Decimated’! কথাটি এসেছে ‘প্রতি দশম ব্যক্তিকে হত্যা করা’ থেকে। কিন্তু এখন ব্যবহার সার্বিক ধ্বংস অর্থেই।
ইংরেজি মাসগুলির দিকে তাকালে মনে হতে পারে নামগুলি তাদের সংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে না – শেষ চারটি মাস – September, October, November ও December কিন্তু মোটেই সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম মাস নয়। বরং তারা যেন দুটি মাস পিছিয়ে গেছে। এর কারণ কিন্তু অন্য – জুলিয়াস সিজারের আগে কিন্তু ইংরেজি মাস শুরু হত মার্চে। সেই হিসেবে ঠিকই ছিল। কিন্তু পরে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, যোগ হলেও জনসাধারণের বিভ্রান্তি এড়ানোর জন্য আর নাম পরিবর্তন করা হল না। আর এক মজার ব্যাপার দেখা যায় ল্যাটিন আর গ্রীকে – ল্যাটিনের ‘S’ গ্রীকে ‘H’ – ল্যাটিন থেকে আসা -September কিন্তু গ্রীকোদ্ভূত Heptathlon। যেমন, ছয় – ‘Six’ আর ‘Hex’, বা আর ‘অর্ধ’ – ‘Semi’ ও ‘Hemi’। কেউ কেউ বলে থাকেন সংস্কৃতে যা ছিল ‘সপ্তসিন্ধু’ গ্রীকদের কাছে তাই হল ‘হপ্তহিন্দু’ আর তা থেকেই নাকি ‘হিন্দু’ র উৎপত্তি। তবে এ নিয়ে প্রচুর মতভেদ আছে।
লক্ষণীয় যে ইংরেজিতে যেমন Novel (New) ও Novem (Nine) খুব কাছাকাছি, বাংলাতেও তাই – নব ও নবম। হয়ত দুই জায়গাতে প্রচলিত দশমিক প্রথাই এর কারণ। আটের পর নয় – দশমিক প্রথা অনুযায়ী মনে হবে এটিই শেষ সংখ্যা, এর পর এক অঙ্ক শেষ হয়ে দুই অঙ্কে যাবে বা দুই থেকে তিন অঙ্কে (৯ – ১০, ৯৯-১০০ ইত্যাদি)। ইংরেজিতেও তাই। কাজেই ‘নয় নয়’ এলেই নতুনের পূর্বাভাস, ‘নব আনন্দে জাগো, নব রবিকিরণে’
দূরবীনের দুটি চক্ষু, তাই Binocular হল Bi (দুই) Ocular (চক্ষু) – দুটি vowel এর মধ্যে একটি ‘n’ এর আমদানি হল উচ্চারণের সুবিধার্থে, সেই একেবারে ‘a’ ‘an’ এর পুরনো নিয়ম মেনে।
আগে বাংলা দ্বিধার কথা বলেছি, ইংরেজিতে ‘Dilemma’ তেও সেই দুই (Di)। আবার দুই এর মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করার কাজ হল-‘Balancing’! এর উৎস হল দুই পাল্লাযুক্ত ‘তুলাদণ্ড’ যা আদতে হল – Bi(দুই) আর ‘Lance’ – অর্থে – পাত্র। প্রকৃত ‘Balanced’ মানুষ যদিও অনেক দিক সামনে চলেন, তবুও শব্দতত্বের বিচারে সম্ভবত: তিনি সামঞ্জস্য রক্ষা করেন দুটি সবচেয়ে বিপরীতমুখী চরিত্র বা কর্মকাণ্ডের মধ্যে যাদের ইংরাজিতে বলা চলে – ‘Diametrically opposite sides’! উদাহরণ, – একজন সুগৃহিনী তার পরিবারের আয় ও ব্যয় এর মধ্যে Balance করে চলেন। Dialog হল দুজন অথবা তার বেশী লোকের কথাবার্তা।
দুটি খুব প্রচলিত শব্দের আলোচনা করা যেতে পারে – একটি হল ‘Noon’ মানে দুপুর। এর উৎপত্তি হল সংখ্যা ‘Nine’! সকাল ৬টায় দিন শুরু হলে চার্চের ‘Noon Time’ ছিল বিকেল তিনটাতে (অর্থাৎ ৯ ঘণ্টা পর) যখন ছিল মধ্যাহ্নভোজনের বিরতি। কিন্তু ক্ষুধার্ত সন্ন্যাসীদের চাপে ক্রমশ: সেই সময় এগিয়ে এসে হল বেলা বারোটাতে। ব্যস, যাকে বলে ‘বারোটা বেজে গেল’ আসল অর্থের। এখন তো Noon বলতে বেলা বারোটার আশে পাশেই বোঝায়। এই হল ভাষার মজা, হযবরল এর মত – ‘ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল’।
আর একটি শব্দ হল – “Trivial”!! এর অর্থ ‘তুচ্ছ’ । অনেকেই হয়ত বিশ্বাস করবে না যে এই কথাটির উৎস কিন্তু মোটেই
হেলাফেলা করার নয়। ‘Tri’ হল তিন, ‘Via’ হল রাস্তা (যেমন via Mumbai মানে মুম্বাই এর রাস্তা হয়ে), তাহলে কথা টা হল তিন-রাস্তা। আচ্ছা, তিনমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে লোকে কি কোন গুরুত্বপূর্ণ, গোপনীয় আলোচনা করতে পারে? আদপেই না। যা গালগল্প হয় তা একেবারে ‘কথার কথা, ব্যাঙের মাথা’ – তাই তা হল ‘তুচ্ছ’।
অনেক মানুষ তাদের জীবনের অধিকাংশ সময়ে “Company Quarter” এই কাটান। আবার কোন ব্যাপারে অনড় বা নির্দয় মনোভাব দেখাতে আমরা ব্যবহার যে শব্দবন্ধ তা হল – “Give no quarter”! এই “Quarter” কথাটির উৎপত্তি নিয়েও মতভেদ আছে। এই কথাটির প্রচলিত অর্থ হল – ‘সাময়িক আশ্রয়’ যা আবার এসেছে ‘সামরিক আশ্রয়’ থেকে! কেউ ভাবেন – ‘Quarter” ক্রিয়াপদটির মধ্যেই আছে ‘আংশিক’ প্রবণতা। ষোড়শ শতকে শাষনের সুবিধের জন্য বিভিন্ন জায়গাকে চার ভাগে ভাগ করা হত আর মূল যে ভাগের হাতে কর্তৃত্ব থাকবে – তা হল – “Head Quarters”! আবার কেউ ভাবেন এটি এসেছে সম্ভবতঃ এর উৎস সরাসরি ভাবে ‘এক-চতুর্থাংশ’ এর সঙ্গে যুক্ত নয় – এর উৎপত্তি ফরাসী শব্দ – “quartermaster” থেকে – যিনি ছিলেন নৌবাহিনীর কর্তা এবং যাঁর কাজ ছিল নৌ-সেনাদের সব রকম দেখাশোনা করা যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল তাদের সামরিক বাসস্থান ও। তবে ‘Quarantine’ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। এটির উৎপত্তি চল্লিশ সংখ্যা থেকেই। আগেকার দিনে কোন জাহাজ বন্দরে ভেড়ার আগে ৪০ দিন অপেক্ষা করতো। কারণ জাহাজের মধ্যে কোন রকম বীজানু যদি অন্যদেশ থেকে পরিবাহিত হয়, তাহলে এই সময়ে তাদের নির্ঘাৎ ‘পঞ্চত্ব’ প্রাপ্তি ঘটবে, জাহাজ নিরাপদে ভিড়তে পারবে বন্দরে।
এইরকম আরো অনেক শব্দই দুই ভাষা তে আছে, তা নিয়ে পাঠক-পাঠিকারা নিভৃতে বা ‘একান্তে’ বসে ভেবে দেখতে পারেন। আর কিছু না হোক, নিজের আনন্দে নিজেই ‘আহ্লাদে আটখানা’ হলেও হতে পারেন।
অসাধারন লেখা!!
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ!! বাংলা অক্ষর দেখে আরো খুশী।
LikeLike
Khubi shundor aar informative . Onek kichu janlam
LikeLiked by 1 person
খুব আনন্দ হল।
LikeLike
দারুণ লাগলো।
কত কি নতুন কিছু জানতে পারলাম। লেখাটিতে ভাস্করদার স্বভাবজ কৌতুকী মিশে ভারী উপভোগ্য হয়েছে।
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ , প্রদীপ্ত।
LikeLike